ডিটেকটিভ গল্প: সেলিব্রিটি প্রবলেমস ৭

জ্বিনের বাদশা এর ছবি
লিখেছেন জ্বিনের বাদশা (তারিখ: শনি, ১১/০৮/২০০৭ - ৬:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'মনের কথা মন বোঝেনা'গানটি পুরো দু' দু'বার শোনা শেষ করে যখন তৃতীয়বার শুনতে যাবে, তখনই হাসনাইন দেখল যে স্টুডিও থেকে রেশমা হন্তদন্ত হয়ে বের হচ্ছে। রেশমাকে দেখেই হাসনাইন হেডফোন সরিয়ে উঠে দাঁড়াল, রেশমা বের হয়ে আসলে জিজ্ঞেস করল,'এনি প্রবলেম, ম্যাডাম?'

তাড়াহুড়োর মধ্যে থাকা রেশমা হড়বড় করে বলে যেতে লাগল, ' কোন সমস্যা না, পাঁচ মিনিটের একটা ব্রেক নিলাম, গেস্টরুমে আমার লেটেস্ট গানটা একবার শুনে নেব।' বলতে বলতেই সাদাকভারের সিডিবক্সটা হাতে নিয়ে রেশমা বের হয়ে গেল।

বের হয়ে যেতে থাকা রেশমার প্রফেশনাল এটিচিউড, ত্রস্তব্যাস্ত হাঁটার ঢংও হাসনাইনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল খানিকটা। মুগ্ধ চোখে সে যখন রেশমার দিকে তাকিয়ে আছে তখনই দেখল, টুক করে নিজের রূম থেকে বের হয়ে রেশমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন হামিদ সাহেব। দরজার কাছে যেতে যেতে রেশমাকে বলছেন, 'রেশমা কি এখন গেস্টরুমে যাচ্ছ? বিজি?'

দরজার ওপাশ থেকে রেশমার কর্কশ গলা শুনতে পেল সবাই, 'আমি আগে একটু টয়লেটে যেয়ে নিই!!'

হাসনাইন, লাবু ভাই, টুটুল --সবার মুখে মুচকি হাসি। হামিদ সাহেব সেই হাসিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন, 'লাবু ভাই, রেশমা কি গেস্টরূমে বেশী বিজি?'

'বস্, ভালই বিজি। কারণ, উনার নতুন রিলিজড গানটা আজকে খালি গলায় গাবে তো, ঐটা একবার শুনে নিবে আর কি। পরে আরেকদিন আপনার সাথে কফি আওয়ার সেট করে দিমুনে।' লাবু ভাই এমনভাবে বলে যেন একটা বাচ্চা ছেলেকে বোঝাচ্ছে।

'আরে তা না মিয়া।' হামিদ সাহেব আন্তরিক গলায় লাবু ভাইকে বলে যায়, 'আপনি যা ভাবতেছেন তা তো না। অন্য দরকার, রেশমা হলো গিয়ে মিউজিক আর মডেলিং জগতে সবচেয়ে বড় নেটওয়ার্কের অধিকারী। আমাদের বিজনেসে উনি অনেক কন্ট্রিবিউট করতে পারবেন।'

টুটুলের কাছাকাছি বসে থাকা হাসনাইন টুটুলের স্বগোতক্তি শুনতে পায়, 'হালার মাউড়া, সবকিছুতে ব্যাবসা।'

'কি বললা, টুটুল?' হামিদ সাহেবের গলা কর্কশ হয়ে আসে, 'তোমরা কিন্তু আজকাল বেশী বেশী করছ!'

রূমের পরিবেশে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব, হাসনাইন অস্বস্তিবোধ করে। অস্বস্তি কাটাতে রূম থেকে বের হয়ে গিয়ে লিফটের সামনের ওয়েইটিং রুমে ঢোকে হাসনাইন। ঢুকতেই তার মেজাজ খানিকটা খিঁচড়ে যায়, কারণ সে দেখতে পায় কালাম খেতে খেতে টিভি দেখছে।

'কি ব্যাপার? কালাম? তোমার তো এখানে থাকার কথা না! পজিশন ছাড়লা কেনো?' হাসনাইন কড়া গলায় বলে।

'স্যার, আমি ১০ মিনিট আগে এখানে খেতে আসলাম, ডিনার প্যাকেট নিয়ে। একটু পরেই চলে যাব, প্রভা রহমানের এই গানটা শেষ হলেই।' কালাম কৈফিয়তের ভঙিতে বলে।

হাসনাইন মাথা বাঁকিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে দেখে চকচকে, ঝলমলে এক কটকটে টিয়া রঙের শাড়ী পরে নেচেগেয়ে একাকার করে ফেলছেন প্রভা রহমান। কিছুটা উন্নাসিকতার সাথেই বলে, 'এই আজব মহিলার নাচগান দেখবা তুমি ডিউটি ছেড়ে?'

কিছুটা রাগ সামলেই অভিমানের সুরে বলে কালাম, 'সবার পছন্দ তো আর এক না স্যার।'

'তাও ঠিক।' বলতে বলতে হাসনাইন নিজেও বসে যায় টিভি দেখতে। টিভিতে যা দেখাচ্ছে তাতে মোটেও মজা পাচ্ছেনা সে, বরং চিন্তা করছে হামিদ সাহেবকে নিয়ে। মনে হচ্ছে লোকটা চায় রেশমা তার সাথে ব্যাবসায় নামুক।

আচ্ছা? এরসাথে রেশমাকে ভয় দেখিয়ে হয়রানি করার কি মানে আছে? নাকি লোকটা পুরোপুরি ফ্রীক? সে একইভাবে রেশমার প্রতি ভয়ানকভাবে আকর্ষিত, আবার তার সাথে ব্যবসাও করতে চায়? নাকি ব্যবসার ব্যাপারটা বানিয়ে বলেছেন?তবে হামিদ সাহেব আর রেশমার এই প্রথম দেখা হলো বলেই তো হামিদ সাহেব দাবী করলেন। নাকি হামিদ সাহেব তাকে মিথ্যা কথা বলল? একটু সন্দেহ ঘনীভূতও হয় আবার। এদিকে কথাপ্রসঙ্গে রেশমার কাজিন কাম সেক্রেটারী পিয়ার কাছে হাসনাইন জেনেছিল যে রেশমাকে আজকের প্রোগ্রামে সেট করার জন্য লাবু ভাই প্রাণপণ খেটেছে। আচ্ছা? এটা কি হামিদ সাহেবের নির্দেশ ছিল লাবু ভাইয়ের উপর যে রেশমাকে আনতেই হবে এই প্রোগ্রামে? তাহলে লাবু ভাইয়ের বেতন অনেক বেড়ে যাবে এমন কিছু?

কিন্তু যাই হোক, আসল সমস্যাটা তো থেকেই যাচ্ছে। হাসনাইনের প্রথম খটকাটা!
রেশমা কেন শুরু থেকেই সব চিঠি জমিয়ে রাখবে? কেন সে শুরু থেকেই ডায়েরীতে কোনদিন কিভাবে উত্তক্ত হয়েছে সেটা নোট করে রাখবে? এরকম ঘটনা তো হরহামেশা হয়ই, অনেক আগে থেকেই 'সবকিছুর প্রমাণ দেখিয়ে মামলা করব' এমন উদ্দেশ্য না থাকলে তো সবকিছুর এত নিখুঁত ট্রেস রাখার কথা না! তাহলে কি ব্যাপারটা এমন যে রেশমা এই 'উড়ো চিঠি' ফ্যাক্টর তৈরী করে খবরের শিরোনামে এসে আরো বিখ্যাত হতে চাচ্ছে? তবে কি সেই খ্যাতি নিয়ে সে এরপর কারোসাথে ব্যবসায় নামবে? কিন্তু, রেশমা তো এখনই যথেষ্ট জনপ্রিয়! সব ভেবে হাসনাইন কিছুটা এলোমেলো বোধ করা শুরু করে। যাই হোক, আমার কাজ রহস্য সমাধান করা না, রেশমাকে প্রোটেকশন দেয়া -- মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দেয় সে।

তারপরও মানুষের কৌতুহল বলে কথা, দেখা যায় যে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আবার সমস্যাটা নিয়ে ভাবা শুরু করে। তার মনে হয়, রেশমা সম্পর্কে আরও অনেক খোঁজ নিতে হবে, কারণ, সম্ভবতঃ ঘটনার বীজ অন্য জায়গায় রয়েছে। লাবু ভাই, হামিদ সাহেব এরা তো যাস্ট কো-ইনসিডেন্স! গতকাল রেশমার প্রটেকশনে আসলেতো এদের সাথে হয়ত হাসনাইনের দেখাও হতোনা।

কে দিতে পারবে রেশমা সম্পর্কে ভাল খবর? তখনই তার আবার মনে হয় যে যেহেতু সে নিজে এই কেইসের মূল দায়িত্বে না, মূল দায়িত্বে হলেন শাহাদাত স্যার, কাজেই আজকের রিপোর্টে সে যাস্ট 'রেশমা সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য দরকার, তার পরিমন্ডল সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা আবশ্যক' এরকম একটা কমেন্ট লিখে দিলেই হবে -- একটু চিন্তামুক্ত সে হয় বটে, তবে মনটা তার খারাপ হয়ে যায় ঠিকই। সে ভেবেছিল খুবই এক্সাইটিং কোন ক্লু সে খুঁজে পাবে, যেটা দেখে তাকেই পুরো রহস্য উদঘাটনের জন্য বলবে ডি.বি, আর সেও জীবনের প্রথম এক্সাইটিং কেইস সল্ভ করবে যেখানে দেশকাঁপানো নায়িকা রেশমা ভিকটিম। অথচ পুরো ব্যাপারটাই একটা পানসে উপসংহার দিয়ে শেষ হতে যাচ্ছে, যা হলো, 'রেশমা সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য দরকার।'

ভাবতে ভাবতে হাসনাইনের মনটা বিষাদে ভরে গেল। তার ওপর যখন তার মনে হওয়া শুরু হলো যে শাহাদাত স্যারের নির্দেশে আগামী কয়েকদিন তাকে পত্রিকা অফিসগুলোতে দৌড়াতে হবে রেশমার পরিমন্ডল সম্পর্কে খোঁজ নিতে, তখন তো পুরো চেহারাটাই পাংশুবর্ণ ধারন করল। সোফা থেকে উঠে নিজেকে ঠেলতে ঠেলতে হাসনাইন আবার হাজির হয় তারুণ্য অফিসে। কালামও ৫ মিনিটের কথা বলে ১৫ মিনিট কাটিয়ে চলে যায় নিজের জায়গায়, পজিশনে।

সাড়ে নয়টার দিকে যখন ফের তারুণ্য অফিসে ঢুকছে হাসনাইন, তখন অনুষ্ঠানটা পুরো জমে গেছে! হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে লুৎফা, রেশমাকে দেখেও মনে হচ্ছে তিনি চমৎকার মানিয়ে ফেলেছেন আখতার-লুৎফা জুটির সাথে, হাসনাইনের মনে হয় একটু আগে রেশমার মুখে যে ভীতি বা দুঃশ্চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছিলো, সেটা এখন অনুপস্থিত, একটুও ভীত নয় সে এই মুহূর্তে। আখতারের ফাইনাল তুবড়ি ছুটে চলছে। একটু পরেই ইউ.এস টপ ওয়ান শুনিয়ে, তারপর খানিক গালগপ্পোর পর রেশমা খালি গলায় গাইবেন 'মনের কথা মন বোঝেনা' গানটি।

লাবু ভাই'র মন অবশ্য কিছুটা খারাপ, টুটুলের কম্পিউটার শো করছে যে শ্রোতার সর্বোচ্চ পার্সেন্টেজ ৩৫% ক্রস করেনি, বিলবোর্ডের রেকর্ড যেখানে ৩৭%। আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই, তবে লাবু ভাইয়ের এখনও ক্ষীণ আশা যে শেষে যখন রেশমা খালি গলায় গান গাইবে তখন একটা হিট আসতে পারে। তবে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে আজ একই সময়ে টিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'অমুক-তমুক' হচ্ছে, এবং সেটা প্রায়ই দশটার খবরের পর পর্যন্ত গড়ায়।

দেখতে দেখতে একসময় রেশমার খালি গলায় গাওয়ার সময় চলে আসে, 'মনের কথা মন বোঝেনা'। লালনীয় ধাঁচের এই গানটা যখন রেশমা গাওয়া শুরু করে, তখন চারদিক স্তব্ধ হয়ে যায় হঠাৎ করে, নিবিষ্টভাবে শুনতে থাকা হাসনাইন দেখতে পায় রেশমার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ে যাচ্ছে, হাসনাইনের হঠৎট খুব বলতে ইচ্ছে করে, 'কি এমন দুঃখ তোমার? আমি তোমার সব দুঃখ শুষে নেব বিষের মতন, তুমি শুধু একটু হাসো।'

গান শেষে কান্নাজড়িত কন্ঠে উল্লাসপ্রকাশ করতে করতে রেশমাকে অভিনন্দন জানায় লুৎফা আর আখতার। আখতার বলে, 'প্রিয় দর্শক, এখন আপনাদের রুমাল দিয়ে চোখ মোছার জন্য দশ সেকেন্ডের একটা ব্রেক দিচ্ছি; আজ যে গানটি শুনলেন এটি রিলিজ হবে আগামী শুক্রবার; যারা আজ মন ভরে কাঁদতে পারেননি তাদের জন্য সিডির কাভারে থাকবে একটা এক্সট্রা রুমাল ... হেই, হোল্ড অন, নেভার ট্রাস্ট আ হ্যান্ডসাম ডি.জে ....... ' পরিবেশ হালকা করে ফেলে প্রফেশনাল ডি.জে আখতার, হো হো, হি হি হাসি শোনা যায় রেডিও সম্প্রচারে।

অনুষ্ঠান শেষ হবে হবে, এমন সময় তারুণ্যের দরজায় জোরালো আর ঘনঘন নক শোনা যায়। দরজা খুলতেই দেখা যায় ভুইঁয়া টাওয়ারের পার্কিংয়ের দারোয়ান মুসলিম এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, 'খুন! খুন! রেশমা ম্যাডামের গাড়ী রক্তে ভাইসা গেছে।'

(চলবে)


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ডিটেকটিভ গল্পের লেখক তো খুব নিষ্ঠুর মানুষ । রেশমা নামের রেশমের মতো তুলতুলে (পাঠকের কল্পনা) মেয়েটা খুন করে ফেললেন ।
হাসনাইন নামের বোকা গোয়েন্দা বাঁচাতে পারলোনা? আগেই বলেছিলাম নাম বদলে হাসান করে দিন । তাহলে রেশমা উদ্ধার করে বিহারে চলে যেতো চোখ টিপি

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

বস্,
রেশমের মতো তুলতুলে মেয়েটিকে মারার মতো নিষ্ঠুর কি আমি হতে পারি? রেশমা তো এখনও স্টুডিওতে, খুন হয়েছে অন্য কেউ।
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

হাসান মোরশেদ এর ছবি

লেখক সাহেবের দয়ার কলম
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

হা হা হা
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

ভ্রাত: আপনি কতোগুলো মার্কেটিং আইডিয়া দিলেন? অ্যাড কোম্পানীগুলো খবর পেলে আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে। হা হা।

অতিথি এর ছবি

হায় হায়, নায়িকা তো মইরাগেলো!

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

দেখি @ শিমুল ,,, যেহারে অফিসে বসে ব্লগে কমেন্ট করি ,,, চাকরীটা চলে যেতে পারে মন খারাপ

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।