চোর-পুলিশ

মূর্তালা রামাত এর ছবি
লিখেছেন মূর্তালা রামাত (তারিখ: সোম, ১৯/০৩/২০১২ - ৩:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পন করেছে। আমরা স্বাধীন। আনন্দে মাতোয়ারা পুরো বাংলাদেশ। ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আনন্দ উল্লাসের মধ্যে জল ঢেলে দিল ছোট্ট একটি খবর। মিরপুরের বিহারীরা স্বাধীন বাংলাদেশ মানতে নারাজ। তারা কিছুতেই হার মানবে না। খবর শুনে আমাদের শরীরের রক্ত টগবগ করে উঠল। অপেক্ষাকৃত তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা পারলে তখুনই মিরপুর স্বাধীন করতে ছোটে। কিন্তু হাইকমান্ডের নির্দেশে আমরা যার যার ইউনিটকে তখনকার মত সামাল দিলাম।

যুদ্ধ চলার সময়ে বিহারীদের বর্বরতার কথা আমাদের কারো অজানা ছিল না। তারপরও আমরা রক্তপাত এড়াতে চাইছিলাম। খবর ছিল বিহারীরা বেশ কিছু বাঙালীকে জিম্মি করে রেখেছে। সমঝোতার মাধ্যমে হয়তো তাদের জীবন বাঁচান সম্ভব। তাছাড়া যুদ্ধের এই শেষ সময়ে এসে নতুন করে সহযোদ্ধাদের কাউকে আমরা হারাতে চাইছিলাম না। তাই শান্তিপূর্ণ একটা সমাধানে আসার চেষ্টা চলতে লাগল। কিন্তু বিহারীগুলো গোয়ারের গোয়ার। কিছুতেই শেষ রফা করা গেল না। ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম শেষ হলে আমরা অপারেশন শুরু করলাম।

পুরো মিরপুর দখল করতে বেশ বেগ পেতে হল। বিহারীরা আগে থেকেই ভারি অস্ত্রসস্ত্র গোলাবারুদ মজুদ করে রেখেছিল। টানা তিনদিন যুদ্ধের পর তাদেরকে বাগে আনা গেল। এলাকায় ঢুকে আমরা তাজ্জব বনে গেলাম। পুরো মিরপুরই যেন আস্ত এক কসাইখানা! এখানে সেখানে বাঙালিদের বিকৃত লাশ। এলাকার এক পানির ট্যাঙ্কে শখানেক বাঙালির জবাই করা লাশ পাওয়া গেল। এক বাড়ির চোরাকুঠিরি থেকে উদ্ধার করা হল ক্ষতবিক্ষত তরুণীদের। ডোবায় পানিতে অন্যান্যদের সাথে ভাসছিল খ্যাতনামা শিক্ষক প্রফেসর আশরাফের গলিত লাশ। গণকবরও মিললো গোটাতক। জানা গেল কবরগুলোতে অনেক বাঙালিকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে। পাড়ার বেকারীর ছাইয়ের ভেতর পেলাম পোড়া হাড়গোড়। বিভিন্ন বাঙ্কার থেকে যেসব বাঙালিকে আমরা জীবন্ত উদ্ধার করলাম তাদের কাছ থেকে জানা গেল, অনেককে নদীর পাড়ে গুলি করে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। নারকীয় নৃশংস এসব ঘটনা দেখে আমরা কেউই স্বাভাবিক থাকতে পরছিলাম না। মনে হচ্ছিল সবকটা বিহারীকে এক লাইনে ব্রাশ ফায়ার করে এখুনি খতম করে দেই। কিন্তু হাইকমান্ডের কড়া নির্দেশ ছিল কেবল মাত্র দোষীদেরকেই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে নইলে সারা বিশ্বে মু্িক্তযোদ্ধাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা হবে।

উপরের নির্দেশ মেনে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে পেতে আমরা মিরপুর থেকে আটক করা সব লোককে এক জায়গায় জড়ো করলাম। তারপর শুরু হল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ। এদের মধ্যে বাঙালি অনেক রাজাকারও ছিল। তাদেরকে সহজেই আলাদা করা হল। রাজাকারদের দেয়া তথ্য ধরে কিছু বিহারী জল্লাদকেও চিহ্নিত করা গেল। বাদবাকিদের বিভিন্ন উপায়ে জেরা করে, স্বাক্ষীপ্রমাণ চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দোষী বা নির্দোষ নির্ধারণ করার পালা চলল।

জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে চারজন উপজাতিকে পেলাম। এদের দুজনের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় এরা পেশাদার খুনি। স্বাক্ষ্য প্রমাণেও এর সত্যতা মিললো। এক বন্দীকে সহযোগিতার অপরাধে বিহারীরাই তাকে গুলি করেছিল প্রমাণিত হওয়ায় তৃতীয়জনকে নিঃশর্ত ছেড়ে দেয়া হল। চতুর্থজনকে নিয়ে পড়লাম ঝামেলায়। হাত পা বাধা অবস্থায় উদ্ধার করা এই লোকটি সম্বন্ধে কেউই কিছু বলতে পারল না।
প্রায় বৃদ্ধ এ মানুষটিকে যাই বলা হোক না কেন সে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, চাটগাইয়া ভাষায় তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হল। সবই বৃথা। শেষে আমাদের সহযোদ্ধা রতন চাকমা ভাঙা ভাঙা বার্মিজে তার সাথে কথা বলে যা জানতে পারল তা হল লোকটির নাম সাঙ্গামারা। সে ঢাকায় এক বার্মিজ হোটেলে কাজ করত। হপ্তাখানেক আগে পাক আর্মির লোকজন তাকে এখানে ধরে আনে। বিহারীরা তাকে জবাই করতে চেয়েছিল... বলতে বলতে সাঙ্গামারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, বারবার শরীরের রক্তাক্ত ক্ষতস্থানগুলো দেখায়।

তার কথায় অবিশ্বাস করার মত কিছু দেখলাম না। লোকটির পকেটে পাওয়া বার্মিজ হোটেল থেকে ইস্যু করা পরিচয়পত্রও তার পক্ষে কথা বলে। কিন্তু কেন জানি আমার মনের খুঁতখুঁতানি কিছুতেই যাচ্ছিল না। চট্টগ্রামে অনেক বার্মিজকে আমি পাকিস্তানীদের হয়ে কাজ করতে দেখেছি। হয়ত এ কারণেই বার্মিজ লোকটির প্রতি আমার মন সদয় হচ্ছিল না। মনের একটা অংশ বলছিল এই ব্যাটা মহা ধুরন্ধর, মারাত্মক অভিনেতা। আদতে সে কুখ্যাত বিহারী কসাই জুলফিকারের চেয়েও ভয়ঙ্কর কোন খুনি। আরেকটা অংশ বলছিল, অসম্ভব। লোকটার চেহারা সচারচর বার্মিজদের চেয়ে আলাদা। বার্মিজদের কুতকুতে চাখ, ভোতা নাক আর থ্যাবড়া মুখে যে প্রাকৃতিক হিংস্রতা থাকে এর চেহারায় তা নেই। বরঞ্চ তার চোখে মুখে এক ধরনের সৌম্যতা খেলা করছে। নিরীহ গোবেচারা এই লোকটির দ্বারা মানুষতো দূরে থাক একটা প্রজাপতিরও ক্ষতি করা সম্ভব না। এই লোক কখনোই পাকি নরপশুদের হয়ে বাঙালিদের জবাই করতে পারে না। কিন্তু দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ আমাকে অনেক তুচ্ছ জিনিস নিয়েই ভাবতে শিখিয়েছে। তাই আমি শেষ সিদ্ধান্ত নেবার আগে লোকটাকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইলাম।

ঘন্টাদুয়েক পরে লোকটিকে যখন আমার সামনে হাজির করা হল তখন আমি কড়া সুরে বাংলায় বললাম “তুমি দোষী, তোমার মৃত্যুদন্ড দেয়া হল”। লোকটির চেহারায় কোন ভাব ফুটল না। এবার আমি উর্দুতে একই কথা বলে এক দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেখানে কোন অনুভূতি নেই। আমরা একবার এক পাকিস্তানী মেজরকে ধরেছিলাম। মশা মাছির মত মানুষ মারায় তার সুখ্যাতি ছিল। সেই মেজর পর্যন্ত মৃত্যুর কথা শুনে ভয়ে কাতর হয়ে গিয়েছিল। তার কাঁচের মত চোখ বেয়ে ফাঁসির দড়ির মত নেমে এসেছিল অশ্রুর সরু রেখা। সেই হিসেবে বার্মিজ লোকটি আমার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অভিনয় নয়, সে যা বলেছে সত্যিই বলেছে। সে আসলেই বার্মিজ ভাষা জানা এক নিরীহ বার্মিজ । মহসিনকে ডেকে বললাম, ছেড়ে দাও ব্যাটাকে। লোকটি এবারও আগের মত ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি তার দৃষ্টি পড়ার চেষ্টা করলাম। নাহ, তার চোখে কোন ভাষাই নেই। পূর্ব পরিকল্পনা মত মহসিন স্টেন ঠেকিয়ে লোকটিকে এমনভাবে টেনে হিচড়ে নিতে লাগল যেন আমি তাকে মেরে ফেলার হুকুম দিয়েছি। লোকটির চেহারায় তারপরও কোন ভাব ফুটল না। আমি হতাশ হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছি এমন সময় আমি লোকটার চোখে এক ঝলক আনন্দ এসেই আবার মিলিয়ে যেতে দেখলাম। বাংলায় বলা মুক্তির আদেশ তার বুঝতে পারার কথা নয়! অথচ আমি নিশ্চিত, সাঙ্গামারার চোখে মুক্তির আনন্দই আমি দেখেছি। না বোঝার ভান করে মৃত্যুভয়কে সে চাপা দিতে পারলেও, মুক্তির স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ অনুভূতির কাছে সে হার মেনেছে। মনে হল, আমাদের সাথে নিঁখুত অভিনয়ের যে খেলাটা এতক্ষণ সে খেলছিল তাতে বিজয়ী হবার আত্মতুষ্টিই যেন খানিকের জন্য তার নিরেট মুখোশে চিড় ধরাল। আমি যা বোঝার বুঝে নিলাম। খুব দক্ষ, উঁচু মাপের সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত কারো পক্ষেই এমন সুচারুভাবে নিজের অনুভূতিকে আড়াল করা সম্ভব। এই লোকটা পাকিস্তানীদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুখ্যাত বার্মিজ সহচরদের একজন না হয়ে পারে না। এরাই কক্সবাজারের বর্মিজ পল্লী, চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গী বাজার, পুরান ঢাকার আর্মানিটোলায় গণহত্যার জন্য দায়ী। আমি মহসিনের দিকে মাথা ঝাঁকালাম।

**বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত।

১৯/০৩/২০১২
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।