স্টিফেন কিং এর গল্পগুচ্ছ - ২

অবনীল এর ছবি
লিখেছেন অবনীল (তারিখ: শুক্র, ০৫/১২/২০০৮ - ৫:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শেষ হোটেল

“আরো জোরে!” টমি রিভিয়েরা বলে উঠলো। “আরো জোরে!”

“৮৫ তে আছি” কেলসো ব্ল্যাক বললো।

“পুলিশ আমাদের ঠিক পিছনে,” রিভিয়েরা বললো, “৯০ এ তোল।“ জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো। পলায়নরত গাড়ীটার পিছনে একটা পুলিশের গাড়ী। সাইরেনের বিলাপধবনি আর লাল আলোর ঝলকানি দিয়ে যাচ্ছে।

“সামনের সাইড রোড দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, “ ঘোঁতঘোঁত করলো ব্ল্যাক। গাড়ীর চাকা ঘুরিয়ে কাঁকর বিছানো আঁকাবাকা পথটাতে মোড় নিল।

ইউনিফর্ম পরা পুলিশটা মাথা চুলকালো, “গেল কোথায়?”

ওর পার্টনার ভ্রু কুঁচকালো। “জানি না। যেন - হাওয়া হয়ে গেল।“

“দেখ,” ব্ল্যাক বলে উঠলো। “সামনে আলো দেখা যাচ্ছে।“

“একটা হোটেল,” বিস্মিতভাবে বললো রিভিয়েরা। “এই গরুর গাড়ী চলা রাস্তায় হোটেল! এত সোনায় সোহাগা! পুলিশ জীবনেও এখানে খুঁজতে আসবে না।“

ব্ল্যাক, চাকাগুলোর প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে, ব্রেক কষলো। রিভিয়েরা পেছনের সিটে হাত বাড়িয়ে একটা কালো ব্যাগ তুলে নিল। হেঁটে হোটেলে দিকে এগুলো ওরা।

হোটেলটাকে দেখে মনে হলো যেন ১৯শতকের শুরুরদিকের কোন দৃশ্যপট থেকে তুলে আনা।

রিভিয়েরা অধৈর্য্যভাবে ঘন্টা বাজালো। একটা বুড়োলোক পা টেনে টেনে বেরিয়ে আসলো। “একটা রুম দরকার।“ ব্ল্যাক বললো।

বুড়োলোকটা কোন কথা না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো।

“একটা রুম,” ব্ল্যাক আবার বললো।

বুড়োলোকটা ঘুরে ওর অফিসের দিকে চলে যেতে লাগল।

“দেখেন, বুড়া মিয়া,” টমি রিভিয়েরা বলে উঠলো। “ব্যবহারটা কিন্তু ভালো করলেন না।“ আটত্রিশটা বের করলো সে। “এখন একটা রুম দেন।“

লোকটাকে মনে হলো যেতেই থাকবে, কিন্তু অবশেষে বলে উঠলোঃ “রুম পাঁচ। হলের শেষে।“

সে কোন রেজিস্টারে সাইন নিল না, ওরা উপরে চলে গেল। একটা লোহার ডবল বেড, একটা ভাঙ্গা আয়না আর ময়লা ওয়ালপেপার ছাড়া রুমে কিছুই ছিল না।

“কি ফালতু একটা জায়গা,” প্রচন্ড বিরক্তির সাথে বললো ব্ল্যাক। “বাজী ধরে বলতে পারি এখানে যত আরশোলা আছে তা দিয়ে পাঁচ-গ্যালনের একটা টিন ভরে ফেলা যাবে।“

পরদিন সকালে রিভিয়েরার যখন ঘুম ভাঙলো, সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলো না। সে একটা পেশীও নাড়াতে পারলো না। তাকে পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। ঠিক তখনি বুড়োলোকটা ওর চোখের সামনে আসল। হাতে একটা সুচ। সে ওটা ব্ল্যাকের হাতে ঢুকিয়ে দিল।

“ও তুমি জেগে গেছ,” সে বললো। “আহ্‌, পঁচিশ বছর পরে তোমরা দুজন আমার জাদুঘরের প্রথম সংযোজন। ভালভাবেই সংরক্ষন করা হবে তোমাদের। তোমরা মরবে না।“

“তোমরা আমার জীবন্ত জাদুঘরের বাকি সংগ্রহের সাথে যাবে। চমৎকার নমুনাসব।“

টম রিভিয়েরা তার আতঙ্ক প্রকাশও করতে পারলো না।

[স্টিফেন কিং এর ‘হোটেল এ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্যা রোড’ এর অনুবাদ]

================================================

কুয়োতলার ওটা

ওল্গেথ্রপ ক্রেটার ছিল একটা কুৎসিত, ইতর, পিচ্চি একটা বদমাশ। কুকুর-বিড়াল উত্ত্যক্ত করতে, ফড়িংয়ের ডানা টেনে ছিঁড়তে আর কেঁচোদের টুকরো করে ফেলার সময় মোচড়ানি দেখতে সে খুবই ভালোবাসত। (তবে যখন শুনলো কেঁচোরা ব্যাথা পায় না তখন আর ওতে মজা পেত না )।

কিন্তু ওর মা, বোকা মহিলা, তার এইসব নিষ্ঠুর আচরণের ব্যাপারে একেবারেই যেন অন্ধ ছিলেন। একদিন ওল্গেথ্রপ আর তার মা সিনেমা দেখে ফেরার পর ওদের রাঁধুনি দড়াম করে দরজা খুলে প্রায় মৃগি রোগীর মত করতে থাকলো।

“ওই হতচ্ছাড়াটা ভাড়ার ঘরের সিঁড়িতে এমনভাবে দড়ি বেঁধে রেখেছিল যে, আমি আলু আনতে নিচে গিয়ে দড়িতে পা বেঁধে পড়ে মরতে বসেছিলাম! “ সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো।

“বিশ্বাস করো না! বিশ্বাস করো না! ও আমাকে ঘেন্না করে!” চিৎকার করে বললো ওল্গেথ্রপ , অশ্রুজলে ভরে উঠলো ওর চোখ, এম্নভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো যেন তার ছোট্ট হৃদয়টা ভেংগে টুকরো হয়ে যাবে।

মা রাধুনিকে বিদায় করলেন আর ওল্গেথ্রপ, প্রিয় ছোট্ট ওল্গেথ্রপ, ওর রুমে চলে গেল, যেখানে সে তার কুকুর, স্পটিকে পিন দিয়ে খোঁচাতে লাগলো। যখন মা জিজ্ঞেস করলেন স্পটি কেন কাঁদছে, সে বললো ও পায়ে কাচের টুকরো বিঁধে ফেলেছে। বললো, সে ওগুলো টেনে বের করবে। মা মনে করলেন তার প্রিয় ছোট্ট ওল্গেথ্রপ পরোপকারি ভাল ছেলে।

তারপর একদিন, ওল্গেথ্রপ যখন মাঠের মধ্যে অত্যাচার করার জন্য আরো কিছু খুঁজছিল, সে একটা গভীর, অন্ধকার এক কুয়োতে উঁকি দিল। প্রতিধবনি শোনার আসায় সে নিচে ডাক দিলো,

“হ্যালো!”

কিন্তু একটা নরম কন্ঠস্বর উপরের দিকে ভেসে এলো, “হ্যালো, ওল্গেথ্রপ”

ওল্গেথ্রপ নিচে তাকালো, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলনা। “কে তুমি?” ওল্গেথ্রপ জিজ্ঞেস করলো।

“নিচে নেমে এসো” কন্ঠস্বরটা বললো, “আমরা খুব মজা করবো।“

অতএব ওল্গেথ্রপ নিচে নামলো।

দিন কেটে গেল ওল্গেথ্রপ ফিরে এল না। মা পুলিশকে খবর দিলেন, খোঁজ শুরু হলো। প্রায় এক মাসের উপরে প্রিয় ছোট্ট ওল্গেথ্রপের খোঁজ চললো। যখন তারা হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি ওকে একটা কুয়োর ভেতর খুঁজে পেল, মরা লাশ হিসেবে।

কিন্তু তার যে কিভাবে মৃত্যু ঘটেছে!

তার হাত গুলো টেনে খুলে ফেলা, যেমনভাবে লোকে ফড়িংয়ের ডানা ছিঁড়ে ফেলে। চোখের মধ্যে সুঁচ গাঁথা, আরো এমন সব বিভৎস অত্যাচার যা বলার অযোগ্য।

যখন ওর মরদেহটা ঢেকে ( যা অবশিষ্ট ছিল ) দলবেঁধে চলে যাচ্ছিল, মনে হলো তারা সত্যি যেন কুয়োতলা থেকে একটা অট্টহাসি ভেসে আসতে শুনলো।

[স্টিফেন কিং এর ‘দ্য থিং এট দ্য বটম অফ দ্য ওয়েল’ এর অনুবাদ]

================================================

অভিশপ্ত অভিযান

“বেশ,” গ্যানট্রির ওপর পারে মরুভূমির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা রকেটের দিকে তাকিয়ে, জিম কেলার বলে উঠলো। নিঃসংগ একটা বাতাস মরুভূমির উপর দিয়ে বয়ে গেল। হিউ বুলফোর্ড বলে উঠলো, “হ্যাঁ, শুক্রগ্রহে যাবার সময় হয়ে গেছে। কেন? কেন আমরা শুক্রে যেতে চাই ?

“জানি না,” কেলার বললো। “আমি জানি না।“

রকেট শিপটা শুক্রে নামলো। বুলফোর্ড বাতাস চেক করে বিস্মিতস্বরে বলে উঠলো, “আরে এত দেখি একদম পৃথিবীর মত বাতাস! সম্পূর্নভাবে শ্বাসযোগ্য।“

ওরা বাইরে গেল, এবার কেলারের বিস্মিত হবার পালা, “আরে এত একেবারে পৃথিবীর বসন্ত! চারিদিকে গাছপালা, সবুজ আর সুন্দর। এত স্বর্গ!”

ওরা দৌড়ে বাইরে এলো। বিচিত্ররকমের সব ফলমূল, সুস্বাদূ, একেবারে সঠিক তাপমাত্রার। রাত নামলে, ওরা বাইরে ঘুমালো।

“আমি একে এখন থেকে বলব গার্ডেন অফ ইডেন”, উৎসাহের সাথে কেলার বলে উঠলো।

বুলফোর্ড আগুনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। “আমার কাছে কিন্তু ভাল ঠেকছে না, জিমি। মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা গলদ আছে। একটা কিছু...অশুভ ব্যাপার আছে এর মধ্যে।“

“তোমাকে মহাশূন্য সুখে ধরেছে।“ ব্যঙ্গস্বরে বললো কেলার। “ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে।“

পরদিন সকালে জেমস কেলারকে মৃত পাওয়া গেল।

তার চেহারায় এমন এক বিভীষিকা ছিল, বুলফোর্ড আশা করলো তাকে যেন আর কখনো দেখতে না হয়।

দাফনের পর, বুলফোর্ড পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলো। কোন জবাব নেই। রেডিও নিস্তব্ধ। বুলফোর্ড ওটা খুলে আলাদা করে আবার জোড়া লাগালো। না কোন সমস্যা নেই, কিন্তু বাস্তবতা এইঃ ওটা কাজ করছে না।

ওর দুশ্চিন্তা দ্বিগুন হলো। দৌড়ে বাইরে আসলো। সেই একই মনোরম, সুখি প্রাকৃতিক দৃশ্য। কিন্তু বুলফোর্ড ওটার ভেতরের অশুভকে দেখতে পাচ্ছিল।

“তোমরাই ওকে মেরেছ!” সে চিৎকার করে বললো। “আমি ঠিক জানি!”

হঠাৎ মাটি ফাঁক হয়ে গেল, গড়িয়ে গড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো। প্রায় আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় সে দৌড়ে শিপে ফিরে আসলো। কিন্তু আগেই এক টুকরো মাটি সাথে নিয়ে নিল...

মাটি বিশ্লেষন করে সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লো। শুক্র জীবন্ত।

হঠাৎ মহাকাশযানটা কাত হয় পড়লো আর উল্টে গেল। বুলফোর্ড চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু ধীরে ধীরে যানটাকে চারদিক থেকে মাটি গিলে ফেললো। অনেকটা মনে হলো যেন ঠোঁট চাঁটলো।

তারপর ঠিক আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল, পরের শিকারের অপেক্ষায়...

[স্টিফেন কিং এর ‘দ্যা কার্সড এক্সপেডিশন’ এর অনুবাদ]


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অনুবাদ ভাল হয়েছে। চলুক।
আপনার মৌলিক লেখাও পড়তে চাই।


A question that sometimes drives me hazy: am I or are the others crazy?

অবনীল এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অতন্দ্র প্রহরী। আরও ভাল করার অনুপ্রেরনা পেলাম। মৌলিক লেখা দেবার ইচ্ছা আছে। আশা করি শীঘ্রই উপস্থাপন করতে পারব।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

সবজান্তা এর ছবি

নাভেদ ভাই, দারুন হচ্ছে চালিয়ে যান। আপনার গল্পগুলির সিলেকশন ভালো হচ্ছে। ছোট সাইজের ফলে, বিনা আয়াসেই পড়ে ফেলা যাচ্ছে।

পুনশ্চঃ ছোট্ট একটা পরামর্শ। আমার মনে হয় কী, আপনি সম্ভবত কিং এর বাক্য গঠণ রীতি পুরোটাই অনুসরণ করছেন। আপনি যদি বাংলার নিজস্ব বাক্যরীতিতে অনুবাদ করেন, তবে অনেক বেশি "আপন" মনে হবে লেখাটাকে। আর কিছু শব্দ একটু বেশি অভিধান ঘেষা, এগুলোর বদলে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দ দিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন একবার।

আগাম দুঃখিত ভাই, বেহুদা জ্ঞান বিতরণের জন্য মন খারাপ


অলমিতি বিস্তারেণ

অবনীল এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, পাঠকের গঠনমুলক সমালচনাই একজন লেখকের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশংসা। কারন, এ থেকেই একমাত্র বোঝা সম্ভব পাঠকের অনুরাগের গভীরতা। তাই আমি সবসময়ই একে স্বাগত জানাই হাসি । আর কমিউনিটি ব্লগের মত এত তাড়াতাড়ি পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানার মত কার্যকারী পন্থা আর আছে কিনা সন্দেহ। এর জন্য সচলকে ক্ৃতজ্ঞতা জানাই।

গতানুগতিক বাংলা বাক্য গঠনরীতি অনুসরনের জন্য সবসময়ই চেষ্টা থাকে আমার, তারপরো কোন কোন অবস্থাকে ফুটিয়ে তুলতে (বিশেষ করে এইরকম অস্বাভাবিক চোখ টিপি ) দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তে হয়। এই শব্দগুলো কি ঘটনাক্রমকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারলো কিনা। একে ছোট গল্প। তার উপর লোমহর্ষক গল্প। তাই মুল শব্দচয়ন কে যথাসম্ভব অবিকৃত রাখার চেষ্টা করি। এখানে একটা ভারসাম্যতা বজায় রাখার ব্যাপার আছে, যেটাই অনুবাদকের দক্ষতার উপরি নির্ভরশীল। ভবিষ্যতে এই ব্যাপারটাতে আরো সজাগ দৃষ্টি রাখব। আবার ধন্যবাদ তোমাকে। আর তোমার অটপ্সি রুম ফ্লোর এর অনুবাদের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। হাসি

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

রানা মেহের এর ছবি

খুব ভালো লাগছে অবনীল।

তবে আমার মনে হয় মূল লেখার বাক্যগঠন রাখলে
পড়লে আসল লেখাটার আমেজ পাওয়া যায়।
বাংলা বাক্যরীতির বদলে বরং চলমান রীতিই চলুক

অবনীল মানে কী?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অবনীল এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
অবনীল আলোর একপ্রকার অদৃশ্যরূপ।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।