পৌরুষ (শেষ পর্ব)

রোমেল চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন রোমেল চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ৩১/০৭/২০১২ - ২:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১ম পর্ব
২য় পর্ব

“পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি”, কাঠের রুলার গুটাতে গুটাতে স্বস্তির সাথে বলেন মিঃ উইলসন, “তুমি আমার চেয়ে লম্বা, এটা সত্যিই উল্লেখযোগ্য।”

“সামান্য কিছু লম্বা।”

“কিন্তু তোমার বাড়ন্ত শরীর। এখন তোমাকে এমন ব্যায়াম করতে হবে যাতে করে তুমি একই সাথে লম্বা ও চওড়া হও। তোমাকে আমরা বেসবল খেলায় মধ্যমণি হিসেবে দেখতে চাই। দেখতে চাই দলের মধ্যে সবচাইতে ওজনদার ফরোয়ার্ড হিশেবে।”

ছেলে সার্ট হাতে তুলে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে সেটার হাতায় নিজের হাত ঢুকাতে লাগলো।

“ওরা কখন দলগঠন করার ডাক দেয়?” মিঃ উইলসন জিজ্ঞেস করেন, “আমার তো মনে হয় ওরা ইতিমধ্যে সেটি করেই ফেলেছে।”

“তারা সেটি করে ফেলেছে,” মাথা নিচু করে শরীর বাঁকিয়ে চেয়ারের তলা থেকে নিজের মোজা জোড়া তুলতে তুলতে ছেলে বলে।

“করে ফেলেছে...আর তুমি কিনা...”

“আমি দলে টিকি নি,” নিবিষ্ট দৃষ্টিতে মোজা জোড়ার দিকে তাকিয়ে ছেলে বলে। যেন সে গভীরভাবে মোজা জোড়ার রঙ ও বুনটের সূক্ষ্ম ব্যবধান পর্যবেক্ষণে নিমগ্ন।

মিঃ উইলসন মুখ খুললেন, আবার বন্ধ করলেন, জানালা দিয়ে খানিকক্ষণ বাইরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর আলতোভাবে ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন। শান্তস্বরে বললেন, “ভাগ্য খারাপ।”

‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি,” ছেলে তাড়াতাড়ি উত্তর দিলো।

“আমি নিশ্চিত যে সেটা তুমি করেছ।”

“নির্বাচনী খেলাগুলোতে আমি আমার সবটুকু ঢেলে দিয়ে খেলেছি।”

“এটা নেহায়েতই মন্দভাগ্য,” মিঃ উইলসন বললেন, “যে কারও ক্ষেত্রে এটা ঘটতে পারতো।”

তারা যখন পোশাক পাল্টাচ্ছিল তখন সারা ঘর জুড়ে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা বিরাজ করছিল। কোন কিছু ভাজবার একটা ক্ষীণ গন্ধ যখন বাতাসে ভেসে ভেসে তাঁদের নাকে এসে লাগলো তখন তারা শুনতে পেল মিসেস উইলসন টেবিলে সকালের নাস্তা লাগাচ্ছেন।

“এই মৌসুমের জন্য তাহলে এটাই শেষ,” মিঃ উইলসন যেন আপনমনে নিজের উদ্দেশ্যেই বলে উঠলেন।

“যদিও একথা আমি তোমাকে বলতে ভুলে গেছি যে আমি বক্সিং টীমে টিকেছি,” ছেলে বললো।

“তু -মি! আমি জানতাম না যে তোমাদের স্কুলে একটি বক্সিং টীম আছে”

“এটি একদমই নতুন। কেবল সেদিনই দল গঠন করা হয়েছে। গত টার্মের শেষের দিকে দল গঠনের অনুশীলন চলছিল। আমি দেখলাম, আমার পাঞ্চিং অন্যদের চাইতে ভালো কারণ আমি পাঞ্চবলের উপর যথেষ্ট অনুশীলন করেছিলাম।”

মিঃ উইলসন এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছেলের বাইসেপ টিপে দেখলেন, “মন্দ নয়, মন্দ নয় একদম,” নিবিড় সমালোচকের ভঙ্গিতে বললেন, “কিন্তু তুমি যদি মুষ্টিযোদ্ধা হতেই চাও আর যদি তোমার স্কুলকে প্রতিনিধিত্ব করতে চাও তবে ওখানে তোমার অনেক শক্তি থাকতে হবে। আমি বলে দেব তোমাকে কি করতে হবে। আমরা একযোগে অনুশীলন করবো। ”

“তবে তো সেটা খুব মজার হবে,” ছেলে বলল, “আমি তো স্কুলেও অনুশীলন করছি।”

“তোমাকে ওরা ওজনভিত্তিক কোন শ্রেণিতে ফেলেছে?”

“ওজনভিত্তিক নয়, শ্রেণি ভাগ করা হয়েছে বয়সভিত্তিক। অনূর্ধ্ব পনের। পনের বছর পেরুলে তবেই তারা ওজনভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ করে।”

“ভালো,” গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে মিঃ উইলসন বললেন, “অনূর্ধ্ব পনের শ্রেণিতে তোমার অবস্থান বেশ ভালোই হবে আশাকরি। চূড়ান্ত খেলার আগে তোমার হাতে সময় থাকবে ছয় মাস। কোন কারণই নেই যে এই সময়ের মধ্যে শরীরটাকে পেশীবহুল করে গড়ে নিতে পারবে না। বোধকরি তোমরা টীম হিসেবে টুর্নামেন্ট জাতীয় কিছু একটাতে অংশ নেবে?”

“হ্যাঁ, আগামী টার্মের শেষেই বড় ধরণের একটা টুর্নামেন্ট আছে। আমি সেটাতে থাকবো।”

দৃঢ় আস্থার সাথে তামাশা করতে করতে বাপ বেটা সকালের নাস্তা করতে নিচে নামলো।

“ওর জন্য দুটো ডিম, মম,” মিঃ উইলসন বললেন, “ও অনুশীলন করছে। ও একজন হেভীওয়েট হতে যাচ্ছে।”

“একজন হেভীওয়েট কি?” ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন মিসেস উইলসন, টি পট তাঁর হাতে ধরা।

“বক্সার,” স্মিত হেসে ছেলে জবাব দিল।

গ্রেস উইলসন হাত থেকে টি পট নামিয়ে রাখলেন, নিজের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকালেন একবার বাবা আরেকবার তাঁর ছেলের দিকে, তারপর তীক্ষ্ণস্বরে পুনরায় উচ্চারণ করলেন, “বক্সিং?”

“বক্সিং,” শান্তস্বরে উত্তর দিলেন মিঃ উইলসন।

“আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে,” অসম্ভব দৃঢ় স্বরে বললেন মিসেস উইলসন, “এই একটি খেলা, আমি নিশ্চিত করে বলছি, সে কখনই খেলতে যাচ্ছে না।”

“অনেক দেরী করে ফেলেছ। এরই মধ্যে ওকে ওরা অনূর্ধ্ব পনেরোর দলে নিয়ে নিয়েছে। ও সেখানে অনুশীলনসহ অন্য সবকিছুই করছে।”

“এটা কি সত্য, বাবা?”, মিসেস উইলসন নিশ্চিত হতে চান।

“হ্যাঁ,” দ্রুত খেতে খেতে ছেলে উত্তর দেয়।

“ঠিক আছে, তুমি ওদের বলে দিতে পার যে তুমি তোমার নাম কাটিয়ে নিচ্ছ, ব্যারননেস সামারস্কিল”

“ব্যারননেস সামারস্কিল, কিছু মনে করো না!”, চিৎকার করে উঠেন তাঁর স্বামী।“এই প্রথম সে একটা কিছু করবার সুযোগ পাচ্ছে, এই প্রথম তাকে একটা টীমে নেয়া হয়েছে, সে যে কি বস্তুতে তৈরি সেটা দেখাবার জন্য তাকে একটা সুযোগ দেয়া হয়েছে, আর তুমি কি না ব্যারননেস সামারস্কিলকে সামনে টেনে আনছো।”

“কিন্তু এটা মগজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে! ঐসব ঘুসিগুলো যেগুলো খুলির সামনের দিকটায় আঘাত করে। আমি এ সম্পর্কে পড়েছি।”

“মগজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে!” মিঃ উইলসন নেকো সুরে ভেংচি কেটে উঠেন। “তুমি কি বলতে চাও ঐ ঘুসিগুলো ইঙ্গেমার জোহান্সনের মগজকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে? তাহলে তিনি কি করে বিশ্বের তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যবসায়ীদের একজন হতে পারলেন?”

“বাবা,” মিঃ উইলসন অবিচলিত স্বরে বলেন, “স্কুলে গিয়েই তুমি খেলাধুলার শিক্ষকের সাথে দেখা করবে আর তাঁকে বলবে যে তুমি বক্সিং ছেড়ে দিচ্ছ।”

“আমাদের স্কুলে কোন খেলাধুলার শিক্ষক নেই। সব শিক্ষকই ভিন্ন ভিন্ন সময়ে খেলাধুলার বিষয়ে কিছু না কিছু অনুশীলন দেন।”

“নিশ্চয়ই কেউ একজন আছেন যিনি বক্সিংয়ের দায়িত্বে। তোমাকে শুধু যেটি করতে হবে তা হলো তাঁকে গিয়ে বলা...”

“তুমি কি তৈরি, বাবা?” মিঃ উইলসন বলেন, “এখনই রওনা না হলে তোমার কিন্তু স্কুলে দেরী হয়ে যাবে।”

“এখনও হাতে প্রচুর সময় আছে, বাবা। এখনও নাস্তাই শেষ করিনি।”

“কিছু মনে করো না। এগিয়ে যাও, জোয়ান ছেলে। তোমার ডিম-পাউরুটি শেষ কর আমি ততক্ষণ তোমার মায়ের সাথে কথা বলি।”

এক টুকরো শুকনো টোষ্ট মুখে চালান করে দিয়ে ছেলেটি কাঁধে ঝোলা তুলে নিলো আর চটজলদি বাইরে ছুট লাগালো। স্বামী-স্ত্রী ঘরে এসে বসলেন, চোখ লাল করে একে অন্যের দিকে জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

ঝগড়া শুরু হলো এবং সেটা অনেকদিন পর্যন্ত চলল। শেষ পর্যন্ত রফা হলো, আগামী বছরের মার্চ মাসে স্কুলের হয়ে টুর্নামেন্টে অংশ নেয়া পর্যন্ত ছেলে বক্সিং চালিয়ে যাবে, তারপর সেটা ছেড়ে দেবে।


“ছিয়ানব্বই, সাতানব্বই, আটানব্বই, নিরানব্বই, একশ’,” মিঃ উইলসন গুনলেন, “হুম, ঠিক আছে! এখন যাও, শাওয়ার নিয়ে বিছানায় যাও।”
“আমি ক্লান্ত বোধ করছি না, সত্যি...,” প্রতিবাদের সুরে ছেলে বলে উঠে।

“কে ম্যানেজার, শুনি? তুমি না আমি?”, মিঃ উইলসন স্পষ্ট করে বলে উঠেন। “আমি যখন ট্রেনিঙয়ের দায়িত্ব নিয়েছি তখন তুমি তো বলতে পারো না যে আমার প্রশিক্ষণ পদ্ধতি কাজ করে না। পুরো পনের হপ্তা ধরে চালিয়ে যাচ্ছি, কাল ফাইট, আর তুমি আজ এসে আমার সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করছো!”

“এটা নিছকই নির্বুদ্ধিতা যে আমাকে বিছানায় যেতে হবে যখন কিনা আমি মোটেই ক্লান্ত নই...”

“আমার প্রিয় খোকা, আমার উপর বিশ্বাস রাখ। কোন বক্সারই বড় কোন ফাইটে অংশ নিতে ড্রেসিং রুমে যাবার আগে এক দুই ঘণ্টা বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করেন নি, এমন নজির নেই।”

“ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। তবে আমি বাজি রেখে বলতে পারি, অন্য কাউকেই এ ধরণের জ্বালা পোহাতে হচ্ছে না।”

“সে জন্যই তো তুমি অন্যদের চাইতে ভালো করতে যাচ্ছ। যাও, ঠাণ্ডা লেগে যাবার আগেই শাওয়ার নিয়ে নাও। ঝাঁপাবার দড়িটা ফেলো, আমি ওটা তুলে রাখবো।”

ছেলে চলে যাবার পর মিঃ উইলসন ঝাঁপাবার দড়িটা একটা পরিচ্ছন্ন গুটলির মতো করে গুছিয়ে সেটাকে প্যাকেটের ভেতর পুরে ফেললেন। ওই প্যাকেটের ভেতর আরো শোভা পাচ্ছিল ছেলের বক্সিং গ্লোভস, সিল্কের ড্রেসিং গাউন, লম্বা ফিতেওয়ালা বক্সিং বুট আর ট্রাংক (বক্সিং খেলার শর্টস)। -সেটার ডান পায়ের উপর জায়গামতো স্কুলের ব্যাজ সেলাই করা। রিঙয়ে নামার আগে একটু স্কিপিং করে নিলে তেমন ক্ষতি নেই, বরং সেটা স্নায়বিক দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করবে, ভাবলেন মিঃ উইলসন। তারপর গুনগুনিয়ে একটা সুর তুলতে তুলতে লেদার কেসের ঢাকনা ফেলে দিয়ে বাড়ীর ভেতর গিয়ে ঢুকলেন।

তিনি ঘরে ঢুকবার সময় মিসেস উইলসন টেলিভিশন সেট থেকে দৃষ্টি সরালেন না। “সব প্রস্তুত মম,” বললেন মিঃ উইলসন। “বিশ্রাম নেবার জন্য সে এখন বিছানায় যাচ্ছে। ভোর ছটার দিকে রওয়ানা করবে। আমি ওর সাথে যাব আর দরজা খোলার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করবো, রিংয়ের ডানদিকের আসনটি দখল করতে হবে যে...,” পাশের সোফাটিতে বসে হাত বাড়িয়ে স্ত্রীকে কাছে আকর্ষণ করেন তিনি। আদুরে গলায় বলে উঠেন, “আহা এসো তো, সোনা! আমার প্রতীক্ষার রাতটিকে নষ্ট করো না।”

মিসেস উইলসন ঝট করে স্বামীর দিকে ফিরে তাকান। বিস্ময়াভিভূত হয়ে মিঃ উইলসন দেখতে পান, স্ত্রীর দু’চোখে ক্রোধের অশ্রু ছাপিয়ে উঠছে। “আর আমার সেই দীর্ঘ রাত্রির কি হবে?” মিসেস উইলসন ফুঁপিয়ে উঠেন, “মনে করতে পার, চৌদ্দ বছর আগের কথা, যখন সে এই পৃথিবীতে এলো...”

স্ত্রীর কথা এড়িয়ে যেতে চান মিঃ উইলসন, “ঠিক আছে, এটার আবার কি হলো?”, টিভি সেটটির কাঁপা কাঁপা আওয়াজ আর দুর্বল সংকেত যে তাঁর মনোযোগের প্রান্তদেশ ছুঁয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে তিনি ছিলেন স্বাচ্ছন্দহীন সচেতন আর দৃশ্যপট ক্রমেই অশোভন বিয়োগান্তক নাটক থেকে বিশ্রী প্রহসনে রূপান্তরিত হচ্ছিল।

“তাহলে তুমি আমাকে আগে বল নি কেন?” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন মিসেস উইলসন। “একদল বুলেটমেথো অভদ্র দুর্বিনীত দস্যু তাকে ঘুসিতে ঘুসিতে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে এটাই যদি তুমি চাও তাহলে কেন আমাকে ছেলের জন্ম দিতে হলো?

“নিজেকে শক্ত করো, গ্রেস। নাকে একটা দুটো ঘুসিতে ওর কিছুই হবে না।”

“তুমি একজন অস্বাভাবিক পিতা,” বিলাপের মতো শোনাল মিসেস উইলসনের কণ্ঠস্বর। “আমি বুঝতে পারিনা ওকে চড়-ঘুসি-মার হজম করার জন্য রিঙে ঠেলে পাঠানো তুমি কি করে সহ্য করছো...ওহ, কেন তুমি এখুনি ওকে থামাতে পারছো না? ওকে বাসাতেই আটকে রাখো। কোন আইনই আমাদের বাধ্য করতে পারে না যে...”

“ওখানেই তুমি ভুল করছো, গ্রেস,” কঠোর স্বরে বলেন মিঃ উইলসন। “আইন একটা আছে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। সেই নিয়ম বলে দেয়, পুরুষ প্রজাতির তরুণ প্রজন্ম স্বভাবতই শক্তি পরীক্ষার পৌরুষ-দীপ্ত প্রতিযোগিতায় মত্ত হবে। আজ যারা রিঙে নামছে তাদের সবার কথা চিন্তা কর। তুমি কি ভাবছো তাদের মায়েরা তোমার মত বসে বসে বিলাপ করছে আর অযথা কোলাহল করছে? না...তারা তাদের পেশীবহুল, শক্তিশালী পুত্রদের জন্য গর্বিত, যারা কিনা সাহসের সাথে মাথা উঁচু করে কয়েকটা ঘুসির মুখে রিঙে গিয়ে দাঁড়াতে পারে।”

“দয়া করে চলে যাও,” চোখ বন্ধ করে পেছনে দেহ ডুবিয়ে দিয়ে মিসেস উইলসন বলেন। “আমার কাছ থেকে একদম দূরে চলে যাও, সবকিছু শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর কাছে এসো না।”

“গ্রেস!”

“দয়া করে, দয়া করে আমাকে একা থাকতে দাও। আমি না পারছি তোমার দিকে তাকাতে, না পারছি তোমার কথা শুনতে।”

“তুমি ছিটগ্রস্ত,” তিক্ত স্বরে বলেন মিঃ উইলসন। তারপর হলরূম থেকে উঠে আসেন, সিঁড়ি বেয়ে তাঁর দৃষ্টি উপরের দিকে চলে যায়, “বাবা, তুমি কি বিছানায়?”

একটা সামান্য বিরতি তারপর ছেলের গলার ক্ষীণ স্বর ভেসে আসে “বাবা, তুমি কি একটু উপরে আসতে পার?”

“উপরে? কেন? কিছু হয়েছে?”

“একটু উপরে আসতে পার?”

মিঃ উইলসন দৌড়ে উপরতলায় যান। “কি হয়েছে?” হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠেন তিনি, “তোমার কি কিছু হয়েছে?”

“মনে হয় আমার এপেন্ডিসাইটিস,” মুখ কুঁচকে ছেলে বলে উঠে। বিছানায় শুয়ে বালিশের উপরে দেহ মোচড়াতে থাকে সে, মুখমণ্ডল বিকৃত ও লম্বা দেখায়।

“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না,” তৎক্ষণাৎ বলেন মিঃ উইলসন। “পনের সপ্তাহ ধরে গভীরভাবে আমি তোমার প্রশিক্ষণের তদারকি করেছি এবং আমি জানি, তুমি একটি বেহালার মতোই সমর্থ। তোমার কোন সমস্যাই হতে পারে না।”

“পেটের পাশটায় আমি প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছি,” ছেলে বলে। “তলপেটের খানিকটা নিচে, ডান পাশে। ওখানেই তো এপেন্ডিসাইটিস হয়, তাইনা?”

মিঃ উইলসন বিছানায় বসে পড়েন। “বাবা, শোন, তুমি আমার সাথে এটা করো না। আমি অনুরোধ করি, শুধু একবার রিঙে যাও আর অন্ততঃ একটিমাত্র বাউটে অংশগ্রহন কর। তোমাকে স্কুল টীমে স্থান দেয়া হয়েছে, সবাই তোমার উপর ভরসা করে আছে।”

“এই মুহূর্তে তুমি যদি ডাক্তার না ডাকো তবে আমি ঠিক মরে যাবো,” হিসহিসিয়ে বলে উঠে ছেলে। “মা...”, সে চিৎকার করে উঠে।

তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসেন মিসেস উইলসন “কোথায় ব্যথা, বাছা!”

“আমার পাকস্থলীতে ব্যথা করছে। ডান তলপেটে।”

“অ্যাপেণ্ডিসাইটিস!”, তিনি ভ্রুতবেগে ঘুরে দাঁড়িয়ে মিঃ উইলসনের মুখোমুখি হন, “এই হলো তোমার নির্বুদ্ধিতার ফল!”

“আমি এটা বিশ্বাস করি না,” বলেন মিঃ উইলসন। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসেন তিনি। লিভিং রুমে টিভি সেটটি তখনো হড়বড় করে বকেই যাচ্ছে। পনের মিনিট ধরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে মিঃ উইলসনকে ঝলমলে ধাতব আলোয় ভেসে যাওয়া কর্কশ পুতুলগুলোর বকবকানি শুনতে হলো, যতক্ষণ ধরে তারা তাদের তুচ্ছ আচারানুষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছিল। তারপর তিনি আবার উপরে এসে ছেলের শোবার ঘরে ঢুকলেন। মিসেস উইলসন তখন ছেলের কপালে পানি ঢালছিলেন।

“ওর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক,” মিসেস উইলসন বললেন।

“অবশ্যই, ওর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক”, মিঃ উইলসন বললেন। “মোদ্দা কথা হলো, সে লড়তে চায় না।”

“ডাক্তার ঢেকে আনো,” ছেলের মুখ ঢেকে রাখা ঠাণ্ডা ফ্লানেল কাপড়ের ভেতর থেকে একটি কন্ঠ বলে উঠে।

“তাই করবো বাছা, যদি তুমি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ বোধ না কর,” স্বামীর দিকে খুনী দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন মিসেস উইলসন।

মিঃ উইলসন ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলেন। একমুহূর্তের জন্য টেলিফোনের দিকে তাকালেন, তারপর সেটা তুলে নিয়ে গ্রামার স্কুলের নম্বর ডায়াল করলেন। কেউ উত্তর দিল না। রিসিভার রেখে সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ালেন, তারপর জানতে চাইলেন, “এই টুর্ণামেন্টের মাষ্টার-ইন-চার্জের নাম কি?”

“আমি জানি না,” ছেলে দূর্বল গলায় উত্তর দিল।

“তুমি আমাকে বলেছিলে যে তুমি মিঃ গ্রাঞ্জারের তদারকিতে অনুশীলন করছিলে,” মিঃ উইলসন জিজ্ঞাসা করেন, “তিনি কি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন?”

কোন উত্তর এল না। মিঃ উইলসন টেলিফোন নির্দেশিকা ঘেঁটে সব ক’জন মিঃ গ্রাঞ্জারের নম্বর বের করলেন। শহরে পাঁচজন পাওয়া গেল, কিন্তু একজন মাত্র এম.এ.। “এই সেই জন,” আপন মনে বললেন
মিঃ উইলসন। বুকে ভারী সীসা এঁটে আর আংগুলে বরফের হিম নিয়ে তিনি মিঃ গ্রাঞ্জারের নম্বর ডায়াল করলেন।

মিসেস গ্রাঞ্জার ফোন ধরে মিঃ গ্রাঞ্জারকে মিলিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, তিনিই স্কুলে পড়াতেন। ঠিক ব্যক্তিটি তিনিই। কি করতে পারেন তিনি মিঃ উইলসনের জন্যে?

“বিষয়টি আজ রাতের বক্সিং টুর্ণামেন্ট নিয়ে”

“দুঃখিত, কি বলছেন? লাইন খারাপ, শুনতে পাচ্ছি না”

“আজ রাতের বক্সিং টু-র্ণা-মে-এ-এ-ন্ট”

“আপনি কি সঠিক ব্যক্তির সাথে কথা বলছেন?”

“আপনিই তো আমার ছেলেকে পড়ান, ঠিক তো? বিষয়টি হলো আজ রাতের বক্সিং টুর্ণামেন্ট নিয়ে যেখানে তার অংশ নেবার কথা ছিল।”

“কোথায়?”

“কোথায় মানে? অবশ্যই স্কুলে। সে অনুর্ধ পনের বছরকে প্রতিনিধিত্ব করছে।”

একটু বিরতি। “আমি ঠিক নিশ্চিত না যে আপনি কি ভুল করছেন, মিঃ উইলসন। তবে বোধকরি আপনি অন্ততঃ একটি কাঠির ভুল প্রান্ত ধরে আছেন,” একটি সহৃদয় আত্মরক্ষার হাসি ভেসে আসে। “আপনার ছেলে যদি কোন বক্সিং ক্লাবের অন্তর্ভুক্ত তবে সেটা আমার জন্য একটা নতুন খবরই বটে, তবে কোনভাবেই সেটা স্কুলের সাথে সম্পর্কিত নয়। আমরা বক্সিং শেখাই না, অংশও নিই না।”

“স্কুল থেকে বক্সিং এ অংশ নেয় না?”

“না, ওটা আমাদের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত নয়।”

“ওহ,” মিঃ উইলসন বলেন, “ওহ, আপনাকে ধন্যবাদ, আমি আপনাকে হয়ত......আচ্ছা ঠিক আছে, আপনাকে ধন্যবাদ।”

“একেবারেই নয়? যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে আমি আনন্দিত হই। আশাকরি, সবকিছু ঠিক আছে।”

“ওহ...হ্যাঁ,” মিঃ উইলসন বলেন, “হ্যাঁ, আপনাকে ধন্যবাদ, সবকিছু ঠিক আছে।”

মিঃ উইলসন টেলিফোন রেখে দেন, কিচ্ছুক্ষণ ইতস্ততঃ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর ঘুরে এসে সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করেন।


মন্তব্য

বন্দনা এর ছবি

যাক শেষ করলেন তাহলে।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

চলুক

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সজল এর ছবি

তিন পর্বই পড়লাম। এই পর্বটা বেশী অনুবাদ অনুবাদ লেগেছে। সব মিলিয়ে বেশ লেগেছে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ সজল। এই গল্পটার গুচ্ছ গুচ্ছ মেটাফোর নিয়ে আরেকটি পোষ্ট দেবার ইচ্ছে আছে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অস্বাভাবিক  এর ছবি

শেষে তো কিছুই বুঝলাম না
অনুবাদ ভাল লেগেছে

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

শেষটা একটু মন লাগিয়ে বুঝতে হবে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পড়লাম।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

কল্যাণ এর ছবি

এক ধাক্কায় তিনটাই শেষ করলাম।

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ কল্যাণ,
যেমনটা সজল ভাইয়ের মন্তব্যের জবাবে লিখেছি, এই গল্পটার গুচ্ছ গুচ্ছ মেটাফোর নিয়ে আরেকটি পোষ্ট দেবার ইচ্ছে আছে।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

কল্যাণ এর ছবি

বাহ দারুণ হবে হাততালি

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।