ডিজিটাল মৌলবাদঃ রুখে দেয়ার সময় এখনই

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী (তারিখ: সোম, ১১/০২/২০১৩ - ৭:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইন্টারনেট এবং বিকল্প মিডিয়া বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত করেছে এক নূতন দুয়ার। এই মিডিয়া এতটাই শক্তিশালী যে এখন মূল ধারার মিডিয়া কোন ভ্রান্ত বা ভুল সংবাদ পরিবেশন করলে এই বিকল্প মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের সামনে খুব সহজে সত্য বেরিয়ে আসছে। এ কারণে সেলিব্রেটিদের নিয়ে ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর রমরমা ব্যবসাও বেশ ভালো ভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন মূল ধারার মিডিয়ার কোন রকম সাহায্য ছাড়াই সেলিব্রেটি এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান খুব দ্রুত টুইটারের মাধ্যমে নিজেরাই নিজেদের মতামত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারছে।

২০০৯ সনে যুক্তরাষ্ট্র যখন অর্থনৈতিক মন্দার তুঙ্গে, তখন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে দেখা গিয়েছিল প্রতি সপ্তাহে ইউটিউবে পোস্ট করা বাছাইকৃত মন্তব্যের জাবাব দিতে। ব্লগগুলো এখন হয়ে উঠেছে যে কোন খবর দ্রুত ছড়িয়ে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে। অনলাইন সংবাদপত্রের মন্তব্য অংশ মানুষকে সুযোগ দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সংবাদের ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে। আর ফেইসবুকের কথা নাই বা বললাম। ফেইসবুক এখন প্রত্যেকের “ভার্চুয়াল আইডেনটিটি”। গত পাঁচ দিন ধরে আমরা প্রত্যক্ষ করছি এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। তরুণ প্রজন্ম একত্র হয়েছে শাহবাগের রাজপথে। তাদের অভিন্ন দাবি - যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। স্মরণাতীত কালের মধ্যে বাংলাদেশে ঘটা এটা সবচেয়ে বড় বিপ্লব। আর এই বিপ্লবের সূচনা হয়েছে বিকল্প মিডিয়ার হাত ধরে। প্রথমে ব্লগারা ডাক দিয়েছিলেন, তারপর ফেইসবুকের লাইক আর শেয়ারে শেয়ারে সেই ডাক ছড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর কম্পিউটারে। তারপর তারা ধীরেধীরে জড়ো হয়েছেন শাহবাগে। এক সময় শাহবাগ ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে। তারপর দেশের সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোতে।

তবে ভুলে গেলে চলবে না এই বিকল্প মিডিয়ার একটা দুর্বল দিকও রয়েছে। এই শক্তিকে অপশক্তিতে পরিণত করা যায় বেশ সহজে। এখানে যা কিছুই প্রচার করা হোক না কেন, সেটার সূত্র উল্লেখ করার বাধ্যবাধকতা নেই। এতে অপপ্রচার এবং উস্কানি-মূলক প্রচার প্রশ্রয় পাচ্ছে। একটি ব্লগপোস্ট, একটি আউট-অব-কনটেক্সট ছবি বা ভিডিও ক্লিপ অথবা শুধুই কিছু ফেইসবুক স্ট্যাটাস বা রিটুইট সোস্যাল নেটওয়ার্কিং এর ভূবনে একটা মিথ্যেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলতে পারে, অন্তত কিছু সময়ের জন্যে। এক্ষেত্রে যারা ব্যবহারকারী অর্থাৎ “আমি” এবং “আপনি” পালন করতে পারি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই মিথ্যা অপপ্রচার আমার-আপনার অংশগ্রহণ ছাড়া কিন্তু সম্ভব নয় কারণ শেয়ারগুলো আমরাই করি। একজন সূচনা করে কিন্তু বাকি কাজ আমাদের হাত দিয়ে হয়। তাই আমরা কী শেয়ার করছি, কতটুকু সত্য শেয়ার করছি এবং আমার শেয়ার করা পোস্টের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেটা জেনে এবং ভেবে আমাদের শেয়ার করা উচিত।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সব সময় এটা করতে পারি না। আমাদের কিছু দুর্বলতা রয়েছে যা স্বাভাবিক মানবিক দুর্বলতা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু। তারা সাদাসিদে জীবন-যাপন করে। সাধ্যের মধ্যে তাদের ধর্ম পালন করে, অন্য ধর্মের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে তাদের। দেশকে ভালোবাসে, দেশের জন্যে হয়তো তেমন কোন ভূমিকাই রাখতে পারে না কিন্তু অন্তরের অন্তস্থল থেকে চায় দেশটা ভালো থাকুক। রাজনীতিবিদদের উপর তারা হতাশ কিন্তু পাঁচ বছর শেষে কোন এক অপ্রিয় ব্যক্তিকেই আবার ক্ষমতায় বসায়। গণতন্ত্রের সুষ্ঠু প্রয়োগ না হলেও একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের দেশে রয়েছে। এগুলো হচ্ছে আমাদের অনুভূতির জায়গা। এ জায়গা গুলোকে ব্যবহার করা সহজ। ইসলামকে আক্রমণ করা হচ্ছে এমন একটা ছবি আমরা খুব সহজেই শেয়ার করে দেই। বিবেচনা করি না ছবিটা মিথ্যা নাকি পুরা ঘটনাটাই জাল। ফলে ছড়ায় সাম্প্রদায়িক বিষ-বাষ্প। অথবা একটি রাজনৈতিক দল অন্য দলকে হেয় করতে দেশ নিয়ে অপপ্রচার শুরু করলেও আমরা একই কাজ করি। এতে হয়তো সুবিধা পায় তৃতীয় কোন পক্ষ।

জামাত নামের আড়ালে বাংলাদেশের অস্তিত্বে অবিশ্বাসী রাজনৈতিক দলটি এবং শিবির নামে সেটার হিংস্র ছাত্র সংগঠনটি বিকল্প মিডিয়ার এই দুর্বল দিকটার ভয়াবহ ক্ষমতার ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরেছিল বেশ আগেই। ঠিক যেই মুহূর্তে ফেইসবুকে পেইজ অপশনটা চালু হয়েছিল, তারা সাথে সাথে সেটার সর্বোচ্চ সুযোগ গ্রহণ করার জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা শুরু করে। অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই চেষ্টায় তারা সফল। বেশ ভালো ভাবে সফল। ২০১০ এবং ২০১১ সনে প্রায় ১০ মাস জামাত-শিবির পরিচালিত বেশ কিছু পেইজে ইচ্ছাকৃত যোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম কী করে তারা মানুষের মনে বিষ ঢালতে চেষ্টা করে। আমার পর্যবেক্ষণ থেকে আমি জামাত-শিবিরের পেইজগুলোকে তিনটা শ্রেণীতে ভাগ করেছিলাম। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, প্রথম শ্রেনী ধর্মের ছদ্মবেশে অপপ্রচার চালায়। দ্বিতীয় শ্রেনী এ্যাডাল্ট কৌতুক বা এ জাতীয় পেইজের মাধ্যমে অপপ্রচার চালায় এবং সর্বশেষ শ্রেণী দেশাত্ববোধকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ উদ্ধার করে। মজার ব্যাপার, এদের মধ্যে আবার খুবই সখ্য। এ দৃশ্যও দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল যে হাদিস শেয়ারের পেইজ এ্যাডাল্ট পেইজকে অনুরোধ করছে তাদের পেইজের লিঙ্কটা প্রচার করে দিতে। আবার এমনটাও দেখেছি যে এ্যাডাল্ট কৌতুকের পেইজ হাদিস শেয়ার দেয়া শুরু করেছে। তারপর যখন পেইজের সদস্যরা জিজ্ঞেস করে ঘটনা কী, তখন তারা জবাব দিয়েছে “আমাদের মূলনীতি পরিবর্তন হয়েছে”।

আমার এ লেখার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমার পর্যবেক্ষণ আপনাদের সামনে তুলে ধরা। তারপর আমার একটা অনুরোধ আছে। সেটা আমি সব শেষে জানাবো। যাইহোক, আর কথা না বাড়িয়ে এবার আমি প্রত্যেকটা শ্রেণী নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ আলোচনা করছি।

আপনারা হয়তো অনেকেই লক্ষ্য করেছেন ফেইসবুকে বেশ কিছু পেইজ আছে যারা হাদিস এবং কোরআনের আয়াত শেয়ার করে। ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা সেখানে যোগ দিচ্ছেন। ফলে অনেক ফ্যানও পাচ্ছে তারা। এ ধরনের একটা হাদিসের পেইজকে আমি প্রায় দশ মাস পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। প্রথমে সাধারণ বিষয় নিয়ে হাদিস শেয়ার করতো। তারপর যখন পেইজের ফ্যান সংখ্যা বেড়ে উঠলো, তখন তারা হাদিসের পাশাপাশি নিজেদের কিছু আর্টিকেলও প্রকাশ করতে শুরু করলো। এই আর্টিকেলগুলোতে থাকতো মূলতঃ হাদিসের ইন্টারপ্রিটেশন। প্রথম যে আর্টিকেলটা নিয়ে ঐ পেইজে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল সেটা ছিল জিহাদ সংক্রান্ত। তারা সহি হাদিসের রেফারেন্স দিয়ে প্রচার করতে শুরু করলো জিহাদের গুরুত্ব। তাদের মতে প্রকৃত জিহাদ হচ্ছে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে জিহাদ এবং এ ধরনের জিহাদে অংশ নিলে তাদের পরিবারকে স্বয়ং আল্লাহ দেখাশোনা করবেন। প্রচারণাটায় যতটা না বিরক্ত হয়েছিলাম তার থেকে বেশী ভীত হয়েছি বেশ কিছু মানুষকে এমন ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে যেন পারলে তারা এখনই অংশ নেবে! এর কিছু দিন পর তারা তুলে ধরলো অমুসলিমদের সাথে কোন রকম বন্ধুত্ব না করার হাদিস নিয়ে এক সুবিশাল প্রবন্ধ। অমুসলিমরা মুসলিমদের বন্ধু হতেই পারে না এবং তারা মুসলিমদের ভালো চাইতেই পারে না – এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করা ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। এর কিছুদিন পর তারা অমুসলিমদের থেকে ধর্মীয় কর তোলা বাধ্যতামূলক – সে বিষয়ে মানুষকে “সচেতন” করার চেষ্টা শুরু করলো। এরপর আলোচনায় এলো নারীর শাসন ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ এবং সেটা আমাদের সমাজেও গ্রহণযোগ্য নয়। প্রত্যেকটা ঘটনায় তারা সব সময়ই যে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চেয়েছে তা হলো বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে “আল্লাহর আইন” প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অতএব বিপ্লবের ডাক দিতে হবে এবং তাদের সাথে যেন সাধারণ মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করে। ফেইসবুকের বাহিরে যে ওয়েব সাইট থেকে আর্টিকেলগুলো প্রকাশ করা হতো তার নাম “সরল পথ”। আমি আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে ছিলাম বেশ কয়েক বছর। সেসময় ঘটনাক্রমে একজন জামাত-কর্মীর সাথে পরিচয় হয়েছিল। সেই লোক আমাকে সাইটটা দেখিয়ে বলেছিল এটা তাদের পরিচালিত সাইট। পরবর্তিতে দেশে গিয়ে দিগন্ত টিভিতে একটা অনুষ্ঠানে সাইটটার নাম এবং লোগো দেখে নিশ্চিত হয়েছিলাম এটা সত্যিই জামাত-শিবিরের সাইট। এই সাইটটার বিশেষত্ব হচ্ছে, এটার “স্লো পয়জনিং” করার ক্ষমতা ভয়াবহ। ওখানে প্রকাশিত লেখাগুলো পড়তে থাকলে হয়তো দেখা যাবে আপনার অজান্তেই আপনি আপনার পাশে বসা ভিন্ন ধর্মের ভাই বা বন্ধুটার দিতে এক সময় বিদ্বেষের সাথে তাকাতে শুরু করবেন। আপনার অজান্তেই তারা আপনাকে গ্রাস করে নেবে। যাইহোক, এভাবে অপপ্রচার চালাতে থাকলে ঐ পেইজেরই কিছু সদস্য পেইজটাকে জামাত-শিবিরের পেইজ বলে উল্লেখ করে কণ্ঠস্বর তোলেন এবং মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে এসব কার্যক্রমের প্রতিবাদ জানান। ফলে পেইজ থেকে দ্রুত তাদের ব্যান করা হয় এবং ওখানে কথা বলার জন্যে একটা নীতিমালা চাপিয়ে দিয়ে কণ্ঠরোধ করার মাধ্যমে আবার তাদের প্রচারণায় ফিরে যায় পেইজটা। এই পেইজটা ছাড়াও কাছাকাছি রকমের প্রচারণা আরো দুইটা হাদিস শেয়ারের পেইজেও দেখতে পেয়েছিলাম। তবে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম জামাত-শিবিরের দৌড় দেখে যখন আমার জিমেইলে তারা কোরআনের কিছু আয়াত পাঠিয়ে তাদের আরেকটা সাইটে নিয়মিত যাবার জন্যে বলে। আমি ঐ সাইটে কখনই যাই নি বা সাবসক্রাইব করি নি। তারপরও আমার কাছে ইমেইল আসে। ফলে আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না এরা ইমেইল এ্যাড্রেস সংগ্রহ করে মানুষকে নিজেরাই সাবসক্রাইব করে দিচ্ছে।

দ্বিতীয় শ্রেনীতে রয়েছে নিরপেক্ষ নামের আড়ালে লুকানো জামাত-শিবিরের হায়েনা পেইজগুলো। আপনারা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, যে সময়ের কথা আমি বলছি, অর্থাৎ ২০১০ এর শেষ থেকে ২০১১ এর শুরুর দিকের ঘটনা, ফেইসবুকে তখন দ্রুত বেশ কিছু ফান পেইজ তৈরি হয়েছিল যেগুলোর নাম খুব অদ্ভুত। যেমন, ওই ছেড়ি, ওরনা গলায় না দিয়া বুকে দে, কামে দিব, মাইয়া তোরে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইছি প্রেমপত্র না, লাগবো না তোর ডিজিটাল বাংলাদেশ আমার এ্যানালগ বাংলাদেশ ফিরাইয়া দে ইত্যাদি। পেইজগুলো মূলতঃ কৌতুক এবং মজার ঘটনা শেয়ার করার উদ্দেশ্য নিয়ে খোলা হয়েছিল। এভাবে চলতে চলতে এক সময় তারা শুরু করে তাদের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা। দেখা যেত একটা ছবি দিয়ে দাবি করছে এক হিন্দু নভোচারী মহাশুণ্য ঘুরে এসে মুসলিম হয়ে গিয়েছে অথবা জাপানে সুনামীর পর সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছে শুধু রয়ে গিয়েছে মসজিদ। সাথে তারা এটাও প্রচার করে দিচ্ছে এই ধরনের ছবি পশ্চিমা মিডিয়া কখনও ছাপাবে না তাই তারাই সেই মহান ব্রত পালন করছে। এই পেইজগুলোতে অমুসলিমদের নিয়মিত হেয় করা হয়। বিচিত্র কারণে এ ধরনের পেইজের এ্যাডমিনদের হিন্দু বা খৃস্টান হতে দেখি নি কখনও। তারা সব সময়ই মুসলিম এবং বিকল্প মিডিয়াতে ইসলাম প্রচারের মাধ্যমে নেকি অর্জনই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। পেইজগুলোর পোস্টের ধরন এবং স্বর প্রায় সময় একই রকম দেখতে পাই। সবচেয়ে জনপ্রিয় যে তত্ত্ব তারা প্রচার করে সেটা হলো - যারা মুসলিম নয়, তারা মুসলিমদের শত্রু। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে তারা প্রতিনিয়ত অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। তাদের ট্রেডমার্ক কিছু শব্দ রয়েছে। “তথাকথিত-সুশীল” “মানবতাবাদী” ইত্যাদি তাদের পোস্টে নিয়মিত খুঁজে পাওয়া যায়। তাদের মতে লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকরা যারা মানবতার কথা বলে তারা আসলে ইসলামের শত্রু। বিভিন্ন সময় ফটোশপ দিয়ে ছবি বানিয়ে তাদের কথার সত্যতা প্রমাণের চেষ্টাও তারা কম করে না।

ফেইসবুকে জামাত-শিবিরের তৃতীয় শ্রেনীটা সবচেয়ে মারাত্মক। দেশাত্মবোধের প্রলেপ দিয়ে এরা মৌলবাদকে বিক্রি করে। পেইজের নামে বাংলাদেশ, ১৯৭১ ইত্যাদি শব্দ থাকে। কিন্তু পেইজ থেকে প্রচার করা হয় পুরোই উল্টা তথ্য। এরা কথা বলে যুক্তির ছদ্মবেশে। শুনলে মনে হয় কিছু যুক্তিবাদী মানুষ সমাজের কিছু সমস্যা আপনার সামনে তুলে ধরছে। হঠাৎ হয়তো লক্ষ্য করলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্থানের নারকীয় ভূমিকা নিয়ে কথা হচ্ছে এমন সময় এক দল মানুষ বাংলাদেশকে ভারত কী করে শোষণ করছে সেটার ফিরিস্তি তুলে ধরলো। কিম্বা পাকি সেনাবাহিনী কর্তৃক নারী নির্যাতনের ঘটনা আলোচনায় এলে সেই দলটা ফেলানীর প্রসঙ্গ তুলে ধরছে। সৌদি আইনের মার-প্যাচে পড়ে যখন আটজন বাংলাদেশী ভাই-এর শিরশ্ছেদ হয় এবং তা নিয়ে কেউ কথা বললে তখন সেই মানুষগুলো যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে বলে আফগানিস্থান এবং ইরাকে এতগুলো শিশুকে যখন মারা হলো তখন আপনার এই মায়া কান্না কোথায় ছিল? তাদের কথা শুনে আপনি হয়তো বিভ্রান্ত হবেন। কারণ ফেলানীর হত্যাকারীদের বিচার হোক সেটা আপনিও মনে প্রাণে চান। ভারত যে চারদিক থেকে বাংলাদেশকে শোষণ করছে সেটা আপনি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক এবং আফগানিস্থান আক্রমণ এবং হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার ঘটনা আপনিও টিভিতে দেখেছেন এবং ব্যথিত হয়েছেন। অতএব, মানুষগুলো তো অযৌক্তিক কিছু বলছে না! তাদের আপনার সমমনাই মনে হচ্ছে! কিন্তু এখানে একটা বড় “ফাঁক” রয়েছে। আপনাকে তারা তাদের ফ্যালাসির পাকচক্রে আটকে বিভ্রান্ত করছে।

আমি উপরে যে উদাহরণগুলো উল্লেখ করেছি সেগুলো মোটেও কাল্পনিক নয়। প্রত্যেকটা উদাহরণ এধরনের পেইজ থেকে সংগ্রহ করা। বক্তব্যগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাবেন এখানে প্রতিটা ক্ষেত্রে “মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ” দুটা ঘটনাকে এক করে একটার মাধ্যমে আরেকটাকে জায়েজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাকিস্থানীদের বিরুদ্ধে কথা বলার মানে এই নয় যে আপনি ভারতকে সমর্থন দিচ্ছেন এবং ফেলানীর হত্যাকারীদের বিচার চান না। সৌদি আইনের বিরোধীতা করা মানেই আপনি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নয়। আপনি দেখে থাকবেন এই সচলয়াতনেই ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে বিভিন্ন ভাবে শোষণ করার ঘটনা নিয়ে উত্তপ্ত পোস্ট আসে। আবার একই ব্লগাররাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানীদের অপকর্মকে বিভিন্ন সময়ে আমাদের সামনে তুলে ধরছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরাক আক্রমণে যায় তখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবাদের ঢল নেমেছিল। আপনি আমিও ছিলাম সেই প্রতিবাদীদের দলে। কিছুদিন আগে খেলায় পাকিস্থানকে সমর্থন না করার জন্যে যে পোস্টগুলো এসেছিল সেখানে এই পেইজগুলোই ভারতকে সমর্থন না করার বিষয়ে কেন কথা বলা হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তুলেছিল। একই ফ্যালাসি, একই কণ্ঠস্বর।

আপনি হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন আমার কথা আপনি বিশ্বাস করবেন কেন? নাহ, আমাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কোনটাই করতে বলবো না। শুধু অনুরোধ করবো মিলিয়ে দেখুন তো। একটা ঘটনাও কি আপনার চোখে পড়েনি? আমি নিশ্চিত আমার অভিজ্ঞতার সাথে নিজের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে নিলে সামঞ্জস্য খুঁজে পাবেন; যদি সত্যি মুক্তমন নিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেন। আবার অনেকে হয়তো বলবেন ফেইসবুকে এসব করে ওরা আর আমাদের কতটুকু ক্ষতি করতে পারবে? ভুল। খুবই বড় ভুল। জামাত-শিবিরের এসব অপপ্রচারকে যদি আপনি হালকা ভাবে নেন তাহলে বলবো ভুল করছেন। এই কাজে তারা লক্ষ লক্ষ টাকা ঢালছে। “অপ্রকাশিত সত্য” নামের একটা পেইজের এ্যাড ঢাকায় আমার ফেইসবুকে একটানা অনেক দিন এসেছিল। তারপর বিরক্ত হয়ে পেইজটায় গিয়ে দেখতে পেয়েছিলাম ভয়াবহ ধর্মীয় মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ বিদ্বেষ। এ্যাড দিয়ে যখন কেউ এমন মিথ্যাচার চালায় তখন বুঝতে কষ্ট হয় না এটা কোন বালকের ছেলেখেলা নয়, এটা বড় এক ষড়যন্ত্রের অংশ। কোরআনের পাতায় পা রেখে ছবি তুলে এবং সেই ছবিতে অন্য ধর্মের মানুষকে ট্যাগ করে খুব সহজেই রামুতে আগুন লাগিয়েছিল এই জামাত। ইসলামকে ব্যবহার করে এরা হত্যা ও ধর্ষনের অপরাধীদের রক্ষা করার জন্যে দেশ জুড়ে অরাজকতা করছে যা বেগবান হচ্ছে এই ফেইসবুক পেইজগুলোর মাধ্যমেই। সর্বশেষ শাহবাগের বিপ্লব যখন তাদের প্রাণ-ভোমরে হাত দিয়েছে তখন তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে বিপ্লব নিয়ে বিভিন্ন ভাবে অপপ্রচার চালাতে।

যে অনুরোধটা করতে এ লেখার অবতারণা করেছিলাম, এবার সে কথায় আসছি। আমরা যেমন রাজপথে নেমেছি জামাত-শিবিরের মাথাগুলোকে শেষ করতে; ঠিক তেমনই ফেইসবুকে “স্লো পয়জনিং” এর বোতল নিয়ে বসে থাকা আগাছা গুলোকেও শেষ করতে হবে এখনই। আমরা কম-বেশী সবাই ফেইসবুক ব্যবহার করি। আসুন আজ, এই মুহূর্তে আমরা পণ করি - যখনই জামাত-শিবিরের পেইজ চোখে পড়বে, আমরা তাতে রিপোর্ট করবো। একটা পেইজও আমরা এড়িয়ে যাবো না। যখনই চোখে পড়বে তখনই রিপোর্ট করবো। লক্ষ লক্ষ হাত শাহবাগে স্লোগান মুখর। আমরা যদি পণ করি ঐ লক্ষ লক্ষ হাত দিয়ে পেইজগুলোও রিপোর্ট করা শুরু করবো, তাহলে জামাত-শিবিরের কোন অস্তিত্ব থাকবে না ভার্চুয়াল জগতেও। মনে রাখবেন, ওরা সংখ্যায় কম। তাই তারা যা করার ফেইসবুকে ফেইক আইডি আর পেইজ দিয়ে করে। আমাদের সংখ্যা অগুনতি। রাজপথ আমাদের দখলে। আসুন ফেইসবুকও আমাদের দখলে নেই। ডিজিটাল মৌলবাদকে রুখে দেই।

১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
গ্লাসগো, যুক্তরাজ্য


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

একটাই দাবি ফাঁসি, ফাঁসি, ফাঁসি চাই।
জয়বাংলা শ্লোগানে প্রকম্পিত করুন
রাজাকারের হৃদয় আত্মা।
একাত্তরের হাতয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।
জযবাংলা।

তুহিন সরকার।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

একটাই দাবি - রাজাকারের বংশ নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে বাংলার বুক থেকে।

ন এর ছবি

সহমত। অত্যন্ত গুরুতবপূণ পোস্ট। শেয়ার করার অনুমতি দিলে খুশি হব, সবার জানা দরকার।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

অনুমতির প্রয়োজন নেই। সচলে প্রকাশিত আমার যে কোন লেখা শেয়ার করতে পারেন।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

সহমত।
রিপোর্ট করব।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

যখনই দেখবেন, তখনই রিপোর্ট করবেন। আমরা এক হয়ে 'ক্লিক' করা শুরু করলে সেটা গুলির থেকে কোন অংশে কম কার্যকর হবে না।

বাউলিয়ানা এর ছবি

ইদানিং ছবি ফটোশপিং করে রাজাকারি করাটা খুব বিপদজনক হারে হচ্ছে। অনেক শিক্ষিত লোক (যেমনঃ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাবসায়ী)-কে দেখেছি ছবির উপর পুরোপুরি বিশ্বাস করতে। আমি অবাক হয়ে গেছি যখন দেখি সিএসই বিভাগের একজন পাশ করা ছেলে এই ফটোশপিং বিশ্বাস করেছে এবং দাবী করেছে শাহবাগে একজন ফাঁসী অভিনয় করতে গিয়ে মারা গেছে!

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

ধর্মের প্রভাব মানুষের উপর ব্যাপক এবং গভীর। আর এই প্রভাবকে যখন কেউ নেতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে ব্যবহার করতে শুরু করে তখন তা হয়ে উঠে ভয়াবহ। যে শিক্ষিত মানুষের কথা আপনি বললেন, হয়তো দেখবেন তারা এটা কল্পনাও করতে পারছে না যে একটা ছবি ফেইকও হতে পারে। তাদের চিন্তায় জামাত-শিবির এটা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে ইসলাম মানে জামাত, জামাত মানে ইসলাম। আর সেজন্যে তারা নির্বোধের মত নিজেদের জামাতের ফাঁদে ঠেলে দিচ্ছে।

আমি প্রথমে আমার বন্ধু তালিকায় এমন মানুষদের বোঝানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু পরে দেখলাম সেই চেষ্টা প্রায়ই বিফলে যায়। আর সেজন্যেই সরাসরি রিপোর্টের অনুরোধ করছি। আসুন, যখনই এমন পেইজ দেখবো, রিপোর্ট করবো। প্রয়োজনে সমমনাদের অনুরোধ করবো রিপোর্ট করতে। ডিজিটাল মৌলবাদকে একবিন্দু ছাড় দেয়া ঠিক হবে না।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

ঘচাং

(ভুল করে মন্তব্যের রিপ্লাই পোস্ট করে ফেলেছি এখানে)

অতিথি লেখক এর ছবি

ডিজিটাল মৌলবাদ রোখার জন্য অবশ্যই পেজগুলো বর্জন করা জরুরী, তবে খেয়াল করে দেখতে হবে জামাতী পেজ না হয়েও যে কেউ জামাতী ট্যাগ না পায়। আমার জানামতে ৩২ টা থাপ্পড় দিয়ে একটা দাঁ ত ফালায়ে দিমু পেজটা জামাতী না। এইটা রাসয়াত রহমান জিকো পরিচালিত একটি পেজ। জিকোকে নিশ্চয়ই কেউ ছাগু বলবেন না। সেরকম পেইজগুলি নামে ফেসবুক এ আল্লামা শয়তানের একটি লিস্ট আছে, সেটা ফলো করতে পারেন।

ডেমিয়েন থর্ন

মিরাজ এর ছবি

ধন্যবাদ ডেমিয়েন থর্ন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।