চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষাঃ মুখস্থ বনাম প্রয়োগমুখী বিদ্যা

নির্ঝর অলয় এর ছবি
লিখেছেন নির্ঝর অলয় [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১২/০৯/২০১২ - ২:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

-বাবা, পার্কের বই আছে?
-জ্বী স্যার।
-মেডিকেল সায়েন্স- সায়েন্স না আর্টস?
-স্যার, সায়েন্স।
-সায়েন্স তো বাবা নিজের ভাষায় বানিয়ে বললে হবে না, আর্টস বানিয়ে বলার বিষয়; আর সায়েন্স কীসের বিষয়?
-জ্বি স্যার, মুখস্থের।
-হ্যাঁ, এইবার ঠিক আছে, যাও।

এগুলো ছিল একজন সহযোগী অধ্যাপকের করা প্রশ্নসমূহের শেষ অংশ। ময়দান- দ্বিতীয় বৃত্তিমূলক পরীক্ষার ‘পানিপথ’, বিষয় কমিউনিটি মেডিসিন বা জনস্বাস্থ্য। ছাত্রটি প্রায় সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছিল। কিন্তু উত্তরের ভাষা, পরীক্ষকের বাইবেল পার্কের টেক্সটবুকের সাথে হুবহু মিলছিল না; দাঁড়ি-কমা, বাক্যের গঠন মিলছিল না! অবশ্য গোপন খবর- বইয়ের ভাষার বাইরে এক লাইন শুদ্ধ ইংরেজি বলা বা লেখার ক্ষমতা এই পরীক্ষকের ছিল না। যাইহোক ৩-৪ মাস পরে রেজাল্ট দিলে দেখা গেল ছাত্রটি ওই বোর্ডে টেনেটুনে ৬০ অর্থাৎ পাস-মার্ক পেয়েছে। ভাগ্যিস ছেলেটা আবেগের বশে সত্যিটা বলে বসেনি যে, বিজ্ঞান ‘বোঝার’ বিষয়। ওটা বললেই নির্ঘাত ফেইল! যাহোক, বিবেকের সাথে ছোট্ট আপোস করা ছাত্রটি ছিলাম আমি! আমার ছোটবেলা থেকে অর্জিত জ্ঞান তখন প্রশ্নের মুখে। কেননা আমার শিক্ষকেরা শিখিয়েছেন এবং বইপত্তরেও পড়েছি বিজ্ঞান মুখস্থের জিনিস নয়, বরং শিল্পকলার জ্ঞান অর্জনে সৃজনশীলতার পাশাপাশি মুখস্থের ভূমিকাও প্রচুর। থেলিস থেকে শুরু করে হকিং পর্যন্ত কোন বিজ্ঞানীর মুখস্থ করার গপ্পো কোত্থাও পড়িনি! তবে কী বাংলাদেশের অধিকাংশ চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষকের মতামত বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলোকেই অস্বীকার করছে? বাংলাদেশে মেডিকেল সায়েন্স কি এখন আর্টসের মতো করে শেখানো হচ্ছে, কিছু দলবাজ মৌলবাদী শিক্ষকের কল্যাণে? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে। যে স্বল্পসংখ্যক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষক আছেন, নানা মহলের চাপে তাঁরা কিছুই করে উঠতে পারেন না। এই লেখার বিষয় কীভাবে বিজ্ঞান হিসেবেই চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখানো উচিত –তারই একটা ক্ষুদ্র কড়চা। এ নিয়ে পরে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ রচনার ইচ্ছে আছে।

আমাদের দেশে মেডিকেল কলেজের ভর্তি-পরীক্ষা থেকে শুরু করে শেষ বৃত্তিমূলক পরীক্ষা পর্যন্ত শুধুই মুখস্থবিদ্যার জয়জয়াকার! আমাদের সময় ভর্তি পরীক্ষায় একটা প্রশ্ন এসেছিল- “বেনজিনের সান্দ্রতাঙ্ক কত?” অথচ এর চেয়ে অনেক অনেক বুদ্ধিদীপ্ত ও যৌক্তিক প্রশ্ন ছিল। ঠিক এভাবেই অগণিত মেধাবী শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অন্ধের মতো মুখস্থকারী কতিপয় তোতাপাখিরাও মেডিকেল কলেজে ঢোকে এবং এই মনুষ্যত্ববোধহীন তোতাপাখিদের একটা অংশই পরবর্তীতে নানা কুকীর্তি করে এই মহান পেশার সবাইকে বদনামের ভাগীদার করে। এটা একটা দুঃখজনক সত্য যে, চিকিৎসাবিজ্ঞান শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম এখনো ইংরেজি হওয়া সত্ত্বেও অনেক মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজির জ্ঞান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পর্যায়ের। এর ফলে তারা অধীত বিদ্যার অনেক কিছুই বুঝতে পারে না। গ্রুপ স্টাডির সময় আমার অনেক বন্ধুকেই দেখতাম শব্দের মানে না জেনেই মুখস্থ করছে এবং ভালো স্মৃতিশক্তির জোরে ওগুলো পরীক্ষার হলে উগড়ে দিচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মত একটা প্রয়োগমুখী বিদ্যা না বুঝে মুখস্থ করার ফলাফল কখনোই শুভ হওয়ার কথা না! অ্যাপেন্ডিক্সের বিভিন্ন অবস্থানগুলোর পার্সেন্টেজ আমাদের দশমিকের পরের ঘর পর্যন্ত মুখস্থ রাখতে হত, অথচ দেখা গেল, একটা স্টাডিতে সম্পূর্ণ উলটো ফল পাওয়াতে ওই পার্সেন্টেজগুলো “গ্রেজ অ্যানাটমি”র ৩৯ তম সংস্করণে বর্জন করা হয়েছে! বিভিন্ন ল্যাবরেটরী-ভ্যালু আমাদের দশমিকের পরের ৩ ঘর পর্যন্ত মুখস্থ করতে হত। আমাদের বায়োকেমিস্ট্রির টিউটোরিয়ালের ম্যাডাম তো এসব মানে একটু ভুল হলেই খেপে গিয়ে বলতেন, “এইজন্যেই তো এখনকার ডাক্তারদের এই অবস্থা, কাগজে রেফারেন্স ভ্যালু লিখে দেওয়া থাকে!” ম্যাডাম কি জানেন যে, USMLE পরীক্ষায় এই ল্যাবরেটরী রেফারেন্সগুলো পরীক্ষার সফটওয়্যার এ দেওয়াই থাকে এবং প্রয়োজন মত পরীক্ষার্থী সেটা দেখে নিতে পারে! কিন্তু ওই দেখা মানগুলো এবং ডেটাগুলো বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আছে কিনা –সেটাই পরীক্ষায় দেখা হয়। আমাদের চলতি এম,বি,বি,এস কোর্সে মাত্র ১০-২০% প্রবলেম বেজড প্রশ্ন থাকে এবং এগুলোতে বিশ্লেষণী ক্ষমতার কোন পরীক্ষাই নেওয়া হয় না। যেকোন রকমের রিসার্চ রীতিমত নিরুৎসাহিত করা হয়!

যেকোন বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি যুক্তি এবং অনবরত পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ। ডিডাকশন এবং ইনডাকশন যুক্তিবিদ্যার দুটি অত্যন্ত বেসিক শব্দ। এই শব্দদুটোর মানে না জেনেও এদেশে বিজ্ঞান নিয়ে এস,এস,সি-এইচ,এস,সি তে দিব্যি ভালো ফল করে মেডিকেল কলেজের প্রফেশন্যাল পরীক্ষায় প্লেস পর্যন্ত করা যায়! এ তো দেখছি নিয়মের ব্যতিক্রম নয়, নিয়মের দৃষ্টান্ত! আমার ইন্টার্ন জীবনের একটা ঘটনা বলছি- সার্জারীর এক আই,এম,ও(ইনডোর মেডিকেল অফিসার) আপু ওয়ার্ডের সাপ্তাহিক সেশনে নিজের “Decision making in critical situations”-শীর্ষক প্রেজেন্টেশন শেষে প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করলেন, “ স্যার এই ‘ডিডাকশন’ শব্দটার মানে কী? আর এখানে...হুম...রিডাকশন মানে কী?’ আমাদের মাথায় বাজ পড়ল! ইনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রফেশনাল পরীক্ষায় প্লেস করা! যাই হোক অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনার শেষে আমি প্রশ্ন করলাম-“ আমাদের ওয়ার্ডে যে নামগোত্রহীন রোগীটা বিনা পরিচর্যায় জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি পড়ে আছে”- তার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হবে? আমরা তো কিছুই করছি না তার জন্য।“ বাকি ইন্টার্নদের তুমুল সমর্থন পাই আমি। বলাবাহুল্য আমাদের সেই গ্রন্থকীট আপু ওই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তো তো করে থেমে গিয়েছিলেন এবং প্রফেসর স্বীকার করলেন আমরা যেটা করছি সেটা মানবিক না! এই জ্ঞানের কী মূল্য যার কোন প্রয়োগ আমরা করি না? তার চেয়ে বইটা একবার-দুবার বুঝে পড়ে বাস্তবক্ষেত্রে সেই আলোটা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করাই ভালো নয় কি? সেদিন খবর পেলাম সেই আই,এম,ও এক চান্সে সার্জারীতেএফ,সি,পি,এস পার্ট টু পাস করেছেন এখন আর,এস পোস্টের জন্য জোর তদবির করছেন। এই মুখস্থবিদদের আটকানোর কোন ব্যবস্থাই আমাদের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার কোন পর্যায়েই নেই! এই তোতাপাখিরা কি কোনদিন মানুষ হবে? আরেকটা সেমিনারে এক আই,এম,ও ভাইয়া প্রশ্ন করেছিলেন “স্যার, অ্যা-লগ্-রিদম মানে কী?” ভাবুন এরা সবাই এম,বি,বি,এস; বি,সি,এস এবং এফ,সি,পি,এস প্রথম পর্ব পাস করা!

আমাদের প্রফেসররা খুব বড় গলায় দাবী করেন যে, আমাদের মেডিকেল শিক্ষা বিশ্বমানের। এটা হুবহু ব্রিটিশ মডেলের- ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ রহস্যজনক কারণে এই বিশ্বমানের ডিগ্রী নিয়ে এমনকী যাদের মডেলে এই পদ্ধতি গড়া সেই বিলেতেও বিনা পরীক্ষায় প্র্যাকটিস করার সুযোগ মেলেনা! শুধু তাই নয় কোন ভাল ক্লিনিক্যাল পোস্টগ্র্যাজুয়েট কোর্সে ভর্তিও হওয়া যায় না। প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তো এটা হয় না! তবে কি আমাদের মেডিকেল শিক্ষা বিশ্বমানের নয়? উত্তর হল, নয় এবং আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। কিন্তু এটাও সত্যি যে বিশ্বমানের চিকিৎসক আমাদের বেশ কয়েকজন আছেন। তাঁদের যে অল্প কয়েকজনের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে, তাঁরা সবাই বলেছেন যে তারা সেলফ-মেড। অর্থাৎ এই অনন্যসাধারণ চিকিৎসকদের জন্য আমাদের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা কোনরকম কৃতিত্বের দাবীদার নয়! সারা বিশ্ব এখন ধীরে ধীরে “প্রবলেম বেজড লার্নিং” এর দিকে এগুচ্ছে, আর আমরা পোস্টগ্র্যাজুয়েট লেভেলেও আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলের মত এনাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি মুখস্থ করে বেড়াচ্ছি! এ নিয়ে আলোচনাও অনেকে বুঝতে পারে না। আমার এক দূর সম্পর্কের ভাগনে, (যদিও বয়সে পনের বছরের বড়!) ছিলেন সার্জারীর রেজিস্ট্রার। তাকে একদিন ক্যান্টিনে বিষয়গুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কথা বলতে গিয়ে দেখি- অরণ্যে রোদন! তার প্রথম কথা- সব কথার মানে জানতে হবে, তার কি মানে আছে। (এ কথার মানে কি উনি জানেন?) দ্বিতীয় কথা, মেডিকেল কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বনির্ভর হতে হবে, স্পুনফিডিং চলবে না। এগুলো নিজের দায়িত্বে মনে রাখতে হবে। যে সিস্টেম চলছে সেটারই ১০০% বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা দরকার। মজার ব্যাপার হল আমার সে ভাগ্নে নিজেই কেন যেন কিছু মনে রাখতে পারেন না এবং সার্জন হিসেবে তার কাজের মান কিছু কিছু ইন্টার্নের চেয়েও খারাপ! অথচ এই সমন্বয় করা খুব কঠিন কিছু নয়। ধরুন ফার্মাকোলজিতে কার্ডিয়াক ড্রাগসগুলো পড়াচ্ছে। ঠিক ওই সময়েই যদি ওই ব্যাচকে হাসপাতালের কার্ডিওলজি ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট দেওয়া যায় তো তাদের জ্ঞান অনেক পাকা হয়। কিন্তু ফার্মাকোলজিতে ওটা পড়ার ছ’মাস পর ওয়ার্ডে প্লেসমেন্ট হলে আগের পড়ার ছায়ামাত্র মনে থাকে। আমার দিদি আমেরিকায় ইউনিভার্সিটি অফ মিসৌরি কলাম্বিয়া থেকে এম,ডি পাস করেছে –ওদের ওখানে এভাবে সমন্বয় করে পড়াত। আমরা চাইলেই আমাদের মত করে রূপান্তর করে নিতে পারি। কিন্তু এই প্রস্তাব দেবার পর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন সাহেব কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে ফটিকের মত আমার দিকে চেয়ে ছিলেন। যেদেশে এরা ডীন হয়, সেখানে ভাল কিছুই কি করা সম্ভব?

বিশ্বের সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম,বি,বি,এস এবং এম,ডি কোর্সে বর্তমানে একেবারে শুরু থেকেই “প্রবলেম বেজড লার্নিং” উৎসাহিত করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রথম বর্ষ থেকেই শিক্ষার্থীরা হাসপাতাল ও রোগীর সংস্পর্শে এসে এনাটমি-ফিজিওলজির তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিকগুলো শেখে। আমরা এটা ভুলেই গেছি যে, গ্রে সাহেব তার এনাটমি বইখানা মুখস্থ করে লেখেননি, অসংখ্য শবব্যবচ্ছেদ করে, দেখে লিখেছেন। অথচ বাংলাদেশের কয়টা মেডিকেল কলেজে যথাযথভাবে ডিসেকশন শেখানো হয়। প্রায় সবই বই দেখে মুখস্থ করতে হয় বলে এনাটমির অপর নাম হয়ে দাঁড়ায় আতঙ্ক। আমাদের মেডিকেল কলেজে এন্তার শব আর হাসপাতালে অঢেল রোগী- এটা আসলেই শিক্ষার বিশাল সুযোগ এবং এ কারণে সত্তরের দশকে এমনকী শুনেছি আশির দশকেও দক্ষ ক্লিনিশিয়ান হিসেবে আমাদের ডাক্তারদের নাম ছিল। বিলেতের ডাক্তাররা এখানে আসত ইন্টার্নশিপ করতে এবং তাদের আমরা তাত্ত্বিক চিকিৎসক হিসেবে খেপাতাম। কিন্তু গত দুই দশকে বায়োমেডিকেল সায়েন্সের অভাবনীয় উন্নতির ফলে বিলেত আমাদের ছেড়ে বহুদূর এগিয়ে গেছে। আমাদের শিক্ষামূলক এবং সেবামূলক হাসপাতালগুলো অভিন্ন হওয়ায় অত্যধিক রোগীর চাপে একাডেমিক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হয়। একটা রোগী নিয়ে পর্যাপ্ত পরীক্ষণ ও গবেষণার সুযোগ শিক্ষার্থীরা কখনোই পায় না এবং সব সময় সব রোগী থাকেও না। যেটা থাকে না সেটা শেখা হয় না। পাশ্চাত্যের ওরা কিন্তু সিম্যুলেশনের সাহায্যে,ডামির সাহায্যে- যেভাবেই হোক শিখছে! আমাদের দেশের অনেক সরকারী মেডিকেল কলেজ থেকেই ভালো ভালো শবদেহ উঁচু দামে বেসরকারী মেডিকেল কলেজে বিক্রি হয়ে যায়। অঢেল বডি দেখার সুযোগ অন্তত আমরা কেউ পাইনি। তবে দেশের সেরা মেডিকেল কলেজ হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজে শব ব্যবচ্ছেদ তুলনামূলকভাবে বেশি হয়, যদিও সেটা পর্যাপ্ত নয়। একেবারে ছেঁড়াখোঁড়া এবং রেডিমেড কাটা মৃতদেহ আমরা দেখতাম যাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশই দেখা যেত না। দেড় বছর গেলে 'প্রফ' পরীক্ষায় আমরা মুখোমুখি হতাম এক আনকোরা নতুন মৃতদেহের, যেখানে সবকিছুই অচেনা লাগত। উন্নত দেশগুলোতে বডির অভাব পূরণ করতে এখন থ্রি ডাইমেনশনাল টেকনোলজি ব্যবহার করে এনাটমি শেখাচ্ছে, মূল্যবান ডামিতে শেখানো হচ্ছে ডিসেকশন আর অপারেটিভ সার্জারী। আর আমরা প্রচুর বডি থাকা সত্ত্বেও উপকৃত হতে পারছি না কিছু অসৎ শিক্ষকের জন্য! দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, সুলভ রোগী আর মৃতদেহ থাকা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্বমানের মেডিকেল শিক্ষা থেকে ইউরোপ-আমেরিকার মানের দক্ষ ক্লিনিশিয়ান খুব কম বের হয়। ওদের তো উপকরণ নেই, তাহলে নিশ্চয়ই ওদের শিক্ষার মান বেশি ভালো!

তাহলে আমাদের অনেক অধ্যাপক কেন এই দম্ভোক্তি করেন? আমার মনে হয় কারণটা ব্যবসায়িক। আমাদের চিকিৎসাশিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা বিশ্বমানের একথা বললে রোগীরা যেভাবেই হোক দেশে চিকিৎসা করাতে উদ্বুদ্ধ হবে। এর যেমন ভালো দিক আছে, তেমনি একটা নিদারুণ ব্যবসায়িক দিকও আছে। কতিপয় সুযোগসন্ধানী চিকিৎসকরূপী শৃগাল এভাবে রোগীদের সরলতার সুযোগ নেন। ঢাকায় এক প্রথিতযশা সার্জন তার বিজ্ঞাপনে লিখেছেন যে তার কাছে সুদূর ইতালি থেকে রোগীরা এসে অপারেশন করিয়ে যাচ্ছেন। এখানে একটা বিশাল ফাঁকি আছে। এর মানে কিন্তু এই নয় যে ইতালিতে তার মাপের সার্জন নেই, হয়তো ওখানে এই অপারেশনের খরচ প্রায় ১০ গুণ এবং সেই কারণেই তিনি দেশে এসে অপারেশন করিয়েছেন। আমি একবার ক্যাজুয়ালটিতে একটা ছোট্ট অপারেশন করেছিলাম, সেই রোগী সিঙ্গাপুরে চাকরি করতেন। এই অপারেশনের জন্য ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলেন। ্তিনি বললেন, ওখানে এটা করতে ২০০০ ইউ,এস ডলার চেয়েছিল, বাংলাদেশে খরচ হল শুধু শ খানেক টাকার একটা সুতো কেনা! এখন আমি নিশ্চয়ই বলব না যে, আমার কাছে সিঙ্গাপুর থেকে লোক এসে অপারেশন করিয়ে যাচ্ছে! হুমায়ুন আহমেদের যে অপারেশনটি হয়েছিল সেটা নিয়ে আমাদের অনেক চিকিৎসক ক্ষোভে মুখর হয়েছিলেন। অবশ্য এই ক্ষোভের পেছনে অনেক অভিমানও কাজ করেছিল। অনেক সময়ই রিপোর্টার কিছু না বুঝেই মিথ্যাই ডাক্তারকে ভিলেন সাজায় এবং পুরো চিকিৎসকসমাজকে অপমান করে। কিছু বদমাশ লোকের জন্য পুরো চিকিৎসক সমাজকে গালি দেওয়া উচিত নয়। এ পরিস্থিতিতে আবেগে ভেসে গেলেও এ সত্য বদলায় না যে, আমেরিকার চিকিৎসাসেবার মান আমাদের চেয়ে উন্নত। হুমায়ুন আহমেদের রোগ যে পর্যায়ে ছিল তার সফল অস্ত্রোপচার বাংলাদেশে সম্ভব ছিল বলে আমার মনে হয় না। এটাও ঠিক বাংলাদেশে সঠিক অপারেশনের পরও রোগী মারা গেলে ডাক্তারকে ভিলেন করা হয়, অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এমন হতে পারে। যেমন ভীষণ খারাপ কোন রোগীর ক্ষেত্রে কখনো কখনো সবরকম চেষ্টা করেও রোগীকে বাঁচানো যায় না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী আমাদের চিকিৎসাসেবার মান গোটা বিশ্বের মধ্যে ৬৯ তম এবং সার্বিক সেবায় আমরা ভারতের চেয়ে এগিয়ে। অর্থাৎ চিকিৎসাসেবায় আমরা বিশ্বের মানদণ্ডে মাঝারি মানের। কিন্তু আমাদের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশেই বিশ্বমানের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। এ কারণেই PLAB, USMLE, AMC পরীক্ষায় না পাস করলে আমাদের ডাক্তাররা ওসব দেশে উচ্চশিক্ষার ও প্র্যাকটিসের সুযোগ পান না!

কাজেই সময় এসেছে, আমরা মেডিকেল সায়েন্সে বিশ্বমানের – এই ফক্কিকা ছেড়ে মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে মন দেওয়া। এখনো এদেশে অনেক শিক্ষক এনাটমির ক্লাসে নানারকম ভাবধারা জাগিয়ে তোলেন, এম্ব্রায়োলজি পড়াতে গিয়ে অপ্রাসঙ্গিক রেফারেন্স দেন অথচ একটা ভালো অ্যানিমেশন দেখাতে পারেন না! আজো এখানে চল্লিশ জন ছাত্রের ব্যাচ করে সমন্বয়বিহীনভাবে বিষয়গুলো পড়ান হয়। অথচ আমরা একটু সৎ হলে, একটু উদ্যমী হলে আর সামান্য বিনিয়োগ বাড়ালে সত্যিই বিশ্বমানের মেডিকেল শিক্ষা দিতে পারি, যার ভিত্তি কখনোই মুখস্থবিদ্যা নয়, বরং বিজ্ঞানসম্মত প্রায়োগিক বিদ্যা। অবশ্য অনেকে এই লেখা পড়ে বলবেন যে, আমার স্মৃতিশক্তি খারাপ বলেই এই লেখার অবতারণা! আপনারা নিশ্চয়ই জানেন বিদ্যাসাগর মশাই মুগ্ধবোধ মুখস্থ করতে খুব কষ্ট পেতেন, তাই বড় হয়ে তিনি মুগ্ধবোধ বধ করেছিলেন, ব্যাকরণ-কৌমুদী লিখে! আমার সে সামর্থ্য নেই, কিন্তু আশা আছে- একদিন এদেশের তরুণ চিকিৎসকেরা চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের মত করেই শেখানোর ব্যবস্থা করবে এবং জীর্ণ প্রথাবদ্ধতার অবসান ঘটবে।

(সঙ্গত কারণেই এই লেখায় কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়নি! হলে আমার আর কোন পরীক্ষা পাস করা হবে না, যত ভালোই পারি না কেন! পোস্টগ্র্যাজুয়েট লেভেলে তৈলমর্দনে আমরা শুধু বিশ্বমানের নই, এক্কেবারে বিশ্বসেরা!)

নির্ঝর অলয়


মন্তব্য

ক্লোন৯৯ এর ছবি

ভাইভা জিনিষটা আমার সব সময়ই ভয়ন্কর লাগত/লাগে/লাগবে সব সময়।

বাদ্যাও (btw) USMLE পরীক্ষা আমেরিকানদেরও দিতে হয় ডাক্তারি করার আগে (আমি যতদূর জানি)। আর PLAB, AMC মানে কি?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ! আমার ধারণা আপনি মেডিকেল ছাত্র বা ডাক্তার।

ভাইভাকে আতঙ্ক করে তুলেছেন কিছু সেকেলে ও আথোরিটারিয়ান অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক। এরা ছাত্রের মধ্যে শুধুই খুঁত খুঁজে বেড়ান। প্রফেসররা সম্মানিত হবেন এটাই কাম্য। কিন্তু বাংলাদেশে বিশেষ করে মেডিকেলে তাদের পূজো দেয়া হয়, তেল নিবেদন করে। বিশেষ করে পোস্টগ্র্যাড পরীক্ষাগুলো পুরোপুরি তাদের হাতের মুঠোয়। কোন ছাত্র তাদের কোন ভুল ধরিয়ে দিলে বা যৌক্তিক সমালোচনা করলে তার আর কোনদিন পাশের আশা থাকে না! পাশ করার পর ছাত্ররা ব্যবসায়ে প্রতিদ্বন্দী হয়ে যাবে ভেবে অনেক যোগ্য ছাত্রকে ইচ্ছে করে ফেইল করানো হয়। পৃথিবীতে আর কোথাও মেডিকেল পোস্টগ্র্যাজুয়েট কোর্সে বাংলাদেশের মত এত ফেইলের দৃষ্টান্ত নেই! দেখা গেছে ,৬ বারে FCPS পাশ হয়নি কিন্তু MRCS এ একবারেই রেকর্ড মার্ক। কারণ দেখা গেল পরীক্ষার্থীর ওপর এক ক্ষমতাবান এক্সামিনার নাখোশ, একটা সেমিনারে তার ভুল ধরার জন্য! FCPS ধারীরা এমনকি যাদের শুধুমাত্র MRCP ডিগ্রী আছে তাদেরকেও গুণতে চান না! সেদিন আমাদের এক সহকারী অধ্যাপক অত্যন্ত রসিয়ে রসিয়ে শ্রদ্ধেয় এ,বি,এম আবদুল্লাহ স্যারের এফ,সি,পি,এস ফেইলের গল্প করছিলেন- যেন আবদুল্লাহ স্যার ওনার চেয়ে নিম্ন মেধার! যদিও তিনটে আন্তর্জাতিক মানের টেক্সটের রচয়িতা এ,বি,এম আবদুল্লাহ স্যারের মানে উনি কোনদিনই পৌঁছানোর যোগ্যতা রাখেন না!

হ্যাঁ, USMLE আসলে PLAB বা AMC র মত শুধুই আন্তর্জাতিক মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটদের জন্য নয়, আমেরিকান ছাত্র-ছাত্রীদেরও ওটা দিতে হয়। কিন্তু সেটা তাদের জন্য আলাদা কোন পরীক্ষা নয়। আমাদের এখানে এম,বি,বি,এস এ যেমন তিনটা প্রফেশনাল পরীক্ষা তেমনি ওদের USMLEর তিনটা স্টেপ।
PLAB আর AMC যথাক্রমে যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় বিদেশি ডাক্তারদের রেজিস্ট্রেশনের পরীক্ষা। বাংলাদেশেও যারা বাইরে থেকে পড়ে আসে , তাদের জন্য বি,এম এন্ড ডি,সি পরীক্ষার কথা কগজে-কলমে আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই। অস্ট্রেলিয়ায় কিন্তু ইউ,এস,এ; ইউ,কে; দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা ডাক্তারদের AMC পরীক্ষা দিতে হয় না। তারা সরাসরি চাকরির আবেদন করতে পারে। একে শুধু বর্ণবাদী মনোভাব বলে চালিয়ে দিলে হবে না। আসলেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের ফাঁক আছে।

নির্ঝর অলয়

nibedita aich এর ছবি

এবার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক নিয়ে কিছু লিখে ফেল।

নিবেদিতা

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

এই পরিস্থিতি আমার মনে হয় শুধু মেডিকেল নয় সকলক্ষেত্রেই।
এই বিষয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে এটা চলে শৃংখলের মত করে। মুখস্তকরেই ভালো ফল করা যায়, ভাল ফল করলৈ শিক্ষক হওয়া যায়, সেই শিক্ষক মুখস্ত না করলে ভালো ফল করতে দেন না!

কীভাবে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে আমার জানা নেই। খুব আশা করে থাকি পরিবর্তন হবে।
চমৎকার লেখা। আরো আরো লিখুন। সচলায়তনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর লেখা দিন হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অতিথি লেখক এর ছবি

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ভাল লেখা। তবে 'আর্টস' কিন্তু স্রেফ বানিয়ে লেখার জিনিস না, অনেক বিষয়ই আছে যা রীতিমত বুঝে বিশ্লেষণ করে লিখতে হয়।

- সাম্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তবে লেখাটা একটু দায়সারা বৈকি! হাসি

আর্টস বানিয়ে লেখার বিষয় – এটা আমার মতামত নয়, আমার সেই প্রাচীনপন্থী জামাতী, বিটকেল স্যারের মতামত! কাজেই আমি নির্দোষ!

তবে একেবারে শ্রেষ্ঠ মাপের শিল্পী ও বোদ্ধাদের সৃজনশীলতার পাশাপাশি ভাল স্মৃতিশক্তি সাহায্য করে। সৈয়দ মুজতবা আলী মাঝে মাঝে এক দু লাইন উদ্ধৃতি দিয়ে গিয়ে পুরো প্রবন্ধ বা গল্প আবৃত্তি করে যেতেন। এই গুণ অবশ্যই সাহিত্য ও ইতিহাসের জন্য উপকারী। জীবনানন্দের মতে সত্যিকারের কবিকে ‘বিগত অনেক শতাব্দী ধরে এবং আধুনিক কালের নব-নব কাব্যবিকীরণ’ সাহায্য করে। এসব ধারণ করতে, স্মৃতিশক্তির প্রয়োগ স্বভাবতই বেশি। তুলনামূলকভাবে বিজ্ঞানের বেসিক কথা মনে রাখার জন্য মুখস্থ করার কোনই দরকার নেই। আবার এটাও ঠিক যে, ভাল কবিতা বা গান এমনিতেই মানুষের মনে থাকে।
নির্ঝর অলয়

Hasan Rahman এর ছবি

চলুক

হিমাদ্রি এর ছবি

চমৎকার লেখা

নীল রোদ্দুর এর ছবি

মেডিকেল সায়েন্স- সায়েন্স না আর্টস?
-স্যার, সায়েন্স।
-সায়েন্স তো বাবা নিজের ভাষায় বানিয়ে বললে হবে না, আর্টস বানিয়ে বলার বিষয়; আর সায়েন্স কীসের বিষয়?
-জ্বি স্যার, মুখস্থের।
-হ্যাঁ, এইবার ঠিক আছে, যাও।

ঠিক এইকারনেই, কদিন আগে যখন মেডিকেলে ভর্ত পরীক্ষা হবে কি হবে, সে নিয়ে তুমুল ঝড় উঠল, আমি বলেছিলাম, অ্যাডমিশন যেমনেই হোক, কোন তফাত নাই। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় যে প্রশ্ন হয় আর এরপর শিক্ষার্থীরা যা শেখে, তাতে ভর্তি পরীখা হয়া বা না হওয়া আক্ষরিক অর্থে একই কথা। ভর্তি হয়ে তো বাবারা মুখস্থই করবে, বুঝতে না কিছু! ঢাকা মেডিকযালের সমসাময়িক মেধাবীদের দেখেছি, ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড কত তাপমাত্রায় কতক্ষন দেখা উচিত, এইটা নিয়ে কোন চিন্তায় করে না তারা! যারা কখনো কিছু স্বাভাবিক চিন্তার কথা মাথায় আনে না, তারা রিসার্চ করবে, এই মানসিকতা তৈরী হওয়া দূরের কথা। যে ছাত্রকে সারা জীবনে চিকিতসা বিজ্ঞান অনুধাবন না করে গলাধ করণ করতে হবে, তার অ্যাডমিশন ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে হল না জিপিএ দিয়ে নিলো, তাতে বাংলাদেশের অসংখ্য নিরুপায় রোগীদের কিচ্ছু আসে যায় না। প্লেইন এন্ড সিম্পল!

-----------------------------------------------------------------------------
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। এটা বিশ্লেষণধর্মী লেখা নয়। অন্তত একজন তরুণ মেডিকেল শিক্ষার্থী বা চিকিৎসক এই লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হলেই লেখা সার্থক। নয়তো নয়। ইতোমধ্যে আমার এক বন্ধু এই লেখার জন্য আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে! ভয়ের কারণ একটু আছে বৈকি! বাংলাদেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট জাফর ইকবাল স্যার বা সায়ীদ স্যারের স্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশি নোংরা এবং ভয়ংকর!
আচ্ছা, 'নির্ঝরা' বলে কি বাংলায় কোন শব্দ আছে?

নির্ঝর অলয়

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সায়েন্স বা আর্টস কোনটাই মুখস্থ করে উগড়ে দেবার বিষয় নয়। সমস্যাটা স্কুল পর্যায় থেকেই শুরু হয়। কবিতা ও কবির নামসহ, দাড়ি-কমা অক্ষুণ্ন রেখে কবিতার প্রথম বারো লাইন পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দেয়া কোন্‌ কাজে আসে? তার দরকারটা কোথায়?

ইদানিংকালে শিক্ষা বোর্ডের অধীন স্কুলগুলোতে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়েছে। তবে এটিও খুব কার্যকর হবে না আমাদের শিক্ষক, পরীক্ষক, শিক্ষণপদ্ধতি ও মূল্যায়ণপদ্ধতির জন্য। বাজারে ইতিমধ্যে সৃজনশীল গাইড চলে এসেছে। অচিরে জোড় বছরের কমন প্রশ্ন, বিজোড় বছরের কমন প্রশ্ন চিহ্নিত হয়ে যাবে। যেই লাউ, সেই কদু। বাংলাদেশের মেডিক্যাল শিক্ষা তারই ধারাবাহিকতা।

মুখস্থের দৌরাত্ব প্রকৌশল শিক্ষায়ও আছে। তত্ত্বীয় শিক্ষার প্রয়োগের ও প্রাকটিসের সুযোগ সেখানে আরো কম। অনেক যন্ত্রপাতি, যেগুলোর নাম-কর্ম-পরিচালন ইত্যাদি পড়তে পড়েতে ফানা ফানা করে ফেলা হয়েছে, সেগুলো অনেকে সারা জীবনেও চোখে দেখতে পায় না।

এই পোস্টে একটা ভালো আলোচনা আশা করছি।

নির্ঝর, মেডিক্যাল নিয়ে আরো পোস্ট দিন। ছোট ছোট ব্যাপারে বিস্তারিত।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

পাণ্ডবদা, কবিতার শেষ আটলাইনও মুখস্থ লিখতে বলা হয় অনেক সময়। মানে ব্যাপারটাই হল কে কত ভালভাবে মুখস্থ করতে পারছে!

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, আপনার গঠনমূলক আলোচনার জন্য।

হ্যাঁ! আপনার সাথে পুরোপুরি একমত। সায়েন্স আর্টস কোনটাই মুখস্থ করে উগড়ে দেবার বিষয় নয়। কবিতা যখন অন্তরের বিষয় হয়ে যায় তখন তা এমনিই আত্মস্থ হয়, তোতাপাখির মতো মুখস্থ করতে হয় না।

ঠিকই বলেছেন। সৃজনশীল পদ্ধতি আসলে নামেমাত্র। সায়ীদ স্যার এ সদুদ্যোগের মূল হোতা। কিন্তু তাঁর মহান উদ্যোগকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পাঞ্জেরী, শেষ সম্বল ইত্যাদি বেনের দোকানদারেরা নানা রকম "সৃজনশীল" গাইড বের করেছে! কোচিং এর নাম রাখা হচ্ছে 'সৃজন!' আমাদের এক সহপাঠিনী বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল, অনেক ট্যালেন্টেড বন্ধুদের টপকে। তা তার নাকি পাঞ্জেরী গাইডের সব অঙ্ক রেজাল্টসহ মুখস্থ ছিল(আস্তফউল্লাহ!)! অথচ গণনার যোজনবিধির মত সাধারণ নিয়ম অনেক বিজ্ঞানের ছাত্রই জানে না! অবশ্য আমি এটা বলছি না যে বুয়েটে এমন বোকারাই ভর্তি হয়। বুয়েট এখনো সবচেয়ে মেধাবীদের পীঠস্থান। তবে সিস্টেমের দুর্বলতার কারণে কিছু জাঙ্ক ঢুকে ঝামেলার সৃষ্টি করে। আই,আই,টি র পরীক্ষা পদ্ধতি বুয়েটের চেয়ে উন্নত, সেখান থেকে ভালো জিনিসগুলো আত্মীকরণ করা উচিত। যেমন কোন প্রশ্ন পুনরাবৃত্ত না করা, ৬ মিনিট সময় কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত কঠিন অঙ্ক, যা কখনোই পুরোপুরি চর্চাসাপেক্ষ নয়, ভেতরে বস্তু থাকলেই পারা যাবে, ৩ মিনিটে পাঞ্জেরী-আফসারুজ্জামান উগড়ে দেয়া নয়। তবে বুয়েটে নব্বই এর দশকে শুনেছি বেশ ভালো প্রশ্ন হত।

আমার এক বড় ভাইয়ের কাছে শুনেছি ইলেক্ট্রিক্যাল আর কম্পিউটার এঞ্জিনিয়ারিং বাদ দিলে বাকীগুলোর নাকি ৮০% ই মুখস্থবিদ্যানির্ভর! সে তুলনায় যন্ত্রের ওপর দখল কম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। দক্ষ সার্জন কম্পাউন্ডারের চেয়ে সব দিক দিয়েই দক্ষ। কিন্তু মেকানিককে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন এঞ্জিনিয়ার দুঃখজনকভাবে বিরল। এর জন্য দায়ী অপর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা!

মেডিকেল নিয়ে বেশি পোস্ট দেয়া ক্যারিয়ারের জন্য অস্বাস্থ্যকর! চোখ টিপি

প্রকৃত সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা কিন্তু রবিঠাকুর অনেক আগেই কিছু করে দেখিয়েছেন। লোকটাকে আজকাল যতই গাল দেয়া হোক, অনেক দারুন কাজ তিনি করে গেছেন। সেখান থেকে শেখা উচিত।

নির্ঝর অলয়

সাইদ এর ছবি

আই বি এ ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও সম্পূর্ণ মুখস্থবিদ্যাহীন ভর্তি পরীক্ষা হয় কি না আমার সন্দেহ আছে।

সজল এর ছবি

মুখস্ত না করেই দিব্যি বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, খারাপও করিনি তেমন একটা।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

অতিথি লেখক এর ছবি

সজলদা,
আমি কিন্তু কোথাও বলিনি যে, বুয়েটে সব মুখস্থবিদরাই ভর্তি হয়! যাতে ভেজালগুলোকে আটকানো যায়, আমি সেই কথাটা বলেছি।

তবে আপনাদের বছর থেকেই আফসারুজ্জামানের বই থেকে বড় বড় অঙ্ক আসা শুরু হয়েছিল, আমাদের বছর তা আরো চরমে ওঠে! এই অঙ্কগুলো মুখস্থ করে ভালো ফল করা আপনার বা আমার পক্ষে কল্পনাতীত হলেও, অনেকেই অত্যন্ত দক্ষতার সাথে অঙ্ক মুখস্থ করে। সায়েন্স গ্রুপ ওয়ান এ এরকম চীজ অনেক ছিল, যারা মুখস্থনির্ভর অনুশীলন করে ভাল করেছিল। ৩মিনিটে কলমের ডগায় বুঝে নিয়ে আসতে আপনি সক্ষম ছিলেন, কেউ কেউ মুখস্থ করে সেটা করেছে! এরাই পরবর্তীতে বিটকেল সব কীর্তি করে!

যাইহোক বুয়েটের কথা বলার যোগ্য লোক আমি নই। যেকোন কারণেই হোক, আমি তো আর ওখানে চান্স পাইনি! মন খারাপ চোখ টিপি

নির্ঝর অলয়

সজল এর ছবি

আগের জনের কমেন্টের জবাবে বলা।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সাইদ এর ছবি

@সজল- আমি বলেছি সম্পূর্ণ মুখস্থবিদ্যাহীন ভর্তি পরীক্ষার কথা। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা ১০০% মুখস্থবিদ্যাহীন সেটা আপনার কাছ থেকেই জানলাম। আপনি বা আপনার মত হয়ত অনেকেই মুখস্থ না করেই চান্স পেয়েছেন। সেজন্য আপনি বা অন্যরা অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্য, তার মানে তো ভাই এটা না বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার সকল প্রশ্ন মুখস্থবিদ্যা ছাড়া উত্তর করা যায়। আশা করি আমার কথাটা আমি বুঝাতে পেরেছি।

স্যাম এর ছবি

চলুক

songjukta  এর ছবি

উত্তম জাঝা!

Ashis  এর ছবি

মুখস্থবিদ‌্যা পরীক্ষা‌য় পাসের জন্য ভালো কিন্ত অ‌্যাপ্লিকেশনের ক্ষেত্রে খুব খারাপ। না বুঝে অ্যাপ্লিকেশন করলে সেটার ফলাফল খুব ভয়াবহ হতে পারে। সেটা মেডিকেল বা ইন্জিনিয়ারিং যাই হোক না কেনো। খুব সুন্দর বিশ্লেষণধর্মী লেখা উপহার দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ডাক্তারী জীবনের জন্য শুভকামনা।

আশিস

তানভীর এর ছবি

মুখস্ত্ , বোধগম্যতা এবং প্রয়োগ এই তিনটি জিনিসের সমন্বয় হলেই কেবল ভাল কিছু করা যায় ! যেকোনো একটিকে বাদ দিলে লেখাপড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায় !

তবে আমার মতে এই তিনটি বিষয়ের ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল প্রয়োগ ! তারপর বোধগম্যতা এবং শেষেরটি হল মুখস্তকরণ !

আপনার লেখাটির মূলভাবটা আমার পছন্দ হয়েছে ! চালিয়ে যান ! তবে লেখালিখির কারণে আপনার লেখাপড়ার ক্ষতি যেন না হয় ! হাসি গুরু গুরু
হাততালি

অতিথি লেখক এর ছবি

মেডিকেল ভর্তির একটা প্রশ্ন এখনো আমার মনে পড়ে। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সমীকরন কোনটি ?

a) E=mC^2 b) e=mc^2 c) E=Mc^2 d) E=mc^2

গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি

ইফতি

রাজিব এর ছবি

দারুন লিখেছ। মুখস্থ বিদ্যা আমাদের এডুকেশন সিস্টেম এর আসল সমস্যা। সথিক প্রায়োগিক বিদ্যার চর্চা ছাড়া প্রোফেসনাল লাইফ এ প্রবেশ এর অনুমতি দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়া তে জি পি হিসেবে চর্চা করতে হলে অনেকগুলো
ধাপ পার হতে হয়। কম্পিউটার সায়েন্স এ

রাশেদুল ইসলাম রনি এর ছবি

আমি ডাক্তার নই, কিন্তু এত দুরেও নই। এই শিক্ষকরাও মুখস্ত করেই শিক্ষক হয়েছেন, তাই ইনারা এর বাইরে ভাবতে নারাজ- রীতিমত বিরক্ত হন। আপনার লিখা পরে অনেকেই অনুপ্রাণিত হবে, নতুন চিন্তার ডাক্তার বা শিক্ষক হবে এই আশা করি। লিখাটা খুব দারুন হয়েছে- আসলে মেডিকেলের পড়াশোনার ব্যাপারটা বাইরের মনুষ্জন কমই জানে....আরেকটু জানার সুযোগ করে দিননা।

কল্যাণ এর ছবি

ইয়ে মানে একটা কথা ছিল। রম্যরচনা খুঁজতে নীড়পাতায় ক্লিক করে লিস্টের প্রথমেই এই পোস্ট পেলাম। কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারলাম না এটা রম্যরচনা হল কিভাবে!!! খাইছে

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

নির্ঝর অলয় এর ছবি

তেমন রম্য হয়নি বোধহয় , কী আর করা, 'খাট্টা রচনা' ধরে নিন!

Nishika এর ছবি

সব সত্য কথা....

Nishika এর ছবি

সব সত্য কথা

অতিথি লেখক এর ছবি

এত সুন্দর লেখা আর বিশ্লেষণ আমি খুব ই কম পড়েছি। কিছু কিছু বিষয়ে আপনার বিশ্লেষন অসাধারণ। প্রফে প্লেস করা আর ডাক্তার হয়া এক জিনিষ না। অন্তত আমাদের এই বর্তমান ব্যবস্থায়।

আশিকুজ্জামান পিয়াশ

নির্ঝর অলয় এর ছবি

ধন্যবাদ, পড়ার জন্য।

অনীক এর ছবি

আমি এমবিবিএস ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। আমাদের দেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলো আপনি অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তবে আশার বাণী হচ্ছে বিগত ২ বছর যাবত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন মুখস্থনির্ভর নয়, বরং কনসেপচুয়াল হচ্ছে। তবুও মেডিকেলে যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের একটা বিশাল অংশ মুখস্থবিদ্যার জোরেই টিকে আছে। এর কারণ বোধহয় আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেডিকেল পড়তে ইচ্ছুকদের মুখস্থবিদ্যার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়। মুখস্থ না করেও শুধু বুঝে বুঝে যে একটা জিনিষ মনে রাখা যায়, এই ধারণাই তাদের মাঝে গড়ে উঠে না। আর টিচারদের একটা অংশও ছাত্রছাত্রীদের মুখস্থের প্রতি আগ্রহী করে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।