মোজার্টের আঁতুরঘরে

সুমাদ্রী এর ছবি
লিখেছেন সুমাদ্রী (তারিখ: রবি, ২৫/০৯/২০১১ - ১০:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ধর্মতলার ব্যস্ত ফুটপাত দিয়ে বছর পনের আগে জনতার স্রোত ঠেলে মা হাঁটছিল আমায় একহাতে ধরে রেখে। অন্য হাতে ঝুলছিল পাটের একটা ব্যাগ, ওতে“ ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়” থেকে এক আত্মীয়ার বিয়ের জন্য সদ্য কেনা শাড়ী। ধর্মতলার ধর্ম বজায় রেখে লোকজন হন্যে হয়ে ছুটছে; কারো প্রতি কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে যেন ভেসে এল ক্ল্যারিনেটের অমোঘ একটা সুর। ধর্মতলার সবগুলো কর্কশ শব্দ তাতে ম্লান হয়ে গেল, কোলকাতার দুপুরকে মুহুর্তে বিবশ করে দিল সে, আমার মনে হচ্ছিল সমস্ত পথচারী, ছুটন্ত বাস, উড়ন্ত মোটরসাইকেল সে সুরের ইন্দ্রজালে যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। কয়েকটা মুহুর্ত কেটে গেল এভাবে, তারপর সে সুরের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলাম বড় একটা ক্যাসেটের দোকান, নাম তার “সিম্ফনি”। মা’র হাতে টান পড়ল, ব্যাপার কী জানতে চাইলে আঙুল তুলে দোকানটা দেখিয়ে বললাম,“গান কিনব।” আমাদের গানের ঘর, মা একটু হেসে জানতে চাইল কী গান কিনব, বললাম, “ঐ যেটা বাজছে।” দোকানী প্যাকেট করতে করতে চোখ কপালে তুলে বললেন, “এ যে বড়দের সংগীত। তোমার ভাল লাগবে?” আমিও তখন মুখে বড় বড় একটা ভাব এনে বললাম,“ আমার তো ১৫ বছর হয়ে গেছে।” মা, দোকানদার দুজনেই একথায় হেসে উঠল কেন তা বুঝিনি সেদিন।

বাসায় এসে ক্যাসেটের ফ্ল্যাপে দেখলাম সৌম্যদর্শণ একটা মানুষের ছবি, এককোনায় তার লেখা আছে MOZART’S CONCERTO COLLECTION। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম এর মানে কী, বাবা বললেন, মোজার্ট বিশ্বখ্যাত জার্মাণ সুরস্রষ্টা আর কনচেয়ার্তো হল পাশ্চাত্য সংগীতের বিশেষ একটা রূপ। অতকিছু কী আর বুঝি, শুধু ঐ মোজার্ট শব্দটা মাথায় গেঁথে গিয়েছিল, তারপর যখনিই পেরেছি সমানে শুনে গেছি ক্যাসেটের দুইদিক। অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বেচারা একদিন বিদ্রোহ করে বসল, ক্যাসেট-প্লেয়ারে নিজের ফিতা আটকে দিয়ে আত্মাহূতি দিল। আমার সে যে কী কষ্ট! ভালবাসার শুরু সেই কষ্ট থেকেই। মোজার্টের অনেকগুলো সংগীত পরবর্তীতে যোগাড় করেছিলাম ঢাকা, চট্টগ্রাম আর কোলকাতা থেকে। তবু যে সুরটা সেদিন আমায় তন্ময় করে দিয়েছিল ধর্মতলার মোড়ে[CLARINET CONCERTO: 1(ALLEGRO) ] সেটি এখনো পর্যন্ত সম্ভবত সবচেয়ে বেশী শোনা কোন সুর।

মোজার্টকে বলা হয় পাশ্চাত্য উচ্চাংগ সংগীতের প্রাণপুরুষ। সংগীতের এই প্রবাদ-প্রতিম পুরুষ সংগীত-অনুরাগীদের কাছে ঈশ্বরতূল্য। জন্মেছিলেন অস্ট্রিয়ার সাল্‌স্‌বুর্গ নামের ছোট্ট একটা শহরে ১৭৫৬ সালে, সেই শহর আজ পৃথিবীর তাবৎ মোজার্টপ্রেমীদের কাছে এক মহান তীর্থ। অন্য আরো একটি কারণে সাল্‌স্‌বুর্গের বেশ খ্যাতি আছে, বিখ্যাত চলচ্চিত্র SOUND OF MUSIC সাল্‌স্‌বুর্গ আর তার আশেপাশের গ্রামগুলোতেই নির্মিত হয়েছিল। মনে বড় ইচ্ছে ছিল মোজার্ট যে শহরে জন্মেছিলেন তার ধূলো মাথায় নিয়ে আসব একদিন। মানুষের ইচ্ছেগুলো বড় বিচিত্র। জীবনভর পাপ করে মৃত্যুর পরের প্রমাণহীন জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য মানুষ বহু অর্থ ব্যয় করে কাশী, গয়া, হরিদ্বার, মক্কা, জেরুজালেম গিয়ে কান্নাকাটি করে আসে। আমার পাপের বোঝা কমানোর এহেন তরিকার প্রতি কোন মোহ নেই, তবু সাধ ছিল কোন একদিন এই মহান সংগীতকারের জন্ম-শহরে গিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আসার। এই গ্রীষ্মে হঠাৎ সুযোগ পেয়ে যাই বহু-আকাঙ্ক্ষিত এই তীর্থ করার।

ভেনিস থেকে ইচ্ছে করেই গভীর রাতে ট্রেনের টিকিট করেছিলাম যাতে সকাল সকাল গিয়ে সাল্‌স্‌বুর্গ পৌঁছি। উদ্দেশ্য একটাই, হোটেলের খরচ বাঁচানো। সেই সকালটা একটু বেশী সকালই হয়ে যাওয়ায় সাল্‌স্‌বুর্গ স্টেশনের ভূগর্ভস্থ অপেক্ষাগারকেই শয়নকক্ষ করে নিয়েছিলাম কয়েক ঘন্টার জন্য। তারপর স্বপ্নে দেখলাম মোজার্ট আমায় পিয়ানো শেখাচ্ছেন, আর ভূল নোটে আঙুল পড়তেই দমাদম পিঠে বসিয়ে দিচ্ছেন কয়েক ঘা। শিক্ষক মোজার্ট কিন্তু খুব কড়া মেজাজের। কিন্তু এক সময় মনে হল মারের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, কিলের বদলে পিঠে পড়তে লাগল লাথি। ব্যাপার কী, কোথাও গন্ডগোল হচ্ছে নিশ্চয়ই! ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠতেই দেখি অস্ট্রিয়ান পুলিশ, বুট দিয়ে গুঁতো মেরে আমার ঘুম ভাঙাচ্ছে। মনে মনে বললাম, একেক দেশের একেক সংস্কৃতি, মনে কিছু করার কোন কারণ নেই। ডয়শ্‌ ভাষায় কী বলল বুঝলাম না, আমি ইংরেজীতে বললাম, মোজার্টের বাড়ি দেখতে এসেছি সেই সুদূর আফ্রিকা থেকে আমি পর্যটক। অমনি কী হল কে জানে, মুফতে স্টেশনে রাত্রিযাপনের জন্য আমায় কোন জরিমানা তো করলই না, বরং তর্জনী উঁচিয়ে দেখিয়ে দিল পর্যটন তথ্যের অফিসটা। সেদিকে যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার মত রাত্রিযাপনকারীদের অনেকের হাতেই হলুদ একটা কাগজ। ব্যাটারা নিশ্চিত মোজার্টের নাম ভূলভাবে উচ্চারণ করেছিল।

সাল্‌স্‌বুর্গের আকাশ মেঘলা, ঝিরঝির ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে আর সাথে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। মনটাই খারাপ হয়ে গেল, ফ্রান্সে কিংবা ইতালীতে এই দুদিন আগেও দেখে এলাম রোদের প্লাবন,এদিকে আমার কাছে ছাতাও নেই। তথ্য অফিস জানাল দুটো প্যাকেজের কথা। একটা সেই বিখ্যাত সাউন্ড অব মিউজিক ট্যুর, তিনদিনের একটা প্রোগ্রাম, সাল্‌স্‌বুর্গের বাইরে বিখ্যাত এই ছবিটির যতগুলো লোকেশন আছে, সমস্ত পার্বত্য এলাকা আর অভূতপূর্ব সুন্দর লেকগুলো, সব আপনাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাবে এরা। খরচ পড়বে মাত্র ৩৭ ইউরো। হিসাবের খাতা খুলে বসলাম, যোগ করলাম, বিয়োগ করলাম। তারপর, নেগেটিভ। অন্যটি শহরের ভেতর। শহরের নতুন আর পুরোনো দুই দিকেই ঘুরিয়ে আনবে আপনাকে, বিনিময়ে গুনতে হবে ১৭ ইউরো। আবারো ভেটো দিলাম। শহরটা হেঁটে ঘুরে আসতে বড়জোর কয়েকঘন্টা লাগবে, খামোখা পয়সা খরচের কোন মানে হয়! একটা ম্যাপ নিলাম শহরের,এমনিতেই দিল। তারপর স্টেশনের সাথে লাগোয়া বাস টার্মিনালে গিয়ে খোঁজ নিতে লাগলাম সারাদিনের টিকেটের। ইউরোপের শহরগুলো মূলতঃ অতিথি(পর্যটক)সৎকার করেই খায়। সুতরাং পর্যটন মৌসুমে আপনার সামান্যতম সাহায্যের জন্য কর্তৃপক্ষ শহরগুলোতে নিয়োগ করে রেখেছে অনেক সেবাকেন্দ্র আর সেবকদের। টার্মিনালে স্মিতহাস্য একটা ছেলে বলল, “ পাঁচ ইউরোর এই টিকিটটা নিন, সারাদিন যেকোন বাসে করে শহরের ভেতর যতখুশি যাওয়া আসা করতে পারবেন।” লে হালুয়া, এটাই তো খুঁজছিলাম। ইউরোপের প্রায় সব শহরের মতই সাল্‌স্‌বুর্গও গড়ে উঠেছে ছোট্ট শান্ত একটা নদীর দুই কিনারে, নাম তার সালজাক্‌। সাল্‌স্‌বুর্গ নামের অর্থ হল লবনের প্রাসাদ। সালজাক্‌ নদীর উপর দিয়ে এককালে ভেসে বেড়াত লবনবাহী বজরা, ওখান থেকেই এই শহরের এমন নাম।

বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ না দেখে বাস একটাতে উঠে পড়লাম। কিছুদূর গিয়ে একটা স্টপেজে দাঁড়াতেই দেখলাম লোকজন হুড়মুড় করে নেমে যাচ্ছে। আমিও ওদের দেখাদেখি নেমে পড়তেই দেখি সামনে দাঁড়ানো অপূর্ব মিরাবেল প্রাসাদ আর তার সুবিখ্যাত বাগান। ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স আর্চবিশপ উল্‌ফ ডিয়েট্রিচ্‌ তার দয়িতা সালমে আল্ট-এর মনোরঞ্জনের জন্য নির্মাণ করেছিলেন বারোক রীতির এই সুরম্য প্রাসাদ। তবে প্রাসাদের পেছনের অপূর্ব বাগানটিই মন কেড়ে নেয় সবার। হাল্কা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই পর্যটকরা ঘুরছেন বাগানের চারদিক। কেন্দ্রস্থলে এর বিশাল পেগাসাস ফোয়ারা যাকে ঘিরে আছে বেশ কয়েকটি সুন্দর মূর্তি, ঐখান থেকে চোখ তুলে তাকালেই দেখা যায় ফেস্টুনবার্গ পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে থেকে সাল্‌স্‌বুর্গ শহরকে নজরে রাখছে মধ্যযুগের ইউরোপের বৃহত্তম দূর্গ হোহেনসাল্‌জ্‌বুর্গ। বিশাল বাগানটির একপ্রান্তে রয়েছে আর্চবিশপ ফ্রাঞ্জ হারাচ এর নির্দেশে ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত “বামনদের বাগান” যেখানে বৃত্তাকারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে হারাচের রাজদরবারের বিশিষ্ঠ বামনদের ভয়ালদর্শণ সব মার্বেল পাথরের প্রতিমূর্তি। মিরাবেল প্রাসাদটি বর্তমাণে সাল্‌স্‌বুর্গের মেয়রের অফিস, তবে এখানে শহরের কুলীনদের বিয়েও অনুষ্ঠিত হয়, ঘুরতে ঘুরতে হলরুমে এসে দেখি সদ্য বিবাহিত নবদম্পতি এক পরিবারের সদস্যদের সাথে বিয়ের ছবি তুলছে। এবার বুঝলাম বাস থেকে ওভাবে পড়ি-কি-মরি করে যাত্রীদের এখানে নেমে পড়ার রহস্য।

প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আবার বাসে উঠলাম, এবার নামলাম গেট্রেইডগাস নামে শহরের পুরোনো অংশে। একটা রাস্তার দুপাশে সারি সারি সব বিপনী বিতান, মূলতঃ এটি শহরের বানিজ্যক কেন্দ্র। ম্যাপ বলছে মোজার্টের বাড়ি এখানেই আশেপাশে কোথাও, ছাতা কেনার ছুতোয় এক দোকানীকে জিজ্ঞেস করলে সে একটা নির্দেশনা দিল ডয়শ-এ। আমার ডয়শ ঐ গুটেন আবেন্ড আর ডাংকে অবধি, তাই দোকানীর আঙুল যেদিকে তাকাল সেদিকে নাক রেখে সোজা হাঁটা দিলাম। এসে পড়লাম একটা বিশাল চত্ত্বরে। মাঝখানে তার তেজী ঘোড়ার মার্বেল মূর্তি পরিবেষ্টিত প্রকাণ্ড এক বারোক ফোয়ারা। চারপাশে বেশকিছু রাজকীয় ভবন আর একদিকে একটা কাল ব্রোঞ্জের মূর্তির সামনে মানুষের ভীড়। ম্যাপে চোখ বুলালে বুঝলাম দাঁড়িয়ে আছি সাল্‌স্‌বুর্গের নগরকেন্দ্র রেসিডেনজপ্লাটজ-এ। রেসিডেনজপ্লাটজ আর্চবিশপ উলফ ডিয়েট্রিচ রাইটনোর বারোকরীতির শিল্পের প্রতি অনুরাগের প্রকাশ। বলা হয়ে থাকে তৎকালীন বাভারিয়ার সবচেয়ে ধনশালী নগর সাল্‌স্‌বুর্গকে রোমের আদলে তৈরী করার মানসে ৫৫টি বড় বাড়িকে গুড়িয়ে দিয়ে সেই জায়গায় নির্মাণ করা হয় রেসিডেনজপ্লাটজ। এর চারদিকে আছে বেশ কয়েকটি বারোক স্থাপত্য ডম কাথেড্রাল, রেসিডেনজ(আর্চবিশপের রাজপ্রাসাদ), সাল্‌স্‌বুর্গ মিউজিয়াম, নিউ রেসিডেনজ আর মোজার্টপ্লাট্‌জ। একটু আগে যে কাল মূর্তির কথা বলেছিলাম ভীড় কমলে তার কাছে গিয়ে দেখি উদাসী মোজার্ট বিষাদমাখা চোখে সামনে তাকিয়ে আছে। এই সেই মোজার্টের বিখ্যাত মূর্তি, সুরকারের মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে সাল্‌স্‌বুর্গবাসী তাদের নগরগর্ব এই শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মোজার্টপ্লাটজ-এ এই মূর্তিটি স্থাপন করে। আমার উদ্দিষ্ট বাড়িটির খোঁজ তখনও পাইনি। এদিক ওদিক হাঁটছি, একবার ঢুকলাম রেসিডেনজগালেরিতে, আবার বেরিয়ে এসে ডম কাথেদ্রালের পাশ দিয়ে গিয়ে পড়লাম আরেকটা চত্ত্বরে যেখানে কয়েকজন অ্যাকর্ডিয়ন শিল্পী বাজিয়ে চলেছে মোজার্টেরই পরিচিত একটা ধুন। তাদের একপাশে দেখলাম অদ্ভুত একটা মূর্তি, হলোম্যান সিনেমার নায়কের মত মুখের জায়গাটায় কিছু নেই, , একজন বলল এর ভেতরে নাকি একটা দুষ্টু আত্মা থাকে যার কাজই হল মানুষের পথ ভুলিয়ে দেয়া। চত্ত্বরটা থেকে সোজা একটা রাস্তা উপরের দিকে চলে গিয়ে শেষ হয়েছে ফেস্টুনবার্গ পাহাড়ের দেয়ালে, যে পাহাড়টার উপর রক্ষীর মত দাঁড়িয়ে আছে হোহেনসাল্‌জ্‌বুর্গ দূর্গ। দূর্গে ওঠার জন্য দুটো পথ, এক ইলেক্ট্রিক ট্রাম, দ্বিতীয়টা হাঁটাপথ। ওখানে গেলে পুরো দিনটাই মাটি হয়ে যাবে ভেবে আর ওপথ মাড়ালাম না। ম্যাকডো’র বার্গার চিবোতে চিবোতে আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলাম মোজার্টের বাড়ির হদিসটা একটু জানিয়ে দিতে, সদাশয় ছেলেটা সুন্দর ইংরেজীতে আমায় পথটা বাতলে দিল। আরে বাড়িটার সামনে দিয়েই তো এতবার ঘুরঘুর করছি, কোন ভূতের খপ্পরে পড়লামরে বাবা!

গেট্রেইডগাস রোডের নয় নম্বর বাড়িটা ছয় তলার হলুদ রঙের একটা দালান। এই বাড়িটার চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটটিতে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারী জন্মেছিলেন মোজার্ট এবং জীবনের সতেরটি বছর তিনি এখানেই অতিবাহিত করেছিলেন। বাড়িটির চতুর্থ, তৃতীয় এবং দ্বিতীয় তলা এখন মোজার্ট মিউজিয়ামের অংশ। সাত ইউরো দিয়ে একটা টিকেট কেটে দুইশ বছরের পুরোনো কাঠের সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম চতুর্থ তলায়। ভেতরটাকে অবিকল সেরকম অবস্থায়ই রাখার চেষ্টা করেছে এরা যেমনটি ছিল মোজার্টের জীবদ্দশায়। ছোট ছোট কামরা। কোনটা রান্নাঘর, কোনটা শোবার ঘর, কোনটাতে মোজার্টরা খাবার খেত একসাথে, কোনটাতে বসে গল্পগুজব করত। নিজের অজান্তেই আমি যেন পৌঁছে যাচ্ছিলাম সেই সময়টাতে যখন মোজার্টের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ পিতা লিওপোল্ড শিশু মোজার্ট আর তার অমিত প্রতিভাবান সহোদরা মারিয়াকে পিয়ানোর ক,খ,গ,ঘ শেখাতেন। প্রতিটা রুমেই মোজার্টদের ব্যবহৃত টুকটাক জিনিসপত্র শোকেসে সাজানো, ডয়শ এর পাশাপাশি ইংরেজীতেও তাদের বর্ণনা দেয়া আছে। ছোট্ট মোজার্ট এর যে বেহালায় হাতেখড়ি হয়েছিল তা এখনও চকচক করছে। পারিবারিক ক্লাভিকর্ডটি(এক ধরনের পিয়ানো)ও ঘুনে ধরে যায়নি এত বছরে। প্রায় সবগুলো রুমের দেয়ালেই ঝুলছে মোজার্টদের পারিবারিক তৈলচিত্র, বিভিন্ন বয়সী মোজার্টের ছবি, বংশলতিকা ইত্যাদি। আছে মোজার্টের প্রিয়তমা স্ত্রী কনস্ট্যাঞ্জ লিখিত মোজার্টের প্রথম জীবনালেখ্য’র একটি কপি। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সময়ে লেখা লিওপোল্ডের চিঠিগুলো যেসবের ভেতর দিয়ে দর্শণার্থীরা জানতে পারেন বালক মোজার্ট এবং তার বোন মারিয়ার সাংগীতিক প্রতিভা সম্পর্কে লিওপোল্ডের উচ্চধারণার কথা। মোজার্ট পরিবা্রের সাল্‌স্‌বুর্গের অভিজাত সমাজে নিয়মিত যাওয়া আসা ছিল কারণ লিওপোল্ড মোজার্ট ছিলেন সাল্‌স্‌বুর্গ রাজদরবারের অপেরা শিল্পী এবং বেহালার শিক্ষক। সে আমলের বৈঠকখানার চেহারা কেমন ছিল তার একটি নমুনা সাজিয়ে রাখা আছে একটা রুমে। অন্য একটা কামরায় চলছে মোজার্ট এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনার উপর নির্মিত একটা প্রামাণ্যচিত্র। তৃতীয় তলাটাকে করা হয়েছে মোজার্ট এর রচিত অপেরাগুলোর মঞ্চসজ্জ্বার উপর। অনেকগুলো থিয়েটারের ক্ষুদ্রাতিকৃতি নমুণা রাখা আছে এখানে। মোজার্টের সময়ের সাল্‌স্‌বুর্গ তথা ভিয়েনার অপেরাকে যেন নিজের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম এখানে। একটা খুপরি মতন রুমে বাজছিল মোজার্টের অমর সিম্ফনি ৪০। কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে চলে এলাম স্যুভনির কেনার স্থানটাতে। মোজার্টের আবক্ষ ছোট্ট একটা মূর্তি আর বারবারা ক্রাফট অংকিত মোজার্টের বিখ্যাত পোর্টেটটির একটা পোস্টকার্ড কিনে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালাম। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি তখনো থামেনি। রাতের ট্রেণেই ভিয়েনা যাব, আবারো সেই একই প্ল্যান, গভীর রাতে ট্রেণ ধরব যাতে পরদিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ভিয়েনায় এসে পৌঁছাতে পারি।

বি,দ্র- আমার ক্যামেরাটি স্লোভাকিয়ার ব্রাতিস্লাভা শহরে চুরি যায়, ফলে সাল্‌স্‌বুর্গে যে ছবিগুলো তুলেছিলাম তার একটাও আমার কাছে আর নেই, এখানের ছবিগুলো নেট ঘেঁটে বের করা।

ছবি: 
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm
23/05/2011 - 9:47pm

মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

যাক, আমি সালসবুর্গ নিয়ে লিখতে যাচ্ছিলাম, এমন তথ্যপূর্ণ পোষ্টের পর মনে হচ্ছে আপাত ঐটা থামিয়ে রাখি। ক্যামেরার জন্য খারাপ লাগল ! ব্রাতিস্লাভা কি ফেরী চেপে গিয়েছিলেন দানিয়ুব ধরে!

সুমাদ্রি এর ছবি

কী বলছেন? এখনি বসে পড়ুন কাগজ-কলম নিয়ে, আরে এতক্ষণ বসে বসে আপনার পুরোনো লেখাগুলো পড়ছিলাম, এই মুহুর্তে পড়ছি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার লেখাটা। সাল্‌স্‌বুর্গ এর টুর টা নিশ্চয় করেছেন আপনি, দয়া করে ওটা নিয়ে লিখুন ছবি সমেত, ব্রাতিস্লাভা গিয়েছি ভিয়েনা থেকে ট্রেন চেপে, দানিউবের উপর দিয়েই, নীল দানিউব, কাল দানিউব। ধন্যবাদ।

তারেক অণু এর ছবি

লিখব পরে, গিয়েছিলাম সাউন্ড অফ মিউজিক আর প্রিয় সুরকারের টানে। আগের মন্তব্যে লিখতে পারিনি- আপনার শুরুর কাহিনীটা দারুণ হৃদয়ছোঁয়া! খুব চমৎকার লেগেছে জেনে। আমার তো মনে হয় কোন মানুষের কোন সময় মন খারাপ হলে মোজার্ট শোনা উচিত, মন খারাপ পালিয়ে যাবে অনেক অনেক দূরে। ভালো থাকুন।

মিলু এর ছবি

উত্তম জাঝা! ছবিগুলো আরেকটু বড় হলে ওখানকার রূপসুধা আরেকটু ভাল করে পান করা যেত। এমন আরো পোস্ট চাই।

nefi এর ছবি

আপনার হলোম্যান এর নাম coat of peace.সালজবুর্গ ক্যাথেড্রালে ঢু মেরেছিলেন কি??খুব সুনদর।আমি তিনবার গেলাম শহরটায়।হোহেসালজবুর্গ ট্রামের ভাড়া বাচাতে হাটা পথে উঠে দুর্গের পিছনে পর্যন্ত গিয়েছি,আলপসের ভিউ দেখে চোখ টেরা হয়ে যায়।

সুমাদ্রি এর ছবি

যাক বড় বাঁচা বেঁচে গেছি, চোখে আমি এমনিতেই সবকিছু হাল্কা বাঁকা দেখি, পুরো ট্যারা হয়ে গেলে কী আর রক্ষে ছিল। হো হো হো ক্যাথেড্রাল বন্ধ ছিল বলে ঢুকতে পারিনি, জীবনে আবার সুযোগ এলে যাবার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ।

সুমন তুরহান এর ছবি

দারুণ লাগলো লেখা। অনেক কিছু জানলাম। চলুক

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

কর্ণজয় এর ছবি

ভাল লাগলো....

ফাহিম হাসান এর ছবি

চমৎকার পোস্ট। ক্যামেরা চুরি হয়েছে শুনে কান্না পেল ওঁয়া ওঁয়া

বন্দনা এর ছবি

লিখা খুব সুস্বাদু হয়েছে সাথে ছবিগুলা ও, তবে Sound of music cinema এর দৃশ্যপট দেখতে পেলে আর ও ভালো লাগতো।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

উচ্ছলা এর ছবি

অনেক কিছু জানলাম, দেখলাম।
সুন্দর লেখার জন্য ধন্যবাদ।

আসমা খান, অটোয়া। এর ছবি

খুব সুন্দর লেখা এবং ছবি। অশেষ ধন্যবাদ সুমাদ্রই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।