এ ও সে ও : ৮ - দুটো বিশ্বাস আর একটি না হওয়া সিনেমা

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: শনি, ০১/১০/২০১১ - ৩:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্লেনটা এতক্ষন মেঘের মধ্যে ছিল। মেঘ ফুড়ে নির্মেঘ আকাশে বের হয়ে আসতেই আলোর বিন্দুগুলো ঝুপ করে ভেসে ওঠে। সের্গেই আইজেনস্টাইন জানালার কাঁচের ভেতর দিয়ে অনেক নিচে আলোর বিন্দুগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। রাশি রাশি মশাল জ্বালিয়ে কোন এক অজানা শহর জেগে আছে। কোন শহর? কোনদিন হয়ত এই শহরে পা ফেলাই হবে না। ভাবতে না ভাবতেই শহরটাকে পেছনে রেখে -আবার অন্ধকার। এলোকেশী কুমারীর দীর্ঘ কালো চুলের মত। ঘুমের মত। নিঃশেষিত আশার মত। নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্য দিয়ে একটানা গো গো করতে করতে প্নেনটা ছুটে চলেছেতেআ চলেছেই। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্লেনটা নামবে সেই অন্য একটা পৃথিবীতে। আমেরিকা।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রধান তাত্ত্বিক এবং সোভিয়েত চলচ্চিত্র নির্মাতা সের্গেই আইজেনস্টাইন উড়ে যাচ্ছেন আমেরিকায়।
বিমানবালা তার সামনে পানীয় আর হালকা কিছু খাবার দিয়ে গেল। ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু একটুও ক্ষেতে ইচ্ছে করছে না। তিনি জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকান। অন্ধকার আর অন্ধকার। তিনি নিকষ কালোর মধ্যে ডুবে যান।
ভিন্ন একটা জাতি, ভিন্ন একটা পরিবেশ, ভিন্ন একটা দর্শন। আমেরিকা। তাদের ওখানে কী ছবি বানাবেন তিনি?
ঘুরে ফিরে এই চিন্তাটাই বারবার আসছে। সেই দিন থেকে, এটার উত্তর তিনি খুজে ফিরে বেড়াচ্ছেন।
হলিউড। যতটুকু শুনেছেন, তার কাছে একটা রূপকথার মত মনে হয়েছে।
ভাল ছবির দিক থেকে নয়। তাকে হলিউড টানছে অন্য একটি কারনে। সিনেমা একটা নতুন শিল্প মাধ্যম। দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষই এর সম্পর্কে এখনও পরিচিত হয় নি। সার পৃথিবীতে চলচ্চিত্র মাধ্যমটাকে ছড়িয়ে দেয়ার কর্মযজ্ঞে হলিউডযে একটা কেন্দ্রভূমি হতে চলেছে এটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। মাঝে মধ্যে আলতো চিন্তার মত, তার মনে হতো- হলিউডে গিয়ে একবার ওদের ব্যাপারস্যাপারগুলো দেখতে পারলে বেশ হতো। কীভাবে ওরা কাজ করছে, কীভাবে চিন্তা করছে? হলিউডে গিয়ে কাজ করার জন্য অনুরোধটা যখন হলিউড থেকেই এলো, তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু তার আনন্দটা বেশিক্ষন থাকেনি। জোসেফ স্ট্যালিনের কঠিন মুখটা তার মগজে এসে দাড়াতেই তার ঠোটে হাসিটা ফুটে উঠেছিল, বিষন্ন আর হতাশা মাখা।
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্ট্যালিন আদর্শ আর বিশ্বাসের দিক থেকে অত্যন্ত কঠিন আর কঠোর প্রকৃতির। অনেকেই বলে - তার সৃজনশীলতাটা কম। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি নিবিষ্ট সততা দিয়ে প্রকৃতিদত্ত এই ক্ষমতার অভাবটিকে তিনি বুঝতে দেন নি। শ্রমিকের অটল পরিশ্রম দিয়ে তিনি প্রায় ভঙ্গুর আর দূর্বল সামন্ততান্ত্রিক একটি দেশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলছেন। এখনে ওখানে ছড়িয়ে থাকা বিশাল বিশাল অঞ্চলগুলোকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর মধ্যে আনতে গিয়ে তিনি এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন - সেগুলো অনেকসময় খুব নিষ্ঠুর মনে হয়। আইজেনস্টাইন নিশ্চিত ছিলেন- পূঁজিবাদী শত্রুরাষ্ট্র আমেরিকায় গিয়ে তার কাজ করার প্রস্তাবে ষ্ট্যালিন কখনই অনুমোদন দেবেন না। নিরাশ হবেন জেনেও স্ট্যালিনের সাথে এই প্রস্তাবটা নিয়ে কথা বলবেন ঠিক করলেন।
স্ট্যালিনের জ্বলজ্বলে চোখদুটো তার মনে পড়ে।
খুবই সাদামাটা একটা অফিসকক্ষ। সাধারন একটা নিরাভরন টেবিল। কয়েকটা চেয়ার টেবিলটাকে ঘিরে আছে। টেবিলের অন্যপ্রান্তে একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছেন স্ট্যালিন। সামরিক অধিনায়কসূলভ শরীরটায় কঠোর নিয়মানুবর্তিতার চিহ্ন প্রকট হয়ে ফুটে আছে। একটা কাগজে চোখ নিমগ্ন, আইজেনস্টাইন এসে সামনে দাড়ালেন। তিনি চোখ তুলে তাকালেন। ইঙ্গিতে তাকে বসতে বলেন। আইজেনস্টাইন বসতে বসতে ভাবেন, কীভাবে তিনি এই প্রসঙ্গটা তুলবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে কিছুই বলতে হয় নি। স্ট্যালিন নিজেই হলিউডে তার কাজ করার বিষয়টা নিয়ে কথা তুললেন। সেই দৃশ্যটার প্রতিটি ফ্রেম তার মনে আছে।
স্ট্যালিন : আমি শুনেছি হলিউড থেকে সিনেমা বানানোর আমন্ত্রন পেয়েছেন।
আইজেনস্টাইন: হ্যা। ওরা বলছিল আমি যদি ওখানে গিয়ে একটা ছবি বানাই...
স্ট্যালিন: হ্যা, ব্যাপারটা নিয়ে আমিও ভাবছিলাম। ওরা সিনেমার ক্ষেত্রে অনেকদুর এগিয়েছে শুনেছি। আপনি যদি ওদের ওখানে গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসতে পারেন তাহলে সেটা আমাদেরও অনেক কাজে লাগতে পারে।
আইজেনস্টাইন শুনলেন, কিন্তু নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। স্ট্যালিনের গম্ভীর নিরুত্তাপ শব্দগুলো, আবেগশূন্য এক লয়ে এখনও আইজেনস্টাইনের কানে বাজে।
: আপনি যান। গিয়ে দেখুন ওরা কী করছে। অভিজ্ঞতাটা দেশের এবং মানুষের কাজে লাগান।
কিন্তু সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ এবং উল্টো একটি বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি দেশে গিয়ে তিনি ঠিকভাবে কাজ করতে পারবেন তো? পুরনো ভাবনায় ফিরে যান আইজেনস্টাইন।
দেখা যাক। আইজেনস্টাইন সময়েল উপরই সবকিছু ছেড়ে দেন।
আমেরিকায় গিয়ে আইজেনস্টাইন প্রথমেই কাজ শুরু করলেন সিনেমার জন্য গল্প বাছাই করতে।
প্যারামাউন্ট পিকচার্সের তার ছবিটা প্রযোযনা করছে। গল্প নির্বাচন আর অন্যান্য খুটিনাটি বিষয়গুলো ঠিকঠাক হবার পরেই ছবি নির্মানের কাজ আরম্ভ হবে।
শেষ পর্যন্ত একটা গল্প তার পছন্দ হলো। আমেরিকার ঔপন্যাসিক ডেজার্টের ‘অ্যান আমেরিকান ট্রাজেডি’ নামে উপন্যাসটা তার ভাল লেগেছে। পড়তে পড়তেই সিনেমাটা তার চোখে ভেসে উঠছিল।
আমেরিকার শহরের বস্তিতে বেড়ে ওঠা সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ একটা দরিদ্র ছেলের জীবনের গল্প এটি।
শহরের একটা অশিক্ষিত দরিদ্র পরিবারে সে বেড়ে উঠেছে। জীবনের সাধারন প্রয়োজনটুকু যেখানে মেটে না সেখানে পারিবারিক মূল্যবোধও গড়ে ওঠেনা। বাড়িতে সবসময় খিটিমিটি, মারপিট, অশান্তি লেগেই থাকে। ছেলেটার কিছু ভাল লাগে না। ক্ষিধে পেট নিয়ে পথে পথেই সারাদিন কেটে যায়। লোভী চোখে চকচক করে ওঠে বড় বড় দোকানের কাঁচের দেয়ালের আড়ালে দামী দামী খাবার, অত্যূজ্জ্বল পোষাক আর জৌলুসপূর্ণ জিনিষপত্র। মনে হয়, আহা! একবার যদি এ সমবকিছু তার হতো! কিন্তু তার হওয়ারতো দুরের কথা, জিনিষগুলো সে ছুঁয়ে দেখবে- সে ক্ষমতাও তার নেই। একবার একটা দোকানে সুন্দর একটা খেলনা বন্দুক দেখে থমকে দাড়িয়েছিল। কি সুন্দর! ইচ্ছে করছিল ভেতরে গিয়ে বন্দুকটা একটু ভাল কওের দেখবে কিনা। যায়ও নি, একটু বেশি সময় ধরে বাইরে থেকে দেখছিলইতো শুধু- দোকানের কর্মচারীটা ওকে দুর দুর করে কুকুরের মত তাড়িয়ে দিলে। এরপর থেকে আর তার বেশিদুর ভাবার সাহসই হয় না।
তাতে কি। পত্রিকায়, রাস্তায়, দোকানে, দেয়ালের গায়ে কত শত উজ্জ্বল পোষ্টার, বিলবোর্ড, হ্যান্ডবিল হাজারো সব মোহনীয় হাতছানি দিয়ে ডাকে। ও রাস্তায় রাস্তায় সেই সব বিজ্ঞাপন মন দিয়ে পড়ে। আর রাতের বেলা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের মধ্যে সে গাড়ি হাকিয়ে ছুটে বেড়ায়। দামী দামী খাবারগুলো ওর সামনে লুটিয়ে পড়ে থাকে। গাড়ি বোঝাই করে এই কেনে সেই কেনে। কিন্তু যখনই জেগে ওঠে- সেই অনাহার, শতচ্ছিন্ন পোষাক আর বস্তির মত খুপড়ি ঘর। অভাব আর দৈন্যতা বিশাল কুমিরের মত মসৃন দাঁত বের করে হাসে।
সে তার নিজের জীবনকে সে ঘৃণা করা শুরু করে।
এই বঞ্চিত, হতচ্ছাড়া জীবন থেকে মুক্তির পথ খুজে পায় না।
শেষ পর্যন্ত মুক্তির পথ দেখিয়ে দিয়ে যায় তার বোন। অচেনা একটি ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার আগে ফিসফিস করে বলে
- ‘এখানে থাকলে কিছু হবে না, কিচ্ছু না। তুই পচে মরবি। আমার মত তুইও পালিয়ে যা, নিজে কিছু কর।’
কথাগুলো ছেলেটাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ভয় পায়। একসময় বিশ্বাস করে ওঠে- এটাই পথ।
সে পালায়।
অনেক দূরের একটা শহরে চলে আসে ছেলেটি। ভাগ্যের সন্ধানে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে একটা দামী আবাসিক হোটেলে কাজও পেয়ে যায় সে। হোটেলে কাজ করে ঠিকই কিন্তু তার চোখ পড়ে থাকে দামী চেহারার খদ্দেরদের নিপাট চালচলনের দিকে। তার নিজেকে বড্ড হতশ্রী মনে হয়। উপরে ওঠার চিন্তাটা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরঘূর করতে থাকে। একদিন। এক ধনাঢ্য ব্যক্তি রাত্রিযাপনের জন্য আসলেন। তার দায়িত্ব পড়লো ছেলেটির উপর। তার সঙ্গে আরেকজন সঙ্গী ছিলেন। এই দুইজনের কথা শুনে ছেলেটির শরীর হিম হয়ে আসে। এই বড়লোক ভদ্রলোকটি তার কাকা।
তার জন্মেরও আগে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন -এরপরে আর ফেরেন নি। কারো সাথে কোন যোগাযোগও রাখেননি। কিন্তু তিনি কীভাবে ভাগ্যকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন সেই গল্প লোকমুখে ঠিকই বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছিল। তার অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্য্যরে গল্পগুলো শুনে সেই গল্পগুলোকে কল্পনায় নিজের জীবনের বলে কল্পনা করতে করতে কি উত্তেজনাই না হত - সেইসব কথা এখনও তার মনে আছে।
সে কাঁপা কাঁপা উত্তেজনায় কাকার কাছে নিজের পরিচয় দেয়।
কাকা তাকে নিরাশ করেন না। ভাইয়ের ছেলেকে তার বিশাল গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে শিক্ষানবীস হিসেবে চাকরী দেন। চাকরী দেবার সাথে সাথে তার কাকা তাকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিলেন। সে যেখানে কাজ করতে যাচ্ছে সেই গার্মেন্টসে অনেক মেয়ে কাজ করে। সে যেন কোনভাবেই এদের কারো সাথে কোন সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ে। যদি সে কোন মেয়ের সাথে সে জড়িয়ে পড়ে তবে তার এই উচ্চ সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সমস্যা হবে। কাকা চান তার মত সেও একদিন এই সমাজে উঠে দাঁড়াক। কিন্তু তার আগে নিজেকে তৈরী করতে হবে।
সে কাজ শুরু করে। কঠোর পরিশ্রমে ভাগ্যকে তৈরী করতে সে নিজেকে ঢেলে দেয়। কিন্তু জৈবিক নিয়মের তাড়নায় কাকার নিষেধ সত্ত্বেও গার্মেন্টসের একটি মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে । তাদের এই প্রণয়ের ফলে মেয়েটি একদিন অন্তঃসত্বা হয়ে পড়ে। এ সংবাদ শুনে সে বুঝতে পারে না- সে কী করবে, কী করা উচিৎ তার।
ঠিক তখনই কাকার এক ধনী বন্ধুর মেয়ে ছেলেটির প্রেমে পড়ে যায়। তাকে নিয়ে মেয়েটির অনুভূতি বুঝতে পারার সাথে সাথে আনন্দে বিভোর হয়ে পড়ে ছেলেটি। প্রেমিকাকে এড়িয়ে মেয়েটিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সে। এই স্বপ্নটা সত্যিকার ভাবে মেয়েটিকে ঘিরে বললে ভুল বলা হবে। বরঞ্চ স্বপ্নটি ছিল মেয়েটিকে আশ্রয় করে তার আকাঙ্খিত প্রাচূর্য্যময় জীবনে পৌছানোর- যার স্বপ্নই সে আজন্ম দেখে এসেছে।
কিন্তু সমস্যা হলো পুরনো প্রেমিকাটি। কী করে তাকে এড়াবে ছেলেটি? দিনরাত সে এই কথাই ভাবে।
খবরের কাগজ থেকে একদিন সমাধানটা লাফিয়ে ওঠে। - ‘কোন একটি পাহাড়ি হ্রদে স্রোতের তীব্রতায় প্রায়ই নৌকা উল্টে দূর্ঘটনা ঘটছে। দূর্ঘটনার পরে অনেকসময় লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ খবরটা পড়তেই পড়তেই -তার মধ্যে চিন্তাটা জন্ম নেয়। চিন্তাটা সে করলেও, সে সহ্য করতে পারে না। সে চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলতে চায়- কিন্তু পারে না। শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে।
এরপরের ঘটনাটি সরল। সে তার প্রেমিকার কাছে গিয়ে সেই পাহাড়ী হ্রদে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে। ফিরে এসেই তাদের বিয়ের কথা সবাইকে জানাবে, ছেলেটি মেয়েটিকে বলে। মেয়েটি ভারমুক্ত, আনন্দিত, উৎফুল্ল আনন্দে নেচে ওঠে। ওর ইচ্ছে করে পৃথিবীর সবাই ওর এই আন্দযজ্ঞে যোগ দিক। ছেলেটি বলে, উহু। এখন না। ফিরে এসে। এখন জানলে – কাকা ঝামেলা করতে পারে। মেয়েটি একটু থমকে যায়, কিন্তু আনন্দের রেশ আরও দ্বিগুন উচ্ছ্বাসে তাকে ঘিরে ধরে।

পরিকল্পনামতো ওরা গোপনে সেই পাহাড়ি এলাকায় বেড়াতে গেল। সেই পাহাড়ী হ্রদের কাছে একটি হোটেলে উঠলো। সেখানে কিছুটা সময় কাটানোর পরেই এলো সেই নৌকাভ্রমনের মূহূর্ত।
একটা নৌকায় তারা ভেসে যাচ্ছে আদর্শ কপোতকপোতীর মতো। আনন্দে উচ্ছ্বল মেয়েটার কয়েকটি ছবি তোলে ছেলেটা। তাকে একটু অন্যমনস্ক মনে হয়। পাহাড়ে ঘেরা নিটোল জলরাশির মোহনীয় সব দৃশ্য, প্রেমিকের উষ্ণ সান্নিধ্য- সবকিছুতে উৎফুল্ল মেয়েটি ছেলেটির এই অন্যমনষ্কতা খেয়াল করে না।
ছেলেটি আসলে মনে মনে ভাবছে- কীভাবে ঘটনাটা ঘটানো যায়। সে আড়চোখে মেয়েটাকে দেখে। মেয়েটি এই পাহাড় দেখে তো, পরমুহূর্তেই হ্রদের টলটলে জলে হাত ভেজায় আবার পরমুহূর্তেই হয়তো বা আকাশের ছুটে চলা মেঘকে দেখে হেসে ওঠে। মেয়েটিকে দেখে তার মনে পড়ে - এই মেয়েটিকে সে ভালবেসেছিল। মেয়েটির চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে সে মেয়েটার ভালবাসা টের পায়। মেয়েটার ভরাট শরীর দেখে তার মনে পড়ে, তার সন্তান বড় হচ্ছে এই মেয়েটির মধ্যে।
সরল বিশ্বাসপ্রবণ এই মেয়েটিকে সে কীভাবে হত্যা করবে? সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।
এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার মনে হয়, থাক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ভাবে, যা হয় হবে। এই মেয়েটিকেই সে বিয়ে করবে।
ঠিক সেই সময়েই ঢেউটা আসে-
অশান্ত ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা টালমাটাল হয়ে যায়। তাল সামলাতে না পেরে মেয়েটি নৌকা থেকে পড়ে যায়। ছেলেটি মেয়েটির দিকে ঝুকে পড়ে। উত্তাল ঢেউয়ে ডুবে যেতে যেতে মেয়েটির মাথা একবার ভেসে ওঠে। ছেলেটি ক্যামেরা ধরে থাকা হাতটি বাড়িয়ে দেয়। মেয়েটি হাত ধরতে পারে না, উল্টো ক্যামেরাটি ছেলেটির হাত থেকে ছিটকে গিয়ে- মেয়েটার মাথায় আঘাত করে। মেয়েটি তলিয়ে যায়। ঠিক বোঝা যায় না, ছেলেটির হাত থেকে ক্যামেরা ছুটে গিয়ে মেয়েটির মাথায় যে আঘাত করলো - এটা কী ইচ্ছেকৃত, নাকি দূর্ঘটনা?
হ্রদের উচুঁ নীচু ঢেউ রোদে চিকচিক করতে থাকে।
ছেলেটি ভাবে, যা হবার হয়ে গেছে... তার চোখে আবার আগামী স্বপ্ন নেচে ওঠে। আড়ম্বরপূর্ণ স্বচ্ছল জীবন...
পূর্ব পরিকল্পনা মতোই সে ফিরে আসে, একা। ধনী মেয়েটির সাথে সময় কাটায়, বিয়ের পরিকল্পনা করে। তাদের বিয়ের বাগদানের ঘোষণার আয়োজন চলে। একেবারে শেষ মুহূর্তে, যেদিন বাগদানের কথা ঘোষণা করা হবে -ছেলেটিকে ধরতে পুলিশ আসে।
ছেলেটি অকপটে স্বীকার করে, সে মেয়েটিকে হত্যা করার কথা চিন্তা করেছিল, ভেবেছিল, কিন্তু...
বিভ্রান্তিটা তৈরী হলো এই ‘কিন্তু’টি নিয়েই। ডেজার্টের মূল উপন্যাসে -এই ‘কিন্তু’টি ছিল না। উপন্যাসের ছেলেটি মেয়েটিকে সরাসরিই খুন করে। তাই আর কোন ‘কিন্তু’ থাকে না। কিন্তু আইজেনস্টাইন তার চিত্রনাট্যে খুনের ব্যাপারটি অস্পষ্ট করে তোলেন। তিনি এমনভাবে সিনেমাটিকে সাজান যেখানে ছেলেটি কী মেয়েটিকে হত্যা করেছে নাকি করে নি- এটা একটা দূর্ঘটনা- তা ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে যায়।
প্যারামাউন্ট পিকচার্সের সাথে চুড়ান্ত বৈঠকে এই ‘কিন্তু’টিই মূখ্য হয়ে এলো।
: আপনি কেন মেয়েটিকে হত্যা দৃশ্যটি পরিবর্তন করেছেন?
আইজেনস্টাইন এক মুহূর্ত সময় নেন। নিজের চিন্তাগুলোকে যেন খানিকটা গুছিয়ে আনেন। শান্ত চোখ তুলে তিনি প্যারামাউন্ট পিকচার্সের কর্তাব্যক্তিদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন
: আমার কাছে মনে হয়েছে মানব জীবনের মনের ভেতরকার এই টানাপোড়েনটা তুলে আনলে ভাল হবে।
: মনস্তাত্বিক ভাবে টানাপোড়েন হতেই পারে। কিন্তু এটা দেখানোর পরে, আপনি ছেলেটি মেয়েটিকে হত্যা করেছে, এটি সরাসরি দেখালেন না কেন?
: আমার কাছে মনে হয় এটা এভাবে ভাল হবে।
: আমাদের কাছে মনে হয় আপনি মেয়েটির হত্যাদৃশ্যটি সরাসরি দেখানোই যুক্তিসঙ্গত হবে।
আইজেনস্টাইনের মুখে কালো মেঘ জমে।
: আমি মনে করি এভাবেই ব্যাপারটা যুক্তিসঙ্গত হবে।
: কেন, কেন আপনি মনে করছেন আপনারটাই যুক্তিসঙ্গত হবে?
: আমি মনে করি বাস্তবতাটা তাহলে বেশি ভাল করে ফুটে উঠবে।
: তাহলে আপনি কী মনে করেন ছেলেটি মেয়েটির মৃত্যুর জন্য পুরোপুরি দায়ী নয়?
যিনি কথাটি বললেন আইজেনস্টাইন তার দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের চোখে মুখে রাগের চিহ্ন। মুখের সিগারটিকে কামড়ে ধরে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আইজেনস্টাইন নিজেকে সামলে নেন। শান্ত কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললেন
: না। আমি মনে করি ছেলেটি মেয়েটির মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী নয়।
: সরাসরি যদি সে দায়ী নয় তাহলে কে মেয়েটির মৃত্যুর জন্য দায়ী?
ঘরে এক মুহূর্তের জন্য অনন্ত নীরবতা থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। আইজেনস্টাইন এই সময়টুকুতে তার অবস্থান এবং পরিস্থিতিটাকে দেখে নিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তার অবস্থানটি পরিস্কারভাবে তুলে ধরার সময় এসেছে।
: আমি মনে করি ছেলেটি দায়ী নয়।
একটা অস্বোস্তির মেঘ প্রথমে জমা হয়, তারপর প্রচণ্ড বিস্ফোরনে মাথা কাপিয়ে দেয়। এক মূহূর্ত। আইজেনস্টাইনের উত্তরটিই প্রশ্ন হিসেবে ছুড়ে দেয় একজন।
: আপনি মনে করছেন ছেলেটা দায়ী নয়?
আইজেনস্টাইন তার মতে তেমনি অবিচল থাকেন।
: না।
প্রশ্নকর্তাদের একজন পরিবেশটাকে একটু সহনীয় করার চেষ্টা করেন।
: ছেলেটি যে মেয়েটিকে হত্যার চিন্তা করলো, এর জন্য তো সে দায়ী। আপনি এটাতো স্বীকার করবেন?
: না।
: না!
: না।
আইজেনস্টাইনের সরল উত্তর। প্যারামাউন্ট পিকচার্সের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তারা এবার একটু নড়েচড়ে বসেন। তাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বয়স্ক তিনি শীতল গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দেন।
: তাহলে এ ঘটনাটির জন্য কে দায়ী বলে আপনি মনে করেন?
: আমি শুধু এটা বলতে চাই, সমাজই তাকে এভাবে তৈরী করেছে। ঐ বিজ্ঞাপন আর তার চারপাশের যে ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছেলেটির মধ্যে এই মানসিকতা তৈরী করেছে। ছেলেটি যদি দোষী হয় তাহলে যে সমাজে ছেলেটি বড় হয়েছে সেই সমাজও সমানভাবে দায়ী। সেই বিজ্ঞাপন দায়ী। সেই কাঁচের দেয়ালে থরে থরে সাজানো দামী জিনিষগুলো -যেগুলো ছেলেটির চোখের সামনে হাতছানি দিত সেগুলোও এই ঘটনাটির জন্য দায়ী।
: আপনাকে যদি আমরা বলি, আপনি চিত্রনাট্যটা বদলান। আপনি দেখান, মেয়েটাকে ছেলেটিই হত্যা করেছে। এভাবেই সিনেমাটা আপনি বানাবেন।
: আমার পক্ষে অসম্ভব।
আইজেনস্টাইন দৃঢ়ভাবে বললেন।
: এটাই আপনার শেষ সিদ্ধান্ত?
: হ্যা।
: আপনি কোনভাবেই আপনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন না?
: না।
: এটাই আপনার সিদ্ধান্ত।
: সেক্ষেত্রে সিনেমাটির কী হবে?
প্যারামাউন্ট পিকচার্সের আরেকজন কর্তাব্যক্তি প্রশ্নটা ছুড়ে দেন।
: আমার পক্ষে এটা তৈরী করা সম্ভব হবে না।
: এটিই আপনার শেষ কথা?
: হ্যা এটিই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।
: এটিই আপনার সিদ্ধান্ত?
আইজেনস্টাইন একটু ক্লান্ত বোধ করলেন।
: হ্যা।
: দেখুন আমাদের ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও, আমাদের চাপ সত্বেও আপনার এই সিদ্ধান্তটি কিন্তু আপনিই নিলেন। আপনি বলতে - ব্যক্তি আইজেনস্টাইন। আমরা আমেরিকানরা মনে করি, আপনার মতই প্রতিটি মানুষ শেষ পর্যন্ত তার সিদ্ধান্তটা সেই নেয়। যতই পারিপার্শ্বিকতা প্রভাব ফেলুক না কেন, সিদ্ধান্তটি ব্যক্তিরই। যেই মুহূর্তে কোন ব্যক্তি সম্ভাব্য অনেকগুলো বিকল্পের মধ্যে একটি সিদ্ধান্ত বাছাই করছে তখন সেই সিদ্ধান্তটি শুধু তারই। আর যেহেতু সিদ্ধান্তটি কোন ব্যক্তি নিজেই নিচ্ছে তাহলে সেই সিদ্ধান্তের পূর্ণ দায়দায়িত্বটাও তারই হয়। আমরা মনে করি, তার চিন্তা এবং প্রতিটি কাজের জন্য সেই এককভাবে দায়ী। এই কারণে আমরা মনে করি, আমাদের সামাজিক আদর্শ অনুসারে ছেলেটিই মেয়েটির মৃত্যুর জন্য দায়ী। সে হত্যার অপরাধে অপরাধী।
আইজেনস্টাইন বুঝে গিয়েছেন হলিউডে তার ছবি নির্মানের ভাবনার মৃত্যু ঘটেছে। তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতা এবং স্বাধীনতার অবাধ বিশ্বাসে গঠিত সামাজিক দর্শনের বিপরীত বিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি আলোচনার সমাপ্তি টানেন।
: হা সিদ্ধান্তটি আমি নিলেও - আমি শুধু আমি নই। এই আমির সাথে জড়িয়ে আছে আমার সমাজ, আমার বিশ্বাস যেটি আমার পারিপার্শ্বিকতার সাথে আমার সংযোগের ফলে গড়ে উঠেছে। এই কারণে আমি মনে করি একজন্য ব্যক্তি কখনই শুধু ব্যক্তি হিসেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। ব্যক্তিগতভাবে সে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলেও তার চিন্তার এবং কাজের মধ্যে তার সামাজিক বিশ্বাস এবং বোধ সেই ব্যক্তিকে তৈরী করে। এই একই কারণে একজন মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার দায় দায়িত্বও তার একার নয়। এই কারণে সে ব্যক্তি হিসেবে সম্পূর্ণ দায়ী নয়, সমাজও সমানভাবে দায়ী থাকে।
দুটো দর্শন।
দুটো দৃষ্টিভঙ্গি।
দুটো সামাজিক কাঠামো।
মিললো না। আইজেনস্টাইনের সাথে প্যারামাউন্ট পিকচার্স তার চুক্তি বাতিল করলে আইজেনস্টাইন আমেরিকা ছেড়ে চলে গেলেন।
সিনেমাটা হলো না।
কিন্তু এই না হওয়া সিনেমাটা সমাজ এবং ব্যক্তি স্বাধীনতানির্ভর দুটো দর্শনের বৈপরিত্যের দ্বন্দ্বের একটা বড় চিহ্ন হয়ে ঝুলে থাকলো।
এই চিহ্নটা মাথার মধ্যে কাটা হয়ে শুধু খুচিয়ে যায়।
একজন মানুষ তার নিজের জন্য কতটুকু দায়ী?
একজন মানুষের জন্য সমাজ কতটুকু দায়ী?
শিমুল আর সেতু দুজনের কথা মনের মধ্য থেকে মাথা তোলে। এতদিন ওরা ওখানে ডুব মেরে ছিল। নদীর মধ্যে মাছের মত। এখন হটাৎ সময় বুঝে উঠে এসেছে।
শিমুল - ও যা করেছে তা ওকে ১০১ বার ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য যথেষ্ট। আর সেতু - সফল ভাল মানুষের একটা উদাহরন।
সেতু আমার কৈশোরের বন্ধু ছিল আর শিমুল - এক চিংড়ির ঘেরে ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।
সুন্দরবন সংলগ্ন এ অঞ্চলটা সমুদ্রের কাছেই, তাই লোনা পানির প্রাচুর্য্যে চিঙড়ি বাড়ে তরতর করে। তারই লোভে ফসলের জমিতে নোনা পানি ঢুকিয়ে এখন ঘের আর ঘেরের পর ঘের । ঘেরের আগে যখন চাষ হতো - এক টুকরো জমিতে একটা পরিবারই বাঁচতো - তা নয়। ফসল মানেই সারাবছর জুড়ে কাজ আর কাজ। মজুরেরা সারা বছর খাটছে - তাদের পরিবারগুলোও বাঁচছে। কিন্তু ঘের মানেই নিদিষ্ট কয়েকটা মাসের ব্যাপার। আর এত লোকও লাগে না। আর ফসলের জমিতে লোনা পড়ে আগে যে শাক সবজি হতো, পুকুরে মাছ হতো - অভাবের সময়ে তার দু’একটা ধরে নিয়ে খাওয়াটা জুটতো - এখন তাও বন্ধ। পুরো অঞ্চল জুড়ে বাড়িতে বাড়িতে অভাব আর অভাব। অভাব আর ফুরোয় না। শুধু রপ্তানির চিঙড়ির প্রচুর টাকা এখন ধনী ঘেরমালিকের হাতে হাতে ফুলঝুরি ছড়াবে। টাকার সাথে সাথে গুলোগুলি, খুনোখুনি, দখল।
এই অঞ্চলের ডাকাতির গল্প কিংবদন্তির মতো। তা সে বনের ডাকাতিই হোক কিংবা ঘের ডাকাতি। বনের ডাকাতের ব্যাপারটাই অন্যরকম। সুন্দরবনের মাছধরা আর গোলপাতা সংগ্রহের মৌসুমে বোঝাই নৌকার কাছ থেকে নৌকাপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা ধার্য্য করা আছে, তাই দিয়েই সবাই খালাস। এর বিনিময়ে তারা অন্য ডাকাত কিংবা দুস্কৃতিকারীর হাত থেকে নৌকার মানুষ এবং পণ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে। রাষ্ট্র যখন মানুষের নিরাপত্তার আর বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে পারে না তখন এভাবেই মানুষ বিকল্প ব্যবস্থা তৈরী করে। এই ব্যবস্থাগুলো রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্য দিয়ে কার্যকর হলে সেটা হয় বিপ্লব আর ব্যক্তির নামে হলে সেটা দস্যূতা। এখানেও হিসেবটাও একই। কিন্তু ঘেরের ব্যাপারটা আলাদা।
করের মত একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সবসময় ঘেরটা বাঁচানো যায় না। চিংড়িগুলো একটু বড় হলে ডাকাতের দল এসে বন্দুকের মুখে ঘেরের মালিক, শ্রমিক সবাইকে বেঁধে ধরে, হারিকেনের আলোয় সারারাত মাছ ধরা মচ্ছব চালাবে। ভোরের আলো ফোটার আগেই ওরা চিঙড়ি বোঝাই গাড়ি নিয়ে চলে যাবে। ঘের মালিক আর অন্যরা ছাড়া পাবে - কিন্তু ততক্ষণে চিঙড়িতে কিলবিল করা ঘেরের পানি শান্ত, নিথর চোখের মত। তাই ঘের রক্ষা করতেও ঘের মালিকরা পয়সা দিয়ে অস্ত্রবাজ ভাড়া করে। চিঙড়িগুলো যখন হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে, বাজারে বেশ একটা চেকনাই দামের সম্ভাবনা মিলবে মিলবে করছে, তখনই ওরা আসে। এইসব ভাড়াটে অস্ত্রধারীদের কোন পক্ষ নেই। কখনও ওরা নিজেরাই কোন ডাকাতিতে অংশ নেয় আবার কখনও মালিকের হয়ে ডাকাতরা যেন চিঙড়িগুলো হাপিস না করে দিতে পারে - এ জন্য বন্দুক হাতে রাত জাগে। ওরা কন্ট্রাক্টটাই মানে, পক্ষটা টাকার ভিত্তিতে হয়। এইসব পেশাদার ভাড়াটে অস্ত্রবাজ, শিমুল তাদেরই একজন। কালো, উচু্ ঁদাঁত, তোবড়ানো মুখের উপর দুটো কুতকুতে চোখ বসানো। সেখানে একটা নিষ্ঠুরতা খেলা করে।
সে সেবার এসেছিল একটা ঘের পাহাড়া দিতে। আর আমি দুবলার চরে মাছের শুটকী করা দেখবো বলে ঘুরতে ঘুরতে এক ঘের মালিকের আস্তানায় আটকে গেছি। ওর সাথে ওখানেই পরিচয়। বন্দুকটাকে কোলের উপর ফেলে রোদ পোহাচ্ছিল তখন। পাশে দুইটা বানরের বাচ্চা। বিরাট বিরাট দুইটা ফল কোলে নিয়ে গম্ভীরমুখে এদিক ওদিক দেখছে। ঘের মালিকটা পাশের সুন্দরবন থেকে পালার জন্য ধরে নিয়ে এসেছে - শিমুল বলে। এখন শিমুলের সময় কাটানোর সঙ্গী ।
দলে একা নাকি? - আমি আলাপ জমাই। না, আরও আছে- মৃদু হাসে সে।
- বেশ জীবন - না?
- খারাপ লাগে না। থ্রিল।
ওয়েষ্টার্ণ সিনেমার মত মনে হয়। আমরা একটা র্যাঞ্চ হাউজের সামনে কসে আছি। আকাশে পূর্ণিমা। কিন্তু মেঘে ঢাকা পড়ে আছে সবকিছু। রাতের অন্ধকারে অসংখ্য শব্দ। অনেক রকমের, অনেক মাত্রার। এখন বর্ষার মৌসুম। বনের সব পশুপাখির প্রজননের কাল। সবাই বেরিয়েছে অভিসারে। তাদের প্রেম কুঞ্জনে বাতাসে বিচিত্র সঙ্গীতের মূর্ছণা। কত শব্দ, কত রকমের শব্দ । একটা অজানা পৃথিবী। এই শব্দময় পৃথিবীর মধ্যে বসে বসে শিমুলের গল্প শুনি।
এঞ্জিনিয়র বাবা আর অধ্যাপিকা মায়ের আদরের ছোট ছেলের গল্প এটা। বড় ভাই, বাবার মত এঞ্জিনিয়র হওয়ার অপেক্ষায়। একমাত্র বোন ডাক্তারী পড়ছে। সুখের স্বচ্ছল সংসার। শিমুলও এরকম একটা কিছু হবে, এমনটাই কথা ছিল। মেট্রিকের আগে- বয়সের স্বাভাবিক নিয়মে একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে। এ বয়সে যেমনটা হয় - মেয়েটাকে ছোট্ট একটা এক লাইনের চিরকুট লেখে শিমুল।
আমি তোমায় ভালবাসি -
মেয়েটার সেই চিরকুট পেয়ে সে কি হাসি। স্কুলে সবার মধ্যে এই চিঠির শব্দ উড়িয়ে ব্যাঙ্গমাখা কটুক্তি বিলোতে থাকে।
এই চেহারা নিয়ে প্রেম করতে চাও। আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছে কখনও! এই কুৎসিত চেহারা নিয়ে প্রেমের কথা মনে হয় কী করে!
শিমুল আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কানে বেজে ওঠে মেয়েটার কথা। আয়নার চকচকে পারদমাখা নিটোল দেয়ালে একটা কদাকার মুখ শিমুলকে ভেঙচি কাটে।
প্রেম তো পাখি। এক পাখি উড়ে যাবে, উড়ে এসে সেই ডালে এসে বসবে অন্য কোন পাখি- বাসা না বাঁধা পর্যন্ত এইতো খেলা। কিন্তু মেয়েটা যেন সেই ডালটাই ছেটে দিল। পড়ায় মন বসে না। কানে শব্দগুলো নাচে। কি চেহারা .. আহা।
চেহারাই কী সব? সব তো না। কিন্তু এই চেহারার কথাটাই তার মাথায় ঘুরে ঘুরে আসে। পরীক্ষার সময় গড়িয়ে গড়িয়ে আসে। পড়া শেষ হয় না। পরীক্ষার খাতায় আঁকিবুকি কিছু এলোমেলো অক্ষর। পরীক্ষা শেষ হলে কিছুদিন এদিক ওদিক উড়ে বেড়ায় । তারপর রেজাল্ট বের হলে একটা গুমোট মেঘ ঝড় হয়ে আসে। উচ্চশিক্ষিত পরিবারে পরীক্ষায় অকৃতর্যতার পরিণামের যন্ত্রনা কী তাতো সবার জানাই। মাথার মধ্যে মেয়েটার হাসি, আয়নার সামনে সেই কদাকার চেহারার সাথে আরো ধ্বনি প্রতিধ্বিনি যোগ দেয়। পরিবারের গঞ্জণা আর কুটুক্তি ফুটতে থাকে। প্রতিটি মুহূর্ত কেমন তিক্ততায় ভরে যায়। বন্ধুরা সরে যায়। বন্ধু পাল্টে যায়। রঙ বদলে যায়।
নেশার জগতটা জানি কেমন। পরপর দুইবার মেট্রিক ফেল করার পর আর পালানোর জন্য কোন জায়গা অবশিষ্ট থাকে না। সবকিছু লুটপাট হয়ে যায়।
শিমুলের মধ্যে প্রতিশোধ নড়ে চড়ে বসে। চিন্তার মধ্যে সেই এক রিনরিন শব্দ। এই যে রূপের দেমাকে মেয়েটা তার জীবনকে এলামেলো করে দিল- সেই রূপের দেমাকটাকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। মাথার মধ্যে আর কিছু কাজ করে না। এসিডে ঝলসে যাওয়া মুখ ভাবে একবার, ছুরি দিয়ে মুখটাতে কি আঁকিবুকি বসিয়ে দেবে- ভাবে কয়েকবার কিন্তু কিছুই করা হয় না। কিন্তু প্রতিশোধটা আসে অনেকটা হুট করেই, না ভাবিয়ে।
সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল। একটা নির্জন পরিত্যাক্ত বাড়িতে শিমুল দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। কড়কড় বাজের শব্দে চারদিক কেঁপে কেঁপে উঠছে। শিমুলের বিরক্ত লাগে। পকেটে একটা নেশার বোতল। গলায় ঢেলে দিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করে। বৃষ্টিটা ধরে এসেছ্ েএইবার। খুব হালকা ঝিরি ঝিরি কয়েক ফোঁটা এখনও পড়ছে। বেরিয়ে পড়া যায়। পা বাড়াবে এমন সময় আবার বৃষ্টিটা ঝাপিয়ে আসে। বৃষ্টি কমেছে মনে করে কেউ একজন বেরিয়েছিল, বৃষ্টিটা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জোরে নামতেই- দৌঁড়ে সে আবার ছাদের তলে চলে আসে। শিমুল সেদিকে তাকিয়েই জমে যায়। সেই মেয়েটা।
শিমুলের সেই প্রথম, সেই শুরু। শিমুল এখনও সেই সময়টুকুর প্রতিটা মুহূর্ত দেখতে পায়, শুনতে পায়, স্পর্শ করতে পারে। মেয়েটা ওক কিল মারছিল, আঁচড়ে দিচ্ছিল , গাল দিয়ে উঠছিল, আর কখনও কান্নার কাতর ধ্বনিতে ভেঙে পড়ছিল। কখনও অনুনয়, কখনও অভিসম্পাত। কিন্তু সে কোনদিকে তাকায় নি। আসলে সে মেয়েটার সর্বনাশ চেয়েছিল। আসলে তাও না। প্রতিশোধের মধ্যে একটু আশ্রয় খুঁজে পেতে চেয়েছিল ।
মেয়েটা ওর কাছে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। সে তার অশ্র“সজল সেই কথাগুলো আজো ভুলতে পারে না। কথাগুলো আজো ওকে তাতিয়ে আরও হিং¯্র করে তোলে।
: আমার জীবনটা যখন নষ্ট করেছো তাহলে আমাকে বিয়ে কর।
শিমুল কেরুর গোলাপফুল মার্কা বোতল থেকে ঢক ঢক করে খানিকটা মদ গেলে । কথা একটা ঢেকুর দিয়ে সে বুকের মধ্যে জঁমাট বাস্পটার সাথে একটা গালিও বের করে।
: শালী - ঠিক দুইদিন পর ... বুঝছেন...
শিমুলের কথাগুলো জড়িয়ে যায়। ছোট্ট একটা কথা বলতে তার এখন অনেক সময় লাগবে। এক কথা কয়েকবার বলবে। আমারও তাড়া নেই। আমি অপেক্ষা করি। অনেকক্ষণ পর শিমুল মাথা তোলে। অথবা আমারই সময়টাকে অনেক দীর্ঘ মনে হয়।।
: বলে, বলে কী জানেন? আমাকে বিয়ে কর। আচ্ছা মানুষ যে বলে - জীবনে পড়ালেখা করো, মানুষের মত মানুষ হও, এই যে এত বড় বড় কথা- এগুলোর কী কোন মূল্য আছে? পড়াশোনা ছাড়া আরতো কিছুই ছিল না আমার মধ্যে। আপনারা যাকে সৎ বলেন তার সবকিছুই তো ছিল আমার মধ্যে। তখন মেয়েটা আমাকে সবার সামনে অপমান করে হাসি তামাসার পাত্র করে তুললো। আর আমি ওর সাথে যা করেছি- যার জন্য আমাকে ওর ঘৃণা করার কথা ছিল, আমার ফাঁসি দাবী করার কথা ছিল- সেই কাজটার কারণে সে সেদিন আমার কাছে এসে লুটিয়ে পড়লো। বলে - আমাকে বিয়ে কর। হু ... এরপর এরপর...
ও চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। এটা শুধু এখনই নয়। আগেও দেখেছি সুযোগ পেলেই খোলা আকাশের নিচে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী সব ভাবে। জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলে নি। খালি হেসেছে। এখন ওর চেয়ে থাকার খানিকটা বুঝতে পারি। ও ওর ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবছে। যে জীবন ওর হতে পারতো - সেই সব উজ্জ্বল জীবনের কথা ভাবছে। আজকে সে আকাশের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। একসময় জড়ানো গলায় বলে ওঠে
: মেয়েরা আসলে শক্তি, জোর আর ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পন করে।
শক্তি, জোর আর ক্ষমতাকে উৎসর্গ করে শিমুল আরেকটা নতুন বাংলা মদের বোতল খোলে ।
বোতল থেকে ঢক ঢক শব্দ তুলে সে গলায় মদ ঢালে। জিব দিয়ে চেটে ঠোটে লেগে থাকা মদটুকুর শেস কণাপর্যন্ত টেনে নেয়। তারপর সাদা দাতের হাসি ছড়িয়ে একটা দুষ্টু হাসিতে খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠে।
: সত্যি তাই। আমি এর পরেও অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছি। এটা একটা অভ্যাসের মতন হয়ে গেছে বলতে পারেন। আমাকে আপনি ঘৃণা করতে পারেন - কিন্তু, একটা কথা। মেয়েরা কিন্তু এই শক্তির ব্যাপারটা খুব এনজয় করে। এটা আমি দেখেছি। এটা সত্যি। মেয়েরা - দুনিয়ায় খালি বাস্টার্ড জন্ম দেয়।
শিমুল আর এক ঢোকে অনেকখানি মদ গেলে। সহ্য করতে পারে না বোধ হয়, কাশির দমকে শরীরটা কুঁকড়ে আসে। কাশতে কাশতেই প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় -
: এইযে সব ভালো ভালো কথা, যেগুলো বইতে লেখা থাকে আর বাবা মারা বলে- এইগুলো আসলে কী পৃথিবীতে থাকে?
ওর জন্য কষ্ট হয়। ও যে এই জীবনের ভেতরে আরেকটা জীবন লুকিয়ে বেঁচে আছে - ওর এই কথাতে ঝরে পড়ে। আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। হতাশার একটা পর্দা ওর চোখে কাপছে। আমি শিমুলের জীবনটা দেখতে পাই। সেই দশম শ্রেণীর একটা ছেলে - প্রেমে পড়ে জীবনটা অন্য দিকেও যেতে পারতো। সেতুর মতন।
মেয়েরা পেপার ওয়েটের নীল কাঁচের ভেতরে জমে থাকা বাতাসের মতো-
চারিদিকে কাঠিন্যের এক শীতল আবরনের মধ্যে জমে থাকা
একরাশ অনুকম্পা।
স্কুলে থাকতে সেতু এই কবিতাটা লিখেছিল কেমেষ্ট্রির প্র্যাকটিক্যাল খাতায়। আমাদের সবেধন এক নীলমনি কবি সেতু। ‘বড়আপুদের নিটোল সব প্রতিমূর্তিদের মধ্যে নাকি বাস করে অলৌকিক সন্ধ্যা’- এমন সব কথা বলে মনের মধ্যে সন্ধ্যা নামিয়ে দিত। পড়ার বই এর অক্ষরে হাতছানি দিত বিকেলবেলার ছাদে দেখা অপ্সরাদের নীল হলুদ রঙ।
পড়ায় মন কিছুতেই বসে না। রাতের অন্ধকারে জ্বলে জ্বলে ওঠে কামনার উত্তাপ। কিন্তু এই উত্তাপ মাখনের মতো নরম। এই উত্তাপে আমরা পুড়ে যাই না, এই উত্তাপে আমরা ভিজে যাই। সেতুর কাছ থেকে এইসব কথা বলতে আমরাও শিখে গেছি।
এই সেতু এক দিন এক আশ্চর্য্য কবিতা শোনালো। পাড়ার মিষ্টি মেয়ে সুমীটার সাথে ওর প্রেম হয়েছে। আমরা হা হা করে উঠি।
এক ঝকমকে দুপুরে সে সুমীকে কাছে ডাকলে সুমী বলে - না ।
একলা ঘরে সেতু ভাবে - কিসে না করছে সুমী?
‘তোমাকে আমার ভয় করছে।’ সুমীর চোখগুলো অন্যরকম লাগে। কুয়াশামাখা হাতছানির মত।
দশম শ্রেণী যেন তাতানো আগুন। নিঃশ্বাসে কেমন হলকা ছোটে। আর ঠোটে সবসময় জ্বলতে থাকে প্রথম চুমুর আবেশ । প্রথম চুমু খাবার পর সেতু পুরো দশদিন মুখ ধোয় নি। সুমীর সেই চুমুর আবেশ মেখে সেতু জীবনে খুব সিরিয়াস হয়ে ওঠে। ভাল রেজাল্ট, অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার আদর্শ জীবন। নিপাট রুটিনের অবসরে সুমীকে খুশি করতে মাঝে মধ্যে এখনও কবিতা লেখে। একদিন ও বলছিল - কবিতা আর আসে না জানিস। তারপরও ডিকশোনারি ঘেটে শব্দের মিল খুঁজে খুঁজে কবিতা বানাই। সুমী ওতেই খুশি। আমি শুনে হাসি। সেতুর সুমীকে নিয়ে সেই উচ্ছ্বাস এখনও আগের মতোই আছে। শিমুলের সেই মেয়েটার প্রতি ঘৃণা যেমন- এখনও আগের মতই আছে।
শিমুলকে নষ্ট ছেলে মনে হয় না। সেতুকেও খুব ভাল একটা ছেলে মনে হয় না। শিমুলের জীবন সেতুরও হতে পারতো। সেতুর জীবন শিমুলেরও।
আসলে কী হতে পারতো?
মানুষের যদি নিজস্ব কিছু না থাকে তাহলে আমরা একজনকে ভালবাসি আর একজনকে ঘৃণা করি কেন?
আবার সেই যদি সব হয় তাহলে এই শিমুলের মেয়েটা কে বা সেতুর সুমীটা কে?
শিমুল না, সেতু না, আজফার ভাই না- আমার নিজেরই কথা মনে হয়। আমার জীবনটা কত রকম হতে পারতো। ঝুমি সত্যিই বলেছিল।
আমরা সবাই - ‘আমাকে’ই সবচেয়ে ভালবাসি।
আবার ঝুমির কথা। মেয়েটা খালি কষ্ট দেয়। একই শূন্যতা বারবার ঢেকে ফেলে। আমাকে। বারবার। বারবার। কিচ্ছু ভাল লাগে না। সব রাগ গিয়ে ওর ওপরে পড়ে। শিমূলের মত।


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

শুরুর ঘটনার যে কি চমৎকার লাগল ! তবে স্ট্যলিন নিয়ে অনেক ব্যাপারই আমাদের কাছে এখনো গোপনীয়, এই নিয়ে পরে কোন লেখাতে জানাব। ভালো থাকুন-

tuhin91 এর ছবি

লেখাটি বেশ ভালো লেগেছে।

কল্যাণF এর ছবি

দাদা আপনি কি শিমুলের কার্যকলাপ সমর্থন করলেন?

guest_writer এর ছবি

একটি না হওয়া সিনেমার আলোচনায় আপনি যেভাবে দুটি মতবাদের অন্তর্নিহিত ভাবটি ফুটিয়ে তুলেছেন সেটি খুবই ভাল লেগেছে। কে দায়ী ? ব্যক্তি, সমাজ, নাকি রাজনীতি... ভাববার বিষয় অবশ্যই।

বিষয় নির্বাচনটি চমৎকার।

প্রৌঢ়ভাবনা

কর্ণজয় এর ছবি

সামাজিক প্রাণী হিসেবে ...
সামাজিক রীতি, প্রথা, কানুন, নীতিবোধের পরিপ্রেক্ষিত থেকে ... না...
কিন্তু সমাজকেই যদি আমরা দেখতে চাই...
কিংবা একজন মানুষকে... তার মন এবং আচরনের মনস্তত্ত্ব..
তখন প্রচলিত নীতিবোধ থেকে, সামাজিক মূল্যবোধ থেকে বিচার করার বদলে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত এবং প্রাণীজ বৈশিষ্ট্যের আলোকে দেখলে অন্য একটি বাস্তবতাকে দেখা যায়...
আমি এই অন্য বাস্তবতার গল্পটা বলেছি মাত্র...
আইজেনস্টাইনের কাছে ছেলেটি যেই দৃষ্টিকোন থেকে খুনী নয়...
শিমুলকে অনেকটা সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে... সেও পুরো দোষী নয়।
বা কেউই তার কাজের জন্য পুরোটা দায়ী নয়...
সেটা ভাল কিংবা মন্দ, দুই ক্ষেত্রেই...
এটি একটি দৃষ্টিকোনমাত্র...
আমরা অসংখ্য দৃষ্টিকোন মিলিয়েই জীবনে এগিয়ে যাই...
সত্যের অনেক পিঠের মত...
কখনো এই পিঠ আবার কখনো অন্য পিঠ...
এভাবেই মূহূর্তগুলো পাড়ি দেই আমরা, আমার মনে হয় কল্যাণদা...

কল্যাণF এর ছবি

ধন্যবাদ কর্ণদা', বুঝতে পেরেছি।

তানিম এহসান এর ছবি

কেন জানিনা,আপনার গুনমুগ্ধ পাঠক হিসেবে এই লেখাটায় কিসের যেন একটা ঘাটতি পাচ্ছি। স্ট্যালিনকে আর পুরোপুরি ভালো পাইনা এখন। শিমুল এর কথা জানলাম, এইসব শিমুলের মত মানুষের জীবন এতো কাছ থেকে দেখেছি যে আরো বেশি কিছু আশা করেছিলাম মনে হয়। লেখায় পূর্ণ সহযাত্রী কিন্তু কোথাও যেন একটা অতৃপ্তি থেকো গেলো ভাই। সেটা হয়তো পাঠক হিসেবে আমার ব্যার্থতা!

পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। শুভেচ্ছা,

কর্ণজয় এর ছবি

একটা সমস্যা স্বীকার করে নিচ্ছি..
সেটি ভাষা...
বাক্যে ধ্বনি এবং চিত্রকল্প যোজন করার যে খেলাটা খেলার চেষ্টা করি ..এখানে নেই...
আমি আরও ভাবছি...
দেখা যাক, অন্য সমস্যাগুলো ধরা যায় নাকি...
এই সিরিজের লেখাগুলোর একটা সীমাবদ্ধতা হচ্ছে চরিত্রগুলো আসলে একজনের মনোলগ হয়ে আসছে...
যা আসলে চরিত্রগুলোর গল্প না... শেষ পর্যন্ত একজন মানুষের পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষের বিচ্ছুরিত আলো...
সেই আলোতে চরিত্রগুলো আলোকিত হয় না...
একজন মানুষের পৃথিবীই তুলে ধরে....
আমার কাছে সিরিজটার প্রাথমিক বিন্যাসটা এরকম ছিল...
আমরা একটা ডিমের মধ্যে আটকে আছি...
ডিমটা নিশ্ছিদ্র নয়। এর খোলশের অনু পরমানুর মধ্যকার ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে কণা কণা আলো প্রবেশ করে। সে ঐ কণা কণা আলোকে নিজের চিন্তন দিয়ে সাজিয়ে সাজিয়ে একটা পৃথিবী তৈরী করে। এই পৃথিবী- না বাইরের, না ভেতরের।
শুধুমাত্র এটা ততটুকুই বলতে পারে- যতটুকু ডিমের খোলসের ভেতরে তার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে শুধু তার অস্তিত্বের চিত্রই একে যায়।...
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শিমুল অথবা শিমুলদের নিয়ে আপনার অনেক অভিজ্ঞতা .. শোনার অপেক্ষা- জন্ম নিল...

তানিম এহসান এর ছবি

উহু, ভাষা নয়, বরং যেভাবে আপনি ভাষায় ভাষায় চিত্র বিন্যাস করেন সেটাই আমাকে ধরে রাখে। ভাষা আপনার অন্যতম শক্তিশালী একটা দিক। সত্যি বলছি!

আমি কিন্তু বলিনি আপনার এই লেখাটায় কোন সমস্যা আছে, প্লিজ সেভাবে নেবেননা, আমি বলতে চেয়েছি যে পাঠক হিসেবে কোথায় যেন একটা ঘাটতি লাগলো। অলস রাত্তিরে যেটাকে ঘাটতি মনে হয় সেটাই হয়তোবা আবার সতেজ সকালে ভিন্নরকম মনে হতে পারে। কাজেই খুব বেশি ভাববেননা, কিন্তু একজন পাঠকের কথায় আপনি যতটা গুরুত্ব দিয়ে ব্যাখ্যাটা করলেন সেটা আমাকে খুবই মুগ্ধ করলো, শেখালো হাসি

শিমুলদের নিয়ে কথা বলা? না ভাই, খুব বেশি কিছু দেখিনি তাই তেমন জানিওনা আমি কিন্তু যতটা জানি সেসব কথা বলতে গেলে নিজের ভেতরে যে ক্ষরণ হবে তা বয়ে নিয়ে বেড়াবার সামর্থ্য আমি এখন রাখিনা। তবে একটা কথা জানি, শিমুলদের জীবন আমরা যতটা পোকায় খাওয়া বইয়ের মত পড়িনা কেন, সেই জীবনের গল্প এইদেশে এখনো ঠিকমতো লেখেনি কেউ, পশ্চিমবঙ্গে এন্তার লেখা হয়েছে। শুধু মনে পড়ে ঝিলের ধারে সারারাত কবিতা আবৃত্তি করা আশাবাদি বন্ধু পরদিন লাশ হয়ে গেলে মাছিরাও উড়ে বসে ঠোটের নাগালে, বাধা দেবার কেউ থাকেনা। আপনি আরো লেখুন, আপনার কাছে অনেক প্রত্যাশা।

ভালো লাগছেনা কিছু এখন।

তাপস শর্মা এর ছবি

চলুক খুবই ভালো লেগেছে। আর এই ধরণের না শোনা কথা গুলি শুনতে ভালোই লাগে। একটা অভিজ্ঞতা হয়। আরও বেশি করে এই ধরণের কথাগুলি লিখুন। শুধু ইউরুপ কিংবা আমেরিকার কেন- আমাদের এশিয়ার জনজীবন তাদের উপর ঘাত-প্রত্যাঘাতের বিষয় গুলিও আশা করছি।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বর্ণনায় হীরের ধারালো দ্যূতি অথচ শব্দচয়নে কোমল গান্ধারের সুর। বেশ কবার পড়েও ক্লান্তি ভর করলো না। মানুষের মনজগতের সুস্থ বিকাশের দায়িত্বটি প্রকারান্তরে সমাজের উপর বর্তায়, লেখাটি পড়ে এই বোধ গাঢ় হলো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।