এ ও সে ও :০০০- পূর্বকথা

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: মঙ্গল, ০৪/১০/২০১১ - ২:০৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বৃষ্টি শেষ হয়ে গেছে সেই কখন । আকাশটা একদম নীল। বৃষ্টিশেষের সোনালী রোদে সেই নীল - অনেক উচুঁতে মনে হয়। জানালার গ্রীলে জমে থাকা বৃষ্টির ফোটাগুলো মুঁক্তোদানার মত জ্বলছে। সেখানে একটু ছোঁয়া লাগাতেই তর্জনীটা কেমন ভিজে যায়। চোখের সামনে ভেজা আঙ্গুলটা নিয়ে এসে ‘এ’ যখন ভাবছে - এই ভেঁজা ভেঁজা জলটা একটু আগেই মেঘ হয়ে আকাশে উড়ছিল...
‘সে’ তখন কংক্রীটের পাথুরে কালো পিচঢালা রাস্তা ধরে ভিড়ের হৃদয় খুঁড়তে খুঁড়তে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটছে। অসময়ের বৃষ্টি তার সময়-অসময়ের হিসেবে দারুণ গোঁলমাল বাঁধিয়ে দিয়েছে। এক্ষুণি হিসাবের খাতায় কিছু যোগ বিয়োগ না করলে কি ভীষণ সর্বনাশ যে ঘটে যাবে... মনে পড়তেই তার দৌঁড়োনোর গতিটা আরেকটু বেড়ে যায়।
‘এ’ আর ‘সে’- এই হলো ওরা দু’জন। একজন থাকে কল্পনার রাজ্যে আর অন্যজন নিপাট বাস্তবতায়। দুজনেই - আমার খুব প্রিয়, খুব কাছের।
‘এ’ -এসে উঁকি দেয় যখন- তখন- কখন যে কোথা থেকে - কল্পনার মেঘে চড়ে নাকি স্মৃতির মাটি ফুঁড়ে, কোন ঠিক নেই । ইতিহাসের মত, প্রজাপতির মত - আমার মধ্যে অস্থির রকমের এক অস্থিরতা তৈরী করে সে। অস্থিরতাটা ভাল লাগে। আমি লাফাতে লাফাতে ওর কাছে ছুটে যাই।
ঠিক সেই সময় নিত্যদিনের হাজারো প্রয়োজনের কথা বকতে বকতে বর্তমান এসে হাজির। আমি ওকে বলি - “ সে’ই যে সেই - চললো আবার। বাদ দাওতো।” আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায় ও। একটা ধমকের ঢেউ সেই চোখের মধ্যে জ্বলজ্বল করে - ‘কী বলতে চাচ্ছো ?’। আমি নিরূপায় হয়ে চুপ করে ওর পাশে বসে থাকি। কিন্তু ওর দৃষ্টি এত দিকে ছুটতে থাকে, বুঝতে পারি আমার মত সেও কোন এক প্রজাপতির ডানায় অস্থির আটকে আছে।
কি করবো বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আমি কিছু ফাঁকা জায়গায় ঘুরে বেড়াই।
এই সময়টায় ভাবনার পথ বেয়ে চিন্তা আসে। কেমন একটা জল জল ব্যাপার আছে তার মধ্যে । ওর সাথে সম্পর্কটা সন্ধ্যার মত। আমরা ঠিক করেছি আমাদের জন্য সামান্য একটু সময় রেখে দেব। একটুকরো আলোর মত। স্বপ্নের মত।
কিন্তু স্বপ্নগুলো যেন বুঁদ্বুদ। মনে হয় - উঁড়ে বেড়াচ্ছে। ধরতে গেলেই মিলিয়ে যাবে। আমার তাও ভালো লাগে। আমি বসে থাকি। ও মিলিয়ে যায়। ওর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চেয়ে দেখি, বাস্তবতা চোখ মটকাচ্ছে।
দুশ্চিন্তার বোঝাটা আমার কাঁধে জুড়ে নিয়ে সে তখন বাইরে যাবে বলে তৈরী হচ্ছে। আমি তাকে বললাম - তুমি এখানে একটু বসোতো।
সে বলে- এখনই ছুটতে হবে। দৌঁড়... দৌঁড়...দৌঁড়...
পৃথিবী আমাদের হয়ে দৌঁড়াচ্ছে, আমাদের না দৌঁড়ালেও চলবে- আমি তাকে একটু বোঝাবার চেষ্টা করি।
কিন্তু আমি যে তাকে কিছু বলছি- সে কানেই নেয় না। কখন যে কোন প্রয়োজনের চৌহদ্দি ধরে ছুটে চলতে হবে, সবসময় শুধু তারই কথা বলতে থাকে সে।
আমি ঠিক করি- বেশ! এবার আমিও তাকে কল্পনা, স্বপ্ন, স্মৃতি, চিন্তার ভেতরে জেগে থাকা কথাগুলো বলবো।
কিন্তু বাস্তবতা এমনই, কিছুতেই কিছু বলতে দেয় না। সে বলে, জীবনে এসবের কোন মূল্য নেই। গল্প, উপন্যাসের অলস পাতায় এগুলো মানায়।
প্রত্যেক জীবনই আসলে একটা গল্প - কিংবা একটা কবিতা। গল্প, কবিতা আলাদা কিছু নয়।
শুনে সে চোখ পাকায়, বুঝতে পারি কর্কশ বাস্তবতা আঠামাখানো কাঠির ডগায় প্রজাপতিটার মতো সে আমাকেও ব্যস্ত সময়ের ফাঁদে ফেলতে চাইছে। কিন্তু আমি আজ ঠিক করেছি - ওর কাছে কিছুতেই হার মানবো না।
আমার রোখ বুঝতে পেরে ওর ভ্রু নেচে ওঠে। বলে- ‘তবে তাই হোক। এখানে তুমি অক্ষর হয়ে চুপচাপ বসে যতক্ষণ খুশি বকো - আমি আসছি।’
সে আমাকে সাদা কাগজে গেঁথে রেখে চলে যায়।
সাদা কাগজে বয়ে যেতে থাকে অক্ষরে অক্ষরে সাজানো শব্দের নদী। নদীর ছোট বড় নানান ঢেউয়ে রঙ বেরঙের স্বপ্ন, স্মৃতি, কল্পনা, জিঘাংসা আর ত্যাগের চিন্তারা ঘুরে বেড়ায়। বিদেহী আত্মার মত। রক্তপ্রবাহের বিস্তৃত প্রান্তর জুড়ে ঘুরে বেড়ানো প্রাগৈতিহাসিক বাইসনের মত। পাপ-পাপ-পূণ্য বোধশূন্য নিষ্পাপ শিশুর মত।
স্বতঃস্ফূর্ত স্পন্দনে সে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
হতাশায় ঘুমিয়ে পড়ছে।
ক্লান্তিতে হারিয়ে যাচ্ছে।
আশাতে জেগে উঠছে।
প্রতিরোধে ভেঙে পড়ছে।
প্রতিশোধে চুপ করে যাচ্ছে।
লোভে জ্বলে উঠছে।
বিভ্রান্তিতে গলে পড়ছে।
ভালবাসায় চিৎকার করে চলছে।
কোন একটা জায়গায় অনন্ত সময়ের জন্য থাকতে মানুষ ঘৃণা করে। এই জন্য বিরহে প্রেম আসে। প্রেমে বিরহ। বিপ্লবে প্রতিবিপ্লব।
কাগজের পাতায় বন্দী থাকতে থাকতে নিজেকে অমল মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের অমল। ডাকঘরের অমল। অসুখে বন্দী হয়ে ঘরের মধ্যে সারাদিন ধরে জানালার ধারে বসে থাকতো- রাজার চিঠি অপেক্ষায়। জানালার বাইরে রঙবেরঙের মানুষ এই বালকের অপেক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতো। কিসের জন্য যে আমার এই অপেক্ষা- সেটাও ঠিক জানি না। তবু, আপনিতো জানেনই- কারও মধ্যে যখন অপেক্ষা তৈরী হয় তখন সেখানে এক টুকরো জানালা তার জন্য জন্ম নেয়। সেই জানালা ধরে আপনি এসেছেন, অমলের সেই দইওয়ালার মত।
এখন যদি আপনি জানালা দিয়ে সাদা পাতার প্রান্তরে উঁকি দেন তাহলে আপনি দেখবেন - অক্ষরে অক্ষরে সাজানো ছোট বড় শব্দের ঢেউ। আপনি যদি এই ঢেউয়ে নিজেকে ছেড়ে দেন তাহলে দেখবেন - ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলতে দুলতে দুলতে হটাৎ একসময়, নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস আপনার বুক চিরে বেরিয়ে যাবে। আপনি অনুভব করতে পারবেন এই নিঃশ্বাস শুধু আপনার নয়, আপনার অতলে কত না এ ও সে ও’র বাস- এই দীর্ঘশ্বাস তাদের কোন একজনের নীরব হাতছানিমাত্র। আপনার মনে পড়বে, একটি মানুষের আত্মা কেবল এক মানুষের নয়। একটাই জীবন একজনের, তবু সেখানে ঝলসে ওঠে অসংখ্য এ ও সে ও’র খণ্ড বিখণ্ড জীবনের দীর্ঘ-হ্রস্ব ছায়ার আঁকিবুকি।
উঁন্মনা হতে চাইবেন, কিন্তু তখনই বুঝতে পারবেন - কর্কশ বাস্তবতা আর অভ্যাসের আলস্য আপনাকেও ব্যস্ত সময়ের ফাঁদে ফেলেছে। দইওয়ালাকে যেমন অমলের জানালা ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল- দৈনন্দিন বর্তমান আপনাকেও তেমনি সাদা কাগজের শূণ্যতা থেকে সরিয়ে হিসেবের রাস্তায় নিয়ে যেতে চাইছে।
তার টানে আপনি হয়ত পা বাড়িয়ে দিয়েছেন, একটা পিছুডাক কেবল বাতাসে ঘূর্ণির মত পাক খেয়ে আপনার চিন্তায় কড়া নেড়ে বলবে,
এই অক্ষরের পৃথিবীতে - আপনি...


মন্তব্য

কল্যাণF এর ছবি

চিন্তিত

তাপস শর্মা এর ছবি
তারেক অণু এর ছবি

তাই নাকি, এই বলে তাকালো সে! চিন্তিত

তানিম এহসান এর ছবি

গত পোস্টে মন্তব্য প্রতিমন্তব্যের পর আমি আপনার সন্নিবেশিত ভাব আরো পষ্টভাবে বুঝি। পরবর্তীলেখার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম, নিত্য শুভেচ্ছা হাসি

কর্ণজয় এর ছবি

ধন্যবাদ তানিম এহসান। মূলত মন্তব্য আর প্রতিমন্তেব্যর ফসল এই পোস্টটি। যদিও এটি লিখেছিলাম,অনেকটা খসড়া আকারে আগেই, পোস্ট করার ভাবনাটা ছিল না। খসড়ার খড়খড়ে মাটিতে ... আপনার মন্তব্য বৃষ্টি হয়ে নেমেছিল বলেই....

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

এই পোষ্টটি যখন পড়লাম তখন ব্যক্তিমানসের দ্বান্দ্বিক চিত্রনের এই পর্বটি ধাপে ধাপে ৮ টি ধাপ এগিয়ে গেছে। আবার শুরু থেকে পর্বগুলো পড়বো। নিশ্চিত খুঁজে পাবো নতুন অভিজ্ঞান কোনো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

কর্ণজয় এর ছবি

আপনার মন্তব্য আমার মধ্যে নিষ্ঠাবান শ্রমিকের অক্লান্ত অনুভব জন্ম দিয়েছে...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।