পা হারানো এক মুক্তিযোদ্ধার কথা (মুক্তিযোদ্ধার বয়ান পর্ব-০২)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৫/১১/২০১১ - ১:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সালেক খোকন

‘কুটিবাড়ী থেকে নৌকায় করে আমরাও মানপুরে নিয়ে আসি আটটি পরিবারকে। বাকিরা বিভিন্নভাবে চলে যায় বিভিন্ন জায়গায়। লুট হয় অস্ত্র। কিছু অস্ত্রসহ নৌকায় ওঠে হাবিলদার নাজিম উদ্দিন, কাঞ্চন, রিয়াজ, হালিমসহ অনেকেই। তাদের আশ্রয় দিই মানপুর স্কুলে। গ্রামবাসী পালা করে তাদের জন্য পাঠাতে থাকে খাবার।
কুটিবাড়ী ছিল পাকিস্তান রাইফেলস এর দিনাজপুর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার্স। আমাদের গ্রাম থেকে এক মাইল দূরে। কুটিবাড়িকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধ শুরু হয় দিনাজপুরে। সেটাও ১৯৭১ এর ২৮ মার্চের কথা। ২৭ মার্চ কুটিবাড়ীর দক্ষিণে পাওয়া যায় লাশ। পাঞ্জাবি সৈন্যরা ফেলে যায় লাশ ছয়টি। খবর পেয়ে গ্রাম থেকে আমিও লাশ দেখতে যাই। চারটি লাশ বাঙালির, দুটি ছিল সাঁওতালের। ২৮ মার্চ সকালে কুটিবাড়ীতে শুরু হয় গোলাগুলি। শ্রীকৃষ্ণপুরে আসতেই দেখি দলে দলে লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে ক্যাম্পের ভেতর ঢুকছে। গ্রামের কয়েকজনের সাথে আমরাও কুটিবাড়ীতে যাই। ক্যাম্পের ভেতর লাশ আর লাশ। আমরা তখন আটটি পরিবারকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি মানপুরে।
কিন্ত নিজ গ্রামে খুব বেশিদিন থাকা হয় না আমাদের। ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ এ দিনাজপুর শহরের তিন দিক থেকে আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর একটি বড় দল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভূষিরবন্দর রামডুবি হয়ে শহরের নিকটবর্তী চেহেলগাজীতে আক্রমণ করে। সেনাবাহিনীর অন্য দলটি রাজবাড়ী হয়ে শহরে ঢুকে এবং তৃতীয় দলটি পার্বতীপুর, ফুলবাড়ী, আমবাড়ী হয়ে দিনাজপুর শহর দখলে নেয়। শহর দখলে নিয়েই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আশপাশের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিতে থাকে।
মানপুর গ্রামটি ছিল দিনাজপুর শহরের একেবারে নিকটবর্তী। তাই ঝুঁকি ছিল বেশি। ঝুঁকি এড়াতে আমরা গ্রাম ছাড়ার পরিকল্পনা নেই। একদিন ভোরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে গরুর গাড়িতে রওনা হই ভারতের দিকে। আশ্রয়ে থাকা হাবিলদাররাও আমাদের সঙ্গী হয়। দিনাজপুরের পশ্চিম পলাশবাড়ীর বোটের হাট ভান্ডারা সীমান্ত হয়ে আমরা নিরাপদে চলে আসি ভারতের ঝগড়াপাড়ায়। সেখানে দেখি অন্য দৃশ্য। পাকিস্তানিদের ভয়ে এরই মধ্যে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে আরও ২০০টির মতো পরিবার।
থাকার কষ্ট, খাবারের কষ্ট তবুও জীবন বাঁচাতে বাঙালিরা দেশছাড়া। এভাবে তো দেশকে ফেলে আসা যায় না। তাই কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিই যুদ্ধে যাওয়ার। দল গড়তে থাকি। আমাদের সিদ্ধান্তে খুশি হয় হাবিলদার নাজিম উদ্দিন ও কাঞ্চন। তারা আমাদের হাতে তুলে দেয় কুটিবাড়ী থেকে আনা রাইফেলগুলো। আয়োজন করেন রাইফেল চালানো ও যুদ্ধ করার আট দিনের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের। প্রশিক্ষণ শেষে তৈরি হয় আমাদের ১৫ জনের একটি দল। দলের লিডার হাবিলদার নাজিম উদ্দিন। দলটি ছিল ৭ নং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণে। হাবিলদার নাজিম নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন ৭ নং সেক্টরের সাথে।
আমরা ছব্দবেশে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ করে সরে পড়তাম। আমাদের পথ চিনিয়ে. খাদ্য দিয়ে সাহায্য করতো গ্রামের সাধারণ মানুষ। ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে দিনাজপুরের ভান্ডারা, বৈরাগীপাড়া,ডুং ডুংগি, রাণীপুকুর এলাকায় আক্রমণ করে আবার ফিরে যেতাম। নিজাম নামের এক আওয়ামীলীগের কর্মী রাতের আধাঁরে এসে পাকিস্তানিদের অবস্থানের নানা তথ্য আমাদের দিয়ে যেতেন।

বোটের হাটের সীমান্ত পথে জেলের ছব্দবেশে আমরা একবার ঢুকে পড়ি বাংলাদেশে। বিলে জাল দিয়ে মাছ মেরে রাণীপুকুরের বাজারে যেতেই পাকিস্তানিদের সামনে পড়ি। বুক দুরু দুরু করছে। এই বুঝি ধরা পড়ি। ঢালিতে নেই মাছ, রাখা আছে রাইফেল। আমরা সৃষ্টিকর্তার নাম যপি। হঠাৎ একজন পাকিস্তানি সৈন্য বলে ওঠে, ‘মাছরি মারতা, ছোড় দো উসকো, গারিব আদমি’। এভাবেই প্রাণে বেঁচে যাই সেযাত্রায়।
একবার সবাই অস্ত্রসহ আশ্রয় নেই রাণীপুকুরের এক বাঁশঝাড়ের ভেতর। অমনি একঝাঁক মৌমাছি আমাদের আক্রমণ করে। মৌমাছির কামড়ে হাবিলদার কাঞ্চনের মৃতপ্রায় অবস্থা। পরে অবশ্য সাতদিনের চিকিৎসায় হাবিলদার কাঞ্চন প্রাণে বেঁচে যান। এভাবেই চলছিল যুদ্ধ।
১১ নভেম্বর ১৯৭১। শনিবার। গোপন খবরের ভিত্তিতে আমাদের পরিকল্পনা হয়, বিরলের মুল্লুক দেওয়ানের কাছে পাকিস্তানি আর্মিদের ওপর আক্রমণ করতে হবে। আমরা দুটি দলে ভাগ হই। ক্যাম্প থেকে রওনা হই ভোর পাঁচটায়। একটি দলের সাঙ্গে সর্তকতার সাথে আমি ভান্ডারার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। আমরা সব সময় চলতাম মূল রাস্তার পাশ দিয়ে। ভান্ডারার পূর্বদিকে একটি রাস্তার পাশে আসতেই আমার পায়ের কাছে বিকট শব্দ হয়। প্রথম ভেবেছি পাকিস্তানিরা হয়তো আমাদের আক্রমণ করেছে। চোখের সামনে ধোঁয়ার কুন্ডলী। তখনো কিছু ঠাওর করতে পারিনি। পরে খেয়াল করলাম, বাঁ পা-টা অবশ হয়ে গেছে। রক্তে ভিজে গেছে গোটা পা। পায়ের কিছু অংশ উড়ে গেছে। আমি স্থির হয়ে যাই। হাবিলদার নাজিম উদ্দিনকে বলি, আমার বাঁ পা-টা নষ্ট হয়ে গেছে। তারা তখন আমাকে কাঁধে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে। প্রথমে ঝগড়াপাড়ায় পরে রায়গঞ্জের এসবি হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। ১৮দিন অচেতন অবস্থায় ছিলাম। যখন জ্ঞান ফেরে, তখন দেখি আমার বাঁ পা কেটে ফেলা হয়েছে। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় খবর পাই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখনো পায়ের দিকে তাকালে ঘটনার সবকিছু জীবন্ত হয়ে ওঠে। পা হারিয়ে কোন আফসোস নেই আমার। তবু আমরা তো মুক্ত স্বাধীন।’
দিনাজপুরের এক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা এভাবেই বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো। তার নাম কৃষ্ণ কিশোর দাস। পিতা গোর কিশোর দাস ছিলেন মানপুর স্কুলের শিক্ষক। বিরল উপজেলার মানপুর গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা। পড়াশুনা করেছেন প্রথমে মানপুর প্রাইমারি স্কুলে পরে দিনাজপুর একাডেমিক স্কুলে। এসএসসি পাসের পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার আর কলেজে পড়া হয়নি। চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই যোগ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বর্তমানে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঠের কাজ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। এক সকালে মানপুরে বসে তাঁর সাথে চলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপচারিতা।
যুদ্ধের পর কী করলেন? এমন প্রশ্নে মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাস জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি হাসপাতাল থেকে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। ভাঙ্গাচোরা দেশ। তবু সবার মুখে হাসি। নতুন করে বাড়িঘর তুলছিল কেউ কেউ। স্বাধীনতার অর্জন ভুলিয়ে দিয়েছে সকল কষ্টগুলো।
তিনি তখন লাঠিতে ভর দিয়ে চলেন। সে সময় তার ডাক আসে ঢাকা থেকে। প্রফেসর ইউসুফ আলী তখন শিক্ষামন্ত্রী। তার মাধ্যমেই কৃষ্ণ কিশোর ও খোরশেদ নামের এক মুক্তিযোদ্ধা দিনাজপুর থেকে চলে আসেন মগবাজারের সুশ্রী হাউজে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদেরও আনা হয়। সেখানে ভারতীয় ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা লোকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাঠের কৃত্রিম পা তৈরি থেকে শুরু করে নানা ধরণের কাজ শেখান। কৃষ্ণ কিশোর সে কাজ শিখে সেখানেই কাজ করেন। সে সময়ে বেতন পেতেন তিন হাজার টাকা। সেই থেকেই কৃষ্ণ কিশোর নিজেই এখন কৃত্রিম পায়ে চলেন। আর কাঠের কাজ শিখায় নিজেই পরিশ্রম করে পরিবার চালাতে পারছেন।
অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যুদ্ধের পরপরই তৈরি করা দরকার ছিল বলে মনে করেন, আপনি কী বলেন? মুক্তিযোদ্ধা কৃষ্ণ কিশোর দাশ বলেন, ‘সেটা হলে ভালো হতো। কিন্ত দেশ তখন ভঙ্গুর। সে সময় তো দেশের মানুষকে বাঁচানোই প্রধান কাজ ছিল। কেউ কি ভেবেছে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে রাজনীতি হবে। একেক সরকার এসে একেক তালিকা বানাবে। সুবিধা তো দূরের কথা, আমরা বেঁচে থাকব কিনা তারই নিশ্চয়তা ছিল না। যুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, সুবিধা লাভের আশায় তো নয়।’
মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভালো লাগা, জানতে চাইলে এই বীর গর্বের সাথে বলেন, ‘ প্রতিবছর যখন ১৬ ডিসেম্বর আসে, যখন স্কুলের ছেলে মেয়েরা দেশের গান গায়, পতাকা ওড়ায় , তখন খুব ভালো লাগে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা যখন আমাকে ঘিরে ধরে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে চায়, তখন মনটা ভরে যায়। এর থেকে সুখের অনুভূতি আর কী হতে পারে।’
দেশের স্বাধীনতার জন্য পা হারিয়েছেন। এখন দেশের কোন জিনিস দেখলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কষ্ট পান? খানিকটা চুপ থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস, অতঃপর উত্তর, ‘যখন দেখি স্বাধীন দেশে নিজেরাই নিজেদের সাথে হানাহানি করছি, যারা স্বাধীনতা চায় নি তাদের গাড়িতে দেশের পতাকা উড়ছে, যখন দেশ নিয়ে হতাশ হয়ে কেউ বলে, দেশটা পাকিস্তান থাকলেই ভালো হতো- তখন খুব কষ্ট পাই।’
যুদ্ধাহত ভাতা আট হাজার টাকা ও কাঠের কাজ করে যা পান, তা দিয়ে ভালো ভাবেই চলছে এ মুক্তিযোদ্ধার জীবন। কৃষ্ণ কিশোর দাশের বয়স সত্তর। কিন্ত মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কোন ঘটনাই এখনো হারিয়ে যায় নি তার স্মৃতি থেকে।
মাঝে মাঝে সন্ধ্যা নামতেই মানপুর গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। আলো আঁধারিতে আবদারের সুরে বলে, ‘দাদু, একটু যুদ্ধের কথা বল’। কৃষ্ণ কিশোর তখন তাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা শোনান। ছেলে মেয়েদের কাছে তা গল্পের মতো লাগে। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো শুনিয়ে প্রতিবারই কৃষ্ণ কিশোর সবাইকে উৎসাহিত করে বলেন, ‘ তোমরাই দেশের ভবিষ্যৎ, দেশ কীভাবে চলবে তোমাদেরই চিন্তা করতে হবে। তোমরা তো খাঁচায় বন্দী কোন পাখি নও, তোমরা স্বাধীন ও মুক্ত দেশের সন্তান। স্বাধীনভাবে দেশটাকে তোমাদেরই গড়তে হবে।’

- সালেক খোকন

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03am

মন্তব্য

নিবিড় এর ছবি

ভাল লাগল আপনার এই প্রচেষ্টা চলুক

কল্যাণF এর ছবি

চলুক চলুক

তারেক অণু এর ছবি

শ্রদ্ধা।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ফেসবুকে আপনাকে একটা বার্তা পাঠিয়েছি...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সালেক খোকন এর ছবি

বার্তার জবাব দিয়েছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।