চোর

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৬/১১/২০১১ - ৭:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লেবু গাছের তলায় চোরটা দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। গভীর আধাঁরে ডুবে থাকা মধ্যরাতে গাছের মতই নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সে। কেউ কেউ হঠাৎ দেখে গাছ ভেবে ভুল করে। চোরের সেটাই কাম্য। এভাবে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকতেও তার আপত্তি নেই। মানুষগুলো গাছ ভেবে নিশ্চিন্ত মনে যখন পাশ কাটিয়ে যায় চোর তখন চুপিসারে চুরি করে নেয় মানুষের অতি গোপনীয় সম্পদ। মানুষগুলো এলোমেলো পা ফেলে চলে যায় দূরে কি যেন নেই কি যেন নেই ভাবতে ভাবতে।

চোরের নাম আবু সুফিয়ান। অনেক কাল আগে সে বাস করত গিরি অঞ্চলের দুর্গম উপত্যাকায়। ভালই ছিল সে। পেশায় সে একজন সমাজসেবক আর্তের সেবায় নিজেকে নিবেদন করেছিল উদার চিত্তে। তবু কেন যে মানুষগুলো তাকে অকারণে চোর সন্দেহ করত কে জানে। আবু সুফিয়ান ঘৃণাভরে পরিবার পরিজন ত্যাগ করে একদিন পালিয়ে গেল লোকালয় থেকে অনেক দূরে নিভার গহীন পর্বত অঞ্চলে। সৃষ্টির আদি থেকে নিভার পর্বত গুহাগুলি রহস্যাবৃত। জনশ্রুতি আছে মহাগুরু কিরি গভীর সাধনায় ধ্যানমগ্ন আছেন সেই অতি প্রাচীনকাল থেকেই। কিরিকে নিয়ে লোকমুখে অনেক আজগুবি গল্প চালু আছে তার মাঝে একটা এরকম- কিরি নাকি মানুষের অন্তর ধুয়ে ফেলতে পারে। রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণার মত ক্ষতিকর অনুভুতি গুলো ধুয়ে ফেলে একটা সুস্থ তরতাজা অন্তর ফিরিয়ে দেয়। সত্যি মিথ্যা কেউ জানে না। বহুকাল থেকেই এই সব গল্প প্রচলিত লোকসমাজে। কিরিকে কদাচিৎ দেখা যায়। তবে যারা দেখেছে বলে জোর দাবি জানায় তাদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলে কিরি কৃষ্ণকায় খর্বাকৃতি অশীতিপর বৃদ্ধ। কেউ বলে সৌম্যদর্শন দরবেশ। সে যাই হোক আমাদের আলোচ্য চোর আবু সুফিয়ান মনের কষ্টে নিভার গুহায় পালিয়ে এলো। গুহাবাসী এক রহস্যময় সন্ন্যাসীর সেবা করে দিন কাটছিল ভালই। কয়েক শত বছর এভাবে কেটে গে্লে পর এক ভোরে সূর্যের প্রথম কিরণে সন্ন্যাসী ধ্যান ভেঙ্গে চোখ মেলে চাইল। কড়া চোখে কিছুক্ষণ দেখল সামনে উপবিষ্ট সেবককে। তাচ্ছিল্যের গলায় তীক্ষ্ম স্বরে বলে
'চোরের আবার সন্ত হবার শখ জেগেছে। অ্যাঁ !!' সুফিয়ান চমকে গুরুর মুখের দিকে তাকায়। সুফিয়ানের মনের খুব গহীনে ঘাপটি মেরে থাকা চোরটা হাসতে লাগল হেঃ হেঃ করে। যে অপবাদের জন্য নিভার গুহায় নির্বাসিত জীবন বেছে নিল। নিষ্ঠার সাথে এত গুলো বছর করে গেল ধ্যানরত সন্ন্যাসীর সেবা। এত সেবা এত ভক্তির পর গুরুও সেই একই অপবাদ দিলেন?! সুফিয়ানের আহত চোখে অব্যক্ত বেদনা দেখে সন্ন্যাসীর মন নরম হলো। 'তবে তোর সেবায় সন্তুষ্ট কিরি।'
কিরি?!!! সুফিয়ান বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে তাকিয়ে রইল গুরুর পানে। আজন্ম যে রহস্যময় কিরির গল্প শুনে এসেছে সে আজ ওর সামনে উপবিষ্ট!! অন্তরে লুকিয়ে থাকা চোরটা লোভে খলবল করতে থাকে । চোরের কুমন্ত্রণায় ব্যথিত সুফিয়ান বড়ই বিচলিত হয়ে পড়ে। কিরি স্মিত হেসে ভক্তের দুরবস্থা অবলোকন করে সুধায়
'কি চাস তুই?'
কি চাই?! কি চাই তার?! কি চাই সুফিয়ানের? সম্পদ?! নাকি ক্ষমতা?! না! না! সুফিয়ান এসবের কিছুই চায় না। সুফিয়ানের কিছু চাইবার না থাকলেও চোরের চাওয়ার ছিল অনেক কিছু। মনের গহীনে চোর ডিগবাজি খেল খুশিতে।
অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে পড়লে সুফিয়ান একরকম ছুটে পালিয়ে এলো গুরুর সামনে থেকে।
'আবু সুফিয়ান এই সুযোগ । দুনিয়ায় তোমার চেয়ে সম্পদশালী আর কেউ থাকবে না। চেয়ে নাও অন্তর্দৃষ্টি। যে দৃষ্টি দিয়ে লুকানো ধন সম্পদ দেখতে পাবে। চেয়ে নাও প্রজ্ঞা যার বলে যে কোন দেশ তোমার পায়ের তলায় থাকবে। আবু সুফিয়ান তুমিই হবে এই পৃথিবীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী!'
চোরের কুমন্ত্রণায় সুফিয়ান লোভী হয়ে পৃথিবী দখলের চিন্তায় সম্পদের নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে এক কোণে। কিরি সবই দেখলেন বুঝলেন কিছুই বললেন না সুফিয়ানকে। সুফিয়ান অন্তরের চোরের অত্যাচারে অস্থির হয়ে এক একবার ভাবে লোভের পথেই হাঁটবে। পরক্ষণেই নিজেকে তিরস্কার করে ওঠে
'এই জন্যই কি এত গুলো বছর সাধনা করে গেলে?! গুরুর পরিচয় জেনে তবে আজ কেন মতিভ্রম ঘটাবে?!'

কেটে গেল আরও কিছু সন্ধ্যা সকাল আর রাত। পড়ন্ত রোদের আলোয় একদিন গুহার বাইরে বসে ছিল ক্লান্ত সুফিয়ান। ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে দেখছিল দিনের শেষ আলো মুছে গিয়ে রাতের দ্রুত বিস্তার। বিষন্ন মনে চেয়ে চেয়ে দেখছিল কেমন করে দিনের আলো গিলে খাচ্ছে রাতের দুর্বৃত্ত সেনারা। কিরি এসে পাশে দাঁড়ালেন। গুরুর উপস্থিতি টের পেয়ে সচকিতে উঠে দাঁড়ায় সুফিয়ান।
'চোর হবি বলেই এই ধরাধামে এসেছিস। ভবিতব্য এড়াবি কি করে?!' গম্ভীর গলায় বললেন কিরি।সুফিয়ানের চোখ বেয়ে কষ্টের নোনাজল গড়ায়। গুরুর সামনে অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে জানতে চায় সুফিয়ান
'গুরু আমি কোনদিন কারো কোন ক্ষতির কারণ হইনি। সর্বদা অন্যের মঙ্গল কামনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। তবু কেন এই চোর অপবাদ?!'
'হাঃ হাঃ হাঃ! অপবাদ?! চুরি করবি বলে চোর পুষছিস মনের মাঝে । আর ভাল মানুষের ভাব ধরে জিজ্ঞেস করিস কেন এই অপবাদ?! অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল সন্ন্যাসী। তীব্র ভর্ৎসনা করে বলে
'চোরের যন্ত্রনায় অস্থির বলেই তো এতগুলো দিনেও ঠিক করতে পারলি না কি চাই তোর। হু হু বাবা! পরিণাম জেনেও নিয়তি এড়ানো কি এত সহজ! নিয়তির কড়া পাহারা সব জায়গায়। কেউ এর বাইরে নয়। তবে তোকে নিয়ে প্রকৃতির অন্যরকম ইচ্ছে হয়ত। নইলে তুই কেন আসবি কিরির গুহায়?! অ্যাঁ?!'
সুফিয়ান যন্ত্রণায় বিদগ্ধ চিত্তে হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করল 'মহাগুরু এর থেকে মুক্তি কি ঘটবে না আমার?!'
কিরি চোখ বুজে কি যেন ভাবলেন এক মুহুর্ত। জলদ্গম্ভীর গলায় বললেন
'আবু সুফিয়ান নিভায় তোর দিন ফুরিয়েছে। আজ রাত্রি থেকে শুরু করে যতদিন না শেষ মানুষটি এই ধরণীতে আসবে ততদিন তুই মানুষের অন্তুরের চোর ধরবি। যত বেশি চোর ধরবি তোর মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা চোরের শক্তি ততই কমতে থাকবে। শেষ চোরটা ধরা পড়ার দিন তোর চোরের মৃত্যু ঘটবে। সেদিনই পাবি মুক্তি। চিরশান্তি। তবে সাবধান!! চোরের লোভনীয় জালে জড়িয়ে পড়িস না যেন! এখন যা বেরিয়ে পড় পৃথিবীর পথে।'

সেই রাত্রিই ছিল নিভায় সুফিয়ানের শেষ রাত। তারও কয়েক হাজার কোটি বছর পেরিয়ে গেছে। মহাগুরু কিরির সাথে আর দেখা হয়নি। চোর ছুটে চলেছে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। এক মুহুর্ত অবসর নেই তার। মানুষগুলোর অন্তর চোরের প্রতাপে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সর্বদা। আবু সুফিয়ান মানুষের মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা চোর ধরে চলেছে বিরামহীন গতিতে।

চোরটা ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিল লেবু গাছের তলায়। আজ এক বিশেষ রাত। আজ সেই রাত যে রাতে আবু সুফিয়ানের মুক্তি ঘটতে চলেছে। সকল যন্ত্রণার অবসান ঘটতে চলেছে। আবু সুফিয়ান মুক্তির প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে আছে অবিচল।

(সমাপ্ত)

শ্রাবণী আহমেদ


মন্তব্য

কল্যাণF এর ছবি

অতি জটিল গল্প চিন্তিত

শ্রাবনী এর ছবি

অতি জটিল না আসলে। একটু মন দিয়ে পড়লেই বুঝতে পারবেন আশা করি। পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

হুম, থিমটা ভালো। তবে লেখাটা আরো ভালো হতে পারত মনে হয়।

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

শ্রাবনী এর ছবি

রিশাদ আপনাকে এখানে পেয়ে খুব ভাল লাগছে। কেমন আছেন? পড়েছেন এজন্য কৃতজ্ঞতা জানবেন। অসংখ্য ধন্যবাদ।

তাপস শর্মা  এর ছবি

ভালো লেগেছে। আপনার লেখাটা একবার অন্তত ভাবায়। ভাবায় কালকে, ভাবায় সময়কে, ভাবায় প্রতিটি ইচ্ছা সায়রের হিংসাকে। আধুনিক মননের পরিহাসের এই গল্পের সুফিয়ানরা নিত্যদিনের উল্লাস হয়ে বারবার আমাদের মধ্যে ফিরে আসে। কিন্তু দ্বিধা তো আমাদেরই ললাট লিখন......

শ্রাবনী এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ তাপস গল্পটি পড়ার জন্য। পাঠে কৃতজ্ঞতা জানবেন। খুব চমৎকার বিশ্লেষন লিখেছেন। আবারও ধন্যবাদ। মনের মাঝে বসে থাকা চোরের প্রলভন এড়ানো কি যায় না? একটু ভাবি একটু সময় দিই নিজেকে। আসলেই কি ঠিক এমনই আমি? এই প্রশ্ন গুলিই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল আর তারই প্রতিফলন এই লেখা। জানি না ঠিকঠাক বলতে পেরেছি কিনা। তবে আবু সুফিয়ানের মত সংস্কারকদের বড় প্রয়োজন এই ক্ষয়ে যাওয়া সময়ে।

তাপস শর্মা  এর ছবি

লিখতে থাকুন এই ভাবেই। ভাবনা গুলো প্রকাশ পাক। কলমের কিংবা কি-বোর্ড এর হাত ধরে ... হাসি

শ্রাবনী এর ছবি

চেষ্টা অব্যহত থাকবে। ধন্যবাদ।

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

গল্পে রহস্যের উপস্থিতি ভালো লাগলো। শুভকামনা অবিরাম।

শ্রাবনী এর ছবি

ধন্যবাদ দেবানন্দ। আপনার জন্যও রইল শুভকামনা। হাসি

নিটোল. এর ছবি

থিম ভালো। আরো ভালো হবার সুযোগ ছিল। আরো লিখুন।

শ্রাবনী এর ছবি

পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আরো ভাল লেখার চেষ্টা অব্যহত থাকবে।
শুভকামনা রইল আপনার জন্য।

তারেক অণু এর ছবি

চলুক . মেটাফোরটা ভাল লেগেছে। আরো লিখুন।

শ্রাবনী এর ছবি

ধন্যবাদ তারেক। পাঠে কৃতজ্ঞতা জানবেন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শ্রাবনী এর ছবি

ধন্যবাদ নজরুল।

মেঘা এর ছবি

আপু গল্পের থিমটা সত্যিই ভাবার মত। আমাদের মনের মধ্যেই আসলে শয়তান বসবাস করে আর আমরা সেই শয়তানের যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে পাপ করি।

সচলে স্বাগতম আপু।

sraboni এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মেঘা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।