উত্তরাধুনিকতার ব্যাবচ্ছেদ -২

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: শুক্র, ১৩/১০/২০০৬ - ৩:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিচ্ছিন্নতার সুতায় গেঁথে মানবজীবন শুধু অনুভবগুলোকে একটা একটা করে তুলে আনা, উপর্যুপরি বিশ্লেষনের পর অবশেষে নিশ্চিত হওয়া আসলে মদ-মাংস এবং চামড়ার আড়ালে যা আছে সবটুকুই নিখাদ অনু-পরমানুর কোলাহল। বিচ্ছিন্নতার মানসিক অভিক্ষেপ পড়ছে, আমাদের প্রতিটা ভ্রমন এভাবেই একেকটা মনের কানাগলিতে গিয়ে থামছে, এই সাংস্কৃতিক বিবর্তনটা এক পর্যায়ে বস্তু এবং চরিত্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একটা ধাঁধাঁ তৈরি ফেলে। সেই স্টেরিওটাইপড আইডিয়াগুলোকে আবার নিরিক্ষা করা, প্রয়োজন আছে কি নেই এসব যাচাই না করে আঙ্গিক এবং ভাষ্যের ক্রমাগত ভাঙচুড়।আমাদের মানসিকতার ভেতরে আড়ালের প্রয়োজন হয়ে গেছে, আমাদের বর্তমান ফ্ল্যাট কালচারের মতো, নাগরিক জীবনের সহাবস্থান এবং আপাতসংলগ্নতা সত্ত্বেও যে বিচ্ছিন্নতা আমরা বহন করে চলি, আমাদের চোখে ঘন সানগ্লাসের আড়ালে আমরা আমাদের অস্তিত্বকে লুকিয়ে রাখি যেভাবে, এই বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোর ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসা। যদিও আধুনিক শিল্পচর্চাও একই বিষয়কে প্রকাশ করার চেষ্টা করছিলো, তবে ওটার আড়াল ছিলো, শিল্পি নিজেই একটা আড়াল খুঁজে নিয়েছিলো, সেই আড়ালটাকে বা দেয়ালটাকে মুছে দিয়ে সংক্ষিপ্ত ভাবে প্রকাশ করে দেওয়া, নগ্নভাবে এই সত্যটাকে উচ্চারন করে ফেলা- আমরা যন্ত্রযুগের সাথে নিজেরাই যন্ত্রবৎ জীবনযাপন করছি। এই প্রথ এবং প্রথ থেকে উত্তরনের কারসাজি, নিজস্ব শব্দসম্ভার গড়ে তোলা, এসব সিগনেচার তৈরির প্রক্রিয়াটাকেও আমাদের সংজ্ঞায় এনে দেখতে হবে আমরা উত্তরাধুনিক যাকে বলছি সেটা আসলে কতটুকু একেবারে নতুন ধারার বিষয়। আধুনিকতাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে না, পোষ্ট মডার্ন বলার অর্থটা এমন যে তা যখন মডার্ন আর্ট ফর্মের চুরান্ত সাফল্য চারপাশে, যখন এটাই নন্দিত এবং বহুল চর্চিত তখন এই প্রচলিত ফর্মের বাইরে গিয়ে আবারও পৌরানিকতার মুখাপেক্ষি হওয়া, সেই পুরোনো অনুভবকে আবার নতুন কোনো আঙ্গিকে সামনে আনা, লিঙ্গভিত্তিক চিরায়ত ধারনাকে প্রশ্ন করা, এবং আবারও স্টেরিওটাইপ ভাবনাকে পেছনে রেখে একটা পুঁজিবাদী সামজে ভোক্তা এবং পন্যের জগতে নারী-পুরুষের ভাবনার ঐক্য, অনুভবের ঐক্যগুলোকে সামনে নিয়ে আসা।এমন একটা প্রক্রিয়া যা মানবিক( এই অর্থে যেখানে লিঙ্গপরিচয় বা যৌনতার দোহাই দিয়ে নয়, বরং একজনের মানসিক অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার জন্যই, একজনকে মানুষ হিসেবে পরিচিত করার জন্যই তাকে নিয়ে শিল্পচর্চা হচ্ছে,) শিল্পির সাথে সমাজের মিথঃস্ক্রিয়া, সমাজ আমাদের যেভাবে প্রভাবিত করে, আমাদের রাজনৈতিক মতবাদ, আমাদের সোশ্যাল ট্যাবু, আমাদের নির্ধারিত চৌহদ্দি, এসবকে নিরন্তর প্রশ্ন করে যাওয়া। এবং আধুনিকতার সাথে সমার্থক বিমুর্ততার জায়গা থেকে বের হয়ে আরও স্পষ্ট করে তোলা এই সম্পর্কগুলোকে এটাই একটা সময়ে পোষ্টমডার্নিজম ছিলো,অন্যান্য পুঁজিবাদি সমাজে যা হয়েছে 60 এবং 70 এর দশকে সেই একই সামাজিক পরিবর্তনগুলো আমরা অনুভব করছি এখনকার সময়ে, এই কর্পোরেট জগতের প্রভাব, এই অর্থনীতির সাফল্যের মাপকাঠিতে ব্যাক্তির প্রতিষ্ঠা নির্ধারন, এবং আমাদের পরিবারপ্রথার শেকড়ে পড়া আঘাত, এসব আমরা আমাদের শিল্পজগতে খুঁজছি এখন, অথচ সামাজিক বিবর্তনের ধারায় এই একই অনুভবগুলো আমরা 2য় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তিকালে যে সামাজিক পুর্নগঠনের ভেতর দিয়ে গেছে ইউরোপ আমেরিকা সেখানে পেয়ে যাচ্ছি, এই সামাজিক পরিবর্তনের আঘাতটা সামলে নিতে তাদের বাস্তবতার ধারনায় পালা বদল ঘটিয়েছে, এবং এত বড় একটা মানবিক বিপর্যয়ের পর, প্রায় 2 কোটি পুরুষ মরে যাওয়ার পর নারীকে তার সামন্তবাদি অবস্থান থেকে সমাজের প্রয়োজনে অর্থনীতির চাকায় জুড়ে দেওয়া হয়েছে, এই একই প্রক্রিয়ার নারীত্বের সংজ্ঞা হয়েছে পুনঃনির্মিত, সামাজিক চাপে নারী মনস্তত্ত্ব গঠিত হওয়ার ফ্রয়েডীয় ধারনাটা ধ্বসে পড়েছে এই পুনঃ গঠনের সময়কালে, তবে এই পরিবর্তনটা অবশ্যই নতুন শিল্পিরাই বেশী ধারন করেছে, তখনকার আধুনিক প্রতিষ্ঠিত শিল্পিরা একটা নির্দিষ্ট ফর্মের চর্চায় নিজেদের দক্ষ করে ফেলায় সেই প্রচলিত ফর্মের ভেতরেই এটাকে আত্তিকরনের চেষ্টা করেছিলো, নতুন শিল্পিরা যারা এই সমাজের ভেতরেই বেড়ে উঠছে তারা এটার প্রভাবটাকে তাদের অনুভব দিয়ে প্রকাশ করেছে। হিপ্পি যুগের সেই সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্ব ীকার করার প্রবনতা এটাও আধুনিকতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নেশার উপকরন সরবরাহ, জনতা ও রাজনৈতক আন্দোলন থেকে জনগনকে বিচ্ছিন্ন করে একটা কর্পোরেট জগত যেখানে অর্থনৈতিক শক্তিই প্রধান শক্তি, যেখানে মানুষের পন্যায়নের প্রথাটাই রাষ্ট্রকতৃক স্ব ীকৃত একমাত্র পন্থা এই জায়গাটাকে আঘাত করছে পোষ্ট মডার্নিজম, কেউ বলছে এটাই নিয়তি মেনে নাও, এই জীবনযাপনের যন্ত্রনাকে চিত্রায়িত করা হচ্ছে, কেউ বলছে বিদ্্রোহ করো, প্রতিবাদ করো।একই ধরনের বিমর্ষতা, মর্ষকামিতা এবং প্রতিরোধের জায়গায় দাঁড়িয়ে সবাই সামাজিক পরিবর্তনটাকে গ্রহন করার চেষ্টা করছে।আমাদের সাংস্কৃতিক জগত বদলে যাচ্ছে, পুঁজির প্রভাবে,রাজনীতিবিমুখ প্রজন্ম তৈরির এই পরক্রিয়া শুরু হয়েছে আজকের বাংলাদেশে, একটা সুশীল সমাজের আন্দোলন, একটা চেম্বার ওফ কমার্স তৈরি করে সেটাকের্মানুষের উপরে স্থান দেওয়া, পুঁজির আগমনকে স্বাগত জানানোর জন্য রাজনৈতিকপর্্রথাকে নিরন্তর প্রশ্ন করে যাওয়া, এই কাজগুলো করছে আমাদের সংবাদপত্র, আমরা সামাজিক বিবর্তনের জগতে প্রবেশ করছি পুঁজিবাদী বিশ্ব যেই জায়গাটা দেখেছে 60 এর দশকে আমরা তার 40 বছর পর সেই একই বিষয় অনুভব করছি।রাজনীতি এখন পথের জিনিষ নয়, রাজনীতি হবে ড্রইং রুমে, ফাইভ স্টার হোটেলের ব্যালকনীতে বসে হাসি মুখে ব্যাবসায়িক আলোচনার মতো করে আমাদের ক্ষমতার হাতবদল হবে, অবশ্যই জনগনের অংশগ্রহন থাকবে সেখানে, জনগন প্রতি 2 বছর পর পর একটা নির্বাচনে ভোট দিবে, তাদের জন্য রাষ্ট্রকতৃক নির্ধারিত কিছু সুবিধা বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি থাকবে, আমাদের জনসেবার মান উন্নত হবে, আমরা আরও সুশীল হয়ে উঠবো। আমরা ড্রইংরুমে বসে দেখবো কিভাবে টেলিভিশনে স্বপ্ন দেখানো হয়, পুরস্কার এবং উত্থানের ছবি আঁকা হবে টেলিভিশনের পর্দায়, কে হবে লাখপতি, কে হবে কোটিপতি, কে পাবে জনতার রায়, এস এম এস, টেলিফোনে ভোট, এভাবেই একটা প্রক্রিয়ায় জনগনকে ম্যাটেরিয়ালিস্টিক করা হবে।আমার ভাবনাকে প্রতিক্রিয়াশীল বামপন্থি মনে হলেও এই উত্তরআধুনিকতা আন্দোলন এই প্রক্রিয়াকে আঘাত করা এবং এই প্রক্রিয়ার সাথে আপোষের পন্থা খুঁজছে শিল্পে। জিম মরিসনের সাইকোডেলিক মিউজিক, বা পিঙ্ক ফ্লয়েডের সাইকোডেলিক মিউজিক এর সাথে হেভি মেটাল গানগুলোর তেমন পার্থক্য নেই, মুল ভাবে, সুমনের গানে আমরা আধুনিকতার যন্ত্রনা ফুটে উঠতে দেখি, তবে সেখানে মানুষের জাগরনের কথা যেমন নম্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে তেমন নম্রতা সম্ভব শুধুমাত্র পরিবর্তনটা সমাপ্ত হলেই, অঞ্জনের গানের বালক সুমনের গানের বালক দুজনেই একই সামাজিক প্রেক্ষাপটে উঠে আসছে- সেটা কোলকাতার শিল্পসংলগ্ন জগতের ক্ষয়িষ্ণুতা প্রকাশ করছে, মেট্রো চ্যানেলে বড় হওয়া শিশুর যন্ত্রনা নিয়ে সুমনে গান আর টিভি না দেখার অভিমত জানানো অঞ্জন একই প্রক্রিয়াকে ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে।শরত রচনাবলীর পাতায় পাতায় আমরা যেই নারীত্বের ছবি আঁকা দেখছি সেটা আমাদের ভেতরে নারীত্বের চিরকালিনতা এনে দিয়েছে, রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার কিটি একই কারনে লাবন্যের কাছে পরাজিত হয়, চিরকালীন নারীত্বের চিত্রায়নের জায়গাতে গিয়ে নারীকে সামাজিক ভাবে প্রকাশ করার জায়গা থেকে বাংলাদেশের সাহিত্য খুব বেশী সামনে এগিয়ে আসে নি, এই জায়গাটাকে ভেঙে ফেলা সাহিত্যগুলো হবে পোষ্টমডার্ন যা প্রচলিত ধারা থেকে নারীকে অযৌনাঙ্গ একটা মানসিক চরিত্রে রূপান্তরিত করবে, অবশেষে মানুষকে হিংস রাগ দ্্বেষ এবং রিপুতাড়িত একটা অস্তিত্ব হিসাবে প্রকাশ করবে, পন্যায়নের যুগে আমাদের সাহিত্যের ভবিষ্যত এভাবেই পরিবর্তিত হবে।হিন্দি সিরিয়ালের নারীর চিত্রায়নের জায়গাটাও একই ভাবে এই ট্রাডিশনকে মেনে চলছে, এক সাথে চিরকালিন নারিত্বের মুর্তিকে স্থাপন করা, তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সংকটের মুখোমুখি করা এবং এর বিপরীতে আরও এক দল কুটিল নারিকে স্থাপন করে বলে দেওয়া নারীর ভেতরে কুটিলতা এবং মমত্ববোধ দুটোই সমানভাবে ক্রিয়াশীল, এটা মোটা দাগে চিত্রায়িত একটা ব্যাবসা সফল ফর্ম।এগুলো নারীর চিরায়ত ধারনার প্রতিফলন, যেই চিত্রায়নে পুরুষকে কতৃত্বপরায়ন, খেয়ালী, সম্ভোগী, বলিষ্ঠ চরিত্রে রুপায়ন করা হবে এবং এর বিপরীতে দুর্বল পৌরুষের নিদর্শন হিসেবে আসবে মেয়েলী পুরুষ, কাপুরুষ, এদের চরিত্র চিহি্নত করে তাদের সামনে কোনো উত্তরনের সুযোগ দেওয়া হবে না।আমাদের চেতনা বদলাবে না, আমরা ড্রইং রুমে একটা কল্পলোক তৈরি করবো, এবং আমাদের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সুযোগে একটা সুশীল সমাজীয় ধারনা আমাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হবে। একই সাথে চলবে চিরায়ত ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নতুন নতুন তত্ত্ব, উত্তরআধুনিকতাকে বুঝতে হলে এইসব সামাজিক অংশুগুলকে আলাদা করে চিহি্নত করতে হবে শিল্পে, শিশিরের ভয়ংকর ছবিগুলো আমাদের সামাজিক বিবর্তনের একটা রূপ, সেখানে সমাজ খাদকের ভুমিকায়, প্রতিটা মতবাদ যেখানে মানুষের রক্তস্লান করে পবিত্র হতে চাইছে, এই সামাজিক প্রক্রিয়ার উপর অনাস্থা কে প্রকাশ করা এই শিল্পও আধুনিকতার বিকল্প সন্ধান, উত্তরাধুনিক বলাই যায়, কারন এখানে বিমূর্ততা নেই, একটা তীব্র আঘাত লাগে চেতনায়।নাগরিক ভাষা ব্যাবহার,প্রচলিত ভার্চুয়াল রিয়ালিটির জগত, চ্যাট রুমের লোল, আরও এফএল, ল্যামো, সবই আমাদের কথ্যভাষা থেকে সাহিত্যের ভাষায় চলে আসছে,এবং এই কল্পলোকের জগতটাকে মেনে নেওয়ার যাতনা, এই প্রথাকে অস্ব ীকার করবার সচেতন প্রয়াসও থাকছে একই সাথে। আমাদের স্থান-কালের চিরায়ত ধারনার বদল ঘটবে, তবে উপকরন এবং উদ্দেশ্য বিশ্লেষন করতে হবে।একেবারে কথ্যভাষায় লিখিত হলেই সব কিছু উত্তরাধুনিক হয়ে যায় না, আবার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যভাষায় প্রকাশিত হলেই সব কিছুআধুনিক হয়ে যায় না, এই বিভেদের জায়গাটা শিল্পের অভিজ্ঞতা এবং দিক নির্দেশনার, কিংবা সহজ ভাবে বললে শিল্পের দর্শনের উপর নির্ভর করে। ভারি কথা মনে হলে সহজ ভাবে বলা যায়, শিল্প একটা অনুভব তৈরি করে আমাদের ভেতরে, আমাদের একটা ভাবনা উপহার দেয়, এই ভাবনা এবং এর লক্ষ্যটাকে বিশ্লেষন করে বলতে হবে এটা উত্তরাধুনিক হলো কি আধুনিক ফর্মে প্রকাশিত হলো।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।