সমাজতন্ত্রের জুজু আর মৌলবাদের দৈত্য-

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: শুক্র, ০৮/১২/২০০৬ - ২:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পাকিস্তানে সূচনা থেকেই গনতন্ত্রের চর্চা ছিলো তবে পাকিস্তান সূচনা থেকেই সমাজতান্ত্রিকদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত, এখানের বামপন্থি মানুষেরা কিছু হলেই সি আই এ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিয়ে অভ্যস্ত।কার্যকরণ যাই হোক তবে ট্রুম্যান প্রশাসনের কুটনৈতিক নথি মুক্তকরন প্রক্রিয়ায় এখন এই সত্য প্রকাশ হয়েছে যে পাকিস্তানে তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যেনো সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী না হতে পারে তাই যুক্তরাষ্ট্র ইউসিস এর মাধ্যমে এবং অন্যান্য উপায়ে সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। এই কারনে তারা মৌলবাদী দলগুলোকে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়।
বেশ কয়েক দিন আগে "চোর" নামক ব্লগারের পোষ্টে আমার মন্তব্য ছিলো মওদুদী পূঁজিবাদের সুবিধাভোগী মানুষ, সর্বজনাব আরাফাত রহমান আমার মন্তব্যের বিরোধীতা করেছিলেন, তাকেও সাধুবাদ, তবে মওদুদী পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের খোলস বদলেছেন সাপের মতো এটা কোনো অসত্য ভাষন নয়।
তার 1948 সালের জেলে বন্দি থাকা এবং পাকিস্তানী শাসকদের মতে মত দিয়ে উগ্রবাদ পরিহার করে আবার বাইরে আসা এবং বাইরে এসে কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে উস্কানী দেওয়ার অভিযোগে আবার গ্রেফতার করা হয় এবং সে অবস্থায় তার ফাঁসির আদেশ হয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদে তার ফাঁসির আদেশ বাতিল হয়ে 14 বছরের কারাদন্ড হয় এবং অবশেষে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পরই তার গনতন্ত্রপ্র ীতি প্রকাশিত হয়। এইসব বিষয় নিয়েই এই পোষ্ট, যেই ভদ্্রলোক এই নথিগুলো সংগ্রহ করেছেন তাঁর নাম পল উলফ, তাঁর আগ্রহ উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে। তিনি তার ওয়েব সাইটে এই সংক্রান্ত নথি সংগ্রহ করেছেন যেখানে অনেক তথ্যই জানা যায়।মন্তব্য আকারে সেই ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেওয়া হবে।
----------------------------------------------------

দ্্ব ীতিয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি সময়ে বৈশ্বিক ক্ষমতাচক্রের ব্যাপক রদবদল ঘটেছে, এর একটা ধাপ হলো যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী বিশ্বের মোড়ল হয়ে যাওয়া। ঔপনিবেশিকতার জের টেনে ব্রিটেন নিঃস্ব, ফ্রান্স, হল্যান্ড, স্পেন সবাই তাদের উপনিবেশ ছেড়ে চলে আসছে, পৃথিবীর মানচিত্রে ব্যাপক রদবদল ঘটছে, নতুন নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিচ্ছে, পূঁজিবাদী বিশ্বে অস্ত্রব্যাবসার জোড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মোড়ল হয়ে যাওয়াও এমন একটা যুদ্ধকালীন পরিবর্তন।

পরিবর্তনের যে ধারা তৈরি হয়েছিলো তাতে প্রচুর দখলকৃত ভূখন্ড স্বাধীন হলো। দক্ষিন আমেরিকায় ব্যাপক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলো। চীন 1948 এ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো। রাশিয়া টার সীমন্তের পরিধি জুড়ে সমাজতন্ত্রকে রপ্তানি করছে, অনেকটা সাম্রাজ্যবাদী ধারায়, সে সময়টাতেই ইউরোপে একটা সমাজতান্ত্রিক ব্লক তৈরি হলো। এরই সাথে প্রচুর কৌতুক জন্ম নিলো।

একই সাথে এশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক ধারা শক্তিশালী হয়ে উঠলো। এশিয়ার অধিকাংশ দেশই ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ ছিলো, তারা স্বাধীনতা পেলো যখন তখন এদের নেতাদের একাংশের ধারনা তাদের মুক্তির পথ হচ্ছে সাম্যবাদ। এই ধারাটা নিজেই পুঁজিবাদের মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী হতে দিতে আগ্রহী নয়। 2য় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে মানুষের তৈরি কৃত্রিম সংকটে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হলো বাংলাদেশে, 46 এর মনন্তর মানুষের চেতনার পরিবর্তন ঘটালো। সাঁওতালদের নিয়ে ক্ষুদ্্র একটা বিদ্্রোহ হলো। বগুরার আশে পাশে হলো তেভাগা আন্দোলন, সিলেট সংলগ্ন এলাকায় নকশাল আন্দোলন দান বাঁধলো। ঠিক তার আগেই 2য় বিশ্বযুদ্ধ কালীন সময়ে জামাতে ইসলামের জন্মগ্রহন রাজনৈতিক দল হিসেবে। যার কাজ ছিলো মুসলীম লীগের আন্দোলনের বিরোধিতা করা। তারা পাকিস্তান চায় না, মওদুদী অনেক পাতা ব্যায় করেছেন পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষে তার সম্পাদিত তরজমানুল কোরআন পত্রিকায়। সেখান থেকে কিছু অংশ তুলে দেওয়া হবে এখানে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে নৈতিক, কুটনৈতিক ও সামরিক প্রতিরোধের সাক্ষ্য তৎকালীন নিজ দেশের ভেতরে সাম্যবাদীদের বিরুদ্ধে নিষ্পেষন, কিউবা কিংবা বলিভিয়া কিংবা কলম্বিয়ায় তাদের সামরিক কুটনৈতিক পদক্ষেপ।একই রকম পদক্ষেপ পাকিস্তানের রাজনীতিকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছে।
***********************************

1941 সালের 26শে আগস্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে জামাতে ইসলামীর যাত্রা শুরু হয়, মওদুদী তার উদ্্বোধনী ভাষনে বলেছেন-" আমরা সত্যিকারের এবং আসল ইসলাম নিয়ে যাত্রা শুরু করেছি"- পূর্ণ ইসলাম হলো আমাদের আন্দোলন। .....প্রথমে রসুলুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত যে জামাত ছিলো আমরা হুবহু সেই জীবনপদ্ধতি গ্রহন করেছি"
"সিয়াসী কাশমকাশ 3য় খন্ড" তার বিভিন্ন বয়ানে পূর্ন। সেখানের 140 পাতায় তার বক্তব্য " মুসলমান হিসেবে আমার এ বিষয়ে কোনো আকর্ষন নেই যে হিন্দুস্তানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকায় তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হোক। আমার নিকট প্রথম প্রশ্ন হলো আপনাদের পাকিস্তানের শাসনব্যাবস্থার বুনিয়াদ খোদার সার্বভৌমত্বের উপর হবে , না পাশ্চাত্য গনতান্ত্রিক বিধান মোতাবেক জনসাধারনের সার্বভৌমত্বের উপর হবে। ......... যদি জনসাধারনের মতের নিকট নত হতে হয় তাহলে হিন্দুস্তান ও তার মাটিক পূজারীরা জাহান্নামে যাক। এটা এক দেশ থাৗক কিংবা 10000 খন্ডে বিভক্ত হোক, আমার কি লাভ?"
পাশ্চাত্য গনতান্ত্রিক ব্যাবস্থা যেখানে জনসাধারনের রায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইন প্রণয়নের কাজে লিপ্ত হবেন তাদের উপর মওদুদীর স্পষ্ট ঘৃনা বর্ষিত । এটা তার পাকিস্তান হওয়ার পূর্ববর্তি অবস্থান। এমন কি পাকিস্তান তৈরি হওয়ার প্রথম বছরে, যখন তাকে গ্রেফতার করা হলো তার আগ পর্যন্ত তার অবস্থান। তবে গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারে বসে তার মত বিবর্তিত হয়ে যায়, তিনি অনিচ্ছায় গনতন্ত্রের তিক্ত আরক পান করেন।
সেই সিয়াসী কাশমকাশ থেকে কিছু কিছু অংশ তুলে ধরি-
জজগনের সরকার জনগনের জন্য জনগনের দ্্বারা- মুসলমান হিসাবে আমি এ নীতির সমর্থক নই।
তার মতে গনতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমানদের জন্য পৃথক পাকিস্তান গঠনের আন্দোলন কোনো মুসলিম করতে পারে না। এই পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থকেরা কোন মতেই মুসলিম নয়। তবে জামাতে ইসলামির লোকদের এই কে মুসলিম কে মুসলিম নয় এই বিষয়ে ফতোয়া থেমে থাকে নি। যখন তখন যাকে তাকে তারা মুসলমানের খাতা থেকে নাম কেটে দিচ্ছে, তাদের মর্জি হলেই যাকে তাকে মুরতাদ ঘোষনা করে দিচ্ছে। এই অব্যাবস্থার কোনো নিরসন হয় নি।
1946 সালের তরজমানুয়ল কোরআনের ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় তার বক্তব্য হলো " বোকার স্বর্গে বসবাসকারীরা স্বপ্নে যত সবুজ বাগানই দেখুক না কেনো, কিন্তু স্বাধীন পাকিস্তান নিশ্চয়ই ধর্ম নিরপেক্ষ গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রাদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে-- আর তার বিজ্ঞ ঐসলামিক বিবেচনায়" খোদার নিকট মুসলমান ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অধিক অভিশপ্ত", লানত সেইসব মানুষের উপর যারা ধর্ম নিরপেক্ষ পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করছে।
1947 সালের মে মাসে দারুল ইসলামে পঠিত ভাষনে মওদুদী বলেছেন - " মুসলমানদের উদ্দেশ্যে আমি পরিস্কার বলছি বর্তমান যুগের ধর্মহীন( ধর্ম নিরপেক্ষ হবে আদতে) জাতীয় গনতন্ত্র তোমাদের ধর্ম ও ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থি। তোমরা যদি এর সামনে মাথা নত করো তবে রোরানের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। তার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষনে অংশগ্রহন করলে নিজের রসূলের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করবে। এর পতাকা উত্তোলনের জন্য দাঁড়ালে নিজের খোদার বিরুদ্ধে বিদ্্রোহ ঘোষনা করা হবে। ...... ইসলাম এবং এই পদ্ধতি কোথাও পরস্পর সমঝোতা করে না।

যাই হোক 1955 সালের 18ই জুন তিনি আবার একটা ভাষন দিলেন,
তিনটি জিনিষ এমন যার জন্য প্রতিটি দলের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করা দরকার। প্রথমতঃ আইনের শাসন,........
দ্্ব ীতিয় বিষয় হলো, মানুষের লেখা ও বক্তৃতা, সমাবেশ ও চলাফেরার স্বাধীনতা...... তৃতীয় বিষয় হলো গনতন্ত্র.......
তিনি গনতন্ত্র ও ইসলামের সাযুজ্য বিচার করে রায় দিয়েছেন 1955 সালের অগাস্ট মাসের তরজমানুল কোরআনে, তিনি বলেছেন, গনতন্ত্র কোরআন ও সুন্নাহর সারমর্ম।
খারাপ না অবশ্য 8 বছরেই ইসলামী ব্যাখ্যা বদলে গেলো। গনতন্ত্র কুফরি কাজ থেকে ঐসলামিক আন্দোলন হয়ে গেলো।
************************************
যুক্তরাষ্ট্র গনতন্ত্র সরবরাহ করছে, এটা তাদের বৈদেশিক নীতির অংশ।কেনো সমাজতন্ত্রের জুজু থামাতে গনতন্ত্রের মডেল নিয়ে ইসলামী মৌলবাদের দৈতের বোতলের ছিপি খুললো যুক্তরাষ্ট্র এবং এর প্রেক্ষিতে মৌলবাদী দলগুলোর সাথে কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্রতা হলো এ নিয়ে আলোচনা করা যায় আসলে।
1948 সালে জিন্নাহ 5 বছরের জন্য 2 বিলিয়ন ডলারের ঋণ চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিনিময়ে তিনি অনুরোধ করেছিলেন সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যেকোনো সহায়তা করবে পাকিস্তান। জিন্নাহর মৃতু্যর পর এই আনুগত্যে ধারা থেমে থাকে নি। বরং ইউসিসকে ভিত্তি করে গনতন্ত্র বিকাশের একটা আন্দোলন তৈরির রূপরেখা তৈরি হয়। তখন তৎকালীন পূর্ববাংলায় সমাজতন্ত্রের আন্দোলন বেশ শক্তিশালী।এই পরিকল্পনায় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করার অনেকগুলো উপায় ব্যাখ্যা করা হয়। এর একটা হলো উগ্রপন্থি ধর্মিয় দলগুলোর সামনে এই বক্তব্য নিয়ে আসা যে
সমাজতান্ত্রিকরা ইশ্বরবিরোধী, ফলে এই মতবাদ মুসলিম বিশ্বের স্বাধীন দঃর্মিয় ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য মস্ত হুমকি। তাই সমাজতন্ত্রের বিরোধী আন্দোলনের পন্থা হিসেবে ইউসিসের প্রত্যক্ষ্য সহযোগিতায় ইসলামী সামাজিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ প্রচারিত হবে। এই কথা প্রমানের চেষ্টা করা হবে যে, ইসলাম ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও মর্যাদায় এবং অর্থনৈতিক অসমতা দুরীকরনে বিশ্বাস করে। মুক্ত বিশ্বে মানুষ যার যার ধর্ম পালন করতে পারে নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করতে পারে।
সেই 1955 সালের 18ই জুনের ভাষনের সাথে এই গৃহীত নীতির বক্তব্যের শব্দগত বিভেদ থাকলেও প্রচারনা নীতির কোনো বিরোধ নেই। একই সময়ে পশ্চিমা অর্থায়নে গনতন্ত্রের প্রচারনা চলছে এবং সেখানে ঐসলামিক ঔদার্য্য এবং গনতন্ত্রের ও ইসলামি মানবাধিকারের সাযুজ্য প্রচারের চেষ্টা চলছে ঠিক সেই সময়েই মওদুদী গনতন্ত্রের পক্ষে সাফাই গাইছেন শতমুখে- তার পত্রিকা তরজমানুল কোরআনে তিনি গনতন্ত্রের সাফাই গাইছেন, বক্তৃতা বিবৃতিতে গনতন্ত্র গনতন্ত্র বলে নাকি কান্না কাঁদছেন। একই সাথে জামাতে ইসলামিও গনতন্ত্রের সমর্থক ও সংরক্ষক হয়ে গেলো।
যাই হোক এই লেখার সমাপ্তি ঘোষনা করি সেই পরিকল্পনার শেষ অংশ লিখে
" ধর্মিয় মঞ্চ থেকে সমাজতন্ত্র বিরোধি প্রচারনা চালানো যায় যেনো সেই উদ্দেশ্যে ধর্মিয় নেতাদের সাথে একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। এই প্রচারনার লক্ষ্য হবে এই কথা বোঝানো যে যেহেতু সমাজতন্ত্র ধর্ম বিরোধী তাই ওটা ইসলাম বিরোধী।"


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।