৭২ থেকে ৭৫ মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চনার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা

অপ বাক এর ছবি
লিখেছেন অপ বাক (তারিখ: মঙ্গল, ২৭/০৩/২০০৭ - ৮:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের আসলে কেমন আচরণ করা উচিত এটা বুঝতে পারি না। গত রাতে চ্যানেল ওয়ানে একজন মুক্তিযোদ্ধার সাাৎকার প্রচারিত হলো। তিনি পেশায় মুড়ি বিক্রেতা, তার আবাসস্থল ভেঙে যাওয়ার পর দয়াবান একজন তার দোকানে পাশে একটা ছাপড়া তুলে তাকে থাকতে দিয়েছেন।
সংবাদ মাধ্যমে ্মন বিষয়ের উপস্থাপনা যেমন হয় ঠিক তেমনই বিষয়টা, স্মৃতিসৌধের সামনে তার অশ্রু ভরা চোখ আর পেছনে হায়দারের 30 বছর গানটা চলছে-

তবে প্রশ্নটা হলো আমাদের আসলে কি করা উচিত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করা গ্রামের কিংবা শহরের দরিদ্র মানুষগুলো এখনও দরিদ্র, তাদের অর্থনৈতিক কোনো উন্নয়ন ঘটে নি। এটা বাস্তব সত্য, এর সাথে এটাও বাস্তব সত্য যে তারা কোনো রকম পারিশ্রমিক দাবি করেন নি। তাদের বিবেচনায় মনে হয়েছিলো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়া দরকার, তাই তারা যুদ্ধ করেছেন। কোনো রকম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি তারা। বেশ কয়েক দিন আগে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটা স্মৃতিকথায় জানলাম যুদ্ধ শেষের পর যখন অস্ত্র উদ্ধার কিংবা অস্ত্র সমর্পন চলছে তখন পেশায় চোরাচালানি এক মুক্তিযোদ্ধা তাকে বলে আপনাদের সেনাবাহিনী এমনটা করছে। কোনো রকম অসম্মান প্রকাশ না করেই বলি পূর্বে চোরাচালানি এই মুক্তিযোদ্ধা সাহসী যোদ্ধা ছিলেন এবং যুদ্ধের পর অনেক রকম পেশা গ্রহন করে অবশেষে তার পুরোনো পেশায় ফিরে যান।

আমরা এইসব মানুষকে গন মাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করছি। কিছুটা বিজ্ঞাপন কিছুটা আবেগ উৎসরণের জন্য। আমরা তাদের মুখে সম্ভবত ভাষাও তুলে দিচ্ছি। সম্পূর্ণটাই একটা জঘন্য অভিনয়কুশীলতা। কেউ কেউ আমার মন্তব্যে আহত হলেও আসলে বিষয়টার প্রকট বানিজ্যিকতা আমাকে আহত করেছে। সম্মান দেখাতে গিয়ে কাউকে অসম্মানিত করা কিংবা তার দারিদ্র নিয়ে উপহাস বা করুণা সঞ্চারের চেষ্টা আমার কাছে নিকৃষ্ট আচরণ মনে হয়।

তবে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম এসব প্রান্তিক মুক্তিযোদ্ধার জীবনযুদ্ধের সংবাদ ছাপায় আয়োজন করে। সেখানে সাহিত্যিক ভাষার ব্যবহারও লনীয়। তারা আসলে কি বলতে চান আমাদের?

বলেছিলাম পৃথিবীতে সকল যুদ্ধের স্বরূপ একই রকম। ইতিহাসও একই রকম। সুদানের দার্ফুরে যা ঘটছে, ইরাকে যা ঘটছে, কিংবা কসোভোতে যা ঘটেছে সেসব ঘটনাই বাংলাদেশে ঘটেছে। স্বাধীনতার আকুলতা আর রক্তপাত বোঝার জন্য আসলে আলাদা করে একাত্তরে রক্তপাতের দৃশ্য কিংবা ধার বর্ণনা নিস্প্রয়োজন। যুদ্ধের অমানবিকতা, বর্বরতা সব সময়ই একই রকম।
নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণ যুদ্ধের অপরিহার্য পরিনাম। এ জন্য যেসব নারী নির্যাতিত হয়েছে তাদের নির্যাতনের দৃশ্য চিত্রায়নের কোনো প্রয়োজন নেই। তাদের কে কবে কিভাবে ধর্ষণ করেছিলো এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। এমন কি এসব দৃশ্য বাস্তবতার নামে ভিডিও করে বাজারে ছাড়াটাও তাদের প্রতি অসম্মান। কপাল ভালো আমাদের নির্বোধ টিভি সাংবাদিকরা এখনও কোনো ধর্ষিত মুক্তিযোদ্ধা কিংবা বীরাঙ্গনার সাাৎকার গ্রহন করেন নি, তাহলে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো সেই স্থানে যেখানে তাকে আটক রাখা হয়েছিলো, বলা হতো কোথায় কিভাবে তার বস্ত্র হরণ হলো, কোথায় কোন মাপের সৈন্যরা তার উপগত হয়েছিলো এসব বিষয়াসয়।
তার পর বর্তমান প্রসঙ্গে নিবের্াধ সাংবাদিক বলতেন এখন ক্যামোন বোধ করছেন? এখনও কি আপনার আগের মতোই লাগে? ইতরামির চুড়ান্ত হলেও এসব নির্বোধের কাছে এটা বাস্তব ইতিহাস তুলে ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগানো।

যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী অবসাদগ্রস্থ তরুন প্রজন্ম একটা যুদ্ধকালীন বাস্তবতা। তাদের সাংস্কৃতিক বিবর্তন এবং যুদ্ধকালীন সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার পরে তাদের কোনো রকম মানসিক সহায়তা দেওয়ার প্রকল্প ছিলো না সে সময়ে বাংলাদেশের মতো সদ্যজাত দেশে। এসব অস্বাভাবিক তরুনের মানসিক অস্থিরতা কমিয়ে আনা এবং তাদের সমাজিক পুনর্বাসনের উদ্যোগ গৃহীত হলে হয়তো যুদ্ধ পরবর্তি সময়ে হতাশ এসব তরুনের অনেকের আত্মহত্যা ঠেকানো সম্ভব হতো।

এদের একাংশই পরবর্তীতে হতাশ হয়ে সামাজিক বিল্পবের ল্যে জাসদের সাথে যুক্ত হয়। এরাই জন বিপ্লব সংগঠনের জন্য সংগঠিত হওয়ার সময় তাদের যুদ্ধকালীন সহযোদ্ধা এবং আওয়ামী লীগের রী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। লাল বাহিনী - নীল বাহিনী আসলে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এসব শ্রেনী বিভাজন সব সময়ই থাকে। যুদ্ধের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষন করে যদি সেনা পূনর্বাসন প্রকল্প গ্রহনের কোনো সুযোগ থাকতো তাহলে আমাদের নীতিনির্ধারকরা এইসব ঝামেলা এড়িয়ে যেতে পারতেন।

অবশ্য ডামাডোল ছিলো, অস্থিরতা ছিলো প্রকট ভাবে। একই সময়ে প্রচুর অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের সম্পদ জব্দ করা হয়, কিংবা অবৈধভাবে দখল করা হয়। অতি উৎসাহী এসব দখলদার ছিলো মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহন করা কোনো যোদ্ধা কিংবা 2য় কিংবা 3য় সারির অপরাধী, এদের নিয়ন্ত্রনের কোনো মতা ছিলো না প্রশাসনের হাতে। বাঙ্গালীর আবেগের কারনে নায়কের মর্যাদা পাওয়া এসব অস্থির মতি যুবকদের নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা থাকলে হয়তো মুজিবের শাসনামল শেষে এমন জঘন্য ভাবে তাকে নিহত হতে হতো না। অনেক কিছুই সম্ভব ছিলো, তবে মূলত তেমন পরিকল্পিত ভাবে মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন প্রকল্প নেওয়া হয় নি।
একই সাথে অভিযোগ আছে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে বেশ কিছু অপরাধী সংঘবদ্ধ হয়ে লুটতরাজ চালিয়েছে 71এর যুদ্ধাকলীন সময়ে এবং এর পরেও। এসব কারনেও মানুষের ভেতরে একটা ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিলো।

একটা বিষয় কিংবা একটা সত্য উপলব্ধি করতে হবে আমাদের যে আমাদের ভেতরে কিংবা মানুষের ভেতরে যেসব অপরাধ প্রবনতা কিংবা লোভ কিংবা এ জাতীয় দুর্বলতা বিদ্যমান তার কোনোটাই মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য দুর হয়ে যায় না। মুক্তিযুদ্ধ একটা প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়া মানুষগুলো একটা সুন্দর ভবিষ্যতের লড়াই শুরু করেছিলো। তারা আশা করেছিলো যুদ্ধের পর যেহেতু এখন পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরেরা রপ্তানীজাত আয় সংগ্রহ করে নিজেদের সৈন্দর্য বর্ধন করছে না বা নিজেদের সমরসম্ভার বৃদ্ধি করছে না তাই এই টাকা নিজেদের দেশেই বিনিয়োগ করা হবে- তবে মানুষের লোভ কিংবা মতাসীনদের লোভ সে সম্ভবনাকে বাস্তব করতে পারে নি।

এটা একেবারে আমার নিজস্ব বিশ্লেষন। এর কোনো প্রমাণ বা ভিত্তি আমি দেখাতে পারবো না। আমার মনে হয় এই ছিলো প্রাথমিক বাংলাদেশের সমস্যা। আসলে 72 থেকে 75 এর সময়ে অপরাধের পরিমাণ কমে নি, ইত্তেফাকের একটা সংকলন ছিলো সেখানের সংবাদ শিরোনামে নিয়মিত ডাকাতি চুরি হত্যার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে সার ডিলারদের দুর্নীতির সংবাদ, সবই প্রকাশিত হয়েছে। প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া হয় নি এমন বলবো না।শেখ মুজিব তার অদ ব্যবস্থাপনায় যতটুকু করা সম্ভব ততটুকু করতে আন্তরিক ছিলেন, কিংবা সম্ভবত বাঙ্গালীদের সম্পর্কে তার উচ্চ ধারণা ছিলো কারন 71 এর মার্চ মাসে সারা দেশে অপরাধ নাকি লণীয় ভাবে কমে যায়। তবে মানুষের ষড়রিপুর প্রকোপ আসলে সবসময়ই ক্রিয়াশীল।
এ কারণেই সম্ভবত আমাদের শ্রেনী বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন সম্ভবপর হয় নি কিংবা অনেক আগে সুমন চৌধুরি যেমনটা জানিয়েছিলো এটা বুর্জোয়া বিপ্লব হওয়ার কারনেই কিছু স্থানীয় মতাশীল বুর্জোয়াদের হাতে প্রশাসনের কতৃত্ব চলে যাওয়ায় ঘটেছে।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।