জলপাই সময়ের আখ্যান

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি
লিখেছেন পান্থ রহমান রেজা (তারিখ: মঙ্গল, ১০/০৮/২০১০ - ১০:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বইটা নিয়ে আগে থেকে আগ্রহ ছিল। যখন প্রকাশক টুটুল ভাই জানান, বইটা মেলায় আসতেছে। তারপর বইমেলা শুরু হলে টুটুল ভাইকে গুঁতানো, কবে আসবে। আসছি আসছি করে আর আসে না। এর-ওর বই আসে। কিনি। আর এই বইটির জন্য অপেক্ষা করি। টুটুল ভাই বলেন, লেখক পাণ্ডুলিপি দিছে, কিন্তু ফ্ল্যাপ লিখে দেয় নাই। তাকে মেইল দিছি। এই দিলো বলে! লন্ডন থেকে লেখকের ফ্ল্যাপ আর আসে না। মাঝে প্রকাশককে একবার হুমকি দিই। তিনি বলেন, লেখক না দিলে প্রশান্ত মৃধারে দিয়ে ফ্ল্যাপ লিখিয়ে নেবেন। সে লেখাও হয় না। বইও মেলায় আসে না। ততদিনে মেলার ২০ দিন চলে যায়। মেলায় গেলে শুদ্ধস্বরের স্টলে গিয়ে খোঁজ নিই এসেছে কি না! ২৩ কি ২৪ তম দিনেও বই আসে না। আমি অফিসের কাজে কক্সবাজার যাই। ফিরি মেলা শেষে। তারপর আর বইটির কথা মনে থাকে না। মাঝে মাঝে শুদ্ধস্বরে গিয়ে আড্ডা দিই। শেলফে সার বেঁধে নানাজনের বই সাজানো দেখি। কিন্তু এ বইটি চোখে পড়ে না। সেদিন প্রথম আলোয় দেখি বইটি ফেব্রুয়ারির বইমেলাতে বেরিয়ে গেছে। সেদিনই বর্ষার বইমেলায় গিয়ে বইটি বগলদাবা করি। বাসায় এসে পড়তে পড়তে দেখি বইটি জলপাই সময়ে একজন তরুণের ব্যক্তিগত গল্প হয়ে উঠেছে।

ব্যক্তিগত কাসুন্দি থাক এবার। আমরা বরং লেখকের গল্পের চৌহদ্দিতে যাই। এটা কি আসলে লেখকের গল্প? পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এটা আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার গল্প। এটা আমাদের জলপাই সময়ের গল্প। এটা আমার ক্রসফায়ার আতংক নিয়ে দিন যাপনের গল্প। তবে এটা ঠিক গল্প নয়। আখ্যান। বাংলাদেশের সামরিকায়নের আখ্যান। আখ্যান মানুষ নিখোঁজ হওয়ার। হয়তো কেউ ভাত খেতে বসেছে। সেখান থেকে ডেকে নিয়ে গেছে জলপাই উর্দি। তারপর আর তার হদিস মেলেনি। পরে জিজ্ঞেস করলে, মুখস্ত উত্তর পাওয়া গেছে- কই, তাই নাকি! এ নামে কাউকে তো আমরা ধরে আনিনি!

আখ্যানটিতে সময় একটা বড় জায়গা নিয়ে আছে। এ সময় শুধু লিখে চলে স্বজন হারানোর ইতিহাস। বলে দেয় সামরিকায়নের, সামরিক উল্লফনের ইতিবৃত্তও। সময় শুধু লিখেই যায় না, মুছেও দেয় কিছু কিছু। তাই একদিন আমিনুর রহমানকে আমরা ভুলে যাই, যাকে জলপাই বাহিনী একদিন তুলে নিয়ে গিয়েছিল। স্নেহাও একদিন শহর থেকে চলে গিয়ে হারিয়ে যায় কাহিনি থেকে। তাই এটা ভুলে যাওয়ার আখ্যানও বটে। তা যেমন আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের, তেমনি নিখোঁজ হওয়া মানুষদেরও। প্রতিরোধ আছে। আছে সামরিক জান্তার প্রতি ঘৃণার চূড়ান্ত প্রকাশ- ‘আমাদের সামরিক জান্তার ছবি অ্যামবুশ করা গেঞ্জি। খাল কাটতে কাটতে ক্লান্ত হয়ে তিনি কোদাল হাতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। গেঞ্জিটার পিঠের দিকে আমরা থাউজেন্ট পাওয়ারের লাল কালি দিয়ে লিখব ‘এখানে প্রস্রাব করুন’। কলেজের পেছনের দীর্ঘ দেয়াল জুড়ে প্রস্রাব করে পথচারী, রিকশাওয়ালা আর ছাত্ররা সবাই। ওইখানে মাটির ওপর গেঞ্জিগুলো সারে সারে সাজিয়ে রাখবো আমরা। গেঞ্জির কোনগুলো চোখা বাঁশ দিয়ে পুঁতে দেব। প্রস্রাবে প্রস্রাবে ভিজে গেলে উল্টোদিকের সামরিক জান্তাকে স্পষ্ট দেখা যাবে। যে প্রস্রাব করতে আসবে, সেই দেখবে সামরিক জান্তা প্রস্রাবখানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং সেখানকার প্রস্রাব খাচ্ছে।’

সামরিক জান্তার প্রতি এ রকম ঘৃণা থাকলেও তা কোথাও বিস্ফোরণের মতো জোরালো হয়ে উঠেনি। না হওয়াটাই ভালো হয়েছে। তাতে আমরা ইতিহাসের সত্য চেহারাটাই দেখি। এতো কিছুর মাঝেও প্রেম এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা সে প্রেমের উপর আছর ফেলেছে ভালোমতোই। আর তাই চিঠি পাঠানোর ডাকঘরটিও বন্ধ হয়ে যায় একদিন।

যে বইটি নিয়ে এতো কথা সেটি ইমতিয়ার শামীমের ‘আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক’। বইটি সামরিকশাসনধ্বস্ত বাংলাদেশের যাপিত জীবনের এক চমৎকার দলিল। বইটির প্রথমেই লেখক আমাদের জানিয়ে দেন- ‘শেষ ট্রেন চলে যাওয়ার পরও আমি বসে থাকি স্টেশনের উল্টো দিকে দু’মুখ খোলা সিমেন্টলোহার বড় বড় পাইপগুলোর ওপর। একটু শীত-শীত লাগছে এখন। জামাটা ভালো করে টেনেটুনে আরও জড়সড় হয়ে বসে শীত কমানোর চেষ্টা চালাই আর মনে মনে চিন্তা করি, বড়ভাইকে নিশ্চয়ই আর্মিরা খুব মার দিচ্ছে।’ যে উপাখ্যানের শুরুর কয়টি বাক্যই এমন, তা থেকে গল্পের অভিমুখ বুঝতে আমাদের আর সমস্যা হয় না। কাহিনীর যত ভেতরে আমরা ঢুকে পড়ি, আমাদের সামনে তত উন্মোচিত হয়ে ওঠে মুজিব পরবর্তী সময়ে জলপাইদের দাঁত-নখের হিংস্র তাণ্ডব।

‘আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক’ আখ্যানটি শেষ হয়েছে এভাবে- ‌‍'আরও একটু পর আমরা জানতে পারি, ক্রসফায়ারে একজন মারা গেছে। কেননা ক্রসফায়ারেই মারা যেতে হয়। কেননা ক্রসফায়ারই গন্তব্য আমাদের সকলের। আমি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিন্তা করি, আরও এক বড়ভাই মারা গেল হয়তো। হয়তো আরো একটি রূপকথা লেখা হলো.....।' কোথায় জানি পড়েছিলাম, ‘কাহিনীরা জানে, পাঠকের জন্ম হয় পাঠ শেষ হলে’। আখ্যানটির শেষে এসে ক্রসফায়ারে মারা যাওয়া আর তার বিবরণ দিয়ে রূপকথা লেখার মধ্য দিয়ে পাঠক হিসেবে আমিও ঢুকে পড়ি আখ্যানটিতে। আর তখনই ক্রসফায়ারের আতংক এসে আমাকে ঘিরে ধরে। হয়তো দিনযাপনের এই আতংক নিয়েও একদিন আরেকটি আখ্যান রচিত হবে।

আমাদের চিঠিযুগ কুউউ ঝিকঝিক
ইমতিয়ার শামীম
প্রকাশক: শুদ্ধস্বর
একুশে বইমেলা ২০১০


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বাংলাদেশের সবচেয়ে অন্ধকার সময় নিয়ে আমাদের এক ধরনের উদগ্র কৌতুহল আছে, সম্ভবত সময়টা অদ্ভুত ধোঁয়াশায় ঢাকা বলেই। বইটার কন্টেন্ট সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হলোনা, তারপরও পড়ার ইচ্ছে জাগেনি এটা বলা যাবেনা।

অদ্রোহ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

বইটি পড়ার জন্য সময় খুঁজছি কদিন ধরে। আপনার লেখাটা পড়ে মনে হলো সময়টা খুব তাড়াতাড়িই বের করতে হবে।
ধন্যবাদ সুন্দর রিভিউয়ের জন্য।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মূর্তালা রামাত এর ছবি

পান্থ, রিভিউটা জমলোনা বলে মনে হলো....আরেকটু বিস্তারিত আশা করছিলাম...

মূর্তালা রামাত

গৌতম এর ছবি

ইমতিয়ার শামীম এ সময়ের একজন শক্তিশালী লেখক।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

হাসান মোরশেদ এর ছবি

এরকম গুরুত্বপূর্ণ বই মেলার শেষে আসা দুঃখজনক।
আমাদের যাপিত বাস্তবতায় অন্ধকার সময়গুলোর আখ্যান আরো প্রকাশিত হওয়া জরুরী।
পান্থকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

বইটা পড়ার আগ্রহ জন্মাল ...
___________________________
Any day now, any day now,
I shall be released.


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

রণদীপম বসু এর ছবি

পান্থ, সেদিন বইমেলা থেকে যে এই বইটি আনার কথা ছিলো। হোসে সারামাগোর 'অন্ধত্ব' নিয়ে এসেছি ঠিকই, কিন্তু এ বইটি আনা হয়নি। যাক্, সামনের সপ্তায় শুদ্ধস্বর থেকে নিয়ে আসতে হবে।

চমৎকার একটা বুক রিভিউ করতে গিয়ে তো বেশ ফাঁকি দিলেন মনে হচ্ছে ! এতোটা কঞ্জুষ হওয়া কি ভালো ?

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সুমন সুপান্থ এর ছবি

বলতে গেলে এই লেখাটায় মন্তব্য করবো বলেই লগানো ।
একদিন আজিজের কোনচিপায় বলেছিলাম না, সিরাজগঞ্জ আমার প্রিয় মানুষদের জেলা ?
হুট করে মরে যাওয়া মহান লেখক শহীদুল জহির, অপছন্দের লেখক আর প্রিয় বন্ধু সুমন্ত আসলাম, অনুজপ্রতিম পান্থ রেজা , আর এই জন্মে দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষদের একজন এই শামীম ভাই, ইমতিয়ার শামীম। সিরাজগঞ্জ রত্নগর্ভাই ।
( এই আলোচনার পেছনে জেলাপ্রীতি আছে কি না, কে জানে ! পান্থ ? )

শামীম ভাইর লেখা সবসময়ই সমকালীন আর রাজনৈতিকভাষ্য নির্মিত । হয়তো একটু বেশীই । রাজনৈতিক বিশ্বাসের শিল্পিত নির্মাণে সিদ্বহস্ত লেকখকুলের সর্বশেষ প্রতিনিধি এই ইমতিয়ার শামীম, মামুন হুসাইনরাই আমাদের কথাসাহিত্যেরও ভরসার জায়গা বলতে গেলে ।
তাঁর বইয়ের আলোচনার জন্য ধন্যবাদ পান্থ ।
আরেকটু ডিটেইল হলে ভালো হতো ।

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বইটা আপনার কাছ থেকে ধার নিবো...

রিভিউ একটু ছোট হইলেও আগ্রহ পাইলাম পড়বার...

_________________________________________

সেরিওজা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।