এলোমেলো কথা (১)

জলদস্যু এর ছবি
লিখেছেন জলদস্যু (তারিখ: মঙ্গল, ১১/১২/২০০৭ - ৬:৫১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেকদিন লেখালেখি করা হয় না। সময়ের অভাব আর কাজের চাপই এর কারণ। ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। দেশে থাকলে একরকম উদ্দীপনা নিয়ে এ মাসের ১৬ তারিখটি আমাদের বাসায় পালন করা হত। তেমন হয়ত জাঁকজমক কিছু হত না, তবে ১৬ তারিখে কেমন জানি একটা আবেশ ছড়িয়ে রইত বাসার পরিবেশে। কারণ আর কিছু নয়, আমার বাবা। যিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা ১৯৭১ সালে। তাই এ দিনের মর্ম তার কাছে একটু অন্যরকম তো হবেই।

খুব আশ্চর্য্যজনক হলেও সত্য যে আমার বাবা কখনই মুক্তিযুদ্ধের সেই আগুনঝরা দিনগুলো নিয়ে আমি ও আমার বোনদের সাথে আলোচনা করেন নি। আমি জানি না কেন?কখনও জিজ্ঞাসাও করিনি। হয়ত দেশ স্বাধীনের পরবর্তী ঘটনাবলীর কারনে আর দশজন মুক্তিযোদ্ধার মত তিনিও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তাই স্মৃতিচারণ করে স্বপ্নভঙ্গের দুঃখ বাড়তে চাইতেন না। ছোটবেলায় আমরা বাবা চেপে ধরতাম সেসময়ের ঘটনা বলার জন্য। কিন্তু সেরকম রোমহর্ষক কাহিনী কখনই আমরা তার মুখ থেকে বের করতে পারিনি। খুব চাপাচাপি করলে উনি বীরশ্রষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের একটা ছবি বের করে আমাদের দেখিয়ে মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের বীরত্বের কাহিনী আমাদের বলতেন। একই সেক্টর বা সেকশনে যু্দ্ধ করার কোন এক সময়ে হয়ত ৭১ সালে হয়েছিল তাদের পরিচিতি। হয়েছিল ছবিবদল। সে ছবি আজও রয়ে গেছে আমাদের ধুলোপড়া পারিবারিক এ্যালবামে, স্মৃতির আড়ালে। আরও একটা ছবি আছে আমাদের পারিবারিক এ্যলবামে। সম্ভবত যুদ্ধের পর অস্ত্র জমা দেয়ার আগে স্টুডিওতে তোলা বাবা ও তার ২ বন্ধুর অস্ত্র হাতে ছবি। আমরা ভাই বোনেরা প্রায়ই হাসাহাসি করতাম "স্টেন হাতে বাবা" বলে ছোটবেলায়। বাবাও দেখতাম মুচকি হাসতেন। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। এর বেশি আবেগ/নস্টালজিয়ায় ভুগতে আমি কখনই তাকে দেখি নি।

ক্লাস সেভেন এইটে পড়ার সময় একবার বাবাকে দেখাতে বলেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট। খুব বিরক্ত হয়ে তিনি বলেছিলেন "সার্টিফিকেটের জন্য যুদ্ধ করিনি। আমি সার্টিফিকেটের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই না। আমি চাই না আমার ছেলেমেয়েরা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পরীক্ষা দিক। নিজের কর্মে বড় হওয়ার চেষ্টা কর।"

আমরা ভাই-বোনেরা কখনই বাবার পরিচয়ে নিজেদের পরিচিত করতে চাই নি এবং আমার বাবা কখনই তা হতে দেন নি। ক্যাডেট কলেজের ভর্তি হতে না পারার পর মায়ের কান্নার কথা কোনদিন ভুলব না। মায়ের এক কথা ছিল বাবা একটু বলে দিলেই আমার সুযোগ হয়ে যেত। কিন্তু বাবা ছিলেন নির্বিকার। উনার এক কথা তার ছেলের ক্যাডেট কলেজে পড়ার দরকার নেই।

বাবার এখন বয়স হয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আগের সেই কঠোরতা তার মাঝে নেই। খুব দুঃখ করেন আমাকে কিছু দিতে পারেন না ঈদ উপলক্ষ্যে। পারবেন কিভাবে থাকি যে সাত সমুদ্র তের নদীর এপারে। আমারও খুব ইচ্ছা করে ঈদের আগের রাতে বাবার জন্য পানজাবী কিনে এনে বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে। ইচ্ছা করে ঈদের দিন সকালে বাবার পাশে হেঁটে হেঁটে মসজিদে যেতে। কিন্তু হয়ে উঠে না। আমার এই চাওয়া কি এতই বেশি? ভাবছি আগামীবার দেশে গিয়ে বলব -
"চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি বাবা শুনছ
এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না
বাপ-বেটা মিলে মসজিদে ঈদে একসাথে মোরা যাব
মাকে বলে দাও আমি আর বিদেশে যাচ্ছি না"


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

আপনারো দেশে দেশে ঘুরতে সমস্যা তো আমরা ছাপোষা মানুষেরা কোথায় যাই? শত হোক জলদস্যু বলে কথা। আপনি বরং এখন বঙ্গোপসাগরে ডিউটি নেন। মাঝে মাঝে একটু নেমে গিয়ে মালাক্কার কাছে আঘাত হেনে আসবেন। বাড়ির কাছে থেকে জলদস্যুগিরি করার এটাই সহজ পথ।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

খুব আশ্চর্য হলেও সত্যি, মুক্তিযোদ্ধা বাবারা তাঁদের পুত্রকন্যাদের কাছে যুদ্ধের গৌরবগাথা সম্পর্কে অবোধ্যভাবে নীরব। এই কাহিনী আমি অসংখ্যবার শুনেছি। আপনার অনুমান করা কারণটি সত্যি হতে পারে কোথাও কোথাও। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে কারণটি এক হয় কী করে?

আমরা যে খুব হা হুতাশ করি, আজকের প্রজন্মের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে উদাসীন, তার পেছনে এই মুক্তিযোদ্ধা বাবাদের নীরবতারও দায় কিছু থাকে বলে আমার ধারণা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

ওয়েলকামব্যাক।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প না করাটা আমার কাছে একটু ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাই সম্ভবত সেই গৌরবের দিনগুলোর গল্প করতে পছন্দ করে।
লিখার আবেগটা হৃদয় ছুঁয়ে গেল। আপনার বাবার প্রতি শ্রদ্ধা।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আপনার আবেগ ধরা সম্ভব কিনা জানি না। তবে আমাকে সেটা স্পর্শ করেছে।
এই বিষয় নিয়ে অতিথী হিসেবে একটা কলাম লিখেছিলাম। আপনার ভালো লাগতেও পারে।
http://www.sachalayatan.com/arefin/10757

আরেফীন

হাসান মোরশেদ এর ছবি

জলদস্যু-অনেক দিন পর । ভালো আছেন তো?
-----------------------------------------
মৃত্যুতে ও থামেনা উৎসব
জীবন এমনই প্রকান্ড প্রচুর ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।