শুঁয়াচান পাখি-- পর্ব. এক

কুলদা রায় এর ছবি
লিখেছেন কুলদা রায় [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১৭/০৭/২০১০ - ১১:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কেউ রোদ কুড়ায়। কেউ ছায়া কুড়ায়। মাঝে মাঝে পাতা। কোন পাতা? আমপাতা জামপাতা-- বেনে বউ রূপকথা।। হি হি হি। জলকথা মলকথা। পদতল চুপকথা।। এরপর আকাশ। এরপর বাতাস। এরপর ধরনী, দ্বিধা হও গো মা জননী।এ প্রাণ রাখি কেমনে!

এইখানে এসে সুতো ফুরিয়ে গেছে। সুঁইটা চোখের সামনে ধরলে ফুটোর মধ্য দিয়ে দেখা গেল—বেলা বিলের মাঝখানে উঠে পড়েছে। দরিয়াবানু পাতিলের মধ্যে হাত দিয়ে বলল, ভাইগো, দুটো খুদ কুড়ো ফুটাই।
ততক্ষণে একটি তক্ষক সুড় সুড় করে উঠে গেছে তালগাছে। তালের গায়ে হলুদ বর্ণ আসতে শুরু করেছে। দূরে কোথাও টুব পাখি টুব টুব করে ডাকছে। একটি ডেকে উঠছে—ডুব। আরেকটি উত্তর দিচ্ছে—টুব। একটানা। তক্ষক ভ্রু কুঁচকে আছে। চুলোর উপরে টগবগ করে জল ফুটছে। একদলা লবণ খুঁজতে লেগেছে দরিয়াবানু। টুব পাখি দুটো দুরে সরে যাচ্ছে।

এ সময় ঘাট থেকে মঞ্জু মুন্সী হাঁক দিল, চাচীগো, খবর আছে।

দরিয়াবানু চুলার জ্বাল কমিয়ে দিয়েছে। জল শুকিয়ে এসেছে। সরা দিয়ে ঢেকে দিল। ফুস ফুস করে বাষ্প বের হচ্ছে। সোনা বরুর কপালে হালকা তাপ আছে। পাশ ফিরিয়ে শোয়ালো। বলল, বুনডি, ডালিম পাতা ভাইজা দিমুনে।

মঞ্জু মুন্সীর সঙ্গে পুতলি বেগম এসেছে। উত্তেজনায় টগবগ করছে। ফটাফট করে ছবি তুলছে দরিয়াবানুর ভিটেমাটির। তালগাছে বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে। একটা হাতপা ছড়ানো গাবগাছ। এইখানে মুন্নির জাবনা ছিল। দড়িদড়া এখনো পড়ে আছে। একটা জগডুমুর গাছের ডাল জলের উপর ঝুঁকে আছে। পশ্চিম কোণে বাঁশঝাড়। একটু তফাতে পুকুর। জামগাছের কাণ্ড ঘিরে ডাইয়া পিড়ের বাসা। পুতলি বেগম নোট করছে, এইখানে একটি ডিপ টিউব ওয়েল—ফ্রেস ড্রিংকিং ওয়াটার। গলায় ঝোলানো গ্রীনকার্ড। ইহার পানি আর্সেনিকমুক্ত। চালটা পাল্টে দিতে হবে। খড়ের ছাউনি নট। টিন লাগবে—বাঘমার্কা ঢেউতোলা টিন। একটা মৌবাক্স। একটা দুধের গাই। সেনিটারি পায়খানা। এইখানে থেমে পুতলি বেগম বলে উঠল, ও বুড়ি, তোমার জন্য বায়োগ্যাস প্লান্ট।
মঞ্জু মুন্সীর তেষ্টা পেয়েছে। বুড়ির জলের কলসীর মুখ খোলা। একটু থেমে কলসীরটার দিকে আবার গেল। ওয়াটার বোতল আনতে ভুলে গেছে। পুতলি বেগম তার বোতলটি এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনেরা কি যে করেন, আরেকটু ইসমার্ট হন। উইদাউট ওয়াটার বোতল-- নোট ট্যুর। জলবৎ তরলং।

নকশী কাঁথাটি বারান্দায় বিছানো আছে। নানা এ্যাঙেল থেকে পুতলি বেগম ফটো নিতে লাগল। ক্যামেরায় চোখ রেখে বলল, বুড়িগো, তুমারেতো বললাম, বোররাকের ছবি খাড়তে। কি করছ? শুঁয়াচান পাখি? চিনন যায় না। খাড়বা-- বোররাক উইড়া যাচ্ছে। উপ্রে লেখা—যাও পাখি বল তারে
সে যেন ভোলে না মোরে।
ভাই খুব পছন্দ করবে। ফাটাফাটি। পাখি যাও। ঝামেলা কইরো না। হি হি হি।
বলেই ব্যাগ থেকে দুটো বই আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েল আর বায়োগ্যাস ব্যবহারের সুফল—বের করে কাঁথার ঘরে ভিতরে রাখল। আর রাখল ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ে হার্ডভার্ট উইনিভার্সিটির গবেষণাপাত্র। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা তর্জমা। এবং এক প্যাকেট রাজা কন্ডোম। আলট্রা থিন। ডটেড। বলল, বুড়ি ঘরে রাইখো।
--এইডা কি, সুতা নি?
--কন্ডোম। কনট্রাসেপটিভ। এ ছাড়া উপায় নাই। সেভ দি আর্থ। পৃথিবী বাঁচাও।
--কন্ডোম দিয়া কি করুম। আমি বেওয়া বুড়ি। তিনকাল গেছে। লগে নাবাল্লোগ নাতনী। সুতা দ্যাও। কাঁথাডা শ্যাষ করা দরকার।

আকাশের নিচে ধানক্ষেত। ফড়িং বসে আছে। সুতা না হলে কাঁথা শেষ হবে কিভাবে?
পুতলি বেগম গোছগাছ করতে করতে বললে, সুতা আনা হবে। ভাই আসার আগে কাঁথাডা শ্যাষ কইরো। কাপড় আর সুতা আনুম নে। চিন্তা নাই। ভাই দেখার পরে নতুন কাঁথা শুরু করবা। চিন্তা নাই। শুঁয়াচান পাখি নট। বোররাক উইড়া যাইতাছে। ভাই আসবে।
--ভাই কেডা, মুজিবর? শ্যাখ মজিবর?
--ব্যাকডেটেড। মজিবর হইব ক্যান। ডক্টর ইউনুস।
--ইউনুস নবী?
--বুড়ি দেখি কিছু জানে না। একদম ইললিটারেট। ইউনুস নবী না। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস। বাপ অব মাইক্রো ক্রেডিট। নোবেল পাইছেন। ফ্রেন্ড অব ক্লিন্টন।

সোনাবরু ঘুমিয়ে পড়ার আগে বই দুটো নেড়ে চেড়ে দেখল। টিউবওয়েলের নিচে একটি বালিকা হাত দিয়ে জল খাচ্ছে। কানে হলুদ দুল। তুলতুল। ফুঁ দিয়ে ফোলাল আলট্রা থিন কনট্রাসেপটিভ। ডালিম পাতার ভাজি ঠোঁটে লেগে আছে। সেভ দি আর্থ। একটি তরমুজের চেয়েও বড় নিরাপদ বেলুন। উইড়া যাইওগো পঙ্খি কোনবা দূরের গাঁও। আইনা দিও আমার লাইগা ময়ূরপঙ্খি নাও।। ঘুমিয়ে পড়ার আগে সোনাবরু বেড়ার ফোঁকর দিয়ে দেখতে পেল বিলের উপর দিয়ে শুঁয়াচান পাখি উড়ে আসছে। হাওয়া থেকে সা সা করে নেমে এসেছে। জলের উপর বসেছে। ঠোঁট খুলে বক বক করে বলছে, মনে রেখ, ভুলো না আমায়।
এ সময় দরিয়াবানু পিছন দিক দিয়ে জাংলায় ঢুকে পড়েছে। মরিচগাছ থেকে বেছে বেছে লাল মরিচ তুলছে। দুটো ঢেঁড়শ বত্তি হওয়ার আগেই পট করে তুলে কোঁচড়ে রাখল। পুঁই লতাটিকে মাটি থেকে তুলে দিল ঝামটি গাছের উপর। পুকুর থেকে হাঁস দুটো গলা তুলে হাঁক দিয়েছে, পাক পাক পাক। শুষণী শাক তুলতে তুলতে ভুলে গেল, ফতে মোল্লার মেজ বিবি নটে শাক চেয়েছিল। টাকি মাছের মুড়ো দিয়ে নটে শাক খেতে খেতে মেঝ বিবি তাকে পুনরায় গর্ভধারণের বৃত্তান্ত বলতে চেয়েছে। ঘরামি বাড়ির মহাদেবের নাতিটির মুখে ভাতের মুড়ি ভেজে দিতে হবে। এ সময় মনে হল, পুকুরের জল থেকে ইউনুস নবী ইশরার করে ডাকছেন মাছটিকে। মাছটির পেটে লাল দাগ। আর কিছু দ্রুত হাতে করা শক্ত সেলাই। সেলাই দেখে মা জননী দ্বিধা হও। এ প্রাণ রাখিব কেমনে।

ঘাটে এসে মতিয়ার নীরবে ছোট বস্তাটি নৌকা থেকে নামাল। গামছার খুট দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। ততক্ষণে তালগাছের মাথার কাছে তক্ষকটি বার দুয়েক জিহ্বা বের করে আকাশের দিকে তাকিয়েছে। সূর্য পাটে বসার আগে কেঁদে ফেলে। এইসব দেখে শুনে শুঁয়াচান পাখিটি জলের উপর থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে ডানা মেলে ওড়ে। গান গায়। মতিয়ার পাখিটি দেখতে দেখতে ডেকে ওঠে, সোনাবরু। সোনাবরু।
সোনাবরু তখনি পাশ ফিরতে ফিরতে শুনতে পেল বাপজান মুন্নীকে জাবনা দিতে দিতে বলছে, সোনাবরুর মা, এবার বকনা হবে মনে লয়। সোনাবরুর মা দ্রুত হাতে মুড়ি ভাজতে ভাজতে থেমে গেছে। বলছে, সোনা, বাটিটা নিয়া আয়। গরম গরম হুড়ুম খাইয়া নে মা।

মতিয়ার বস্তাটি নিয়ে ঘরে এল। লক্ষ্মীদিঘা ধান। মুড়ির ধান। মেয়ের কপালে হাত রেখে শ্বাস ফেলল ফোঁস করে। কানের পাশে চুল লতিয়ে উঠেছে। সোনাবরু ঘুমের ভিতরে ফিস ফিস করে বলে উঠল, আম্মি, আম্মি।

এই ফাঁকে দরিয়াবানু পুকুরঘাট থেকে আনাজগুলো ধুয়ে নিয়েছে। গলা তুলে বলল, মতি, জাম্বুরাটা নিয়া যাস, বাপ।
মতিয়ার বস্তাটির মুখ বেঁধে রাখল। হাঁস দুটো উঠোনে চুপ করে বসে আছে। ডানা থেকে জল পড়ছে টুপটাপ। বাক্সটির মুখ খুলে দিতেই নড়ে চড়ে উঠল। ভিতরে ঢুকে শেষবার পাক পাক করে হাঁক দিল। বাক্সর দরোজা টেনে দিয়ে দরিয়াবানু বলল, অ মতি, জাম্বুরাটা নে না বাপ। ছোট বিবিরে আসতি কইস। শ্বওরের ভিটা। না আসলি চলে!
নৌকাটি তালগাছের আড়াল হতে হতে মতিয়ার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বর্ষার জল বাড়ে। সোনাবরু নিদ যায়। নিদ্রার ঘোরে বলে ওঠে, আম্মি আম্মি।

কোনবা দ্যাশে যাওরে পঙ্খি
কোনবা তোমার ঘর,
আমার খবর খবর লৈয়া যাইও
সেইনা তেপান্তর।।

এ সময় বিলের মাঝখান থেকে চাঁদ ওঠে। একটু জলে ভেজা। জলের গন্ধ পেয়ে ঝুপ করে লাফ মেরে ওঠে লবটুলি মাছ। মাছের পেটের কাছে লাল। কাটা দাগ। তাই দেখে বাঁশঝাড় থেকে দুটো পাতা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ঝরে পড়ল। দরিয়াবানু পাতা দুটো কুড়োয়। তক্ষকের ছায়া খসে পড়ে। দরিয়াবানু যত্ন করে ছায়াটি কুড়োয়। আকাশ থেকে শুঁয়াচান পাখির মায়া ঝরে পড়ে। দরিয়াবানু ঝিমুতে ঝিমুতে মায়াটুকু কুড়িয়ে নেয়। এই মায়ার মর্ম অপার। সোনাবরুর চোখেমুখে এই মায়াটুকু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ধরণী, দ্বিধা হওগো মা জননী। এ প্রাণ রাখি কেমনে।


মন্তব্য

নাশতারান এর ছবি

অদ্ভুত সুন্দর, জাদুমাখা।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

কুলদা রায় এর ছবি

আমরাতো জাদুর জগতেই থাকি। ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

সুরঞ্জনা এর ছবি

অসামান্য।
............................................................................................
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

কুলদা রায় এর ছবি

ধন্যবাদ। কিন্তু সামান্য কথা বলার চেষ্টা করছি।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

সৈয়দ আফসার এর ছবি

আমি মোহিত...
ভালো থাকুন।

__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!

__________♣♣♣_________
না-দেখা দৃশ্যের ভেতর সবই সুন্দর!

কুলদা রায় এর ছবি

কবি, ধন্যবাদ।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

তাসনীম এর ছবি

অসাধারণ...

+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার বর্ণনা! খুব ভালো লাগলো।

সুমিমা ইয়াসমিন

তিথীডোর এর ছবি

অদ্ভুত সুন্দর!!!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অপেক্ষায় আছি পরের পর্বের।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

তাজিন [অতিথি] এর ছবি

সত্যিই জাদুমাখা.......।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।