আমার অক্ষম ব্লগরব্লগর

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি
লিখেছেন প্রদীপ্তময় সাহা [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৮/০৫/২০১৩ - ৮:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকাল মাঝে মাঝেই নিজেকে খুব অসহায় লাগে। জাপটে ধরে নিরাপত্তাহীনতা। মনে হয় দিন দিন যেন বেঁচে থাকাটা আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন শুনতে হয় এদিক-ওদিক, খুচরো-বড়, চেনা-অল্প চেনা- অচেনা মৃত্যুর অথবা জীবনের বিপন্নতার খবর। ছোটবেলায় গাছপালা, পশুপাখি, দাদু-দিদা মিলিয়ে মিশিয়ে প্রাণের যে বি-শা-ল বৃত্ত ছিল, তা যেন ছোট হতে হতে আমাকে ফাঁস হয়ে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে। কি জানি হয়তো তখনও চারপাশটা এরকমই ছিল, শুধু আমার চোখে ছিল রঙ-চশমা।

আমাদের জীবন তো অসংখ্য ভগ্ন সময়ের সমষ্টি। তা মিলিয়েই আমাদের আয়ু। মায়ের নরম গর্ভ থেকে যে শরীরটাকে নিয়ে আসা, অনেক আত্মীয়-পরিজন-কাছের মানুষের ভালবাসায় যে শরীরটাকে নিয়ে একটু একটু করে বড়সড় একটা মানুষ হয়ে ওঠা, তাকে সাথে নিয়েই তো আয়ুর সময় পথে যাত্রা। সেই যাত্রা পথের হাজারো ঘটনা, হাজারো সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান, ঘাত-প্রতিঘাতের সংমিশ্রণে পাওয়া এই মন। উপলব্ধি আর স্বপ্নের আনাগোনা সেখানে নিরন্তর। মাত্র কয়েকটা বছরের এই অমূল্য সঞ্চয়ে তবে কেন নেমে আসে অযথা ক্ষয়, অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতি বা আকস্মিক চিরকালীন সমাপ্তি।

তাও মেনে নিয়েছি ভাগ্যের অজুহাতে। মেনে নিয়েছি প্রকৃতির খেয়ালে হারিয়ে ফেলাকে। অসহায়তার বাধ্যবাধকতায় মুখ ভার করে দেখে গিয়েছি বন্যা, সাইক্লোন, ভূমিকম্প, দাবানল। টিভির পর্দা থেকে, পেপারের পৃষ্ঠা থেকে উপচে পড়েছে সারি সারি পচা-গলা লাশ। আমি বোকার মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছি তাদের দিকে। তারাও একদিন আমারই মত করে বাঁচত, হাসত, কাঁদত, স্বপ্ন দেখত। ভেতরে চেপে বসতে চেয়েছে ভয়। তবু নিজেকে সাথে নিয়ে পা বাড়িয়েছি সামনের দিকে। কিছু পরে ফিকে হয়ে গেছে তাদের মুখ। আর এই বাধ্যতামূলক এগিয়ে চলাকে নাম দিয়েছি জীবন।

কিন্তু_ _ _

যখন সেই সকল খোকলা নষ্ট জীবন অথবা মাংসদলা হয়ে যাওয়া লাশের পেছনে দেখি আরও কিছু মানুষেরই মত দেখতে বিকৃত জীবের স্বার্থ, লোভ, লালসা, অবহেলা তখন তাকে ভাগ্য বলে মানতে পারিনা। ঘৃণা করি সভ্য মানুষের সভ্যতাকে, ফিরে যেতে চাই অরণ্যের প্রাগৈতিহাসিক নিয়মে। যেখানে আয়ু অনেক ছোট, মৃত্যু অনেক গাঢ় তবু নেই অপ্রয়োজনীয় প্রাণনাশ।

যখন যুদ্ধবাজ অথবা সন্ত্রাসবাদীর বোমায়, গুলিতে ঝাজরা হয়ে যায় অগুনতি মানুষের বুকের খাঁচা, চামড়া-মাংস ছিঁড়ে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে রক্ত তখন সেটা কারও ভাগ্যের দোষ থাকে না, থাকে কিছু বিকৃত, পচে যাওয়া মানুষের উন্মত্ততা। এই একই উদ্দামতা লুকিয়ে থাকে পাগলকে মারা ঢিলের মধ্যে, পাখিকে গুলি করার মধ্যে, একজন প্রতিবন্ধীকে করা বিদ্রূপের মধ্যে, একটা ফুটফুটে মেয়ের শরীরে মনে যন্ত্রণার দগদগে ঘা গেঁথে দেওয়ার মধ্যে অথবা কোন কন্ডাক্টারের নির্মম অবহেলার মধ্যে।

ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-চিন-জাপান-আফ্রিকা-আমেরিকা-ব্রিটেন-ইরাক-ইজরায়েল, সমস্ত দেশ-মহাদেশ নির্বিশেষে, মানুষ-পশু-পাখি-গাছ সমস্ত প্রাণ নির্বিশেষে আজ আক্রান্ত তারাই যারা নির্বিবাদী। মানুষের হিংস্র অবহেলাতেই কোথাও বিল্ডিং ভেঙে পড়ে, কোথাও ঘটে মর্মান্তিক রেল অথবা সড়ক দুর্ঘটনা, তারই লালসায়-রক্ত পিপাসায় কোথাও রাজপথে লাঞ্ছিত হয় মধ্যবিত্ত তরুণী, কোথাও গ্রেনেড আর যুদ্ধবিমানে তছনছ হয়ে যায় অনেক অনেক সাজানো পরিবার, ছোট ছোট স্বপ্ন।

অনাবশ্যক ক্ষয়-ক্ষতি আর মৃত্যুর অন্তহীন মিছিলে ক্লান্ত হয়ে পড়ি আমি। রাগে দুঃখে জ্বলে উঠে মনে হয় চিৎকার করে উঠে দাঁড়াই অনেক অনেক বি-শা-ল হয়ে, মেরে-পিটিয়ে-বুঝিয়ে যেভাবে হোক বন্ধ করি এই ধ্বংসলীলা। শান্ত সবুজ হয়ে উঠুক চারপাশ, বেজে উঠুক হালকা বাঁশি, টুংটাং পিয়ানো, ঝরে পড়ুক মুক্তোর মত খিলখিল হাসি।

কিন্তু আমার বি-শা-ল হয়ে ওঠা অপেক্ষা করে যায় সমষ্টির। একদিন হয়তো আরব বসন্ত, শাহবাগ কিংবা দিল্লীর মিছিল এক হয়ে বি-শা-ল একটা আন্দোলন গড়ে উঠবে গোটা পৃথিবীর বুকে। সেই আন্দোলন হবে লোভ-লালসা-ক্ষমতাস্পৃহা-অবহেলা-উন্মত্ততার বিরুদ্ধে, সেই আন্দোলন হবে গোটা পৃথিবীর নির্বিবাদী, শান্তিপ্রিয় মানুষের।

ততদিন আমি চেষ্টা করে যাব সেই সৈনিক তৈরী করতে যার হাতে থাকবে ফুল। ততদিন আমি লিখে যাব আমার অক্ষম ব্লগরব্লগর।


মন্তব্য

কাজি মামুন এর ছবি

আপনার কাব্যময় লেখাটা পড়ে ভালই লাগল। তবে তার চেয়েও ভাল লাগল আপনার ফিরে আসা। আসলেই আমাদের জীবন ভঙ্গুর মুহূর্তগুলির সমষ্টি, হয়ত থমকে তাকাই, ফ্যালফ্যাল চোখে, তবু বাধ্যতামূলকভাবে এগিয়ে যাই - আর তাই হচ্ছে জীবন। কিন্তু এ কি সত্যিকারের জীবন? ভগ্ন মুহূর্তগুলিতে আমরা দগ্ধ হই না? পরাজয় আমাদের চিত্তকে প্রতি মুহূর্তে পিষে ফেলে না?

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ মামুনভাই।

ঠিকই বলেছেন,
পরাজয় আমাদের পিষে ফেলে, কিন্তু আরও বেশি করে আঘাত করে নিজেদের দুর্বলতা।

তারেক অণু এর ছবি

লিখে যান, সবসময়

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ দাদা।
ভাল থাকবেন।

চরম উদাস এর ছবি

চলুক
কলম চলুক, ওই একটাই তো অস্ত্র আমাদের।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

ঠিকই বলেছেন, ঐ একটাই আমাদের অস্ত্র।

অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে।
ভালো থাকবেন।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ব্লগর ব্লগর টা কিন্তু পুরোপুরি অক্ষম না - একজন দুইজন করে নাড়া দিয়ে যাচ্ছেন আপনার কাব্যময় লেখনী দিয়ে - আস্তে আস্তে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে বাড়তে তা একসময় হয়তো নাড়া দিয়ে ফেলবে গোটা জাতিকে - কে জানে হয়তো পৃথিবীটাকেই একসময়। আর তখনই আমাদের বি-শা-ল হয়ে ওঠা হবে। এই আশাতেই লিখতে থাকা- লিখতে থাকুন। আপনার মত সুন্দর লিখিয়েরা আছে বলেই না আমরা আশায় বুক বেঁধে থাকি।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

লইজ্জা লাগে
হাসি
উৎসাহ দেবার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
এরকম সুন্দর মন্তব্যই তো আমাদের মত লিখিয়েদের সম্পদ।

ভালো থাকবেন।

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অতিথি লেখক এর ছবি

একদিন হয়তো আরব বসন্ত, শাহবাগ কিংবা দিল্লীর মিছিল এক হয়ে বি-শা-ল একটা আন্দোলন গড়ে উঠবে গোটা পৃথিবীর বুকে। সেই আন্দোলন হবে লোভ-লালসা-ক্ষমতাস্পৃহা-অবহেলা-উন্মত্ততার বিরুদ্ধে, সেই আন্দোলন হবে গোটা পৃথিবীর নির্বিবাদী, শান্তিপ্রিয় মানুষের।

চলুক
অপেক্ষায় আছি.....

*****************
সুবোধ অবোধ
*****************
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কেন এত বোকা হয়??!!!

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

ভালোলাগা জানাবার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।

খুব ভালো থাকবেন।
আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।