বৃষ্টিব্লগর

রাহিন হায়দার এর ছবি
লিখেছেন রাহিন হায়দার [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৩/১২/২০০৯ - ৪:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।

একটু আগে এমন এক বৃষ্টি হয়ে গেল যে আমার ঘরের চালে ক'টা টুপটাপ শব্দ হল একটু খাটলে বলে দেয়া যেত। অথচ মেঘ ক'রে এসেছিল ভালোই। ভাবখানা, আবিদজান ভাসিয়ে না নিতে পারলে মেঘদল তার নাম পালটে শিরোনামহীন করে ফেলবে। অথচ কিসের কী, একটু পরই সেই চিরচেনা সূর্য একই প্রতাপে দেখা দিল। আফ্রিকার আকাশ, মেঘ আর সূর্যের সাথে বাংলা মায়ের ও তিনখানার কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনি, শুধু সূর্যটা হালকা একটুখানি বেয়াড়া। শুনলাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আইভরি কোস্টের উচ্চতা নাকি বাংলাদেশের চাইতে ঢের বেশি, যাচাই করিনি। তবে তারপর থেকে মেঘগুলোকে একটু কাছে মনে হয়, আর মনে হতেই হেসে ফেলি।

বৃষ্টি প্রসঙ্গে ফিরে যাই। এসেছি পাঁচ মাস পেরিয়েছে, এর মধ্যে মাত্র একবার এক রাতদুপুরে সেই ঝমঝমে রণসঙ্গীত গাওয়া বৃষ্টির অভিজ্ঞতা হয়েছে। তারও সময়ব্যাপ্তির তুলনা যদি দেশের বৃষ্টির সাথে টানি, হাস্যকর ঠেকবে। এখানকার বৃষ্টির বার্তা মেঘেরা নিয়ে আসে ঢাকঢোল পিটিয়ে, যেমনটা ঘটল একটু আগে, একটু খেয়াল করলে ঠিকই কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে নীল রঙটা দেখতে পাওয়া যায়। শিয়ালের মহাধুমধামে বিয়ে হচ্ছে অহরহ। যদিও এসেছি আধবছরও ঘোরেনি, বৃষ্টিবাদলা আরো জাঁকিয়ে আসার মৌসুম শেষ কিনা সে কথা বলতে পারছি না। তবে আমার ধারণা সে ধরণের কোন মৌসুমের অস্তিত্ব এ অঞ্চলে নেই। ধারণার কারণ হল, এখন পর্যন্ত কোন আবিদজানবাসীর হাতে ছাতা দেখিনি এবং সস্তা বাজারগুলোতেও ছাতা চোখে পড়েনি। আছে নিশ্চয়ই, হয়তো অপরিহার্য বস্তুর আওতায় পড়ে না বলেই সামনের সারিতে রাখা হয় নি (রোদে তাদের অরুচি নেই)। সুতরাং ধরে নিয়েছি এখানকার বৃষ্টি এমনই, রাস্তা কোনরকমে ভিজলেও মন ভেজে না। বৃষ্টির ওপর রাগ করে লাভ নেই, প্রবাসী অলস ও ভোজনরসিক বঙ্গদেশীর মনোরঞ্জণের দায় তার না। আকাশে কালো মেঘ দেখলেই পুরোনো অভ্যাসবশত বিছানা আমাকে ডাকতে থাকে। যদিও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রবাস জীবনে বৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার কোন প্রভাব নেই, তারপরও একদিন দুনিয়া ভাসানো বৃষ্টি হলে জীবনযাপনে (পড়ুন 'ঘুমে') দেশীয় যে আমেজটা আসত তার কথা ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায়। দেশে থাকতে বর্ষামুখর সন্ধ্যাবেলাগুলোতে দুম করে বিদ্যুৎ চলে গেলে জানালার পাশে গরম চা নিয়ে বসার স্মৃতিগুলো উঁকি দিলেই আমি দুরদার করে তাদের তাড়া লাগাই, অযাচিত যন্ত্রণা সব। আকাশ উপুড় করা বৃষ্টির দিনে বসতবাড়ির সামনের গলিটুকু পেন্টুলুন গুটিয়ে পার হতে কেমন লাগে বেরসিক আবিদজানবাসী কোনদিনই টের পাবে না, জানবে না রবিবাবুর প্রাসঙ্গিক গানগুলোর মাজেজা, সদ্য চুলা থেকে নামানো খিচুড়ির ওম। শুধু বৃষ্টি না, শত শত বিষয়ানুগ রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগ করতে পারার জন্যই বঙ্গজনম সার্থক মনে হয়, বাঙ্গালিয়ানার প্রেমে হাবুডুবু খাই ইদানিং।

আইভরি কোস্টের সব জায়গাতে বৃষ্টির ধরণ যে এমনই তা না। দেশটা আয়তনে বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। অথচ লোকসংখ্যা ঢাকার চাইতে কম! পশ্চিমে দিকে 'মান' বলে একটা জায়গা আছে, পাহাড়ী অঞ্চল, শুনেছি সেখানে বৃষ্টির পরিমাণ একটু বেশি। কত আর বেশি হবে, আমার নাকটা উঁচুই থাকে। অতলান্তিক মহাসাগর ঘেঁষে অবস্থানই কি আবিদজানে বৃষ্টির ক্ষণস্থায়ীত্বের কারণ? প্রশ্ন করেই খালাস আমি, কারণে আগ্রহ নেই। অতলান্তিক দেখার প্রাথমিক উত্তেজনাও কেটে গিয়েছে। বাসস্থান থেকে সৈকত আধা ঘণ্টার পথ মাত্র। নিয়মিত বিরতিতে দর্শনের ফলে মহাসাগর মহাশয় পানসে হয়ে গিয়েছেন, আর যেতেই ইচ্ছা করে না। এ উপলদ্ধিও হয়েছে যে নদীরাই বেশি আকর্ষণীয়া। এখানে নদনদী বিশেষ চোখে পড়েনি। ইচ্ছা জেগেছে পশ্চিমের পাহাড়ি দিকটা দেখার।

২।

সেদিন একজন স্থানীয়কে জিজ্ঞেস করলাম 'আবিদজান' নামের শানে নযুল কী? উনি জানতেন না, আরেকজনের কাছ থেকে উত্তরটা শুনে এসে পরে আমাকে জানালেন। ফরাসীরা যখন প্রথম আসে, তারা এক কৃষককে জিজ্ঞেস করেছিল, "তুমি কী কর?" সে স্থানীয় 'এব্রিয়ে' ভাষায় উত্তর দিয়েছিল- "আবিদজিন", অর্থাৎ "আমি ফসল কাটি"। আরো ক'জনের কাছ থেকেও একই উত্তর পেল তারা। সে থেকেই আবিদজান। ঢাক থেকে ঢাকা এটুকু জানি (ঠিক কি?), এর চে' বেশি কারো জানা থাকলে জানালে খুশি হব খুব। বাংলাদেশের বাকি বড় শহরগুলোর নামের ইতিহাসও জানতে আগ্রহী আমি।

৩।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের ৫ জন সাংসদ রাষ্ট্রীয় সফর ক'রে গেলেন এখানে। সফরের অংশ হিসেবে তাঁদের সাথে 'বালেয়া' নামের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেখানে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় পুনর্নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। অতিথিদের সম্মানে একটি স্থানীয় সভা হল। সেখানে গ্রামের প্রধান বক্তৃতা দিলেন স্বগোত্রীয় ভাষায়। আমার ধারণা হয়েছিল তিনি ফরাসী জানেন না। পরে ভুল ভাঙল। চমৎকার লাগল তাঁর মাতৃভাষা ব্যবহারের অভ্যাসটি। সভার পর ঐতিহ্যবাহী গানবাজনা আর নৃত্য হল। তেমন আকর্ষণীয় কিছু না। ভিন্নতার যতটুকু আবেদন তা ফুরিয়ে গেলেই পানসে লাগে। অভিজ্ঞতা হিসেবে খারাপ না যদিও। সমবেত তালবাদ্যবাদনই যা একটু ভালো লেগেছে।

৪।

এটুকু গতরাতে লিখে শুয়ে পড়েছিলাম। সকালে উঠে শুনি গতরাতে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে (আমার ঘুম ভাঙেনি, বলাই বাহুল্য)। বৃষ্টির নাগরিক বোধের প্রশংসা করতে হয়, খালি মাঝরাত্তিরেই ঝেপে আসে!


মন্তব্য

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

রোজনামচা বা দিনলিপি পড়তে গেলে লেখা এতো টানটান থাকে না! আপনার বর্ণনাভঙ্গীটা চমৎকার, পাঠককে ধরে রাখে।
আমি যেখানে থাকি সেখানকার বৃষ্টি হিমশীতল, প্রথম এসে বাল্যখিল্যতা নিয়ে ভিজেছিলিম; দু'দিন কালাজ্বর! সে থেকে বৃষ্টি মাড়িয়ে চলি, হাতে নিই না। যদি-ও কাছেরই।
----------------------------------------
ঢাকার মৌন ঘ্রাণে বকুলফুলের নাভি
----------------------------------------
হা-তে এ-ক প্র-স্থ জো-ছ-না পা-ড়ে-র ঘ্রা-ণ

রাহিন হায়দার এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আশরাফ ভাই। আরো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী চাই আপনার কাছ থেকে।
________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

তিথীডোর এর ছবি

"ভাসিয়ে নিতে না পারলে মেঘদল তার নাম পালটে শিরোনামহীন করে ফেলবে"
হাঃহাঃহাঃ, মজা পেলাম !

দারুণ সাবলীল ভঙ্গি ,বরাবরই আগ্রহ নিয়ে পড়ি..
টুপটাপ শব্দের বৃষ্টিবিলাস বেশি ভাল লাগলো!!

--------------------------------------------------
"সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে..."

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

রাহিন হায়দার এর ছবি

ধনেপাতা!!
________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

মামুন হক এর ছবি

দারুন লাগলো রাহিন ভাই। আবিদজানে আপনার প্রবাস জীবনের আরও কাহিনী শুন্তে চাই।

রাহিন হায়দার এর ছবি

দেঁতো হাসি

তবে আপনি করে বললে অস্বস্তি হয়, বয়সে অনেক ছোটই হব আপনার।
______________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

তারানা_শব্দ এর ছবি

কুব বালু লাগলু লিকাটা ! তারানার থেকে ৫ টা তারা নিন!!!

তা আপনি সারাদিন যেভাবে ঘুমায় কাটাচ্ছেন চাকরি কি আছে নাকি নাই ? দেঁতো হাসি

"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"

রাহিন হায়দার এর ছবি

সারাদিন ঘুমালাম নাকি?
________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

ভ্রম এর ছবি

চমৎকার লেখা! খুব ভালো লাগলো...

রাহিন হায়দার এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ! দেঁতো হাসি
________________________________
তবু ধুলোর সাথে মিশে যাওয়া মানা

ওডিন এর ছবি

খুব ভালো লাগলো আপনার বৃষ্টিব্লগর। বৃষ্টিব্লগর শব্দটাও খুব পছন্দ হলো- টাইপ করতেই মজা লাগছে, বৃষ্টিব্লগর বৃষ্টিব্লগর বৃষ্টিব্লগর। বাহ! হাসি
______________________________________
আসলে কি ফেরা যায়?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।