হারানোর খাতায়

রাহিন হায়দার এর ছবি
লিখেছেন রাহিন হায়দার [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১৮/১১/২০০৯ - ১:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেদিন খোমাখাতা খুলেই মেজাজ টং হয়ে গেল। জনৈক সচল তার স্ট্যাটাসে টাঙ্গিয়ে রেখেছে, "মেঘদলের কনসার্টে যাবেন?"। তারিখটা আগেই জেনেছিলাম, ইচ্ছা করেই ভুলে গিয়েছিলাম। মনোকষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী? নচ্ছাড় বালক সব ভন্ডুল করে দিল। এর কোন অর্থ হয়? তোর যেতে ইচ্ছা হয়েছে তুই যা, এভাবে রাষ্ট্র করার মানে কী? ঘরের দেয়ালে সাঁটা বিশ্ব মানচিত্র আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসতে লাগল। হাসিটার সাথে বালকের হাসির কিঞ্চিৎ মিল আছে। আমি না চাইলেও আমার মস্তিষ্ক যোগবিয়োগ করে বের করে ফেলল মেঘদল যখন বঙ্গদেশে মঞ্চ কাঁপাবে এখানে তখন ক'টা বাজবে। কী যন্ত্রণা! 'শহরবন্দী' বের হবার পর থেকে মেঘদল মিডিয়া প্লেয়ারে স্থায়ী আবাস গেড়েছে। দু'একবার উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছিলাম, লাভ হয়নি। এমনই সম্মোহিত আমি তাদের সঙ্গীতে!

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হলে কথা ছিল। কনসার্ট শেষে বালক আমার দেয়ালে হা-বিতং করে লিখল, সে সামনের সারিতে বসে পুরো কনসার্ট দেখেছে, ওরা সব গান গেয়েছে, তার খুব মজা লেগেছে ইত্যাদি। আমি কল্পনায় পরিষ্কার দেখতে পেলাম সব দর্শক গলা মিলিয়ে 'রোদের ফোঁটা' গাইছে- "শূন্যতার শোকসভা, শূন্যতার যত গান, দিলাম তোমার মুকুটে আমার যত অভিমান"। আমি পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে রইলাম। কোনদিন বালকের কোন ক্ষতি করেছি বলে মনে পড়ল না। শুধু পাশ করার পর একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গিয়ে ওর বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম, তাও তার অনুপস্থিতিতে। বালকের নাম রায়হান আবীর।

আবেগ কিছুটা বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে। হয়তো প্রথম দীর্ঘ প্রবাস জীবন বলে ছোটখাট ব্যাপারগুলোও বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেশে থাকলেও হয়তো অন্য কোন ব্যস্ততায় যাওয়া হত না কনসার্টে (যদিও সেটার সম্ভাবনা শূন্য মনে হচ্ছে এখন)। চাইলেই যেতে পারবো না, এ ব্যাপারটাই আসলে খোঁচা মারে। মেঘদলের গান শুনলেই কেন যেন পড়ন্ত বিকেলে চারুকলার উলটো দিকে বসে লাল চা খাওয়ার দিনগুলো মনে পড়ে যায়, যদিও সেখানে মাত্র একদিনই কথা হয়েছিল মেঘদলের বংশীবাদকের সাথে।

বংশীবাদকের কথা বলতে মনে পড়ে গেল, মাঝে একটা দূর্লভ ঘটনা ঘটে গেছে ঢাকায়। এসেছিলেন পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। আমার যখন জ্ঞানগম্যি হয়নি তখন নাকি একবার এসেছিলেন। এবার যখন এসেছেন তখন জ্ঞানগম্যির ঠেলায়(!) আমাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। ঈশ্বর থেকে থাকলে বাঁশীতে ঈশ্বরের পরেই তাঁর স্থান হত, এ কথা আমি মানিনা। ঈশ্বরের পক্ষে সমস্ত জাগতিক ও মহাজাগতিক চিন্তা ঘাড়ে নিয়ে এমন বাজানো সম্ভব হত না। দেশে গেলে মেঘদলের কনসার্ট হয়তো দেখা যাবে, কিন্তু এ জীবনে তাঁর অলৌকিক বাদন সামনে বসে দেখার সৌভাগ্য আর নাও হতে পারে। ভদ্রলোকের বয়স তো আর কম হল না।

হারানোর তালিকায় আরো আছে। মহাধুমধামে কলেজের পুনর্মিলনী হল কিছুদিন আগে। খোমাখাতা ছবিতে সয়লাব হয়ে গেল। মজার ব্যাপার হল, কলেজ থেকে বের হবার পর কলেজের ছোট বড় যাদের সাথে পরিচয় হয়েছে, উপস্থিত প্রাক্তন সহপাঠীদের চাইতে তাদের সংখ্যা একেবারে কম না। অনেকের ক্ষেত্রে জানতামই না যে আমাদের কলেজ একই। যেতে পারলে আড্ডাটা কেমন জমত চিন্তা করতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। দেখতে ইচ্ছা করল না আর রৌদ্রোজ্জ্বল ছবিগুলো। মাথার ভেতর যখন স্মৃতির ফিতে ঘুরতে শুরু করে তখন ছবি দেখে আর কী হবে? আমি ফায়ারফক্স বন্ধ করে দেই।

নাহ, আর চিন্তা করতে চাই না। আরো ভাবলে হারানোর তালিকা শুধু বড়ই হবে। ব্যাপারটা বোধহয় দুঃখবিলাসের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। এসব হা-হুতাশ অযৌক্তিক। জানি ভুল করে কিছু চাই নি। শুধু হারানোর হিসাব করলে বেঁচে থাকাই দায়। কী হলে কী হতে পারত তা ভেবে শ্বাসকে দীর্ঘায়িত হতে দিলে জীবনেরই অবমাননা। তারচেয়ে বরং বর্তমানেই বেঁচে থাকি। অন্তত চেষ্টাটা থাকুক। মনে পড়ল চৌরাসিয়ার দু'টো ফিউশন এলবামের নাম, একটা 'now', আরেকটা 'here'। কম্পুতে বাজতে থাকে মেঘদলের গান। আমিও গলা মেলাই- "তবু গল্প লিখে যাওয়া, তবু স্বপ্ন স্বপ্ন খেলা, তবু নদীর মত চলি সারাবেলা"। গাইতে গাইতে আবার অভ্যাসবশত ফায়ারফক্সে ক্লিক পড়ে যায়। এফ এ লিখে এন্টার। আর কী আশ্চর্য, দেখি এই কথাগুলোই জ্বলজ্বল করছে রায়হান আবীরের স্ট্যাটাসে।


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

হায় পরবাস...মন ভেজানো পোষ্ট!

মৃত্তিকা এর ছবি

সুন্দর বিষাদময় দিনপঞ্জি।

মূলত পাঠক এর ছবি

চমৎকার লাগলো লেখা!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঢাকায় করা পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার এবারের অনুষ্ঠানে যাবার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। দুর্ভাগ্য বলছি এই কারণে যে অনুষ্ঠানটি দেখে আমার নিজের কাছে প্রতারিত হবার অনুভূতি হয়েছে। গোটা অনুষ্ঠানে পণ্ডিতজী ঠোঁট থেকে বাঁশি নামিয়ে মুছেছেন কয়েকশো বার। মূল বাজনা বাজিয়ে গেছেন তাঁর পেছেনে বসে থাকা সহশিল্পী। সাথে ছিলেন এক ঢোলক শিল্পী যাঁর যন্ত্রের টিউনিং করা ছিলনা। যতক্ষণ ঢোলক বেজেছে ততক্ষণ দর্শক-শ্রোতাদের কানের উপর অত্যাচার চলেছে। পাখোয়াজ শিল্পী দুই হাত নামিয়ে মিনিট দুয়েক বসেছিলেন যখন, তখনো পাখোয়াজ বেজে গেছে কোন কেরামতিতে তা বুঝতে কারো অসুবিধা হবার কথা না। তবে তবলা শিল্পী নমস্য ব্যক্তি। তিনি যতক্ষণ বাজিয়ে গেছেন ততক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়েছে।

ঝোলখোর ভাড়াটে বিজ্ঞজন প্রশংসায় পত্রিকার পাতা যতই ভরিয়ে তুলুক, যারা সচলদের আয়োজিত চ্যারিটি কনসার্টে শিল্পী আবদুল হাকিমের বাঁশি শুনেছেন, অথবা যারা ক্যাপ্টেন আজিজের বাজনা শুনেছেন তাদের কেউ পণ্ডিতজীর উপরোক্ত কনসার্ট শুনে থাকলে বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়বেন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রাহিন হায়দার এর ছবি

আমার শ্রবণ-অভিজ্ঞতা এম্পিথ্রি নির্ভর। উনার দক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। বলতেই হবে বেশ অবাক হলাম।

...............................
অন্ধকারে অন্ধ নদী
ছুটে চলে নিরবধি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমি যখন ঢাকার বাইরে শুটিংয়ে, তখন এসএমএস পাই মেঘদলের কনসার্টের... মনে মনে তিনটা গালি দিছিলাম। যদিও আমি জানি, ঢাকায় থাকলেও আমার যাওয়া হইতো না। আলসেমি কে করবে?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ওডিন এর ছবি

শুধু হারানোর হিসাব করলে বেঁচে থাকাই দায়। কী হলে কী হতে পারত তা ভেবে শ্বাসকে দীর্ঘায়িত হতে দিলে জীবনেরই অবমাননা। তারচেয়ে বরং বর্তমানেই বেঁচে থাকি।

হক কথা! বেঁচে থাকাটাই একটা বিশাল পরিশ্রমের আর সময়সাপেক্ষ কাজ। এত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র হিসাবনিকাশ করতে ব্যস্ত থাকলে বাঁচবোটা কখন? হাসি

---------------------------------------------
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা। চিন্তিত

রাহিন হায়দার এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ সবাইকে।

...............................
অন্ধকারে অন্ধ নদী
ছুটে চলে নিরবধি

রায়হান আবীর এর ছবি

রাহিন ভাই, আপনাদের ভীষণ মিস্করি। আপনাদের শঙ্খ গানটা গত ছয়মাস ধরে আমার মোবাইলের প্লে লিস্টে আছে। হয়তো আরও অনেক অনেক সময় থাকবে।

...শূণ্যতা... এই লাইনটায় চিত্‍কার করে গাওয়ার সময় আপনার আর ফাহিম্ভাই এর কথা মনে হচ্ছিল খুব।

খুব সুন্দর একটা লিখা।


পুচ্ছে বেঁধেছি গুচ্ছ রজনীগন্ধা

রাহিন হায়দার এর ছবি

শঙ্খের ব্যাপারে আর কী বলব? লইজ্জা লাগে লইজ্জা লাগে লইজ্জা লাগে

...............................
অন্ধকারে অন্ধ নদী
ছুটে চলে নিরবধি

রায়হান আবীর এর ছবি

(দুইবার আসছে)

আনন্দ [অতিথি] এর ছবি

কী পেতে পারতাম, বা কী পেলাম না তার চেয়ে বরং কী পাচ্ছি আর কী পেতে পারি সেই হিসাবে আমি বেশি মনোযোগী। তাই আমি সদা সন্তুষ্ট, সদা আনন্দিত।

তোর কূপদেশ অনুযায়ী মেঘদল এখনো নামাইনি। কিন্তু মেঘদল নিজেই আমার কাছে আসছে। সেদিন জনৈকার সাথে চ্যালাপ করার এক ফাঁকে রোদের ফোঁটা উপহার পেলাম। এখন বুঝতে পারছি কেন নামাতে বারণ করেছিলি। খুব ভাল কোনো গান শুনলে কী তোরও খুব অসহায় লাগে? শঙ্খেই যা একটু স্বান্তনা খুঁজি। মন খারাপ

লেখা চ্রম হচ্ছে।

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

জনৈকার থেকে নিয়মিত বিরতিতে গান উপহার পাইলে আর নামায়া কি করবা ... উপহার পাওয়াটাই তো বেশি উপকারি তোমার জন্য তাইনা ... কি কও ?
--------------------------------------------------------

--------------------------------------------------------

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

মেঘদলের প্রতি সেই আবেগটা পাইনাই, তাই সেদিন মেঘদলের কনসার্টের বদলে বিশাল এক সচলাড্ডায় ছিলাম। সেটাও অসাধারন উপভোগ্য ছিল দেঁতো হাসি

চৌরাসিয়া সাহেবের বাঁশি-বাদন বিশেষ গোষ্ঠী'র মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলো। তাই ইচ্ছা থাকা সত্বেও সেখানে যেতে পারিনি মন খারাপ

কলেজে'র অসাধারন দিন স্মৃতিচারনের মাঝে ফিরিয়ে আনার মাঝে অদ্ভুত এক কষ্ট আছে। দিনশেষে মনে হয়, এসব কষ্ট আরো হাজার রকমের সুখের চেয়েও অনেক বেশি কাম্য।
_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দারুণ লেখা।

আই.ইউ.টি-র নাকি? হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।