"চারুলতা" অ্যানাটমি (প্রথম পর্ব)

রায়হান আবীর এর ছবি
লিখেছেন রায়হান আবীর (তারিখ: বিষ্যুদ, ০২/১০/২০০৮ - ১:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিখ্যাত বিখ্যাত বইয়ের অনূকরণে চলচ্চিত্র তৈরী করা কোন নতুন ঘটনা নয়। অনেকে বইয়ের কাহিনীর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে তৈরী করেছেন জগা খেচুড়ি। কেউ বা জগা খেচুড়ির ভয়ে কাহিনী পরিবর্তনের কারণে হয়েছেন সমালোচিত। এর মধ্যে সফলও হয়েছেন অনেকে। আজকে তেমনি একটি সিনেমা নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প "নষ্টনীড়" নিয়ে সত্যজিতের বানানো চলচ্চিত্র "চারুলতা"। মুক্তি পেয়েছে ১৯৬৮ সালে।

কাহিনী

১৮৭৯ সালের উচ্চবিত্ত এক বাঙালি পরিবারকে কেন্দ্র করে এর কাহিনী রচিত হয়েছে। পরিবারের কর্তা ভূপতি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তার বাড়িতেই "Sentinnel" নামে পত্রিকাটির কাজ শুরু হয়। পত্রিকার কাজে দিনরাত মগ্ন থাকায় সদ্য যৌবনে পদার্পণকারী স্ত্রীর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়ার সময় পাননা। স্ত্রী চারুলতার সময় কাটে একা একা। অবসরে চারু সাহিত্য চর্চা করে সময় কাটায়। স্ত্রীর নিঃসঙ্গতা স্বাভাবিকভাবেই ভূপতির চোখে পড়ে। তাই চারুর ভাই উমাপদকে চিঠি লিখে সস্ত্রীক চলে আসার জন্য বলেন। উমাপদকে নিজের পত্রিকার ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। উমাপদের স্ত্রী মন্দাকিনীর সাথে চারুর চরিত্রের আকাশ-পাতাল ফারাক। তাই চারুর নিঃসঙ্গতা খুব কমই প্রশমিত হয়। এমন সময় আগমন ঘটে ভূপতির পিসতুতো ভাই অমলের।

অমলের সাথে চারুর সম্পর্ক আগে থেকেই বেশ ঘনিষ্ঠ। তবে প্রথম দিকে তাদের সম্পর্কে বৌঠান-ঠাকুরপোর স্বাভাবিকতা ছাড়া অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। ভূপতি অমলকে নিজ স্ত্রীর মধ্যে লুক্কায়িত সাহিত্যিক প্রতিভা বের করে আনার দায়িত্ব দেয়। এর সাথে তার পত্রিকার প্রুফ দেখানোর কাজে লাগানোরও চেষ্টা করে। অবশ্য সাহিত্য চর্চা ছাড়া অন্য কিছুতে অমলের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। এর মধ্যে উমাপদর মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে ভূপতি তাকে পত্রিকার আর্থিক দিকটার সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে দেয়। চারুর ভাই বলেই হয়তো উমাপদকে অবিশ্বাস করার প্রশ্ন উঠেনি। চারু অবশ্য তার ভাই সম্বন্ধে এতোটা বিশ্বাসী ছিল বলে মনে হয়না।

অমল চারুর সাথে সাহিত্য চর্চা শুরু করে তার মধ্যের লুক্কায়িত প্রতিভার স্ফূরণ ঘটানোর জন্য। এর সাথে শুরু হয় অমল, চারুলতা ও মন্দাকিনীর পারষ্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন। একান্ত আলোচনা আর মেলামেশা থেকে সহজেই বোঝা যায় চারুর সাথে অমলের সম্পর্ক কেবল বৌঠান-ঠাকুরপোর নয়, এর মধ্যে অন্য কিছুও রয়েছে। ওদিকে মন্দাকিনীও কিছুটা দুর্বল থাকে অমলের প্রতি। তাই অমলের সাথে মন্দার কথাবার্ত বা মেলামেশা সহ্য করতে পারেনি চারু। সে অমলকে দেখাতে চেয়েছে মন্দার চেয়ে সে কতোটা গুণবতী। অমলের লেখা পত্রিকায় ছাপা হবার পর সেও সেই পত্রিকায় লেখা পাঠায়। চারুর লেখাও ছাপা হয় এবং দেখা যায় সাহিত্যিক প্রতিভা অমলের চেয়ে চারুরই বেশী। ইতোমধ্যে অমলের বিয়ের প্রস্তাব আসে বর্ধমান থেকে। বিয়ের পর শ্বশুর জামাইকে বিলেত পাঠাবেন। এক মাস সময় চেয়ে নেয় অমল। সাথে সাথে রাজি না হওয়ায় চারু সাময়িকভাবে স্বস্তি বোধ করে। চারুর আচরণ দেখে অমল অচিরেই বুঝতে পারে দাদার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে তাকে সরে পড়তে হবে।

উমাপদ বিশ্বাসঘাতকতা করে। পত্রিকার দেনা ২৭০০ টাকার মধ্যে মাত্র ৩০০ টাকা পরিশোধ করে বাকিটা নিয়ে সরে পড়ে। পত্রিকা অচল হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে ভূপতি। চারু অমলকে জানায়, কিছুতেই যেন সে বাড়ি ছেড়ে না যায়। কিন্তু অমল সে রাতেই দাদার উদ্দেশ্য একটা ছোট চিঠি রেখে পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। পত্রিকা ছেড়ে স্ত্রীর দিকে মনোযোগী হয় ভূপতি। বেড়াতে যায় সমুদ্রের ধারে। সেখানেই স্ত্রীর সাথে তার অনেক আলাপ হয়, একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য তারা মনস্থির করে যার বাংলা ও ইংরেজি দুই অংশই থাকবে। বাংলা অংশে চারু লেখালেখি করবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতায় ফিরে গিয়ে অমলের চিঠি পায় তারা। সে বর্তমানে মাদ্রাজে এক বন্ধুর বাড়িতে আছে আর বিয়ের বিষয়টা নিয়ে ভালোভাবেই চিন্তা করছে। বিয়ে করে ফেলাটা হয়তো সময়ের ব্যাপার মাত্র। চিঠি না পড়েই কান্নায় ভেঙে পড়ে চারু যা দেখে ফেলে ভুপতি। ভাইয়ের সাথে স্ত্রীর সম্পর্ক তাকে অশান্তিতে ফেলে দেয়। তাদের মিল হওয়াটা তখন অসম্ভবের পর্যায়ে, সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে বিচ্ছেদও অস্বভাবিক। শেষ পর্যন্ত তাদের হাত মিলেনি। তাদের মিলন না বিচ্ছেদ হবে তা মুখ্য নয়। সেই দিনটি বা সে সময়টিতে তাদের নীড় যে ভেঙে গেছে চলচ্চিত্রে তা-ই মুখ্যভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে।

সাহিত্যের গল্প থেকে ছবি

ভিনদেশী এমন অনেক সাহিত্য রয়েছে যা থেকে কোন পরিবর্তন ছাড়াই সম্পূর্ণ চিত্রনাট্য তৈরী করা সম্ভব। কিন্তু নষ্টনীড় সে রকম গল্প নয়। কারণ এই গল্পের প্লট মূখ্য নয়। মূখ্য হলো চারটি চরিত্রের মধ্যকার সম্পর্কের সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ। তা করতে গিয়ে বিভিন্ন ঘটনার সাহায্য নেয়া হয়েছে, যা থেকেই একটা কাহিনীর সূত্র গড়ে উঠেছে। পরিণতির জন্য বেছে নেয়া হয়েছে উমাপদের বিশ্বাসঘাতকতা, তা আকস্মিক কেননা চলচ্চিত্রে এর কোন পূর্বাভাস দেয়া হয়নি।

"নষ্টনীড়" এর সূচনা উমাপদের প্ররোচনায় ভূপতির খবরের কাগজ প্রকাশে উদ্যগী হওয়া দিয়ে। এই কাগজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে তিনি জানতে পারলেন না "কখন তার বালিকা-বধু চারুলতা ধীরে ধীরে যৌবনে পদার্পণ করিল।" কিন্তু এই দৃশ্যটি দিয়ে সিনেমাটি শুরু করা হয়নি। কারণ তাতে করে পূর্বতন আরও ঘটনা নিয়ে আসা প্রয়োজন, যা কিনা ছবিকে দূর্বল করে দিত। ছবি শুরু হয়েছে তাই চারুর নিঃসঙ্গতা দিয়ে। আর তা করতে গিয়েই পরিচালক পড়তে হয়েছে বিকট সমস্যায়। কেননা চারুলতার নিঃসঙ্গতার কথা বলার পর গল্পের প্রথম পরিচ্ছদের রবীন্দ্রনাথ অমলের কথা বলেছেন। "ধনী গৃহে চারুলতার কোন কর্ম ছিলনা। ফলপরিণামহীন ফুলের মতো পরিপূর্ণ- অনাবশ্যকতার মধ্যে পরিস্ফুট হইয়া উঠাই তাহার চেষ্টাশূন্য দীর্ঘ দিনরাত্রির একমাত্র কাজ ছিল।" এই উক্তির সামান্য পরেই আছে, "চারুলতা তাহাকে ধরিয়া পড়া করিয়া লইতো এবং সামান্য একটু পড়াইয়া অমলের দাবির অন্ত ছিল না তাহা লইয়া চারুলতা মাঝে মাঝে কৃত্রিম কোপ ও বিদ্রোহ প্রকাশ করিত; কিন্তু কোন একটা লোকের কোন কাজে আসা এবং স্নেহের উপদ্রব সহ্য করা তাহার পক্ষে অত্যাবশ্যক হইয়া উঠিয়াছিল।" অর্থাৎ নিঃসঙ্গ চারু অমলের সাথে সখ্য স্থাপন করে ভূপতির অভাব কিছুটা মিটিয়ে নিচ্ছে। আর তাই চারুর নিঃসঙ্গতা দিয়ে ছবি শুরু করতে গেলে অমলকে রাখা সম্ভব না। ফলে পরিচালক অমলকে দূরে সরিয়ে রাখলেন, এবং পরবর্তীতে নতুন দৃশ্যের মাধ্যমে তাকে নিয়ে আসলেন। চারুর সাথে অমলের মনের মিল দেখানোর জন্য তার পড়ালেখার প্রতি ঝোঁক, ভুপতির কাগজ নিয়ে ব্যস্ত থাকা এবং চারুর তা মেনে নেয়া দেখানো হয়েছিল।

কাহিনীর পরের ঘটনা মন্দাকিনীর আগমন। মূল গল্পে আছে "যুবতী স্ত্রীর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া কোন আত্মীয়া ভৎসনা করিলে ভূপতি সচেতন হইয়া কহিল- তাই তো চারুর একজন সঙ্গিনী থাকা থাকা উচিত- ও বেচারা কিছু করার নাই।" কিন্তু চলচ্চিত্রে এই অস্পষ্টতা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। আর শুধু মাত্র এই একটি ঘটনার জন্য নতুন চরিত্র আনাও অপ্রয়োজনীয়। ছবিতে তাই ভূপতি হঠাৎ করেই একদিন নিজে থেকেই চারুর নিঃসঙ্গতা আবিষ্কার করলেন। ভোজনের পরের গভীর রাতের দৃশ্য। ভূপতি তখন কাগজ সম্পাদনায় ব্যস্ত। চারু নকশা করা রুমাল নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। সে ভূপতিকে রুমালটি দেয়।

ভূপতিঃ এটা তুমি করেছ?
চারুঃ এবার তোমার একটা চটিতে নকশা করে দিব।
ভূপতিঃ এত সময় তুমি কখন পাও চারু?
চারুঃ আমার কি সময়ের অভাব আছে।

নিংসঙ্গতার এই ইঙ্গিত লক্ষ এড়ায় না ভূপতির। এই পর্যায়েই সে চারুর নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্য উমাপদের স্ত্রী (চারুর বৌদি) কে নিয়ে আসার কথা জানায়।

বইয়ের মূল কাহিনীতে অনেক দিন এবং অনেক রাতের বিক্ষিপ্ত ঘটনাবলীর অজস্র বিবরণ থাকলেও স্বামী- স্ত্রী জড়িয়ে গোটা কোনো দৃশ্য নেই। বইয়ের পাঠক এই অভাব না বুঝলেও, ছবিতে যেখানে চরিত্র, পরিবেশ, ঘটনার স্থান কাল- সবই একটা সময়ের সুত্র ধরে আগাতে থাকে, সেখানে এই ধরণের একটা দৃশ্যের বড় প্রয়োজন। সারাদিন কাজের চাপে যে স্ত্রী কে অবহেলা করে রাতে তার স্ত্রীর প্রতি ব্যবহার কেমন দর্শককে তা জানানোর জন্যই নৈশ দৃশ্য আনা হয়েছে ছবিটিতে। রাতের ভোজন পর্বের এই দৃশ্যে ভূপতি কাগজের ম্যানেজার হিসেবে উমাপদকে বহাল রাখার সংকল্পের কথা চারুকে জানায়। নষ্টনীড় গল্পে উমাপদের কথা আছে মাত্র তিনবার। যেহেতু উমাপদের বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে ছবিটি পরিনতির দিকে যায়। তাই দর্শকদের কাছে এই চরিত্রটির সঠিক নির্মাণ অতন্ত্য প্রয়োজনীয়। তাছাড়া বিশ্বাসঘাতকার দৃশ্যটি দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যেতনা।

(চলবে...)

তথ্যসূত্র

bn.wikipedia.org
বিষয় চলচ্চিত্র- সত্যজিত রায়।

রায়হান আবীর


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।