বার্লিন ওয়াল পতনের বিশ বছর পূর্তি: মনের দেয়াল ভাঙ্গাটাই আসল

রেজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন রেজওয়ান (তারিখ: মঙ্গল, ১০/১১/২০০৯ - ৪:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকের খবরের চ্যানেলগুলোতে শুধু বার্লিন ওয়াল পতনের বিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানমালা - অনেকেই লাইভ দেখাচ্ছে। ১৯৮৯ সালে বার্লিন ওয়ালের এই পতন মধ্য ও পূর্ব ইউরোপব্যাপী সমাজতন্ত্র বিরোধী বিপ্লবেরই শক ওয়েভের ফসল হিসেবে ধরা হয়। তবে এটি আরও তাৎপর্য পূর্ণ। এটি হচ্ছে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মায়ের পেটের দুই ভাইয়ের পুনর্মিলন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসীদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর সমন্বিত পরাশক্তিরা ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত জার্মানী দখল করে রাখে। ১৯৪৯ সালে আমেরিকা গ্রেট ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের দখলে থাকা ১২টি স্টেটের সমন্বয়ে পশ্চিম জার্মানী গঠিত হয় এবং রাশিয়ার দখলে থাকা ৫টি স্টেট নিয়ে পূর্ব জার্মানী গঠিত হয়। প্রাক্তন রাজধানী বার্লিন শহরটি দুইভাগ হয়ে যায় এবং পশ্চিম জার্মানীর রাজধানী বন নির্ধারিত হয়। ১৯৫৫ সালে রাশিয়া পূর্ব জার্মানীকে পুরোপুরি স্বাধীন ঘোষণা করে, তবে রাশিয়ার সৈন্যরা পটস্ডাম চুক্তি অনুযায়ী সেখানে থেকে যায়, যেমন পশ্চিম জার্মানীতে আমেরিকা, ইউকে আর ফ্রান্স এর সৈন্যরা ছিল।

আলাদা হবার পরপরই ১৯৫০ এর দশকে পশ্চিম জার্মানী একটি অর্থনৈতিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যায়। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির অনেকটাই তারা কাটিয়ে উঠে। ঐদিকে পূর্ব জার্মানরা তেমন সৌভাগ্যবান ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম থেকেই তাদের উপর ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারা পোল্যান্ড আর চেকোস্লোভাকিয়া ছাড়া কোথাও যেতে পারত না (তাও বিশেষ অনুমতিক্রমে)। কিন্তু তবুও সীমিত আকারে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হত তখনও। তবে পশ্চিম জার্মানীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থাকায় ১৯৫০ এর দশকে প্রায় ৩৫ লাখ পূর্ব জার্মানবাসী পশ্চিম জার্মানীতে চলে আসে। এই ঢল ঠেকাতে হঠাৎ করে ১৯৬১ সালে বার্লিনের মাঝামাঝি দেয়াল তুলে দেয়া হয় ও ডেথ জোন তৈরি করা হয় নো ম্যানস ল্যান্ডে। পরবর্তী বছরগুলোতে অনেকে এই ডেথ জোন পার হয়ে পালাতে গিয়ে মারা যায় পূর্ব জার্মান সৈন্যদের কাছে।

দুই জার্মানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পূর্ব জার্মানীর সরকার খুব তৎপর ছিল। পশ্চিম জার্মান সরকারও মানবাধিকার ইস্যুগুলো খুঁচিয়ে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতি বজায় রাখত। কিন্তু একই ভাষা, একই জাতি এবং একই পরিবারের মধ্যে টান কিন্তু ঘুঁচাতে পারে নি। ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রায় ১৩০০০ পুর্ব জার্মানবাসী অষ্ট্রিয়া -হাঙ্গেরিয়ান সীমান্তে পালিয়ে আসে। চেকোস্লোভাকিয়ায় পশ্চিম জার্মান দুতাবাসে কয়েকশ পূর্ব জার্মান আশ্রয় নেয় এবং পরে তাদের বিশেষ ট্রেনে করে পশ্চিম জার্মানী নিয়ে আসা হয়। সে মাসেই এরিক হোনেকার পূর্ব জার্মানীর প্রিমিয়ার পদ থেকে সরে দারান।

ক্রমাগত রাজনৈতিক চাপে ১৯৮৯ সালের ৯ই নভেম্বর সরকার ঘোষণা দেয় যে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে পূর্ব জার্মানদের উপর ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে। সেটা ছিল এক নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং তা নিয়ে কোন প্রস্তুতি ছিল না, এমনকি বর্ডার গার্ডরাও কিছু জানতেন না। তবে সেই ঘোষণা দেয়ার সময় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন এই সিদ্ধান্ত কি কখন থেকে কার্যকর হবে? তখন মূখপাত্রটি আমতা আমতা করে বলেন আমিতো কোন সময় উল্লেখ দেখছি না - এখন থেকেই ধরতে পারেন। এটি সরাসরি টিভিতে দেখানো হচ্ছিল। তা শুনে দলে দলে লোক বার্লিনের বিভিন্ন চেকপোষ্টে চলে আসে। লোকের প্রচন্ড চাপে সীমান্তরক্ষীরা হাল ছেড়ে দেয় এবং সরে দাঁড়ায়। প্রায় বিশ হাজার লোক সেদিন দেয়াল ভেঙ্গে ও টপকে পশ্চিম জার্মানিতে চলে আসে। বার্লিন ওয়ালের পতন হয়।

এই ঘটনা পরবর্তী বছরে দুই জার্মান একীভূত করাকে তরান্বিত করে। 'আমরা এক জাতি - এই স্লোগানে আকাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।

আমাদের পূর্ব ও পশ্চিম বাংলাও এক সময় আলাদা হয়েছিল। জার্মানদের ক্ষেত্রে সেটি ছিল দেশ ভাগ এবং ভাবধারার ভিন্নতা। আমাদের ক্ষেত্রে সেটি ছিল ধর্মীয় ভাগ। একই ভাষা, একই সংস্কৃতি, একই জাতীয়তা। অথচ ধর্মের ভিন্নতা আমাদের দুরে ঠেলে দিল।

দুই জার্মানীকে আলাদা রাখার জন্যে সরকার অনেক চেষ্টা করেছে। পূর্ব জার্মানীতে টিভিতে একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যয় করা হত পশ্চিম জার্মানীর বিরুদ্ধে খুনসুটি করার জন্যে। বাইরে দেয়াল থাকলেও কিন্তু লোকজনের মনে দেয়াল ছিল না। তাই দুই জার্মানীর আবার এক হওয়া সম্ভব হয়েছে।

কিন্তু আমাদের দুই বঙ্গের কি অবস্থা? ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প এখনও ছড়ায়। পশ্চিম বঙ্গে বাংলা ভাষার কদর কমে যাচ্ছে। নেই সেখানে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলের প্রবেশাধিকার। সাংস্কৃতিক বিনিময় আগের চাইতে অনেক কম। পশ্চিম বঙ্গে বাংলাদেশের ক'জন লেখকের বই বিক্রি হয়? পূর্ব বঙ্গ তথা বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষ এখন রাজনৈতিক এজেন্ডা- এটি কিছু মানুষের রুটি রুজির ব্যাপার। বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে তারা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলতে ব্যস্ত। আমরা না চাইলেও দুরত্বটা বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।

সব মিলে দুই বঙ্গের কারও কি ইচ্ছে হয় আবার কাঁটাতারের বেড়া ভেঙ্গে এক সাথে মেলার? জানি বর্তমান বাস্তবতায় হয়ত একত্রীকরণ বেশীই চাওয়া হবে। তবে নিদেনপক্ষে ভিসা বিহীন যাতায়াত, ইইউর মত ইকনমিক জোন?

কিন্তু সেটা সম্ভব করার আগে আমাদের মনের দেয়াল ভাঙ্গতে হবে।


মন্তব্য

সবজান্তা এর ছবি

এই দিনে এর চেয়ে চমৎকার গান আর কী হতে পারে ?


অলমিতি বিস্তারেণ

কনফুসিয়াস এর ছবি

সুনীলের একটা বই পড়েছিলাম জার্মানি ভ্রমণ নিয়ে, ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ। আকারে ছোটখাটো একটা বই, কিন্তু পড়তে খুব ভাল লেগেছিলো। সেই বইয়ের প্রচ্ছদটাও বার্লিনের দেয়ার ভাঙ্গার ছবিই।
*
দুই বাংলার মানুষের এমনকি মানসিক দুরত্ব ঘুচবে কিনা সে নিয়েও আমার সন্দেহ হয়। বাস্তবে তো ভিসা পাসপোর্টের ব্যাপার আছেই, তার সাথে আছে মাথা মোটা রাজনীতিকরা, কিন্তু অনলাইন, যেখানে সবই মুক্ত, সেখানেও দুই বাংলার লোকেদের পরস্পরের ব্লগ/ফোরামে যাতায়াত কেমন? একদমই হাতে গোনা।

-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

সুমন চৌধুরী এর ছবি

কিছু বলার নাই ...... মন খারাপ



অজ্ঞাতবাস

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

লেখাটা অনেক ভালো লাগল রেজওয়ান ভাই

হাসান মোরশেদ এর ছবি

রেজওয়ান ভাই,
আপনার পোষ্টের শেষের অংশগুলো অনেক ভাবনার ইন্ধন জোগায়। '৬০ দশকে তীব্র হয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে খুন করায় কার কার লাভ হলো? কার কার দরকার ছিলো এই উত্থানকে ঠেকানোর? ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাকে আজো কারা ঠেকিয়ে রাখতে চায়?
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।