উহান করোনা ভাইরাস নিয়ে করণীয়

রেজওয়ান এর ছবি
লিখেছেন রেজওয়ান (তারিখ: বিষ্যুদ, ৩০/০১/২০২০ - ১১:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


৩০ জানুয়ারী ২০২০ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চীনে শুরু হওয়া উহান করোনা ভাইরাস (2019-nCoV) সংক্রমণ নিশ্চিতভাবে প্রায় আট হাজার মানুষের শরীরে পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১৭০ জন মারা গেছেন এবং ১৩৩ জন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে।

এই মহামারীর কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান, বিশেষ করে এর হুয়ানান সি-ফুড মার্কেট। আক্রান্তরা প্রায় সবাই চীনে হলেও বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এটি ছড়িয়েছে — আক্রন্ত হয়েছেন আমেরিকা মহাদেশে ৮ জন, ইউরোপে ১০ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৭ জন এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে ৮০ জন। চীনের বাইরে যারা আক্রান্ত তারা হুবেই প্রদেশ থেকে ভ্রমণ করেছেন বা এমন কারো কাছ থেকে সংক্রমিত হয়েছেন।

ফ্লু-মহামারীর এই স্ট্রেইন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা এখনো অনেক কিছুই জানেন না তবে এর সাথে পূর্বের সার্স (২০০১-২০০৩) ও মার্স (২০১২-২০১৩) মহামারীর সাদৃশ্য পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত মহামারীর প্রকোপ মূলতঃ চীনে সীমাবদ্ধ থাকলেও বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে গুজব ও ভয়ভীতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে — সোশ্যাল মিডিয়াতে এমনও ছড়ানো হয়েছে যে এই ভাইরাস বায়োলজিকাল অস্ত্র হিসেবে চীনা সরকারের বানানো বা লাখো লাখো লোক সংক্রমিত হয়েছে, হাজারে হাজারে মারা যাচ্ছে আরে সেটা গোপন রাখা হচ্ছে।

ইতিমধ্যে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ সহ বেশ কটি এয়ারলাইন্স চীনে চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। চীনা পর্যটকদের ভিসা দেয়া বন্ধ করেছে বেশ কটি দেশ। চীনে ১০টি শহরে প্রায় ২ কোটি লোকের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার এই ভাইরাসের প্রসার রুখতে। চীনে গত সপ্তাহে চৈনিক নববর্ষের ছুটি ছিল। সেটিকে প্রলম্বিত করে স্কুল কলেজ, ব্যবসাবাণিজ্য ও সরকারী অফিস বন্ধ রাখা হয়েছে। অনেক ফাস্টফুডের দোকান বন্ধ রয়েছে। বাজারে কাঁচা শাকসবজি বা মাছমাংসের যোগান কম, শুধু শুকনো খাবার পাওয়া যাচ্ছে, এবং অবরুদ্ধ শহরগুলোতে ক্রমশঃ দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবু সংক্রমণ আটকে রাখা কঠিন কারণ প্রথম দুই সপ্তাহে এই রোগের তেমন কোন দৃশ্যমান লক্ষণ পাওয়া যায় না। এভাবেই ডিসেম্বর মাসে এবং জানুয়ারির প্রথম দিকে অনেকে হুবেই প্রদেশ থেকে চীনের অন্যান্য প্রদেশে এবং বিদেশে ভ্রমণ করে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।

আরও পড়ুনঃ নতুন করোনাভাইরাস কতটা বিপজ্জনক?

অনেকখানেই উহানের হুয়ানান সি-ফুড মার্কেটকে এই মহামারীর প্রথম সংক্রমণের স্থান হিসেবে বলছেন এবং সময়টা - ডিসেম্বরের শেষের দিকে - জানুয়ারির ২ তারিখে উহানে ৪১ জন রোগীর শরীরে নতুন 2019-nCoV করনাভাইরাস চিহ্নিত হয় । তবে একদল চৈনিক বিশেষজ্ঞ মহামারীতে আক্রান্ত ৪১ জনের উপর গবেষণা করে মেডিকেল জার্নাল দ্যা ল্যান্সেট এ প্রকাশ করেছেন যে এ রোগের সংক্রমণ শুরু হয়েছে ঐ মার্কেটের সংক্রমণের আগে। এক রোগী ১লা ডিসেম্বর আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৪১ জনের মধ্যে ১৩ জনেরই উক্ত মার্কেটের সাথে কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। অর্থাৎ কেউ এই ভাইরাসটি নিয়ে এসে মার্কেটে ছড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে এই তথ্য সত্য হলে নভেম্বর থেকেই এই ভাইরাসটি ছড়াচ্ছে কারণ এর ১ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত ইনকিউবেশন পিরিয়ড থাকে। এবং কোথা থেকে শুরু হয়েছে সেটা এখনো জানান যায়নি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যপারটি হচ্ছে যে লক্ষণ দৃশ্যমান হবার আগে এই ভাইরাসটি ছড়াতে পারে

বাংলাদেশে এই ভাইরাসটি নিয়ে বা এর প্রতিরোধ নিয়ে এখনো স্পষ্টতা দৃশ্যমান হয়নি। সরকার এই রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় সংক্রান্ত গাইডলাইনের উপর এখনো কাজ করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক গুজবের মধ্যে একটি দেখলাম যে চীনা সরকার উইঘুরের মুসলমানদের উপর নির্যাতন করছে বলে এটি একটি গজব হিসেবে এসেছে।

এই ভাইরাসের উপসর্গ সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার মতই ৷ সর্দি কাশি ও মৃদু জ্বর থাকে প্রথম দিকে৷ হাঁচি, খুসখুসে কাশি ও মাথা ব্যথা বা গা হাত পা ব্যথা থাকতে পারে৷ প্রায় এক সপ্তাহ পরে এটি নিউমোনিয়াতে রূপান্তর হয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায় এবং মাল্টিপল অর্গান ফেইলিউর হয়ে মারা যেতে পারে৷ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাস সংক্রমণ খুব কম৷ বৃদ্ধরা এবং যেসব বয়স্ক লোকের অন্য কোন শারীরিক অসুখ আছে তারা এর থেকে বাঁচতে পারেনা। সুস্থ সবল মানুষেরা আক্রান্ত হয়েও কিছু ক্ষেত্রে নিরাময় পেয়ে যাচ্ছে।

এই রোগের চিকিৎসা থেকে সংক্রমণ প্রতিরোধটাকে প্রাধান্য দেয়া জরুরি বেশী। নেটফ্লিক্সে একটি নতুন ডকুমেন্টারি সিরিজ শুরু হয়েছে "Pandemic: How to Prevent an Outbreak" — সেখানে দেখানো হয়েছে যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস নতুন নয় - যুগে যুগে মহামারী লাখ লাখ লোকের প্রাণ নিয়েছে। শতবর্ষ আগের ১৯১৮ স্প্যানিশ ফ্লুতে ২ থেকে পাঁচ কোটি লোক মারা গিয়েছিল। এই ডকুমেন্টারিতে প্যাথোজেন বিশেষজ্ঞ সায়রা মাদাদের কাজকে উপস্থাপন করা হয়েছে যার প্রধান কাজ হচ্ছে এই ধরনের মহামারী প্রতিরোধে সরকার ও ক্লিনিক-হসপিটালগুলোকে প্রস্তুত রাখা। এইধরনের বড় ধরনের মহামারীতে সামনে থেকে কাজ করতে হয় স্বাস্থ্যকর্মীদের এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীদের। এক ডাক্তার ইতিমধ্যে মারা গেছেন চীনে এবং বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত। চীনে হুবেই প্রদেশে ফেসমাস্কের সংকট দেখা দেয়ায় অনেক পুলিশ নিজেদের সুরক্ষিত না করেই বাইরে যাচ্ছিল দেখে এক সাধারণ নাগরিক কয়েক হাজার ফেস মাস্ক পুলিশ স্টেশনের সামনে ফেলে রেখে যায়।

সায়রা বলেছেন বড় ধরনের মহামারী ঠেকানোর উপায় হচ্ছে সর্বশেষ তথ্য জানানো, বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় এবং জনগণ ও সরকারের মধ্যে সহযোগিতা। এবং অবশ্যই নিজেদের প্রস্তুত রাখা।

কাজেই এই ভাইরাস প্রতিরোধ ও নিরাময়ের জন্য দরকার সঠিক তথ্য প্রদান। নিন্মে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লিঙ্ক রয়েছেঃ

  1. হাজারে হাজারে মৃত্যুর সংখ্যা শুনে বিভ্রান্ত হবেন না। ওয়ার্ল্ড-ও-মিটার নামের এই সাইটটিতে আক্রান্ত ও মৃতদের তথ্য সার্বক্ষণিক হালনাগাদ করা হচ্ছে।
  2. গার্ডিয়ান ব্লগে করোনা ভাইরাস নিয়ে লাইভ আপডেট পাওয়া যাচ্ছে।
  3. অস্ট্রেলিয়া সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ইনফোগ্রাফিকের সঙ্কলন

বাংলাদেশে এখনো এই ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হয়নি। যদি সোশ্যাল মিডিয়াতে পড়েছি কোন কোন হাসপাতালে এই ধরনের লক্ষণ নিয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে মারা গেছে এমন চাউর হয়েছে। একই ধরনের রোগে মানুষ মারা যেতে পারে কিন্তু সেগুলো উহান করোনা ভাইরাস কিনা যা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াবে - তা আগে নিশ্চিত হবার প্রয়োজন গুজব ছড়ানোর আগে। তবু সাবধানের মার নেই - ভয় না পেয়ে আপনার আসে পাশে রোগটি ছড়ানোর আশংকা থাকলে নিন্মলিখিত সতর্কতাগুলো পালন করতে পারেনঃ

  1. মাস্ক পরবেন যারা অনুভব করছেন যে সর্দি-কাশি হয়েছে। তারা যাতে অন্যের কাছে ছড়াতে না পারেন সেজন্যে মাস্ক পড়া জরুরী — এই ভিডিওতে আছে কিভাবে সঠিকভাবে মাস্ক পরবেন।
  2. যারা আক্রান্ত না, তাদের মাস্ক থেকে জরুরি হাতে হাতমোজা পরা - কারণ দরজার নব, টেলিফোন, সিঁড়ির রেলিং এইসব যায়গা থেকে সংক্রমণ আপনার শরীরে ছড়ায় - মাস্ক সেটা রোধ করতে পারবে না। বাইরে থেকে এসে হাত, মুখ বা উন্মুক্ত অংশ ধুয়ে ফেলবেন।
  3. বাসায় কারো সাথে খাবার, চামচ-থালা বা তোয়ালে শেয়ার করবেন না।
  4. বাইরে গেলে মানুষের থেকে ১.৫ মিটার দূরত্ব রাখুন।
  5. আক্রান্ত অঞ্চলে কাঁচা বা অল্প সিদ্ধ মাছ মাংস খাবেন না - খাবার ফুটিয়ে নেবেন - অধিক তাপমাত্রায় ভাইরাসটি বাঁচতে পারে না।

আরও কিছু উপদেশ পাবেন এখানে

সবচেয়ে আশার কথা হল হংকং এর বিজ্ঞানীরা উহান করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে বলে ঘোষণা দিয়েছে — তবে এর ক্লিনিকাল ট্রায়াল বাকি। সচেতনতা ও সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আমাদের বাঁচাতে পারে যতক্ষণ না পর্যন্ত কার্যকরী প্রতিষেধক পাওয়া যাচ্ছে।


মন্তব্য

জে এফ নুশান এর ছবি

তথ্যবহুল এই লেখাটার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন।
নুশান

এক লহমা এর ছবি

খুব দরকারী লেখা। ভালো লেখা।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অরূপ এর ছবি

কে এল-এ ফেসমাস্ক আউট অফ স্টক হাসি
ফ্লু জ্যাবও আউট অফ স্টক। অপ্রয়োজনীয় প্যানিকে রূপ নিচ্ছে বিষয়টা.. প্যানিক সামলানোও এখন জরুরী


অরূপের ব্লগ @ http://etongbtong.blogspot.com
অরূপের ফ্লিকার @ http://www.flickr.com/photos/harvie-krumpet

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

তথ্যবহুল লেখা। চলুক

যদিও মহামারী সামাল দেয়া যাবে বলে আমরা আশা করতে পারি, কিন্তু এখনই টিকা/প্রতিষেধক পাওয়া যাবে সেরকম সম্ভবণা কম। টিকা তৈরির চাইতে সে যাচাই করে বাজারজাত করা বহুগুণে কঠিন। নতুন করোনাভাইরাসের টিকা তৈরি হলেও সেটি প্রথমে কোন স্তন্যপায়ী প্রাণি এবং পরে মানুষের উপর "প্রাথমিক" পরীক্ষা করে তারপর বাজারজাত করতে হবে। এই পরীক্ষাগুলো দারুণভাবে সময়সাপেক্ষ।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে, টিকা তৈরি হওয়ার পর টিকা কীভাবে দেয়া যাবে? যারা ইতমধ্যেই সংক্রামিত তাদের উপর টিকা কাজে আসবে না। যাদের ভেতর সংক্রমণ হয়েছে কিন্তু রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, তাদেরকে আলাদা করে চিনতে পারলে মহামারী সামলে দেয়ার প্রাথমিক কাজটি করা যেত, কিন্তু সেটি প্রায় অসম্ভব। সবমিলিয়য়ে পরিস্থিতি খুব সহজ নয়, বৈশ্বিকভাবে আয়োজন করে কাজ করা দরকার হয়ত।

***
নিরাপদ থাকার জন্য সামান্য অভ্যাস পরিবর্তন হয়ত খুব কাজে আসতে পারে। অপরিষ্কার হাত নাকে, মুখে, চোখে (বা শরীরের কাটা-ছেঁড়া ত্বকে) লাগানোর অভ্যাস বদলে ফেললে সংক্রমণের সম্ভাবণা কমবে। মানুষ হাত দিয়ে চোখমুখ স্পর্শ করে কিছু না ভেবেই। সেইজন্য সকলের এই অভ্যাস বদলে ফেলা কঠিন। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, দৃশ্যত পরিষ্কার হাত (অথবা ধরেন একটু আগে সাবান দিয়ে ধুয়ে আসা হাত) কিন্তু সংক্রমণ-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে "পরিষ্কার" নয়। হাত ধুয়ে সেই হাতে পানির কল বন্ধ করলেই হাত আবার "ময়লা" হয়ে যেতে পারে। সেইজন্য হাত দিয়ে চোখ-মুখ স্পর্শ করার অভ্যাস একেবারেই বদলে ফেলা ভালো।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

Prashanta madhu এর ছবি

খুব ভাল মন্তব্যটি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।