বাংলার তরু-লতা-গুল্ম-৩২ : তাল

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ১৪/০৫/২০১৪ - ৬:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


শরতের তাল পাকা গরম। ভ্যাপসা, অস্বস্তিকর। তবে তা শুধু বড়দের জন্য। আমাদের বয়েই গেছে শরৎকে কেয়ার করতে। ঘরকুনো হয়ে বসে থাকার দিব্যি তো কেউ দেয়নি! বিশেষ করে নানা বাড়িতে। মা-বাবার বারণ নেই, চাচার রক্তচক্ষু নেই, তাই অস্বস্তি¡র দুপুরে-ঘুমও নেই। নানা বাড়ির সাথেই বিশাল বাগান। আম, জাম, কাঁঠালের। বাগানের ঠিক মধ্যিখানে এক বিরাট তাল গাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। সব গাছ ছাড়িয়ে আকাশে উঁকি মেরে। ধপাস করে একটা তার পড়ে। আমরা ছুটে যাই। কিন্তু কোথায় তাল! কে যেন কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। ফিরে এসেছি। আবারও ধপাস! এবার ছুটে গিয়ে দেখি, তাল মুখে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন শিয়াল মামা। ধর ধর করে চিৎকার করে, তু-তু করে কুকুর ডেকেও তাল রক্ষা করতে পারি না। তাই অন্য পথ ধরতে হয় আমাদের। তালতলায় বসাই খেলার আসর। দাঁড়িয়াবান্ধা কিংবা গোল্লাছুট খেলার মতো পর্যাপ্ত জায়গা সেখানে নেই। তাই চলে ইচিং বিচিং টিচিং ছা-এর ছন্দ। তার ফাঁকে ফাঁকে চলত তাল কুড়ানো।


বলছিলাম দেড় যুগ আগের গল্প। এমনই রঙিন ছিল আমাদের ছেলেবেলা। নানা রকম লোক-খেলায় কেটেছে আমাদের দুরন্ত শৈশব। পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে পাল্লা দিয়ে তাল কুড়ানোর যে সুখ, তা ভোলার নয়। তালের স্মৃতি এখানেই শেষ নয়। গ্রীষ্মের খর দুপুরে কাঁচা তালের শাঁসে প্রাণ জুড়িয়ে যেত। ছোট চাচা মাঝে কোথা থেকে কাঁদি ধরে কাঁচা তাল আনতেন। ধারালো দা দিয়ে কেটে, শাঁস বের সেই তাল সবাই মিলে এক সাথে খাওয়ার যে মজা, তা বোঝানো মুশকিল। আর ছিল তালের রস। অবশ্য একটু বুঝেশুনে খেতে হয়। সমান্য পচন ধরলেই বেমাক্কা তাড়ি খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়ে যেতে পারে।


তারপর আছে তালের পিঠা, তালে বড়া। আমার খুব প্রিয় ছিল এ দুটি খাবার। আমাদের গাছ ছিল না। তাই নানার বাড়ি গিয়েই মূলত তালের বড়া-পিঠার স্বাদ নিতে হত। পাকা তাল ফুরালেও ফুরাত না তালের আবেদন। তখন নতুন স্বাদ নিয়ে হাজির হত তালের আঁঠি। আঁঠির গা থেকে শাঁস ছাড়ানোর পর সেগুলো মাটিতে পুঁতে রাখতাম। তালের অত্যন্ত শক্ত। পাকা নারকেলের চেয়ে দশগুন। তাই আঁঠি থেকে চারা বোরোতেও সময় লেগে যেত মাস দেড়ক। তবে চারা বেরিয়ে গাছ হওয়া অবধি আমরা অপেক্ষা করতাম না। তালের আঁঠি থেকে প্রথমে অঙ্কুর আকারে শিকড় বেরোত। এতেই তালের আসল মজা। শিকড় বেরোনো আঁঠির ভেতরে থাকত সন্দেশের মতো ফোপল। তবে সন্দেশের চেয়েও মজার এই ফোপলের ভাগ কে কতটুকু নেবে তা নিয়ে রীতিমত মারামারি লেগে যেত ছোটদের মধ্যে। নানা বাড়িতে অবশ্য এ ভয় ছিল না। এ বাড়িতে ছোট বলতে একমাত্র মামাতো ভাই। বয়সে আমার বছর সাতেকের ছোট। আমাকে একপ্রকার গুরু মেনেই চলত ও। বাড়ির আঁটিগুলো ফুরোলে হানা দিতাম মাঠে। শিয়াল মামারা যে তালগুলো ছিনতাই করেছিল, সেগুলোর শাঁস খেলেও আঁঠি খাওয়ার সাধ্য তাদের নেই। আঁঠি ভেঙে ফোপল খাবে সে শক্তি ওদের কোথায়? তাই ঝোপের জঙ্গলের অন্ধকার কোণে বহু অঙ্কুরিত তালের আঁঠি লুকিয়ে থাকত। দা-নিয়ে আমরা দু’ভাই বেরুতাম তার সুলুক-সন্ধানে। বড়রা নিষেধ করত, শিয়ালে খাওয়া বলে কথা! কিন্তু তাঁদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফোপল নামের অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হত না। আঁঠির ভেতরের শাঁস খাওয়ার মতো ছেলেপুলের অভাব পাড়ায় ছিল না। তাই তালের আঁঠি অঙ্কুরিত হওয়ার জন্য পুঁতে রাখতাম মাটিতে। মাটি ফুঁড়ে বের হওয়া শিকড় জানিয়ে দিত, ফোঁপল খাওয়ার সময় হয়েছে।


তাল পাম জাতীয় উদ্ভিদ। বাংলাদেশ-ভারতের প্রায় সব এলাকায় এদের দেখা মেলে। বহুবর্ষজীবি, চিরহরিৎ। শাখা প্রশাখা হয় না। একমাত্র কা-ই এদের মূল সম্পদ। পূর্ণবয়স্ক তাল গাছ ১০০ থেকে ১২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তাল গাছের কাণ্ডের বেড় গোড়ার দিকে ৪-৫ ফুট। ওপরের দিকে ক্রমেই কমতে থাকে। কাণ্ড কালচে ধূসর রঙের। অমসৃণ। তালগাছের কাণ্ড থেকে কাঠ পাওয়া যায় না। তবে টিনের ঘরের চালের বাতা তৈরি করা হয় তালগাছ চিরে। গরুর লাঙলের লম্বা বস্তুটা গরুর সাথে লাঙলের সংযোগ রক্ষা সেই বস্তুটাকে বলে ঈষ। এই ঈষ তালগাছ চিরে তৈরি করা হয়। ঈষ যখন পুরোনো হয়ে লাঙল টানতে অক্ষম হয়ে পড়ে, তখন সেটা কেটে তৈরি করা হয় বালিধারা। বালিধারা গায়ে বালি রেখে তার ওপর দা, নিড়িং ঘসে ঘসে ধার শানানো হয়। তালগাছ দিয়ে সবচেয়ে বড় জিনিস যেটা হয় সেটা হলো ডোঙা। আস্ত তালগাছ কেটে, তার মাঝখান থেকে চোঁছ ফেলে দিয়ে তৈরি হয় সবচেয়ে সহজলভ্য নৌকাটা।


একক পাতা হিসেবে বংলাদেশে তালের পাতা সবচেয়ে বড়। অনেকে হয়ত নারকেল কিংবা গোলপাতার কথা বলতে পারেন। কিন্তু ওগুলো একক পাতা নয়, অনেকগুলো উপত্রের সমন্বয়। শুধু বংলাদেশ কেন এতবড় পাতার গাছ পৃথিবীতে আর কটা আছে আমার জানা নেই। পাতা গোলাকার। তালের পাতার বোঁটা থাকে না। তার বদলে কাণ্ডের সাথে পেঁচানো বিরাট বিরাট ডেগো থাকে। এই ডেগোর মাথায় থাকে তালের পাতা। লম্বা ডেগোর দুই প্রান্ত করাতের মতো খাঁজ কাটা, ধারালো। মূলত এই খাঁজকাটা ডেগোই তালের চারাকে শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করে। বড় তাল গাছের ডেগো কম ধারালো। ডেগোর গোড়া থেকে পাতার শীর্ষ পর্যন্ত ৬-৭ ফুট পর্যন্ত লম্বা। তালের পাতা দিয়ে গাঁয়ের মানুষ ঘরের বেড়া ও ছাউনি দেয়। বাংলার অতি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটা জিনিস হলো হাতপাখা। হাতপাখা বলতে মূলত তালের পাখাকেই বোঝায়। অর্থাৎ তালের পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরি হয়। এছাড়া তালের পাতার পাটি ও চাটাই গ্রমাঞ্চলে ভীষণ জনপ্রিয়। আগের দিনে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ কাগজের অভাবে তালপাতায় লেখালেখি করত। এখনও খুঁজলে সেকালের তালপাতার পুথির সন্ধান পাওয়া যায়। তালের পাতার রং গাঢ় সবুজ। শুকানো পাতা বাদামী রংয়ের। তালপাতার গায়ে লেগে থাকা বাবুই পাখির বাসা হাজার বছরের বাঙালী ঐতিহ্য।


তাল পাম জাতীয় বৃক্ষ। এদের ফুলটাও তাই অন্য রকম। তালগাছের ঠিক আগার দিকে অনেকগুলো মোঁচা বের হয়। মোঁচার ভেতর থাকে কাঁদি। কাঁদির গায়ে নাকফুল আকারের অসংখ্য ছোট ফুল হয়। ফুলের চার-পাঁচটি পুরু পাপড়ি থাকে।


ফুলের ওপর ভিত্তি করে তালগাছের দুটি জাত আছে। একটা গাছে জটাধারী। এগুলোর কাঁদিতে ফুল হয় না। সাপের মতো অনেকগুলো জটা বের হয়। এসব তালগাছে তালও ধরে না। গাঁয়ের লোকে এসব গাছকে পুরুষ গাছ বলে। যেগুলোতে ফুল হয় তাল ধরে সেগুলোকে বলে মেয়ে গাছ। সত্যি বলতে কি মেয়ে ছেলে বলে এভাবে গাছের শ্রেণীবিভাগটা ঠিক নয়। যে গাছে ফুল হয় তাতেই স্ত্রী ও পুরুষ দুই শ্রেণীর পুংকেশর থাকে। তাদের পরাগায়নে তাল ধরে। তাল ধরার ক্ষেত্রে জটাধারী গাছের ভূমিকা একেবারে শূন্য। তাই বলে জটাধারী গাছ একেবারে কাজে লাগে না তা কিন্তু নয়। জটা থেকে অত্যন্ত সুস্বাদু রস পাওয়া যায়। রস পাওয়া যায় তালধারী গাছ থেকেও। জটা আর কাঁদি কেটে রস বের করা হয়। তবে কাঁদি থেকে এভাবে রস বের করে নিলে তাতে আর তাল ধরে না। তালের রস সুস্বাদু ও শ্রান্তিহারক। এর অপব্যবহারও আছে। তালের রস পচিয়ে তাড়ি নামের মাদকদ্রব্যটা তৈরি করা হয়।


তাল বেশ বড় আকারের ফল। কাঁচা তালের রং গাঢ় সবুজ। এক কাঁদিতে ৫০/৬০ টি তাল ধরে। কাঁচা তালের ভেতরে নরম আঁঠি থাকে। সেই নরম আঁঠি তালশ্বাস হিসেবে বাজারে বিক্রি করা হয়। পূর্ণাঙ্গ একটা তালের ভেতর ৩টি আঁঠি থাকে। তাল যত পরিপক্ক হয়, আঁঠি তত শক্ত হতে থাকে। পাকা তালের আঁঠি অত্যন্ত্য শক্ত। সেটা আর শাঁস হিসেবে খাওয়ার কোনও উপায় থাকে না।


কাঁচা তালের আঁঠির গায়ে যে শাঁস থাকে, পাকলে সেটাই হয়ে যায় ছোবড়া। আর সেই ছোবড়ার ভেতরেই থাকে গুড়ে মতো ঘন-তরল তালের শাঁস। পাকা তালের এই শাঁস দিয়ে বিখ্যাত তালের বড়া আর পিঠা তৈরি করা হয়। একটা পাকা তালের ওজন এক কেজিরও বেশি হতে পারে।


তালের বৈজ্ঞানিক নাম : Borassus flabellifer.

আরও ছবি :

নানাবাড়ির সেই তালগাছ আজ আর নেই। আছে তার ছেলেমেয়েরা।


তালভর্তি গাছ


এই তালগাছ দুটো পশ্চিমবঙ্গের, সীমান্তের এপার থেকে তোলা

আগের পর্ব : কৃষ্ণচূড়া


মন্তব্য

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পোস্টটা ভাল হয়েছে। ছবিগুলোও সুন্দর। কিন্তু তালগাছে বাবুই পাখির বাসা কই?

এই যে,

[img]DSCN0497[/img]

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, পৌঢ়দা। বাবুই পাখির বাসার ছবি আমার কাছে নেই যে!

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

এক লহমা এর ছবি

এবারে পোস্ট খুব ভাল হয়েছে। হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

মেঘলা মানুষ এর ছবি

আমার কাছে এই জিনিসটা কউব অবাক লাগত, কাঁচা অবস্থায় যে তালের আঁটিটা নরম থাকত, পরে সেটাই কঠিন রকম শক্ত হয়ে যেত!

শুভেচ্ছা হাসি

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আমার কাছেও অ্যাঁ

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।