বসন্ত, ২০১২

সজল এর ছবি
লিখেছেন সজল (তারিখ: বুধ, ০৯/০৫/২০১২ - ৩:২৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বুকে পাথর বেঁধে ছাব্বিশটা বসন্ত পার করেছি, কখনো কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু এবারের বসন্ত ছিলো অন্যরকম। বলছি তারই গল্প।

সকাল আর দুপুরের যুগসন্ধিক্ষণে চোখ ডলতে ডলতে বাসা থেকে বেরিয়ে বাইসাইকেলের দিকে হাত বাড়াই, আর বিরক্তিতে চোখ কুঁচকে যায়। অ্যামেরিকা হচ্ছে পৃথিবীর স্বর্গ, সেখানকার রাস্তাঘাট পর্যন্ত এমন পরিষ্কার হবে যে চাইলেই রাস্তায় নিজের চেহারাটা দেখে নেয়া যাবে। কিন্তু বাসার সামনে রাখা বাইসাইকেল ভরে আছ রাজ্যের ধুলার আস্তরে। কোন মতে ঝেড়ে মুছে সাইকেল সমেত বাসে চেপে পৌঁছাই ডিপার্টমেন্টে। ঢুকতে গিয়ে অবাক হয়ে দেখি প্রবেশ পথের সামনের কনক্রিটের চত্বর ঢেকে আছে হলদে সবুজ ধুলার গাঢ় আস্তরে।

ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দিনগত পাপক্ষয় করে দিনের আলো থাকতেই বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়। সাইকেল চালাতে চালাতে মাথার ঠিক উপর ঘেষে যাওয়া গাছের দিকে চোখ যায়। সে গাছ তার সঙ্গীসাথীদের মতই বেশ ফুলে ফুলে সেজে আছে। ভালোমত তাকালে কিছু মাতাল মধুখোর পোকাকে ফুলে ফুলে ঢলে পড়ার দৃশ্য দেখতে পাওয়ার কথা। থেকে থেকেই কিছু নির্লজ্জ পুরুষ পাখি মিষ্টি গলায় গান গেয়ে গেয়ে তার জিন প্রজন্মান্তরে স্থানান্তরের চেষ্টা করে যাচ্ছে। বেচারা! একেতো সেলফিশ জিনের স্বার্থপরতার স্বীকার, অন্যদিকে সেক্সুয়াল সিলেকশনে মেয়েদের পছন্দের পুতুল হয়ে অন্য অন্য জরুরী কাজ বাদ দিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে।

ডারউইনের অবলা জীবের কথা ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌছে গেলাম, আর দরজা খুলার আগেই বিরাট হ্যাচ্চোওওওও...। এবার বাসার সামনের চত্বরে তাকিয়ে দেখি সেই হলদে সবুজ ধূলা। বটে! এরা নির্দোষ ধূলা নয়, বরং গাছেদের কীর্তি। বসন্ত হচ্ছে অনেক গাছের মেটিং সিজন, তাই তারা বেশুমার পলেন (পুষ্পরেণু) তৈরী করে বখাটের শীষের মত চারপাশের সব বিপরীত লিঙ্গের গাছের উদ্দেশ্যে ছুড়ে দেয়। জায়গা থেকে নড়তে পারেনা, তাও ডেটিং এর সাধ পুরোই। গাছেরা আমাদের যক্ষের মত বিশিষ্ট ভদ্রলোক নয় মোটেই যে মেঘের কাছে কান্নাকাটি করে মরবে। বরং সুযোগ মত বাতাসে তাদের বার্তা ঠিকমত ছড়িয়ে দেয়। আর এই পলেনদের একটা দল এসে পড়েছে আমার চোখে আর নাকে। অবশেষে বসন্ত ছুয়েছে আমাকে!

চোখের জলে নাকের জলে ভেসে আমার প্রায় তিনটা সপ্তাহ গেল। প্রথম বছর পলেনের আক্রমণে আমার শরীর যেমন প্রতিরোধ দেখিয়েছিল, আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম ট্রাক, হাতি ইত্যাদি বিশালাকার জিনিস এড়িয়ে চলতে পারলে আমার আর মৃত্যুভয় নেই। কিন্তু দ্বিতীয় বছরে এসে একই শরীর এমন প্রতিক্রিয়া দেখালো যার সাথে তুলনা চলে যুদ্ধফেরত বীরের ফুলের ঘাঁয়ে মুর্ছা যাওয়ার। ক্রিসমাসের সিজনে দোকানগুলো ভরে যায় চকলেট আর গিফট কার্ডে। আর সামার সিজনে ক্ল্যারিটনে। নানা চকলেটের যেমন নানান ফ্লেভার, নানা অ্যান্টি অ্যালার্জিক ওষুধে তেমনি নানা ধরনের অ্যান্টিহিস্টামিন। যাই হোক, সে এক করুণ ইতিহাস। নানা ওষুধ নিজের পকেটের টাকায় খেয়ে আর একমাস ভুগে পলেন অ্যালার্জি থেকে মুক্তি ঘটে। কিন্তু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।

কথা হচ্ছে আমার টাউন হচ্ছে একটা কলেজ টাউন, এখানে কোন কিছুরই চাষ হয় না। কোন কবি এসে এখানে বাসা বেঁধেছে এমনটাও শুনা যায়নি। তাহলে এত এত পলেন বরদাস্ত করার কী মানে? আমাদের দেশের মত একটা কাজের হাইকোর্ট নর্থ ক্যারোলাইনায় থাকলে তারা নগরপালের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছা প্রণোদিত রূল জারি করতে পারতেন, "চ্যাপেল হিলে পলেন কেন নিষিদ্ধ করা হবে না" জানতে চেয়ে। গাছগুলোকে ধরে ধরে ভ্যাসেকটমি করে দিলেই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান। আর গাছগুলোর উদ্দেশ্যেই বলি, কেন বাপু এত অপচয়? ডারউইনের চ্যালারা তেড়ে আসতে পারে, আরে এই অপচয়ই তো ডারউইনকে ভ্যারিয়েশন আর সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্টের ধারণা যোগান দিয়েছে। কিন্তু বিবর্তন এখন সবার কাছেই প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব, মগজে সীল মারা মুমিনদের ছাড়া। কবিদের আহাজারি আমরা কানে তুলব না, এরই মাঝে এরা টনকে টন কবিতা লিখে রেখেছে, সেগুলোই বা কখন পড়ব!

গহীন বনপথে কি নগরীর সুসজ্জিত ফুটপাথে হেঁটে যেতে যেতে যারা হঠাৎ করে সদ্যফোটা ফুলের হাসি দেখে গলে যাবেন, তাদের প্রতি একটা অনুরোধ। একবার ভেবে দেখবেন, একটা ফুলের হাসির পেছনে কত শত অ্যালার্জিক আদমসন্তানের অশ্রুজল, নাসিকাজল বয়ে গেছে। আপনি ওষুধ কোম্পানির চাকুরে হলে অবশ্য এই অনুরোধ করে লাভ নেই, এক অ্যান্টিহিস্টামিন বেঁচেই আপনার মুখে যে হাসি ফুটেছে, সেটা মুছে দেয়ার ক্ষমতা এই অধমের নেই।


মন্তব্য

মৌনকুহর এর ছবি

বুকে পাথর বেঁধে ছাব্বিশটা বসন্ত পার করেছি, কখনো কোন সমস্যা হয়নি

এই বাক্যের দ্বারা আপনি ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন? ধরেন যে জানতে চেয়ে রুল জারি হয়েছে।

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

সজল এর ছবি

হাইকোররট অবমাননার সিদ্ধান্ত নিলাম চোখ টিপি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

মৌনকুহর এর ছবি

ইয়ে, মানে...

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

বন্দনা এর ছবি

"অবশেষে বসন্ত ছুয়েছে আমাকে! " হো হো হো
মেলাদিন পর লিখলেন। ছিলেন কই??পোলেনদের কবলে পইরা কাইত হয়ে গেছিলেন নাকি?

সজল এর ছবি

পোলেন একটা ফ্যাক্টর, ছিলাম নানাবিধ ঝামেলায়।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সাত্যকি. এর ছবি

হু। এখন আসল কথা পাড়েন। কেন সাতাশ বছরের বসন্তটি ভিন্ন হইলো?
মাঝখানে অবশ্য ডারউইন আর সেলফিশ জিন ঢুকিয়ে বুদ্ধিমানের জন্যে ইশারা দিয়েছেন। হাসি জ্বিন ছড়াচ্ছেন তাইলে শিগগিরি?

সজল এর ছবি

আর খুলে বলি কীভাবে? চোখ টিপি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সাফি এর ছবি

নর্থ ক্যারোলিনার আবহাওয়া কী অনেক শুষ্ক নাকি? আমার অবশ্য পোলেনে সমস্যা হয়না, তবে আমার বৌ মহাশয়া পুরাই কাইত। মতিকন্ঠের ভাষায় - বসন্ত একটা অভিশাপ।

সজল এর ছবি

না, শুষ্ক না। মাঝে মাঝে ব্রিষ্টি(বানান ঠিক হচ্ছে না) হয়। তুলনামূলক গরম এলাকা বলে হয়্ত।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

দ্রোহী এর ছবি

এখনি উদ্যোগ না নিলে সাতাশতম বসন্তও পাথর চেপে ধরেই কাটাতে হবে।

আমার যে পোলেন অ্যালার্জি আছে তা আমার চৌদ্দপুরুষ কোনদিন জানতো না। একবার পোলেনের ঘায়ে কাবু হয়ে জ্বরেটরে ভুগে ডাক্তারের কাছে যাওয়া মাত্র ডাক্তার উপুড় করে ফেলে পোঁদের মাংসে কী একটা ঠুকে দিল! তারপর থেকে আর কোনদিন পোলেন/নলেন ভাইদের দেখা পাইনি। দেঁতো হাসি

সজল এর ছবি

আমি এখন আলারজি মেডিকেশনে আছি, তবে অহিনংস উপায়ে।
বসন্ত নিয়ে সমস্যা নেই, এলারজি না হলে খেয়ালই করতাম না হয়্তো দেঁতো হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

তানজিম এর ছবি

আপনার কষ্টে সহানুভূতি রইল। প্রথম বছর ভীমভবানী হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ঠিকই কিন্তু আপনার ইমিউন সিস্টেম পরাগের সাথে ভালোবাসা করে নিতে ভুলেনি। তাই এবার পুরানো প্রেমিকের দেখা পাওয়ার সাথে সাথেই ভালোবাসার আবেগ নাকের জল চোখের জল হয়ে বেরিয়ে এসেছে। এবার নাহয় রাইন ওডারের উপর দিয়ে গেল, নেক্সট ইয়ারে গঙ্গা-যমুনা হতে পারে। তাই আগে থেকেই একটু ফিট থাকতে হবে, সারভাইভাল বলে কথা।

সজল এর ছবি

হুম, প্রিপারেশন নিতে হবে আগে থেকে।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আহা!
রোদন ভরা এ বসন্ত...

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

সজল এর ছবি

দেঁতো হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

এবারে পাথরটা নামিয়ে ফেলুন।

সজল এর ছবি

দেঁতো হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

এদ্দিন ছিলা কই?

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সজল এর ছবি

ছিলাম আগের ঠিকানায়, নানা কারণে মুড ঠিক ছিলো না।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

নোবেল এর ছবি

তোমার শিরোনাম দেখে তো ভাবসিলাম--কিসু করে ফেল্লা কি না আবার চোখ টিপি ।।পরে পড়ে দেখি পলেন-পলিন-সারা পলিন দের কাহিনি ঃ)

সজল এর ছবি

না, কিছু করা আর হইলো না, আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করতে পারলাম না। পলেনের পাল্লায় পড়লে বুঝতেন, পলেন তুচ্ছ কিছু নয়।

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

কল্যাণ এর ছবি

বসন্ত তাইলে বড়ই ভয়ঙ্কর দেঁতো হাসি ?

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

সজল এর ছবি

দেঁতো হাসি

---
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।