ভিটার গন্ধ

শামীম রুনা এর ছবি
লিখেছেন শামীম রুনা [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ১২/০৫/২০০৯ - ১০:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তারেক ছাই রঙের রোদ-চশমার আড়ালে চোখ ঢেকে গাড়ির গ্লাসের ভেতর দিয়ে রাস্তার দু’ধারে ছুটন্ত শষ্যক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আছে। উইন্ডশিল্ড দিয়ে নাক বরাবর সোজা রাস্তায় চোখ রেখে অপু আড়-চোখে দেখতে পায় তারেকের শেভ করা ফর্সা গালে নীলের ছোপ। লাল টিশার্টের উপর ঝকঝকে মেদহীন তাগড়া গলা তারেকের আÍবিশ্বাস ও স্বচ্ছলতা জানান দিচ্ছে । বিদুৎ চমকের মত পেছনের এক স্মৃতি অপুর মনে উঁকি দিয়ে যায় , যেসব দিনগুলোতে তারেকের গলা এরকম তাগড়া ছিল না । লিকলিকে গলাটা কিছুতে কাঁধের ওপর দাড়িয়ে থাকতে চাইতো না । ঝাঁকড়া চুলের বোঝা নিয়ে মাথাটা সব সময় সামনের দিকে নুয়ে থাকতো । সেসব দিন আমরা পেছনে ফেলে এসেছি ,দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপু ড্রাইভারের মাথার উপর দিয়ে রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রাখে, ওদের পেছনের সিটে বসা মিরা আর সায়রাকে দেখা যায় । সায়রা সাদা শার্টের বোতাম বুক পর্যন্ত খুলে আধ-বছরের জয়তুকে চেপে ধরে ব্রেস্ট ফিডিং করাচ্ছে।ছেলের মুখ আর মায়ের হাতের ফাঁক দিয়ে স্তনের গোলাপি অংশে অপুর চোখ স্থির হয়ে যায় মুহুর্তের জন্য । দৃষ্টি সরিয়ে ও এবার মিরার দিকে তাকায় , মিরা ওদের পাঁচ বছরের মেয়ে রূপকথার চুলের ঝুঁটি করাতে ব্যস্ত । অপু আবার তারেকের দিকে ফিরে “ গ্রামে কেনো যাচ্ছিস তুই? ওখানে তো তোদের কেউ থাকে না । ”
“ আছে । আমার মা-বাবা দু’জন ওখানে ঘুমিয়ে আছে । ” নীচু স্বরে তারেক বলে , যেন নিজেকে শোনানো । অপু কয়েক মুহুর্ত বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাপাটির গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করে ,“ সরি । আমি তাঁদের কথা ভুলে গিয়েছিলাম ।”
“ মা-বাবার কবর জিয়ারত করবো বলে আমার আসা । সেই সাথে জয়তুকে নিজেদের ভিটার মাটি একটু ছুঁইয়ে আনতে চাই । বড় হলে কি আর ও আসবে ? ” অপু তারেকের আবেগ বুঝতে পেরে মাথা নাড়ে ।

ওদের গন্তব্য চট্রগ্রামের মিরেরস্বরাই উপজেলা । মিরেরস্বরাই এ পদুয়া নামক এক নিভৃত গাঁয়ে তারেকের মা-বাবার কবর। তাঁরা যখন বেঁচে ছিলেন তখন তারেক মা-বাবাকে রেখে আমেরিকা চলে গিয়েছিল স্বচ্ছলতার জন্য । তাদের মৃত্যুর খবর পেয়ে ও দেশে আসতে পারেনি ভিসা জটিলতার কারণে । তারপর বিদেশের মাটিতে ভাল কাজ , বাড়ি-গাড়ি , পছন্দের বিয়ে করে যখন ও সেটেলড করলো তখন কি যেন মনের গহীনে ওকে পোঁড়াতে লাগল রাত-দিন । কর্মব্যস্ত দিন পার করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন ঢলে পড়ার কথা তখন রাতগুলো ক্রমশই বিনিদ্র হয়ে ওঠে ওর জন্য । কাঁচের জানালায় তাকিয়ে তারেক বরফ পড়া দেখতে দেখতে শুনতে পেত আষাঢ়ের বৃষ্টির শব্দ । ওর চোখে ধান কাটা শেষে শূন্য ফসলের মাঠে জ্যোৎস্নার আলো প্রতিফলিত হতো । মায়ের ঘোমটা ঘেরা শ্যামল-মুখ সকল মমতা নিয়ে মনের আয়নায় বার বার উঁকি দিত ওর প্রবাস-জীবনে । বাবার গাম্ভীর্য্যরে ভেতর যে স্নেহ লুকিয়ে ছিল তা বাবা চলে যাবার পর দূর দেশে এসে তারেক বুঝতে পারে । এসব আবেগে তারেক ক্রমশ এতটা ডুবতে লাগল, দেশে না এসে ও আর যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না । ওর বুকের সব অক্সিজেন উড়ে গিয়েছিল ,সব অক্সিজেন ফুরিয়ে গিয়েছিল , বুক ভরে অক্সিজেন নিয়ে বাঁচার জন্য তারেকের ভেতরটা হাহাহার করতে লাগল ।

মিরা কিছুটা বিরক্তি নিয়ে রূপকথার চুল বাঁধা শেষ করে মেয়েকে নিজের গা থেকে সরিয়ে বসায় । ওর বিরক্তির কারণ সায়রার যখন-তখন যেখানে-সেখানে বুক উদাম করে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোতে । আরে, আমরা কি বাচ্চাকে বুকের দুধ দেইনি ! তাহলে এতটা খোলামেলা কেনো ? তারেকরা আমেরিকা থেকে ঢাকায় এসেছে তিনদিন হলো , আসার পর থেকে দেখে আসছে মিরা সায়রাকে কোনো জড়তা ছাড়া সবার সামনে হয় বোতাম খুলে নতুবা জামার গলা টেনে নামিয়ে বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিড করিয়ে দিচ্ছে । প্রথম প্রথম দৃশ্যটি দেখে মিরাই তারেক আর অপুর সামনে লজ্জা পেয়েছে। পরে বুঝতে পারলো তারেকও এতে কিছু মনে করে না । এই যে এখন গাড়িতে বসে সাদা শার্টের বোতাম খুলে বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছে সায়রা মিরা লক্ষ্য করেছে রিয়ার ভিউ মিররে সে দৃশ্য বার বার খেয়াল করছে মাইক্রোর ড্রাইভার । একবার তো অপুও ড্রাইভারের মাথার উপর দিয়ে মিররে সায়রাকে এই অবস্থায় দেখে নিয়েছে । আমেরিকায় বেড়ে উঠেছে বলে কি এত খোলামেলা হতে হবে ! মিরার ভ্রু কুঁচকে যায় , এসব এমন সেনসেটিভ ব্যাপার অপুকে কিছু বলাও যাবে না তাহলে স্বামী ওকে মিন ভাববে । পাশে বসা রূপকথা মা’র হাত ধরে টান দেয় , মিরা তাকালে মেয়ে জানায় সে পানি খেতে চায় । মিরা পানি বোতলের মুখ খুলতে খুলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।

জয়তুকে দুধ খাওয়ানো হলে সায়রা ওকে কাঁধে ফেলে আস্তে আস্তে পিঠে চাপড় দিতে দিতে জানালার গ্লাসের ভেতর দিয়ে বাইরে তাকায় । বাইরে মগজ-ভাজা রোদ , এসি গাড়ির ভেতর বসে থেকেও ও রোদের তেজ শরীরে অনুভব করে । গাড়ি ছুটে চলছে সামনের দিকে , রাস্তার দু’পাশের শষ্যক্ষেত কিংবা জলা-ডোবা কোনো কিছুই সায়রার কাছে আকর্ষণীয় লাগছে না । রাস্তায় চলমান বাস-ট্রাক বা মানুষ সব কিছুতে দারিদ্র্য প্রকট ভাবে দৃশ্যমান । গাদাগাদি মানুষ ভর্তি বাস গুলো ডিমওয়ালা কাছিমের মত মন্থর গতিতে হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে চলছে , দেখে মনে হয় যে কোন সময় একদিকে কাত হয়ে পড়ে সকল লীলা সাঙ্গ করবে। অবশ্য ওদের মত মাইক্রো , প্রাইভেট কার বা লাক্সারী বাসের সংখ্যাও রাস্তায় খুব কম না । এক রাস্তায় সব রকম পরিবহন চলছে ,এমন কি ভ্যান বা সাইকেলও । সায়রা দেখে ওদের সামনের সিটে বসা তারেক আর অপু মগ্ন হয়ে কথা বলছে ।
“ তারেক Ñ ।” সায়রার মৃদু কন্ঠের ডাকে তারেক পিছনে ফিরে তাকায় ।
“ বেবীকে কিছু সময় রাখ । আমি টায়ার্ড হয়ে গেছি ।”
“ শিওর Ñ ” তারেক বাঁকা হয়ে জয়তুকে নিতে গেলে মিরা সায়রার কোল থেকে ছোঁ দিয়ে বাচ্চাকে নিয়ে নেয় ।
“ তোমার টায়ার্ড লাগছে আমাকে বলবে না , আমি দেখছি জয়তুকে ।”
“ থ্যাংকস । ” সামান্য হেসে সায়রা বলে । বাংলাদেশে সে আসার পর থেকে মিরাকে দেখছে , কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে না । কখনো মনে হয় সে বুঝি খুবই আন্তরিক আবার কখনো মনে হয় সে সায়রাদের পছন্দ করছে না । যেমন কিছু সময় আগে ও মিরার চোখে বিরক্তি দেখেছে , কেনো তা ও জানে না তবে ওর কাছে ব্যাপারটি ভাল লাগেনি । মিরার এই বিরক্তি ভাব তখনই হয় যখন সে বেবীকে ব্রেস্ট ফিডিং করায় । সায়রা বুঝে ওঠে না একজন মা সন্তানকে স্তন পান করানোতে মিরার আপত্তি কোথায় ? এই ব্যাপারে পরে তারেকের সাথে কথা বলা যাবে । সায়রা শার্টের বোতাম ঠিক করে চোখে সানগ্লাস পরে নিয়ে জানতে চায় “ আমাদের যেতে আর কত সময় লাগবে ? ”
“ জার্নি তোমার কেমন লাগছে সায়রা ? ” তারেক জানতে চায় ।
“ ভালই । ” ঠোঁট উল্টে সায়রা বলে ।
“ তুমি কি এই প্রথম বাংলাদেশে এলে সায়রা ? ” অপু পিছনে না ফিরে গলার স্বর উঁচু করে জানতে চায় ।
“ না , ছোটবেলা আমার বয়স যখন দশ-এগারো তখন একবার মা-বাবার সাথে এসেছিলাম । সে ট্যুরে আমরা এই দেশে বিশ দিন ছিলাম , ঐ আমার বাংলােেদশের স্মৃতি ।” ব্যাগ থেকে হেয়ার ব্রাশ বের করে চুল আঁচড়ায় সায়রা ।
“ দেখ হানি,আমাদের দেশটা কত সুন্দর !” জানালার বাইরে চোখ রেখে তারেক স্বপ্নাতুর কন্ঠে বলে । সায়রা তারেকের দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকায় তারপর কাঁধ ঝাকিয়ে আবার চুল আঁচড়ানোতে মনোযোগ দেয় ।

অপু ঘাড় ঘুরিয়ে একবার মিরা আর রূপকথাকে দেখে নেয় , মিরা জয়তুকে কোলে শুইয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে । বাচ্চাটা বেশ চঞ্চল, কিছুতেই মিরা ওকে নিজের বশে আনতে পারছে না । সায়রার এখন মিরা বা বাচ্চা কারো প্রতি মনোযোগ নেই সে চুলের ব্রাশ ব্যাগে রেখে ছোট আয়নায় নিজের মেকাপ ঠিক করে নিচ্ছে । অপুর ঠোঁটে হাল্কা হাসি খেলে যায় , তারেক দীর্ঘ সময় পার করে দেশে এসে দেশের জন্য যেমন ভালবাসা অনুভব করছে সায়রা তেমনটা করছে না সম্ভবত সে দেশকে তেমন ভাবে দেখেনি বলে কিংবা এই দেশে সে জন্মগ্রহণ করেণি বলে ! আর দেশের প্রতি তারেকের এত মমতা অপুর কাছে কেমন আরোপিতও লাগছে , কই যে সময় ওরা দু’জন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এক সাথে কাটিয়েছে তখন তো তারেকের মাঝে দেশ নিয়ে সামান্য মাতামাতিও দেখেনি । নব্বইয়ের গণআন্দোলনে সকল মানুষ যখন উত্তপ্ত তখন তারেককে দেখেছে পাঠ্য বইয়ে মুখ গুঁজে কলেজে আসা-যাওয়া করতে । বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনেও তারেক তেমনি , রাজনৈতিক দল দূরে থাকুক কোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও ওর সম্পৃক্ততা ছিল না । “ দেশের প্রতি ভালবাসা ” এ রকম কোন আবেগঘন বক্তৃতাও তারেকের মুখে শুনেছে বলে অপু মনে করতে পারে না । হতে পারে প্রবাস-জীবনে তারেক দেশকে উপলব্ধি করতে পেরেছে । দেশের প্রতি ওর মমতা দেশকে না দেখে মনের গহীনে তৈরী হয়েছে । অপু ওর একটি হাত তারেকের কাঁধে রাখে , তারেক মুখ ঘুরিয়ে বন্ধুর দিকে তাকায় , অপু কিছু বলে না সামনে পিচঢালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবে , বহু কাল বাদে আবার বন্ধুর সাথে দেখা হলো ।
“ স্যার , গাড়ি একটু সাইট করি ? ” ড্রাইভার অপুর অনুমতি চায় ।
“ কেন ?” ভাবনার তল থেকে উঠে অপু জানতে চায় ।
“ সামনের গাড়ির ড্রাইভার হাত নেড়ে থামতে বলছে ।”
“ কেনো ? কে ও ?”
“ আমাদের রেন্টেকারের গাড়ি ওটা ,পরিচিত ড্রাইবার । হয়ত কোনো সমস্যায় পড়েছে। ” গাড়ির গতি শ্লথ করে ড্রাইভার বলে ।
“ দেখ কি চায় । ” অপু অনুমতি দিলে ড্রাইভার সামনের গাড়িকে ইশারায় থামতে বলে নিজের গাড়িটাকে ওটার পেছনে রাস্তার পাশে একটি চায়ের টঙ দোকানের সামনে দাড় করায় । ড্রাইভার সামনের গাড়ির কাছে চলে গেলে তারেক গাড়ি থেকে নেমে সান গ্লাস খুলে হাত-পা ঝাড়া দিয়ে চায়ের দোকানের সামনে দাড়ালে অপুও নেমে আসে । বাবাকে নামতে দেখে রূপকথা হাত বাড়িয়ে দেয় ওকে নামানোর জন্য ।
“আমরা বাবা হয়ে গেছি তাই না অপু ? কোনও একসময় ভাবেছিলাম কি আমরা বাবা হবো ! ” অপুকে রূপকথাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে দেখে তারেক বলে । অপু তারেকের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে।
“ এ্যাই তারেক , আমি নামতে চাচ্ছি । কোন সমস্যা নেই তো ?” সায়রা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেয় ।
“ কিসের সমস্যা ! নেমে এসো ।” অপু সায়রাকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করে ।
“ মিরা তুমি নামবে না ? ” সায়রা নেমে গেলে অপু জানতে চায় ।
“ না থাক , নামবো না । বাচ্চাটা আমার কোলে ঘুমাচ্ছে । ” অপু বাচ্চা কোলে মিরাকে দেখে হাসে , “ রূপকথা বড় হয়ে যাচ্ছে ,এবার সেকেন্ড বেবী নিয়ে নিলে কেমন হয় ?” মিরা অপুর দিকে কপট ভ্রুকুটি করে তাকায় , তখন অপুর পেছনে এসে দাড়ায় ওদের গাড়ির ড্রাইভার ও অন্য একজন লোক।মিরার চোখের ভাব বুঝে অপু পেছনে ঘুরে দাড়ায় ।
“ স্যার , ও ওই গাড়ির ড্রাইভার ,” ওদের ড্রাইভার বলে , “ ওই গাড়ির পেসেঞ্জারদের একটা হেল্প লাগবে ।”
অপু তারেক দু’জন চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকায় , মিরা সন্দিহান দৃষ্টিতে ড্রাইভার দু’জনের দিকে তাকায় , দিনকাল যা খারাপ হয়েছে , মানুষ নিত্য নতুন ট্র্যাপে ফেঁসে যাচ্ছে , তেমনি কোন ট্র্যাপ নয় তো ? সায়রার এদিকে কোনো নজর নেই , সে চা দোকানির চা বানানো দেখছে নিবিষ্ট মনে আর আশপাশের এলাকার লোকেজন যারা দোকানের সামনের বেঞ্চে বসে গুলতানি মারছিল ,তারা রক্তচোষার মত চোখ গোল গোল করে বিদেশী পোষাকের দেশী চেহারার সায়রাকে গিলে নিচ্ছিল।
“ কি হেল্প ? ” অপু জানতে চায় ।
“ স্যার , আমার গাড়ির পেসেঞ্জাররা আসছে লন্ডন থেইকে, গ্রামের বাড়ি যাবে বলে । ” সামনের গাড়ির ড্রাভিার কথা শুরু করে , “ আমি সকালে তাগোরে নিয়ে রওনা হবার আগ পর্যন্ত জানতাম না যে তারা এই দেশে একেবারে নতুন এয়েচে । এই আধেক রাস্তা আসার পর এখন বলে তারা তাগোর গ্রামের বাড়ি চেনে না । আমারে ঠিকানা দিয়া বলে , এই ঠিকানায় নিয়া চলো । ঠিকানাটা যদি কোন শহরের হতো তাও না হয় খুঁজে বার করা যেতো , এটা হলো গিয়ে গ্রামের ঠিকানা । আমি হলাম উত্তরের লোক , খেপ যা মারি ওদিকেরই , ্এইবারই প্রথম এদিকে এয়েচি , এই দিকটা তেমন ভাল চিনিও না । এসে পড়েচি ঝামেলায় , বলে এই দেশের মানুষজন ভাল না , ওরা এই দেশে নতুন এসেছে জানতে পারলে সবাই ওগোর ক্ষতি করবে । তাই কারোর কাছে জানতে দিতেও চায় না । মফিজ ভাইরে দেখে বললাম , আমার পরিচিত লোক উনারে জিগাস করি , বহুত ভাবনা চিন্তা করে অনুমতি দিল । তো এখন মফিজ ভাইও বলতে পারলো না , স্যার আপনারা কি বলতে পারবেন এই গ্রামটা কোথায় ?” সে একটি কাগজের টুকরো এগিয়ে দিলে তারেক হাত বাড়িয়ে নেয় ।
“ বলছেন নতুন, আবার বলছেন গ্রামের বাড়ি যাবে , বুঝতে পারলাম না ।” অপু বলে ।
“ ওনারা নাকি ছোটবেলায় দেশ ছাড়ছে , তারপর আর আসে নাই দেশে । এখন এয়েচে ভিটা দেখতে ।”
“ ভিটা দেখতে ! ” তারেক অস্ফুট উচ্চারণ করে ।
“ বলছে সে ভিটা উনাদের নাই , তবু এক নজর দেখতে চায় নিজেদের ভিটা-মাটি । এখন গ্রামই যদি না পায় তো ভিটা দেখবো কই থিকা ?”
“ শুধু ভিটা দেখতে এসেছে ?” অপু বিস্মিত ।
“ তাই তো বলে ওরা । গ্রাম খুঁইজে না পাইলি এমনি এমনি ঘুরাফিরা কইরে ফেরত যাইতি হইবে শেষ পর্যন্ত । সময়ও নাকি বেশি নাই---ঐ যে স্যার উনারা আসচে ---। ”
সামনের মাইক্রো থেকে এক মহিলা আর বিশ-একুশের এক ছেলে ওদের দিকে এগিয়ে এলো । দেখে মহিলাটির বয়স অনুমান করা যায় না , হতে পারে পঁয়তিরিশ কিংবা পঁতাল্লিশ , মাঝারি উচ্চতার মহিলার পরনে সালোয়ার-কামিজ , হাঁটার ধরণ বলে দিচ্ছে খুবই কর্মট আর সপ্রতিভ একজন মানুষ তিনি। ছেলেটি পরে আছে ছেঁড়া জিনস , টি-শার্ট আর স্নিকার । প্যান্টটি দেখলে মনে হচ্ছে এই বুঝি খুলে পড়ে যাবে ।
“ আমরা বিপদে পড়েছি , আপনারা কি আমাদের একটু সাহায্য করতে পারবেন ? ” দ্বিধাহীন কন্ঠে মহিলাটি জানতে চায় ।
অপু তারেকের হাত থেকে কাগজের টুকরোটি নেয় ,“ তুই তো এই এলাকার ছেলে , চিনিস নাকি গ্রামটা ?” কাগজের টুকরোয় চোখ বুলিয়ে অপু জানতে চায় । তারেক হাসে ,
“ আমার অবস্থা ওদের চে’ আর ভাল কোথায় ! নোয়াখালির ছাগল নাইয়ার মায়ানি গ্রাম--। চিনি না । ছাগল নাইয়ায় এক সময় আমাদের কিছু রিলেটিভ ছিল , সেই ছোটবেলা গিয়েছিলামও , এখন তো আর তাদের কারো সাথে কোনো যোগাযোগ নাই । মায়ানি গ্রাম ? না সরি, চিনি না ।”
“ সরি আপনাদের কোন হেল্প করতে পারলাম না ।”কাগজের টুকরোটি ফিরিয়ে দেয় অপু ।
“ কিছু মনে করবেন না , আপনারা গ্রামটি ঠিকভাবে চিনেন না , অথচ গ্রামের খোঁজে লন্ডন থেকে এসেছেন কেনো ?” তারেক জানতে চায় । মহিলাটি ইতস্তত করে একটু সময় , চোখের দৃষ্টিতে যেন ওদের পরিমাপ করে নিতে চায় ।

“ আমার নাম পূরবী মিত্র ।” জড়তাহীন স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে মহিলা কথা শুরু করে , ওরা সবাই - তারেক, রূপকথাকে কোলে নিয়ে অপু , সায়রা এবং ঘুমন্ত জয়তুকে কোলে নিয়ে মিরাও গাড়ি থেকে নেমে এসেছে, সবাই নবাগত মহিলা মানে পূরবী মিত্রকে ঘিরে বসেছে চা দোকানের সামনে একটি বড়ো কাঠাল গাছের নিচে মুখোমুখি পাতা দু’টি বেঞ্চে । সবার হাতে ধরা চায়ের কাপ । পূরবীর সাথের তরুণটি কিছু দূরে আলাদা একটি টুলে বসে মাথা ঝুঁকিয়ে হাতের মোবাইলে সম্ভবত কোন গেম বা ইন্টারনেট সার্চ করছিল । পূরবী মিত্র দূরে বসা তরুণের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার কথা শুরু করে , “ ও আমার ছেলে দেব , দেবজিৎ মিত্র । ও এই প্রথম বাংলাদেশে এলো । আমি এসেছি আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটা দর্শণে । সে ভিটা ,সে গ্রাম আমি যখন ছেড়ে যাই তখন আমার বয়স ছিল নয় বছর । নয় বছর বয়স ভিটা ,গ্রাম দেশকে জানা বা ভালবাসার জন্য সম্ভবত খুব বেশি বয়স না , কি বলেন আপনারা ? তেমনি আমি যখন এ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম তখন দেশের জন্য তেমন কোনো মায়া অনুভব করিনি । ১৯৭১-এর সে দিনগুলোতে কত তাড়াতাড়ি এই দেশ ছেড়ে চলে যাব সে ভাবনায় আমাদের দিনের শুরু হতো আবার সে ভাবনায় আমাদের রাত গুলো শেষ হতে চাইতো না। ৭১- এর মাঝামাঝি আমার বাবা জমি-ভিটা সব একজনের সাথে বদল করে নেন , যার পরিবর্তে সে লোক আমাদের এ দেশ ছাড়তে সাহায্য করেছিলেন । বাবা আমাদের নিয়ে কলকাতা চলে যান । কলকাতা যেয়ে আমরা প্রতিদিনের মৃত্যু আতংক থেকে বাঁচলাম । মনে হলো এই বুঝি মুক্তি ! বেঁচে থাকবার আনন্দ ! ” পূরবী মিত্র কথা থামিয়ে দূরের শষ্যক্ষেতের দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে নিজের মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিলেন । “ কলকাতা যেয়ে আমার বাবা নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারলেন না । বললেন , পরবাসে যখন থাকতে হবে আমাদের তবে এখানে কেনো ? আরো দূরে কোথাও চলো । কয়েক বছরের মাথায় আমরা ইংল্যান্ড চলে গেলাম । তারপর থেকে আমরা আজো সেখানে আছি । কি এক অভিমানে বাবা পরবর্তী জীবনের কখনো বাংলাদেশ বা ইন্ডিয়া কোথাও আসেননি । তবে তিনি আমাদের বাংলা সাংস্কৃতি থেকে কখনো দূরে সরে যেতে দেননি । বাবার শিক্ষার কারণে আপনাদের সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি ।” সামান্য একটু হাসলেন পূরবী মিত্র ,তাতে তার অহংকার প্রকাশ পেল ।
“ আপনি চমৎকার বাংলা বলেন ।” মিরা প্রশংসা করে ।
“ ধন্যবাদ । আমার বাবার বয়স বর্তমানে আশির উপরে । তিনি এখন হাসপাতালে আছেন, মৃত্যুশয্যায় । ক্যান্সারে ভুগছেন বেশ কিছু দিন থেকে ,খুবই কষ্ট পাচ্ছেন । ডাক্তাররা তার বেঁচে থাকার সময় কয়েক বার বেঁধে দিয়েছিলেন , তারপরও তিনি সে সময় অতিক্রম করে অলৌকিক ভাবে বেঁচে আছেন । বাবার কষ্ট দেখে আমরা তার মৃত্যু কামনা করি , কিন্তু মৃত্যু তার কাছে কি কারণে যেন হার মেনে আছেন ।” পূরবী মিত্রের চোখের কোন অশ্র“ জমে চিক্ চিক্ করে উঠে , গড়িয়ে পড়ে না । তিনি নিজেকে ধাতস্ত করে আপন মনে বলার মত করে আবার কথা শুরু করেন , “ হাসপাতালের বিছানায় বাবা একদিন আমার হাত ছুঁইয়ে কাছে ডাকলেন । আমি তার মুখের কাছে কান নিয়ে গেলে বললেন , আমার ভিটা মাটির গন্ধ নাকে না পেলে আমার মরণ হবে না ।--- বাবাকে তো আর দেশে আনা সম্ভব না ---,তাই ---।” পূরবী মিত্রের চোখের কোনে জমে থাকা অশ্র“ এবার তার গাল বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসে। মাটি থেকে দূরে গেলে মাটি এমন করেই বুঝি টানে !


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

লেখার হাত চমৎকার আপনার ! খুব ভালো লাগলো লেখাটি। অভিনন্দন।
এমন লেখা আরো পাবো নিশ্চয়ই !

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

খুব ভালো গল্প হয়েছে।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

শামীম রুনা এর ছবি

যাক।বাঁচা গেলো।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

ভুতুম এর ছবি

লেখাটা চমৎকার লাগলো। আরো বেশী ভালো লাগার কারণ আমার দেশের বাড়িও মিরসরাই বলে। একটা ছোট কথা, মায়ানি নামে মিরসরায়েও একটা গ্রাম আছে, আবুতোরাব এর পর পর। ছাগলনাইয়াতে আছে কিনা অবশ্য জানি না।
আরো লিখুন।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ।
জায়গা বিভ্রাটটা আসলে গল্পের কারণে।মায়ানি গ্রামটা আমিও চিনি।ওখানে আমার নানা বাড়ি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

ভুতুম এর ছবি

আরি আজব! মায়ানিতো আমারও নানার বাড়ি।

-----------------------------------------------------------------------------
সোনা কাঠির পাশে রুপো কাঠি
পকেটে নিয়ে আমি পথ হাঁটি

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চমৎকার চলুক

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ হে নিয়মিত পাঠক।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

তানবীরা এর ছবি

অসাধারন রুনা অসাধারন, পাঁচ তারা

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ তানবীরা।
আকাশে এখন অনেক তারা।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

মূলত পাঠক এর ছবি

সুন্দর।

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

হুম... সুন্দর...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

শামীম রুনা এর ছবি

অন্তস্থ ধন্যবাদ।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

যুগপৎ মুগ্ধ হয়ে পড়লাম, এবং পড়ে মুগ্ধ হলাম...
চলুক

শামীম রুনা এর ছবি

পড়ার জন্য এবং পড়ে কমেন্ট করার জন্য যুগপৎ ধন্যবাদ।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

অনেক ভালো লাগলো। আরো লিখুন।

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ।আপনারা উৎসাহ দিলে আরো লেখার আশা করি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।