নীরব বৃক্ষ

শামীম রুনা এর ছবি
লিখেছেন শামীম রুনা [অতিথি] (তারিখ: রবি, ২১/০৬/২০০৯ - ১২:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমরা বাবা আর মাকে আব্বা আম্মা ডাকতাম এবং সে ডাকে বুকের ভেতর পরম এক সুখ অনুভব করতাম। আজো করি। আজ আমার সাদাসিদা আব্বাকে খুব মনে পড়ছে, সে কথাই বরং লিখি।
আব্বার সাথে আমাদের সব ভাই-বোনের দূরত্ব বজায় রাখা সম্পর্ক ছিল। এর জন্য হয়তো আব্বার ট্যুরের চাকরি দায়ী ছিল। চাকরির কারণে তাঁকে মাসের বেশির ভাগ দিন আমাদের থেকে দূরে কাটাতে হতো। সন্তানদের থেকে দূরে থাকতেন বলে হয়তো তিনি নিজেকে কিছুটা অপরাধী ভাবতেন আর তাই আমাদের শাসন করতেন না কোনো কিছুতে। শোনা কথা, একবার নাকি আব্বা আমার সেজ বোনের উপর খুব বেশি রেগে গিয়ে ওকে এক টুকরো খড় নিয়ে মারতে গিয়েছিলেন। আব্বার সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল বিস্তর, তাঁর দাঁত-ভরা মুখের হাসি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সে কারণেও হয়তো তাঁর সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। আমার ছোট বোনের ছোটবেলার বিশাল দুঃখ ছিল, ওর বন্ধুদের বাবাদের সবারই দাঁত আছে শুধু আমার আব্বার দাঁত নেই। আমার অন্য ভাই-বোনদের সাথেও তাঁর শাসনের সম্পর্ক যেমন ছিল না তেমনি অন্তরঙ্গ সম্পর্কও ছিল না। অপর দিকে আমরা সবাই ছিলাম যেন আম্মার সন্তান। আম্মা যেমন ছিলেন আমাদের বন্ধু তেমনি ছিলেন আমাদের শাসনকর্ত্রী। আমাদের যত রাগ-অভিমানের পালা তাকেই সামলাতে হতো। আবার আম্মার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারতাম, তিনি কি আমাদের উপর কোনো কারণে রেগে আছেন কি নেই। আব্বা ছিলেন সংসারের নীরব ব্যক্তি। আমাদের বন্ধুদের বাবাদের দেখতাম সন্তানের সাথে ভালো-মন্দ কত শত ব্যাপারে কথা বলতো, আর আমাদের আব্বা যেন জানতেন না সন্তানের সাথে কি কথা বলতে হয়। এই নিয়ে ছোটবেলায় মনে একটি কষ্ট পুষে রাখতাম বড়ো হবার সাথে সাথে সে সব কষ্টরা বনবাসে চলে গেছে। কেননা ততোদিনে জেনে গিয়েছি, নীরব থেকেও একজন মানুষ কি পরিমান মমতা আর ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখতে পারেন স্ত্রী, সন্তান আর সংসারকে। তখন থেকে আব্বার জন্য ধীরে ধীরে বুকের অতল তলে জমে উঠেছে মুক্তার মতো এক ভালবাসা ( নাকি টান! )।

আমাদের বোনের সংখ্যা বেশি থাকা নিয়ে কেউ কোনো কথা বললে আব্বা ভীষণ রকম রাগ করতেন। আমার সেজো বোনের জন্মের পর নানী খুবই বিরক্ত হয়ে জামাইকে ( আব্বাকে) বলেছিলেন, “ এবারও একটা ঝিওলা ( আঞ্চলিক শব্দ, অবজ্ঞা করে মেয়েদের বলা হয় ) হইছে।” আব্বা প্রথম এবং শেষবার শাশুড়ীর উপর ভীষণ রেগে যান। এরপর মেয়ে নিয়ে আব্বাকে কেউ কোনো কথা আর বলেনি। আমাদের সমাজে কন্যা সন্তানের প্রতি এই মনোভাব বর্তমানেও দুর্লভ। আব্বা ছিলেন কিছুটা আত্মভোলা ধরণের মানুষ। তিনি বাসায় কখনো খালি হাতে ফিরতেন না, সব সময় আমাদের জন্য হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন। একবার জিলাপী নিয়ে বাসায় ফিরে তা দিতে ভুলে যান এবং জিলাপী থেকে যায় তাঁর কোটের পকেটে। পরের দিন সে কোট পরে তিনি যথারীতি অফিসে যান এবং জিলাপীর লোভে তাঁর পকেটে হানা দেওয়া পিঁপড়াদের আক্রমনের শিকার হন।

আমাদের ঘিরে আব্বার ভালবাসার কত অসংখ্য স্মৃতি! কতোগুলো মনে পড়ে আবার কতোগুলো হারিয়ে গেছে স্মৃতির ভান্ডারের অতলে। আজ আব্বাকে নিয়ে যে স্মৃতি মনে বারবার উঁকি দিচ্ছে তা তেমন কোনো ঘটনা বহুল নয় তারপরও এই স্মৃতি আমাকে আজো আবেগে আলোড়িত করে । আবার কখনো আব্বা না থাকার দুঃখে কাঁদায়।

আমার তখন এইচ.এস.সি. পরীক্ষা শুরু হয়েছে। একই দিনে দুই পেপার, ফার্স্ট পেপার সকালে তারপর এক ঘন্টার বিরতিতে সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা হতো। মাঝে এক ঘন্টার বিরতিতে অভিভাবকরা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রচুর খাবার-দাবার নিয়ে হলে উপস্থিত হতো। সারা বছর যতো না খাওয়াতো এক ঘন্টার বিরতিতে মনে হয় তারচে’ অনেক বেশি খাওয়ানোর চেষ্টা চালাতো। আমার সিট পড়েছিল ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। ইডেন অনেক বড়ো কলেজ, সে কলেজে কোনো মেয়েকে খুঁজে বের করা অনেক ঝামেলার ব্যাপার। বিশেষ করে একজন পঁয়ষট্রি বছরের মানুষের জন্য, যার দৃষ্টিতে প্রতিটি মেয়েকে নিজের মেয়ে মনে হয়। যাই হোক, আমি মিরপুর থেকে আব্বার সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে এসেছি, প্রচন্ড ভিড়, ভিড় ঠেলেঠুলে আমি হলে ঢুকে পড়লাম আব্বার সাথে কোনো কথা হলো না পরীক্ষা শেষে তাঁর সাথে কোথায় দেখা করবো না করবো ইত্যাদি ব্যাপারে।

ফার্স্ট পেপার পরীক্ষা হয়ে গেলে এক ঘন্টার বিরতি পাওয়া গেল, হলের ভেতরে অভিভাবকেরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লো হাতে বস্তা বস্তা খাবার-দাবার নিয়ে। কোনো কোনো মা মেয়ের মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে আবার কেউবা বাতাস করছে হাত পাখা দিয়ে। এই সব আহ্লাদিপনা কখনো হয়তো দৃষ্টিকটু লাগে আবার কখনো নিজ কপালে না জুটার জন্য নিজেকে বঞ্চিতও লাগে। ততোদিনে আমাদের আহ্লাদ দেখানোর আম্মা আমাদের অবহেলায় ফেলে রেখে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে আব্বাকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথায় আব্বা! তাঁকে খুঁজে না পেয়ে খুবই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, পেটে বেশ ক্ষিধে টের পাচ্ছি, পরীক্ষার টেনশনে গতকাল রাত থেকে কিছু খেতে পারিনি। তারপর সেকেন্ড পেপারে যে একটু চোখ বুলিয়ে নেবো তারও উপায় নেই, সব বই-পত্র আব্বার কাছে। আব্বাকে না পেয়ে নিজের সিটে বসে বসে অন্যদের দেখতে লাগলাম মনোযোগ দিয়ে।

সেকেন্ড পেপার শেষে হল থেকে আস্তে ধীরে বের হলাম। বুঝতে পেরেছিলাম ভিড়ের মাঝে আব্বাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনুমান ঠিক, ভিড় হাল্কা হলে দেখতে পেলাম, কলেজ বাউন্ডারির একটি গাছের নিচে আব্বা বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে আমার কলেজ ব্যাগ হাতে খাবারের বক্স। এর মাঝে কখন যেন এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেছে, বৃষ্টি থেকে গা বাঁচানোর কোনো জায়গা হয়তো খুঁজে পাননি আব্বা, ভিজে কাপড় গায়ের সাথে ল্যাপ্টে আছে। আমি কিছুটা ভয় পেলাম, আমাকে না পেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে বলে এখন হয়তো আমাকে ধমক-ধামক লাগাবেন। আমি ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে যেয়ে দাঁড়ালে তিনি ম্লান চোখে আমার দিকে তাকালেন। ম্রিয়মান কন্ঠে বললেন,“ না খেয়ে পরীক্ষা দিলি, কষ্ট হয়েছে নারে? কিছুতেই তোকে খুঁজে পেলাম না। বুড়ো হয়ে গেছি, সব কটা মেয়েকে তোর মতো লাগে। আমার জন্য তোর কষ্ট হলো রে মা।” আব্বার চোখে পানি চিক্চিক্ করে উঠলো, এবং কি আশ্চর্য সে পানি তাঁর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো! অন্যরা তাঁকে কাঁদতে দেখবে- এই বিষয়টি তিনি বিস্মৃত হয়ে গেলেন। আমি সব কিছু ভুলে মুগ্ধ চোখ মেলে আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ইচ্ছে হলো, তাঁর চোখের পানি ছুঁইয়ে দেখি। ইচ্ছে হলো, আব্বার হাত ধরে বলি, “ ভালো হয়েছে আমাকে খুঁজে পাননি। খুঁজে পাননি বলেই তো আপনার বুকে আমার জন্য এতো যে মায়া লুকানো আছে তা আজ দেখতে পেলাম।” মুখ ফুটে কোনো কথা বলতে পারলাম না, গলার কাছে ব্যাথার দলাটি গিলে নিলাম কেবল। আমরা প্রিয় আরো অনেক কথা প্রিয়জনদের বলতে চেয়েও বলি না। বলা উচিত, সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে, নয়তো কোনো দিন দেখবো সুযোগ আর সময় নেই। যেমন আব্বা-আম্মাকে অনেক কথা বলার ছিল,তাঁদের জন্য কিছু করার ছিল........।


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

কী বলি আর, আপনি আপনার আব্বুর মতোই সাদাসিধে ভালোমানুষ বোধ হয়, লেখাটাও হয়েছে সেই রকম, সরল আর মমতায় ভরা।

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ পাঠকদা।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

জিজ্ঞাসু এর ছবি

সাবলীল লেখা। মায়ের মমতা হারানো আপনার ভাগ্যে বাবার ভালবাসা আরও অনেক দীর্ঘস্থায়ী হোক!

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

শামীম রুনা এর ছবি

আমার বাবাও অনেক বছর হয় আমাদের ছেড়ে গেছেন।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সুন্দর লেখা।

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো খুব।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

শামীম রুনা এর ছবি

লেখাটা ভালো লাগার জন্য আমারও ভলো লাগলো।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

খুব টাচি...

শামীম রুনা এর ছবি

বাবা-মেয়ের সম্পর্ক যে, প্রতিটি টুকরো টুকরো স্মৃতিই টাচি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

ম্যাডাম, লেখেনতো বেশ। কিন্তু লেখা ছেপে দিয়ে এইভাবে চুপচাপ বসে থাকলে কমেন্ট পাবেননা। এর জন্য অন্য ব্লগারদের পোস্টে আপনাকে কমেন্ট করতে হবে। শেয়ার করতে হবে।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

শামীম রুনা এর ছবি

বুদ্ধি বাতলানোর জন্য আপনাকে ধন্যবাদ স্যার।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

তানবীরা এর ছবি

রুনা, কমেন্টের জন্য লিখতে হবে না, লেখা হৃদয় ছুলে কমেন্ট এমনিতেই চলে আসবে।
খুব হৃদয় ভেঙ্গে দেয়া লেখা রুনা।

অফটপিক, বিয়ের দিন তোমাকে খুব মিষ্টি দেখাচ্ছিলো

---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

শামীম রুনা এর ছবি

ধন্যবাদ তানবীরা।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি মুগ্ধ।এই মুহুর্তে 'নীরব বৃক্ষের' যোগ্য কমেন্ট লিখা আমার পক্ষে সম্ভব না।যদি কখনো পারি তো লিখব।এখন আমার মুগ্ধতার কথা জানিয়ে রাখলাম।
শাফিন হক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।