ভূত কিংবা মিথ অথবা ঘুম পাড়ানী কাহিনী

শামীম রুনা এর ছবি
লিখেছেন শামীম রুনা [অতিথি] (তারিখ: শনি, ১১/০৭/২০০৯ - ১১:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আবার আমার শৈশবের সুন্দর ছিমছাম সেই শহরের গল্প করতে এসেছি। এবার ঝর্ণা বা পাহাড়ের গল্প নয়, এবারে অন্য রকম গল্পই বরং বলি.......
সেই শহরে কোনো চোর বা ডাকাতের উৎপাত ছিল না, ছিল না বখাটে তরুনদের উগ্র চলা-ফেরা। তাই মানুষেরা স্বস্তির জীবন যাপন করতো সেখানে। যতই ভালোর গুনগান করা হোক সব ভালোর মাঝেও কিছুটা মন্দ থাকবে-এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম।
সেই শহরের প্রান্ত ঘেসে ছিল মগচিতা আর শ্বশান ( এখন আর প্রান্তে নয়, শহর বাড়তে বাড়তে চিতা আর শ্বশান দু’টিকেই বুকে তুলে নিয়েছে)। দু’টির মাঝে দূরত্ব ছিল আনুমানিক এক কিলোমিটারের মতো তবে দু’টির অবস্থানই ছিল একই ঝিরির পাড়ে। প্রচলিত ছিল যে, এই শ্বশান বা মগচিতায় বাস করে ভয়ংকর দর্শন এক ঘোড়া। যে ঘোড়ার চোখ দু’টি আগুনের ভাটার মতো জলন্ত আর সারা শরীর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মানুষের চোখাকৃতির চোখ। এই চোখগুলি সেই সব মানুষের যারা এই ঘোড়ার পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে মরেছে। সে ঘোড়া গভীর নিশুতি রাতে শ্বশান থেকে মগচিতা পর্যন্ত রাস্তাটুকু ধরে দৌড়ায় আর তীব্র কন্ঠে চিঁ-হি, চিঁ-হি করে ডাকে। অনেকে রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়েও এই ডাক শুনতে পেয়েছে। আবার অনেকে নাকি এই ভয়ংকর দর্শন ঘোড়াকে নিজের চোখে দেখেছেও। অবশ্য আমার পরিচিত কারো কাছে শুনিনি যে এই ঘোড়া দেখেছে, সবার কাছেই শুনেছি তাদের পরিচিত কেউ না কেউ দেখেছে। এই ঘোড়া আমার শৈশবে এমন ভয়ংকর প্রভাব ফেলেছিল যে, অনেক রাত আমি নিজেকে কাঁথায় মুড়িয়ে ঘেমে নেয়ে একসার হয়ে মা’র বুকের মধ্যে ঢুকে চোখ বন্ধ করে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতাম ঘোড়ার ডাক শোনার আশায় । যেদিন বেশি রাতে আমাদের বাসায় কেউ ফিরতো, আমি মনে মনে আশা করতাম সে এসে বলবে, আজ সে ঐ ভয়ানক ঘোড়াটাকে দেখেছে। কিন্তু আমার সব আশাকে কাঁচকলা দেখিয়ে কোনো দিন কেউ বলেনি সে নিজের চোখে ঐ ভয়ানক ঘোড়াকে দেখেছে। আমার রাতের পর রাত গভীর রাত জাগা নিস্ফল হয়েছে, আমি সে ঘোড়ার মধুর ডাক নিজের কানে শুনতে পাইনি। তারপরও সবাই বলতো সে ভয়ংকর ঘোড়া আছে, যে গভীর রাতে শিকারের নেশায় রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে। সুযোগ মতো কারোকে পেলে পা দিয়ে পিষ্ট করে মারে। অদ্ভুৎ কান্ড হলো এই শ্বশান আর চিতা দু’টিই এখন শহরের বুকে এসে দাড়িয়েছে, অগণন মানুষে শহর গিসগিস করছে তারপরও সে ঘোড়ার গল্প কিন্তু মানুষের মাথা থেকে যায়নি। এখনো সবাই বলে, আজো নাকি সে ঘোড়া আছে, গভীর নিশুতি রাতে অবিরাম ছুটে চলে এবং ডাকে। আজো শুনিনি সে ঘোড়া কেউ নিজ চোখে দেখেছে, অমুক দেখেছে কিংবা তমুক দেখেছে শুধু শুনছি। অনেক বছর আগে শহরে যখন মানুষ কম ছিল, শহরের এক প্রান্তে লোক চক্ষুর আড়ালে ভৌতিক কোনো ঘটনা ঘটলে ঘটতেও পারতো কিন্তু বর্তমানে শহরের বুকে এমন ভৌতিক কান্ড-কারখানা কি করে ঘটছে তা আমার অজানা।
এই শহরের অপর ভূতের কাহিনিটি হলো একজন লম্বা নারীর। গতানুগতিক গল্প, নারীরাই কেনো যেন বারবার ঘুরেফিরে ভূতের গল্পে ভূতিনী হয়ে এসে যায়। সে ভূতিনীর বাস ছিল শহরের তিন রাস্তার মোড়ে, যে রাস্তার একটিতে ছিল ছোট সেতু যার নিচ দিয়ে বয়ে যেতো খালের ঘোলা পানি, অপর একটি রাস্তা সোজা চলে গিয়েছিল কোনো এক পাহাড়ী বাংলোর দিকে আর অন্যটি ধরে চলে যাওয়া যেতো একেবারে পাহাড়ে। এই মোড়ের রাস্তায় গভীর নিশুতি(!) রাতে মাঝে মাঝে দেখা যেতো সেই ভূতিনীকে, সে সাদা শাড়ীর আঁচল পেছনে ফেলে ধীরলয়ে পেছনের পথচারীর সামনে সামনে হেঁটে যেতো। পেছনের পথচারী হাঁটতে হাঁটতে সামনের নারীটি কে হতে পারে ভেবে যখন উদ্গ্রীব তখন সে নারী পেছন ফিরে পথচারীর দিকে তাকাতো। আর নারীর মুখ দর্শণ করে পথচারীর মুখে ফেনা-ফুনা উঠে কাঁপতে কাঁপতে হয়তো সেখানে অজ্ঞান নয়তো ভোঁ দৌড় দিয়ে কারো সামনে যেয়ে দাঁত লেগে চিৎপটাং হয়ে যেতো । মনে হচ্ছে না কোনো বাংলা ভূতের সিনেমার গল্প করছি? তবে এই ভূতিনীকে যারা চাক্ষুস দেখেছে তাদের নিজ মুখের বর্ণনা আমি শুনেছি এবং ভূতিনী দর্শণে তারা সবাই যথার্থই ভয় পেয়েছিল বলে আমার ধারণা। এই ভূত কাহিনির সমস্যা ছিল এক জায়গায়, গভীর রাতে যারা ঐ পথে আসা-যাওয়া করতো তাদের বেশির ভাগ মাতাল থাকতো। আবার অন্য একটি বিষয়ও মনে খটকা সৃষ্টি করে, সব মাতাল একই রকম ভূতিনীকে দেখবে কেনো? একই রকম কাহিনির বর্ণনা দেবে কেনো? হয়ত এরও কোনো মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে।
শহরটির আর একটি ভৌতিক গল্প বলি, এই ভূত কোনো জন্তু বা মানব-মানবী নয়, এই ভূত হলো মানুষের শরীরের একটি অঙ্গ- হাত। শহরের একটি স্কুলের টয়লেটের প্যানের ফুটো দিয়ে কনুই পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়ানো একটি হাত উঠে আসতো। তাজা লাল রক্তে ব্যান্ডেজটি ভিজে চুপচুপে! কি ভয়ানক কথা! প্রাকৃতিক ডাকে আপনি টয়লেটে গেলেন আর হঠাৎ নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, প্যানের ফুটো গলে একটি হাত আপনার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন তো অটোমেটিক প্রাকৃতিক সব কিছু ঘটে যাবে কোনো চেষ্টা ছাড়া। এরকম ঘটনাই ঘটতো সে স্কুলের শিক্ষক- ছাত্র- ছাত্রীদের সাথে। ফলাফল, স্কুল টাইমে কেউ আর টয়লেটে যেতো না। শোনা কথা, মুক্তিযুদ্ধের সময় নাকি পাকবাহিনী এই স্কুলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করেছিল। তারপর থেকে স্কুলে এই হাতের উৎপাত শুরু হয় এবং পরবর্তীতে এই উৎপাত বন্ধও হয়ে যায়।
এই সব কাহিনি শহরটির সাথে বেড়ে চলছে আজো। যে যার মতো রঙ চড়িয়ে, পাখা বানিয়ে গল্পের আকাশে ঘুড়ির মতো ওড়ায় কিন্তু মূল গল্প একই থাকে।


মন্তব্য

স্বপ্নহারা এর ছবি

ভূত জিনিসটা আমি বিশ্বাস করিনা একদমই...।কিন্তু ভয় পাইতে ভুলি না!! ...এখন থেকে টয়লেটে গেলে নিচে একটু পরপর তাকাইতে হবে...ঃ(
ভাল লাগছে লেখাটা।
-----------------------------------
হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

পান্থ রহমান রেজা  [অতিথি] এর ছবি

এই শহরটা কোন শহর?

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেলো। আমি তখন ফাইভে পড়ি। তখন আব্বার সরকারী চাকুরীর সুবাদে থাকি রূপগঞ্জে। আমরা যেখানে থাকি তার ঠিক পাশেই শ্মশান ঘাট। কথিত ছিলো, ঐ এলাকায় নাকি প্রায়শঃই গভীর রাতে কোনো পূণ্যাত্মা হেঁটে যায় আর তখন আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে অসম্ভব সুন্দর ঘ্রাণ। অনেক অপেক্ষা করেছি, রাত জেগে নাসিকা কুঞ্চিত করেছি কিন্তু পাইনি কখনোই। একদিন গভীর রাতে হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায় আমার। ঘুম ভাঙতেই খেয়াল করলাম নাকে এসে লাগছে অনেক তীব্র একটা সুগন্ধ, অনেকটা আতরের মতো। আমাদের ঘরে কেউ কখনো আতর ব্যবহার করে না। আর এটা কোনো ফুলের গন্ধও না। ফুলের গন্ধ হলে অন্য সময়ও পেতাম। আর আশে পাশে সারাদিনই চষে বেড়াতাম বলে কোন ঝোঁপে কী ফুল ফুটে সেটাও নখদর্পণে থাকতো সেসময়। কিন্তু সেই রাত দুপুরে তীব্র আতরের গন্ধের কোনো কিনারা পাইনি এখনো। যুক্তিবাদী মন আমার এটা কোনো অশরীরি কিছুর কারসাজী বলেও মানতে চায় না!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

অতিথি লেখক এর ছবি

হে হে হে, ধুগোদা মেম্ব্রসাবের শালীর গন্ধ পাইছেন নাকি?

দময়ন্তী এর ছবি

ইশ্ আমার কত্তদিনের শখ একটা ভুত দেখার৷ কোথায়ও পেলাম না৷ মন খারাপ
ইয়ে, শ্মশান বানানটা শ্'য় ব নয়৷ শ'য় ম৷
----------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

গৌতম এর ছবি

তেঁতুল গাছের তলা দিয়ে প্রতিদিন আমাকে স্কুলে যেতে হতো, প্রাইভেটে যেতে হতো। আর তেঁতুল গাছেই যে ভুত থাকে, সেটা তো সবাই জানে। ছোট্ট পা দুটোর ঠকঠকানি কতো যে তীব্র হতে পারে- ছোটবেলাকার সেই অনুভূতি আজও টের পাইয়ে দেয়- সত্যিই একসময় ভুতের ভয় বড় তীব্র ছিলো!

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

::: http://www.bdeduarticle.com
::: http://www.facebook.com/profile.php?id=614262553/

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হুমম।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

তখন তো অটোমেটিক প্রাকৃতিক সব কিছু ঘটে যাবে কোনো চেষ্টা ছাড়া।

এইটাতে পুরাই হা হা প গে গড়াগড়ি দিয়া হাসি

তুমুল মজা পাইলাম। ভুতিনীর গল্পটা শুনে কানে বাজতে লাগল "নুরী, নুঊঊউরী" হা হা হা। মাইন্ড খাইয়েন না আবার, একটু রসিকতা করলাম।

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

শঙ্কর [অতিথি] এর ছবি

আপনার লেখা আমার ছোটবেলাটাকে বারবার মনে পড়িয়ে দেয়। আপনার সেই শৈশবের শহরটি তো একদম লীলা মজুমদারের 'বকধার্মিক'-এর শহরের মত। সত্যি বুঝি তেমন শহর ছিল? আমি তো চিরকাল ভেবে এসেছি ওগুলো শুধুই কল্পনা !

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

ভাল লাগল। চলুক

শামীম রুনা এর ছবি

পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।