ঘুড্ডি-লাটাই

শেখ জলিল এর ছবি
লিখেছেন শেখ জলিল (তারিখ: শুক্র, ২৫/০১/২০০৮ - ৯:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ ওর দুঃখের দিন। দুঃখের ভাগাড়ে বসে থাকতে থাকতে কোনো দুঃখের গন্ধ ওর নাকে পৌঁছতে পারেনি কখনও। কিন্তু আজ খানিক পরপর লম্বা লম্বা দমে বুকের গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে তা। দমের ফাঁকে ফাঁকে ফোঁপ-ফোঁপ শব্দে নাক-মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে আর্দ্র হাওয়া। আর তাতেই ভারাক্রান্ত হচ্ছে চারদিকের বাতাস। মানে ও কাঁদছে।

বারান্দায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকা হাড্ডিসার স্ত্রীলোকটিকে ঘিরে ধরেছে ক'টি মেয়ে মানুষ। তাদের সবাইকে ও চেনে। সবাই এ বস্তিরই বাসিন্দা। শুয়ে থাকা স্ত্রীলোকটির বুক বরাবর বসেছে যে জন সে হচ্ছে খেদির মা। হাঁটার সময় দু'ঠ্যাং ফাঁক করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। মাথার খুব কাছে বসা জন টেপির দাদী। কানা চোখ থেকে ক্রমাগত জল পড়ছে তো পড়ছেই। তাকে দেখলেই রূপকথার ডাইনী বুড়ির কথা মানে হয় তার। একটু পরেই যেন সে রাক্ষুসীর রূপ ধরবে। দু'পায়ের দু'পাশে বসে ছমিরন-কমিরন দু'বোন সুর করে কোরআন শরীফ পড়ছে। পাশে জ্বালানো আগরবাতির ধোঁয়াগুলো যেন ধীরে ধীরে স্বর্গের উদ্দেশ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।

সামনের বারান্দায় বসে থাকা জনকে অচেনা রহস্যময় মনে হচ্ছে তার কাছে। দু'ঠাং সটান মেলে দিয়ে আরাম করে পান চিবাচ্ছে সে। ডানহাত দিয়ে পানের ডালায় কী যেন হাতরাচ্ছে আর বামহাতে চুলকাচ্ছে উরুর মাংসল অংশ। চুলকাতে চুলকাতে হাঁটুর অনেক উপরে কাপড় উঠে গেছে তার। ও রকম ফর্সা উরু সে একবারই দেখেছিলো। ওর বয়স তখন ছয় কী সাত।

বস্তির ও মাথায় রহিমুদ্দির এক খুবসুরত মেয়ে ছিলো। স্কুলে যেতো সে। কেলাস সিক্স না কোন্ কেলাসে জানি পড়তো! লোকের মুখে শুনতো ও। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় গলায় চেন, লম্বা চুলওয়ালা এক যুবককে ও বাড়ির সামনের দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতো সে। দেখলেই যুবকটি কাছে ডাকতো তাকে। আর জিজ্ঞেস করতো রহিমুদ্দির খুবসুরত মেয়ের কথা। এক টাকার বিনিময়ে যুবকটির কাছ থেকে একবার একটা চিঠি এনে দিয়েছিলো সেই মেয়েটিকে। একটু পরেই হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছিলো সেদিন। ও বসেছিলো মেয়েটির বারান্দার এক কোণায়। ক্রমাগত ঠাণ্ডা হাওয়ায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলো ও।

ওদিকে চৌকির উপর শুয়ে বিশ্রী ভাষার চিঠি পড়ছিলো রহিমুদ্দির খুবসুরত মেয়ে। বারবার ওপাশ ওপাশ করায় পরনের ছায়া মেয়েটির দু'টি উরু ঢেকে রাখতে পারছিলো না আর। ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছিলো উরুর ফর্সা অংশ। প্রথমাবারের মতো সাদা উরু সেবারই দেখেছিলো সে। একটু পরে মেয়েটি কেন জানি তাকে খুব আদর করেছিলো। কোলে তুলে নিয়ে বুকে করে শুয়ে থেকেছিলো অনেকণ। মাঝে মাঝে দু'হাতে ওর মুখ নরম বুকে চেপে ধরায় অনেকখানি শীত কেটে গিয়েছিলো সেদিন।

আজ রতনের দাদী মারা গেছে। ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কাঁদছে ও। দশ-এগার বছরের বালকের গলার মতোন তার স্বর ভেসে আসছে। প্রকৃতপক্ষে ওর বয়স পনের। বাড়ন্তের শেকড় অনেকখানি পুষ্টিহীন বলেই এমন অবস্থা। কিছুদিন আগে ওর বাপ যখন তৃতীয় বিয়ে করলো তখন সে বাড়ি ছেড়েছিলো। সারাদিন খুব করে কেঁদে রাতে গিয়েছিলো এক খাবার হোটেলে কাজ করতে। রাত শেষে ভোরেই ওর উপর পড়লো থালা-বাসন মাজার ভার। হাত ফসকে একটা প্লেট ভাঙ্গার অপরাধে ম্যানেজারের চড় খেয়ে রতন সেদিন চরকির মতো ঘুরেছিলো সে।

সেই থেকে রতন ওর দাদীর কাছেই থাকতো। দাদী তাকে রেঁধে খাওয়াতো। লাঠি ভর ক'রে দাদী সাহেবদের বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতো। আর রতন মেডিকেল হোস্টেলের ছাত্রদের এটা সেটা ক'রে পেতো দু'এক টাকা। দু'জনের সংসারে তারা টানাটনির দুঃখ নিয়েই সুখী ছিলো। রতনের বাবা আর খোঁজ নেয়না তেমন। বাপ থেকেও যেন নেই রতনের।

অনেকদিন পর রতন তার মা মারা যাবার ব্যাপারটা পাড়া পড়শির মুখে শুনেছে। তার বাপের দ্বিতীয় বউ নাকি খুব খাচ্চর প্রকৃতির মেয়ে ছিলো। লোকেরা বলতো সে নাকি তার বাপকে হাঙ্গা করেছিলো। সেই দুঃখে তার নিজের মা ইঁদুর মারা ওষুধ খেয়ে মরে গিয়েছিলো। ওদিকে ক'মাস যেতে না যেতেই এক ড্রাইভারের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলো তার নতুন মা। এ কথা খেদির মার মুখে শুনেছিলো রতন। কিন্তু এসব কথা তার বাবা কিংবা দাদীর কাছ থেকে কোনোদিনই শোনেনি সে।

মরদেহ সৎকার করতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। ভাগ্যিস্ বুড়ির কিছু গয়নাগাটি ছিলো! সেটা বন্দক রেখেই কাফনের কাপড় এনেছিলো বস্তিবাসীরা। এ ব্যাপারে রতনের বাপের কিছু বলার ছিলো না। একটা বোঝা যেন নেমে গেলো তার। অবশ্য তার দ্বিতীয় বোঝা রতনকে নিয়ে ভাবনা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে সে।
সারাদিন কিছুই পেটে পড়েনি রতনের। দু-দু'বার সৎ-মার মুখোমুখি হয়েছে সে। প্রতিবারই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সে। অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে রইলো রতন। দক্ষিণ কোণের আম গাছটায় একটা দাঁড়কাক ক্রমাগত ডেকে যাচ্ছে। শীতের শুরুতে কিছুটা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে পাতায় পাতায়। হাই তুলে পশ্চিমের আকাশে তাকাতেই ওর নজরে এলো লাল-নীল একঝাঁক ঘুড্ডি। গোত্তা মেরে কোনোটা নিচে নামছে আবার উপরে উঠছে কোনোটা। হঠাৎ ওর চোখে যেন বিদ্যুৎখেলে গেলো।

ঘরের ভেতর ঢুকে তক্তার উপর থেকে সূতা পেঁচানো লাটাই বের করে আনলো সে। অনেকদিন হাত পড়েনি ওটাতে। দাদীর অসুখ থাকায় রতন তাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো এতোদিন। সূতাটাতে অনেক ময়লা জমে গেছে। তবু হাল ছাড়লো না সে। রহিমুদ্দির দোকান থেকে এক টাকায় একটা ঘুড্ডি কিনলো। তাদের বস্তির পাশেই আছে দেয়ালঘেরা একটি খালি জমি। দেয়াল টপকে জমিটার ভেতরে চলে গেলো সে। ওখানটাতেই মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে ঘুড্ডি ওড়ায় বস্তির ছোট্ট ছোট্ট ছেলেরা। টুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সাধের ঘুড্ডি উড়িয়ে দিলো হাওয়ায়। গোত্তা মেরে মেরে উপরে উঠতে লাগলো ঘুড্ডি। ধীরে ধীরে সূতা ছাড়তে লাগলো রতন।

এক সময় ওর ঘুড্ডি যেন দূর আকাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। এমন সময় মনে হলো দাদীর কবরের পাশে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা তার নিজের কথা। ঘুড্ডিও কী তাহলে মানুষের দুঃখে থামে? আবার গোত্তা মেরে জানিয়ে দেয়- না ওসব মিথ্যে মায়া! এবার চরকির মতো ঘুরতে লাগলো ঘুড্ডি। রতনের এসময় মনে হলো হোটেলে ম্যানেজারের চড় খেয়ে চরকির মতো ঘোরার কথা। আর একটা গোত্তা খেলো ঘুড্ডি। পট করে ছিঁড়ে গেলো সূতা। দীর্ঘদিন ঘরে পড়ে থাকায় কোনো জায়গায় হয়তো পচন ধরেছিলো সূতায়।

হাতের লাটাই ফেলে এক লাফে দেয়াল টপকালো রতন। পড়ার সময় পায়ের তলায় কীসে যেন একটু চোট খেলো বোধ হয়। সেদিকে খেয়াল না করেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে লাগলো রাস্তার ওপাশে যেদিকে ঘুড্ডি ছুটছে। এদিকে লম্বা লম্বা ছিপ, বাঁশ, ডাল নিয়ে জড়ো হয়েছে একদল ছেলে। সূতা ছিঁড়ে উড়ে আসা ঘুড্ডির আশায়। একটু পরেই হয়তো রতনের ঘুড্ডিটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে কিংবা ধরবে কেউ। এদিকে রতন ছুটছে তো ছুটছেই। ওর হাতে ডাল, ছিপ, বাঁশ কিছুই নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে ও-ই একমাত্র অস্ত্রহীন, সঙ্গীহীন- যে না পাবে ঘুড্ডি, না পাবে লাটাই!
০৯.১১.১৯৮৬


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

জীবনকে খুব চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন। নামগুলো নিয়ে একটু বিপত্তি আছে, এখন করিমনের চেয়ে মৌসুমিই নাম হিসেবে বেশি হিট। অবশ্য যখন রচনাকাল ১৯৮৬ দেখলাম, তখন বুঝলাম, 'ঠিকাছে।' হাসি

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

শেখ জলিল এর ছবি

ঠিকাছে কাকু, এখন থেকে মৌসুমী, শাবনুর, পপি, পূর্ণিমা এরকম নামই রাখুম।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

শেখ জলিলের এই গল্প ১৯৮৬ সালে লেখা। আমি গল্প লেখা শুরু করেছি এই সেদিন। সুতরাং গল্প লেখা নিয়ে আমার মনে অনেক প্রশ্ন। একটা মাত্র গল্প লিখেছি এ পর্যন্ত। সচলে দিয়েছিলাম। কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা কেউ করেননি। মানে যেরকম সমালোচনা করলে গল্পটা আরো ভালো হয়ে উঠতে পারে তেমন সমালোচনা - সম্পাদকের কাছে গল্পের যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে তা গোচরে আনা - কেউ করেননি। সে রকম পরিবেশ হয়তো ব্লগে একটু কম। চোখের দেখার পরিচয় নাই বলে পাঠকরা সমালোচনা করতে সংকোচ করেন হয়তো বা। আরেকটা কারণ থাকতে পারে যে কী সমালোচনা করতে হবে তা জানা না থাকা।

সমালোচনার ব্যাকরণ আমিও জানি না। কিন্তু পাঠক হিসেবে আমি আমার পছন্দ-অপছন্দ বা সমস্যার কথা বলতে পারি নিশ্চই। লেখক তো পাঠকের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইছেন, সুতরাং তিনি নিশ্চই যোগাযোগের অন্তরায়গুলোকে দূর করতে চাইবেন।

পাঠক হিসেবে আমার সমালোচনাটা শুরু করি। ভূমিকাটুকু এজন্য দিলাম যাতে শেখ জলিল এটাকে এ্যাকাডেমিক হিসেবে নেন - আক্রমণ মনে না করেন এবং অন্যান্য ব্লগাররাও একটু সাহস করে সমালোচনায় এগিয়ে আসেন।

××××××××××

গল্পটা শুরু হয়েছে 'আজ ওর দু:খের দিন' এই বাক্য দিয়ে। কিন্তু প্রথম দুটো প্যারা পড়ার পরও আমি ধরতে পারিনি এই ও-টা কে? এবং গল্পের কথক কে - কে আমাকে গল্পটা বলছেন। সুতরাং আমি স্ক্রল ডাউন করে নিচে গিয়ে এই রহস্যের সমাধান করতে চেষ্টা করেছি, সফল হইনি।

নয় নয়টা চরিত্র ও তাদের সম্পর্কে এক-দু লাইন বর্ণনা দেয়ার পর ৫নং প্যারায় (পুরো গল্পটা ১২ প্যারার) এসে লেখক বলেন, আজ রতনের দাদী মারা গেছেন। তখন পাঠক হিসেবে আমার একটা অনুমান তৈরি হয় যে হাড্ডিসার মহিলার কথা বলা হচ্ছে তিনি হয়তো দাদী এবং গল্পের শুরুতে যার দু:খের কথা বলা হয়েছে সে হয়তো রতন। এই সাথে আমার এও মনে হয় গল্পটা এখান থেকেই শুরু হতে পারতো, হয়তো শুরু হলে আমার বুঝতে সুবিধা হতো - আজ রতনের দাদী মারা গেছেন। শুরু হিসেবে খারাপ না।

এরপর গল্পটা পড়তে আমার অসুবিধা হয় না। দাদীর সত্কার হয়ে যায় এবং রতন অনেকদিন পর ঘুড়ি ওড়ানো শুরু করে। তার ঘুড়ি ছিঁড়ে গেছে এবং সে ঘুঁড়ির পেছনে ছুটছে। এবং ঘুড়িটাকে পাওয়ার জন্য তার এই সংগ্রাম ও চেষ্টার বিপরীতে বিপক্ষ বা বিরুদ্ধ শক্তির একটা আভাস দেন লেখক। অর্থাত্ বুঝা যায় জীবন সংগ্রাম-মুখর, অতিপ্রিয়ের মৃত্যুতেও জীবনের স্বাভাবিক কর্মকান্ড থেমে থাকে না। গল্পের মাঝেই বোধহয় লেখক তার মূল ভাবনাটা পাঠকদের মনে গলিয়ে দিয়েছেন, ‌'... না ওসব মিথ্যে মায়া!'

তবে গল্পের শেষে এসেও আমরা একটা বাণী-মত বাক্য পাই। '‌‌যুদ্ধক্ষেত্রে ও-ই একমাত্র অস্ত্রহীন, সঙ্গীহীন- যে না পাবে ঘুড্ডি, না পাবে লাটাই! ' একেও গল্পের মূলভাবনা হিসেবে ভ্রম হয়। আসলে কোনটা লেখকের মূলভাবনা? এই গল্পের মূল মেসেজটা কী? কী কারণে বা কোন ভাবনাটা পাঠককে পৌঁছে দিতে লেখক এই গল্প ফেঁদেছেন। ...জীবন, মৃত্যু ...মিথ্যে মায়া ....নাকি অস্ত্র ও সঙ্গীহীনরা ঘুড়ি নাটাই কিছুই পায় না...এই কথা?

আমার মনে হয় গল্পের প্রিমাইসটা শেখ জলিল ঠিক করে নেন নি আগে-ভাগে। অথবা শেষ করতে এসে আবার নতুন একটা ভাবনায় ঢুকে গিয়ে গল্পটাকে সেখানে শেষ করাটাই ভালো হবে ভেবেছেন। লেখকের ভাবনার উপর কথা নাই। কিন্তু আমার মনে হয় শেষে এসে নতুন যে দর্শন-চিন্তা দিয়ে লেখক গল্পটা মুড়িয়ে ফেলেন সেটি গল্পের মূল-ভাবনা নয়।

বিচার-বিবেচনার পর আমার মনে হয়, রতন ও দাদীই এই গল্পের মূল চরিত্র। ২, ৩, ৪, ও ৫ প্যারায় আনা এতোগুলো চরিত্র এই ছোট গল্পের জন্য অপ্রয়োজনীয়। ভিড়ের জনতা নামহীন থাকলেও চলে। বরং রতন ও দাদীর চরিত্রকে আরো কিছু মাল-মশলা যোগান দিয়ে আরো বাস্তব করে তোলা যেত। রতন কেমন চরিত্রের, মন ও মানসিকতার এবং রতনের দাদী কি আর পাঁচটা দাদীর মতই নাকি তার অন্যরকম বৈশিষ্ট্য ছিল সেসব গল্পে আসলেই গল্প গভীরতা পেতো।

রতন ও দাদীর সম্পর্ক এবং মৃত্যু-মাত্র দাদীকে রতনের ভুলে যাওয়াটাই এই গল্পের মূল উপজীব্য। এই ঘটনা দিয়েই লেখক মানব-জীবন সম্পর্কে একটা গূঢ় সত্য আমাদের জানাতে চান। এই বিবেচনায় রতন ও দাদীর সম্পর্ক নিয়ে আরো কিছু চিত্র আমাদের লেখক দিতে পারতেন। কীভাবে?

উদাহরণ হিসেবে বাংলা ভাষার বিখ্যাত এক গল্পের কথা বলা যায় যেটির মূল একটি চরিত্রের নামও এই গল্পের মতই রতন। পোস্টমাস্টার গল্পে রবীন্দ্রনাথ পোস্টমাস্টারের কাহিনীটা শুনিয়েছেন আমাদের। আর এই গল্পে শেখ জলিল রতনের গল্প শুনিয়েছেন আমাদের, দাদী এখানে গৌণ। কিন্তু দু'টি গল্পেই দুই মানুষের নির্ভরশীলতা, একত্র-সময়ের পর বিচ্ছেদ দিয়ে লেখকরা আসলে একই সত্য তুলে ধরতে চেয়েছেন - জীবন থেমে থাকে না।

এখন পোস্টমাস্টার গল্পে (আমার হাতের কাছে গল্পটি নাই- নতুবা কিছু উদাহরণ দেয়া যেত) রবীন্দ্রনাথ তার বলবার গূঢ় সত্যটি গল্পের শেষে এসে বলেন। যখন নৌকার পালে হাওয়া লেগেছ এবং ফিরবার কোনো উপায় নাই। ফিরিয়াই বা কী? আমাদের মন আর্দ্র হয়, রতনের জন্য। কিন্তু পোস্টমাস্টারের প্রতি তেমন কোনো বিদ্বেষও জন্মে না। কেন জন্মে না? কারণ গল্পের প্রথমেই রবীবাবু কৌশলে পোস্টমাস্টারের প্রতি পাঠকদের এক রকম ভালবাসা তৈরি করেছেন। তার চরিত্র চিত্রন করেছেন 'ডাঙায় তোলা মাছ' হিসেবে। পোস্টমাস্টারের প্রতি পাঠকদের একটা দুর্বলতা মনে ছিলোই।

তারপর রবীন্দ্রনাথ রতনের সাথে পাঠকের পরিচয় করান, রতনের সাথে পোস্টমাস্টারের সম্পর্ক, তাদের ভাব-ভালবাসার বিভিন্ন ঘটনার বিশদ বর্ণনা দেন। রতন বিষয়ে পোস্টমাস্টারের মনে ধ্বনিত হতে থাকা বিভিন্ন চিন্তা ও দোটানার কথাও রবীবাবু আমাদের জানান। তবু শেষমেষ বাক্স-পেঁটরা গুছিয়ে ডাকবাবু রওয়ানা দেন। অত:পর পালে হাওয়া লাগার পর রবীবাবু আমাদেরকে দীর্ঘ বাক্যে শোনান মধ্যবিত্ত বাঙালির আদর্শ প্রতিবিম্ব-চরিত্র পোস্টামাস্টারের দর্শন-চিন্তা, ফিরিয়া লাভ কী?

শেখ জলিল প্রায় একইরকম একটা বিষয় হাতে নিয়েছেন এই গল্পে। এখানে রতন হচ্ছে মূল চরিত্র এবং চরিত্র দুটো আত্মীয়। দাদীই মা-বাবার অনুপস্থিতিতে রতনকে লালন-পালন করে বড় করছেন। সেই দাদীর চিরপ্রস্থানে শিশু রতনের প্রতিক্রিয়া কত দ্রুত পাল্টে যেতে পারে তার গল্পই লেখক বলতে চেয়েছেন। পোস্টমাস্টার গল্পের দিকে তাকালে এখন আশা করি শেখ জলিল দেখতে পাবেন কীভাবে চরিত্র-দুটোর গল্প বললে তার মূল-কথাটা পাঠকের কাছে আরো বেশি মর্মস্পর্শী হয়ে উঠতো।

অনেক গল্পই লেখকেরা বার বার লেখেন। শেখ জলিল যদি আমার এই বিশ্লেষণের দুয়েকটা বিষয়েও একমত হন তবুও হাত দিতে পারেন গল্পটির দ্বিতীয় খসড়ায়। এই গল্পের এক বিশাল সম্ভাবনা আছে। দুই প্রজন্মের দুই চরিত্রের নির্ভরতা, স্বার্থহীন ভালবাসা ও স্মৃতি অকাতরতার একটা মর্মস্পর্শী গল্প হতে পারে এটি।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

শেখ জলিল এর ছবি

দীর্ঘ আলোচনা, দ্বিতীয় খসড়ার সাজেশন দেবার জন্য শোমচৌ আপনাকে ধন্যবাদ। মন্তব্যে প্রতিউত্তর আপনার পোস্টে দিয়েছি।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।