দেশান্তরী উপাখ্যান- দুই

শেখ জলিল এর ছবি
লিখেছেন শেখ জলিল (তারিখ: বুধ, ১৩/০২/২০১৩ - ১১:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

-এই জহির, এই জহির ওঠ্, এই সন্ধ্যাবেলায় এমন ডাইকা ঘুমাইতাছিস্ ক্যান?

তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ কচলাতে কচলাতে চেয়ে দেখে জহির তার প্রাণের প্রাণ বন্ধু ইউসুব ডাকছে তাকে। স্বপ্নের ও বাস্তবের এমন মিল দেখে জহিরের মনটা ভালো হয়ে গেলো আচানক। আজ অনেকদিন পর ইউসুবের সাথে দেখা। সময়-সুযোগ করে জহিরেরও আর যাওয়া হয়নি ছোট বোনটিকে দেখতে। সেই যে ইউসুব-বিবিজানের ছোট মেয়ে জাহানারার জন্মের সময় এসেছিলো একবার, আর আসেনি অনেকদিন। ইউসুবের দিকে চেয়ে জহির বললো- কখন আসলি?

- আইছি ঘন্টাখানেক আগে। আইসা দেহি এই অসময়ে তুই বেঘোরে ঘুমাইতাছিস্ । কী রে, খবর কী? তুই তো দারুণ রেজাল্ট করেছিস্ ইন্টারমেডিয়েটে। আম্মায় খবর দিলো- তর নাকি মন খারাপ। তাই ওদের নিয়া চইলা আইলাম।

ক'টা দিন ধরে মন ভালো যাচ্ছিলো না জহিরের। একে তো গৌহাটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারে নাই তদুপরি সংসারে নানান অভাব-অনটন। যাক, ভালোই হয়েছে ইউসুবরা আসাতে। মজা করে গল্প করবে দুই বন্ধু আর তাস খেলে পার করে দেবে সারা রাত। খুশি মনে ই্উসুবের সাথে নিয়ে কলপাড়ে গেলো জহির। হাত-মুখ ধোয়ার ফাঁকে দুই বন্ধুর হয়ে গেলো আরও কিছু কথা। পাড়ার সমস্ত বন্ধুদের খোঁজ-খবরের সাথে পারুল প্রসঙ্গও এলো একবার।

সন্ধ্যার ঠিক পরপরই রাতের খাবার খেয়ে কাচারি ঘরে তাস খেলতে বসেছে জহির, ইউসুব, বক্কার ও গিয়াস। বক্কার ও গিয়াস জহিরের দুই মামাতো ভাই। ইউসুব আসার খবর শুনে তাস খেলার লোভে ওরাও চলে এসেছে সময় মতো। আজ চলছে স্পেডট্রাম।

এখন রাত নয়টা। এরই মধ্যে দশ দান হয়ে গেছে। বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি পয়েন্টে এগিয়ে আছে ইউসুব। দ্বিতীয় অবস্থানে বক্কার। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে যথাক্রমে জহির ও গিয়াস। এখনও এগার দান বাকি। মনে মনে চিন্তা করছে জহির- যে কোনো মূল্যেই আজ প্রথম হতে হবে তাকে। ওদিকে বক্কারেরও জেদ চেপেছে তার ফার্স্ট হওয়া চাই-ই।

খেলা চলছে জোরেসোরে। ঊনিশ নম্বর দান চলছে এখন। ইউসুব, বক্কারকে ডিঙিয়ে জহির চলে এসেছে এক নম্বরে। আর গিয়াস চলে এসেছে দুই নম্বর পজিশনে। ইউসুব, বক্কারের মুখ কালো। নীরবে চলছে পিঠ চালাচালি। এবারের পিঠ পেয়েছে গিয়াস। এরই মধ্যে চিল্লাতে চিল্লাতে দৌড়িয়ে কাচারি ঘরে চলে এলো ওসমান। ওসমান ছোট মামা আজগরের দ্বিতীয় ছেলে। হাঁফাতে হাঁফাতে ও বললো- বক্কার ভাই, গিয়াস ভাই আট আনী বাজারে বড় চাচাকে কে যেন ডেগার মেরেছে। তাড়াতাড়ি যাইতে অইবো, ওঠ সবাই।

এক চিৎকারে উঠে পড়লো বক্কার। তার পিছে পিছে গিয়াস। জহির ও ইউসুবও হাতের তাস ফেলে ছুটে গেলো তাদের সাথে। তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করতে হবে জয়নালকে। জয়নাল বড় মামা আসাদের বড় ছেলে। বড় মামার বাড়িতে তখন কান্নার রোল। মামী, মালেকা, আন্না তখন আহাজারি করছে। জয়নাল গিয়েছিলো বগড়িবাড়ি বাজারে। সম্ভবত সেখান থেকেই চলে গেছে সে আট আনী বাজারে।

বগড়িবাড়ি বাজারের সব দোকানপাট ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশ নিস্তব্ধ, নিঝুম। এতো রাতে তারা গাড়ি-ঘোড়া পাবে কোথায়? চার ভাই মিলে একরকম দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলো পাঁচ মাইল দূরের আট আনী বাজারে। ততক্ষণে বড় মামাকে নেয়া হেয়েছে স্থানীয় ডিসপেনসারিতে। তখনও অঝোরে রক্ত ঝরছে বড় মামার গলা থেকে। তবে বড় মামা ছিলেন খুব শক্ত মনের মানুষ। ডিসপেনসারির নার্স, পেরামেডিক্স মামার গলায় বাঁধা গামাছা খুলে পরখ করে দেখলেন। তারা বললেন- আঘাতটা কতোটুকু গুরুতর বোঝা যাচ্ছে না, রোগীকে যথাশীঘ্র নিয়ে যেতে হবে বড় হাসাপাতালে। ভাগ্য ভালো জয়নাল পাশেই ছিলো। ও হয়তো বগড়িবাড়ি বাজার থেকে আগেভাগেই খবর পেয়েছিলো।

সেই রাতেই আসাদ মামাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো মহুকুমা সদর ধুবড়ি হাসাপাতালে। স্থানীয় ডিসপেনসারিতে কোনো এ্যাম্বুলেন্স নেই। অগত্যা মালবাহী এক লড়ি ভাড়া করে রাত একটায় ধুবড়ি পৌঁছেছিলো ওরা। রাত দুইটায় শুরু হয়েছিলো অপারেশন আর শেষ হয়েছিলো ভোরের আগে। ছুরির আঘাত গলাতে লাগলেও বড় কোনো রক্তনালী না কাটায় সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলেন বড় মামা। তবে ঘা শুকানোর জন্য দুই মাস ঘরে বসে কাটাতে হয়েছিলো তাকে।

কিছুদিন পরে বড় মামার মুখ থেকেই জহির শুনেছিলো ছুরি মারার ঘটনা। এক অহময়িার সাথে বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে ছুরি মারা হয়েছিলো তাকে। ব্যাপারটা খুবই তুচ্ছ- দোকানের মিষ্টি ভালো না। এই নিয়ে অহমিয়া ও দোকানীর মধ্যে ঝগড়া। বাঙালি হিন্দু দোকানী যতীন ঘোষের পক্ষ নিয়ে ঝগড়া থামাতে গিয়ে মামার এই পরিনতি হয়েছিলো সেদিন। যদিও ব্যাপারটা পুলিশ কেস ছিলো কিন্তু সেই অহমিয়াকে মাথা খারাপ পাগল বলে সাব্যস্ত করলে কেস এগোয়নি আর।

১৩.০২.২০১৩ ...(চলবে)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখার ধরণটি ভালো লাগল।

শেখ জলিল এর ছবি

ধন্যবাদ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হেডিং-এ ব্রাকেটে নাম্বার দিন বস্‌। নয়তো কোন পর্ব মিস্‌ করলাম কিনা সেটা বুঝতে পারবো না।

একটা ব্যাপার ভেবে বেশ অবাক হচ্ছি। যে দেশে আপনি বাস করেননি সেই দেশের পটভূমিতে উপন্যাস কীকরে লিখছেন? তাহলে এই উপন্যাস লেখার পেছনেও কি আরেকটা কাহিনী আছে?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শেখ জলিল এর ছবি

অবাক হবারই কথা @ ষষ্ঠ পাণ্ডব। এর পিছনে কাহিনি তো অবশ্যই আছে।
হেডিং মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।