দেশান্তরী উপাখ্যান- ছয়

শেখ জলিল এর ছবি
লিখেছেন শেখ জলিল (তারিখ: বুধ, ১৩/০৩/২০১৩ - ৯:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

''ধান থুইয়া পাট বুনলাম
বাইষ্যা আইলে তিল বুনলাম
এবার বড় কুষ্টার আমদানি-
বাড়িত যাইয়া কমু আমি
ভাত রানছোনি সুন্দরী?
তোমার জন্য খাইটা মরি
নইলে কী আর এতই হয়রানি!''

নৈচারধাপ গ্রামের দক্ষিণ পাশে আবাদী জমি ও ফসলের মাঠ। এ মাঠের মাটি যেন খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি। গ্রামের সবার সাংবাৎসরিক আাহারের জোগান আসে এ ফসলী মাঠ থেকেই। বিস্তীর্ণ এ মাঠ পূব ও দক্ষিণ পাশ পর্যন্ত বিস্তৃত টিপাই নদী দিয়ে। কিছু অংশ বালুচর, তার ওপারে মশলাপাড়া গ্রাম। জহিরদের যা কিছু আবাদী জমি সবগুলোই এ মাঠে। বছরের নানান ফসলী মৌসুমে তারা বোনে আউশ ও আমন ধান, কাউন, গম, পাট, ইক্ষু, সরিষা, তিল, তিশিসহ অনেক ফসল। পশ্চিম পাশের শ্যাওলা বিলের উত্তর কিনার বরাবর হিজল ও জিগার সারি গ্রামটাকে যেন ছায়া দিয়ে রেখেছে সারাক্ষণ। শাপলা-শালুক-শৈবালে ভরা এ বিলে পাওয়া যায় বাহারি ঝিনুক-শামুক ও নানান স্বাদের মাছ। নৈচারধাপ গ্রামের মাঝখান দিয়ে যে স্রোতস্বিনী খাল সেটা পড়েছে এ বিলে। বর্ষাকালে পানিতে টইটম্বুর থাকে এ বিল। তখন বিল ও নদীকে আলাদা করা যায় না। গ্রামের দক্ষিণ পাশে তাকালে চোখে পড়ে শুধু পানি আর পানি।

একবার ভীষণ বন্যা হয়েছিলো নৈচারধাপ এলাকায়। চারদিকে থই থই পানি। আমন ধান তলিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের কৃষকদের মনে উৎকণ্ঠা। একবার বর্ষায় নৌকা করে বেরিয়েছে জহিরের ছোট ভাই জাফর ও জাবিদ। জাবিদের বয়স তখন পাঁচ। সাথে ছিলো ওদের মামাতো ভাই গিয়াস। অনেক অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা পেলো নিজেদের ধানক্ষেত। ধানগাছগুলোর অবস্থা তখন মরি মরি। সদ্য ফলা ধান পচে যাচ্ছে।

জাফর ও গিয়াস ব্যস্ত ধানের ছড়া পরীক্ষায়। হঠাৎ করে ধুম করে আওয়াজ হলো নৌকা থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার। জাফর পেছন ফিরে দেখে জাবিদ নৌকায় নেই। এক চিৎকারে গিয়াসকে ডেকেই জাফর ঝাঁপ দিলো পানিতে। দুই ভাই মিলে পানির তল থেকে উঠিয়ে নিয়ে এলো জাবিদকে। ততক্ষণে পানি খেয়ে খেয়ে জাবিদের পেট ঢোল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখনও জ্ঞান ছিলো তার। সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলো জাবিদ। তবে তিনভাইকে ইচ্ছেমতো জোঁকে ধরেছিলো সেদিন। তরতাজা রক্ত খেয়ে একেকটা জোঁকের আকার হয়েছিলো বিশাল মোটা মোটা।

বর্ষার পর নদী ও খালের পানি অনেকটা নেমে গেছে। এখন রোপা ধান লাগানোর মৌসুম। বাড়ির পাশে ক্ষেতে রোপা ধানের চারা লাগাচ্ছে জহির, জাফর, জাকির তিন ভাই মিলে। ছোট তিন ভাইকে নিয়ে তাদের মা চলছে টিপাই নদী মুখে। নৈচারধাপ খালের পূব পাশে দুই মামা ও জহিরদের তিন বাড়ি মিলে মাত্র একটি পাকা ইদারা। মাটির কলসীতে সে ইদারার পানি বাড়িতে টেনে এনে সবাইকে গোসল করানো তার মা'র একার পক্ষে অসম্ভব। তাই সবাইকে নিয়ে তিনি চলছেন টিপাই নদীতে। পিছু পিছু ছুটছে জহিরের দুই ভাই জাবিদ ও জাহাঙ্গীর। আর জাহিদ যাচ্ছে মা'র কোলে চড়ে। দূর থেকে জাবিদের কণ্ঠের গান ভেসে আসছে- দান থুইয়া পাত বুনলাম..। আঞ্চলিক বাংলায় অস্পষ্ট উচ্চারণে জাবিদের গাওয়া গান শুনে মা হাসছেন। হঠাৎ সেদিকে চোখ ফিরিয়ে হেসে উঠলো তিন ভাইও। মুগ্ধ চোখে ছোট তিন ভাইকে তাকিয়ে দেখছে জহির আর ভাবছে- কবে ওরা বড় হবে, কবে ওরা হবে লেখাপড়া জানা মানুষের মতো মানুষ! জাফর, জাকির যদিও এখন স্কুলে যাচ্ছে- কী হবে ওদের ভবিষ্যত? ওরা কি তার মতোই যেতে পারবে না আর ইউনিভার্সিটির গণ্ডিতে? নাকি জহিরের মামাতো ভাই বক্কার, গিয়াস, রফিকদের মতো লেখাপড়া ছেড়ে শুরু করবে ব্যবসা?

নৈচারধাপ গ্রামের সিংহভাগ মানুষ ব্যবসায়ী। এর মধ্যে কিছু আছে কৃষক আর বাকি অল্প কিছু সংখ্যক চাকুরেজীবি। জহিরের চার মামা মূলত ব্যবসায়ী। যদিও বেশ কিছু জমির মালিক সবাই, জমির ফসলনির্ভর নয় কেউ-ই। বড় মামা করেন পাটের ব্যবসা, মেঝ মামা কাপড়ের, সেঝ মামা চামড়ার এবং ছোট মামা চাল-ডালের। বগড়িবাড়ির হাট সোম ও বৃহস্পতিবারে সুদূর মশলাপাড়া এবং জহরমুড়া অঞ্চল থেকে আসে বিক্রেতারা। বাঙালি মুসলমান হবার সুবাদে মামারা কিনে রাখেন তাদের মালামাল। মাঝে মাঝে এমন হয় বাকিতেও কেউ কেউ রেখে যায় অবিক্রিত মালামাল। পরে সময় ও সুযোগ বুঝে মামারা বুঝিয়ে দেন যার যার ন্যায্য পাওনা। জহিরের মামাতো ভাইদের মধ্যে বক্কার, গিয়াস, রফিক করে স্টক ব্যবসা। নানান মৌসুমে তারা বিভিন্ন ফসল কিনে ঘরে স্টক করে রাখে। পরে দাম বাড়লে কিছু মুনাফায় বিক্রি করে দেয় সে সব।

মামাতো ভাইদের ব্যবসার সূত্রে হাটবারে অনেকের সাথে পরিচয় ঘটে জহিরের। টিপাই নদীর অপর পাড়ের সমবয়সী অনেকের সাথেই বন্ধুত্ব হয় তার। সেই সাথে বগড়িবাড়ি বাজারের অনেক বাঙালি হিন্দু পরিবারের সাথে শুরু হয় উঠাবসা। তার বাবারও অনেক বন্ধু ছিলো বাজারে। তার খুব কাছের বন্ধু ছিলো বগড়িবাড়ি বাজারের যোগেশ পাল। একটা বিশাল মিষ্টির দোকান ছিলো বাজারের ঠিক পূব পাশ ঘেঁষে। মাঝে মাঝে বাবার সাথে সে দোকানে যখন বেড়াতে যেতো জহির যোগেশ কাকা নানান ধরণের মিষ্টি খাওয়াতো তাকে। তবে টাঙ্গাইলের চমচমখ্যাত এক ধরণের লম্বা লাল মিষ্টি খুব পছন্দ ছিলো জহিরের। একবার এক টুকরো মুখে পুরলে সারাদিন জিহ্বাতে লেগে থাকতো সে মিষ্টি স্বাদ।

যোগেশ কাকার বড় মেয়ে কৃষ্ণা জহিরের ক্লাসমেট। প্রাইমারি স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত একসাথে লেখাপড়া করেছে তারা। অদৃষ্টের ফেরে কৃষ্ণা এখন গৌহাটি ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট আর জহির খুঁজে বেড়াচ্ছে নিজের ভবিষ্যত। কৃষ্ণার সাথে এখন কালেভদ্রে দেখা হয় জহিরের; অথচ এক সময় এমন দিন গেছে সারাদিনে একবার জহিরকে না দেখলে কৃষ্ণার পেটে ভাত হজম হতো না। তাছাড়া কৃষ্ণা ছিলো অংকে কাঁচা জহির ছিলো অংকের রাজা। অংক কষে দেওয়ার ছলে নানান খুনসুটির সেইসব সোনালি মুহূর্তের কথা চিন্তা করলে বুকের ভেতর খচ করে ওঠে জহিরের।

কৃষ্ণাকে অংক কষাতে কষাতে ওর প্রাইভেট মাস্টার বনে গেলো জহির। বিনিময়ে মাস শেষে যোগেশ কাকাও জহিরের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিতে লাগলো। আর পড়ানোর সময় খাবার ও আপ্যায়ণ ছিলো জহিরের উপরি পাওনা। এ নিয়ে মাঝে মাঝেই গলির মোড়ে জহিরের ক্লাসেমেট অমলের কথা কাটাকাটি হতো জহিরের। তুই ও বাসায় কী করিস্? এতো সময় কেন থাকিস্? ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিউত্তরে জহির শুধু বলতো- আমি ওকে অংক পড়াই, এর বাইরে আর কিছু না। কিন্তু সেসব কথায় অমলের মনে সন্দেহ দূর হতো না কখনও। গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে কাকচক্ষু পাহারাদার হওয়া ছিলো তার নিত্যদিনের কাজ।

কৃষ্ণাকে নিয়ে অমলের সাথে একবার তো ভীষণ লেগে গেলো জহিরের। আসলে অমল পছন্দ করতো কৃষ্ণাকে; কিন্তু কৃষ্ণার চোখে অমল ছিলো দুচোখের কাঁটা। যদিও জহিরের সাথে কৃষ্ণার সম্পর্ক অমন প্রেমের ছিলো না, তথাপি অমল হিংসা করতো জহিরকে। এজন্য জহিরকে বেশ মূল্য দিতে হয়েছে একবার। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষ দিনে অমলরা কয়েক বন্ধু মিলে ইচ্ছে মতো পেটায় জহিরকে। যোগেশ কাকা না দেখলে সেদিন নির্ঘাত মরণ ছিলো জহিরের। অমলদের হাত থেকে উদ্ধার করে আহত জহিরকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসার পর সেদিন রাতে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন তিনি। এরপর থেকে কাছের বন্ধু অমল হয়ে যায় জহিরের চির শত্রু।

১৩।০৩।২০১৩ ....(চলবে)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ইয়ে। মাঝ থেকে আর কি মন্তব্য করবো? একে একে পড়ে আসি। তারপর আবার মন্তব্য করবোনে। যাকে বলে ইটা রাইখ্যা গেলাম... রেখে গেলাম।

সামি

অতিথি লেখক এর ছবি

জনাব জলিল, চলতে থাকুক ....
মুগ্ধতার মাঝামাঝি পর্যায়ে পড়ে আছি।

বিজন কথক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।