তাকে ডেকেছিল ধূলিমাখা চাঁদ ও গন্দম

শেখ জলিল এর ছবি
লিখেছেন শেখ জলিল (তারিখ: শনি, ২৩/০২/২০০৮ - ৭:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এবারের বইমেলায় বেশ ক'জন সচলের বই বেরিয়েছে। অন্তর্জাল পাঠকদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে সুখবর। নেটে লেখালেখি, সরাসরি পাঠকদের সাথে শেয়ার করে মন্তব্য পাওয়া, ভাবের আদান-প্রদান এবং বই আকারে শেষে বইমেলায় প্রকাশ- এটা ব্যাপক পরিবর্তনের ঈঙ্গিত দিচ্ছে আজকাল। প্রকাশনা জগতে লেখক-পাঠকদের এই যে পরিবর্তনের হাওয়া একবিংশ শতাব্দীতে অনিবার্য হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।

১৬ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলায় গিয়েছিলাম। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে গিয়েছিলাম বলে তাদের সামলাতেই সময় শেষ। ব্লগারদের প্রিয় কবিতার বই কেনা হলো না আর। কিনেছিলাম নামকরা ব্লগার আলী মাহমেদ-এর 'খোদেজা', আরিফ জেবতিক-এর 'তাকে ডেকেছিল ধূলিমাখা চাঁদ' এবং অমিত আহমেদ-এর 'গন্দম'। বই কিনে বাসায় এসেই এক নাগাড়ে পড়ে গেলাম সব ক'টি বই। পড়তে পড়তে বেশ আশার হাওয়া দিচ্ছিলো প্রাণে। যাক, বই কিনে তাহলে ঠকিনি। তিনজন লেখকই আমার মতো পাঠককে অন্তত ধরে রাখতে পেরেছেন- যার নাকি গদ্য পড়া হয় না তেমন!

আরিফ জেবতিক সুলেখক। সচলায়তন এবং সামহোয়্যারইনব্লগে লেখেন। আড্ডাবাজ এই লেখক এক সময় ছাত্র রাজনীতি করতেন। সাংবাদিকতার পেশাতেও ছিলেন বেশ কিছুদিন। তাঁর লেখা 'তাকে ডেকেছিল ধূলিমাখা চাঁদ' পড়ে আমার কখনো মনে হয়নি এটাই লেখকের প্রথম উপন্যাস। নামীদামী লেখকের মতো প্রথম অধ্যায়ের সূচনা আমাকে বিস্মিত করেছে। একটানে পড়ে গেলাম শেষ পর্যন্ত। কী সুন্দর গল্প, কাহিনীবিন্যাস, চরিত্রসৃষ্টি! কিন্তু একটা অতৃপ্তি থেকেই গেলো। আর এটাই বুঝি আরিফ জেবতিক-এর সহজাত প্রবণতা! পাঠককে এভাবে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা? তবুও বলবো- আমার মতো পাঠকের উপর অবিচার করেছেন তিনি। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জেগেছে- লেখক উপন্যাসের গল্পে কাকে ফোকাস করতে যাচ্ছেন বেশি আনিস না দীপুকে? আনিস যদি প্রধান চরিত্র হয় তবে জয়িতার সাথে তার সম্পর্ককে আরও সাবলীল বা ঘনিষ্ঠ করলেন না কেন? আর যদি দীপুই কেন্দ্রীয় চরিত্র হয় তবে দীপুর ব্যাপারে সেঁজুতির ভাবনা, অনুভবটা আরও গভীর দেখানো যেতো! কেনই বা লেখক সেঁজুতির কাছে দীপুর লেখা এতো সুন্দর একটি কবিতার লাইন অজানা রাখলেন! উপন্যাসের শেষদিকে এসে এতো তাড়াহুড়া কেন করলেন লেখক। বিশেষ করে দীপুর মৃত্যর বিষয়টি। আনিস তাকে দেখতে গেলেন না, দীপুর শরীরে আঘাতের কথাটিও গেলেন চেপে। হ্যাঁ, রাজনৈতিক উপন্যাসে অনেক কিছুই এড়াতে চান নতুন লেখকেরা। তবে যেহেতু স্বীকার করেই নেয়া হয়েছে- ঘটনার পরম্পরা বাস্তব ইতিহাস নয়, এটি উপন্যাসই। সবেশেষ আরিফ জেবতিককে বলবো- আপনাকে দিয়ে হবে। বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক উপন্যাস খুব একটা নেই- একমাত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম ছাড়া। এ লাইনে লিখলে আপনি আরও ভালো করবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

এরপরের লেখক কানাডা প্রবাসী অমিত আহমেদ। তারুণ্যের উচ্ছাসে ভরা সুদর্শন লেখক। লিখেছেনও বেশ আধুনিক জীবনের যন্ত্রণার কাহিনী। তাঁর উপন্যাসের নাম 'গন্দম'- নিষিদ্ধ সময়ের টান, যাপিত জীবন। বিশেষ করে গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডির উচ্চবিত্ত শ্রেনীর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের জীবন, তাদের চাকরি, আড্ডা, জীবনযাপনের খুঁটিনাটি বেশ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন। বলতে হয়- লেখকের দেখার চোখ আছে, যা অনেক দামী লেখকেরও নেই। যেভাবে তিনি গড়েছেন রাজীব-তৃণা- ঋতু-দীপক, সজীব-ইশিতা, রানা-নিপূণ-তমাল-নওরীন চরিত্রগুলো ভাবতে অবাক লাগে এটাই যে তার প্রথম উপন্যাস! মোদ্দাকথা একটা পরিপূর্ণ উপন্যাসের সবকিছুই আছে 'গন্দম' বইটিতে। কাহিনীর বিন্যাস ও ডায়লগগুলোও দারুণ। তবে রাজীব-ঋতুর প্রেমটা আরও বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা যেতো। যার জন্য রাজীব চরিত্রটির প্রতি মেয়েঘেঁষা, ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর অপবাদটা এসেই যায়। মনে প্রশ্ন জাগে- এতা অল্প সময়েই এতো গভীর প্রেম? যার জন্য রাজীব প্লেনে ওঠার আগেও প্রতিশ্রুতি দেয়- সে ঋতুর কাছে ফিরে আসবেই! সে কী প্রেম না অন্য কিছু? সবশেষে তরুণ লেখক যেভাবে 'গন্দম' উপন্যাসে কোলকাতার ক্রিকেট, নন্দীগ্রাম, বাংলাদেশের এনজিও, ড. ইউনুস ও নোবেল বিষয়ক কথা, ইয়াবা সমাচাসহ যে সাম্প্রতিক বিষয়গুলো এনেছেন তাতে বোর লাগেনি কখনো। আর মূলকাহিনীও বেশ পরিণতির দিকেই নিয়ে যেতে পেরেছেন। এখানেই অমিত আহমেদ-এর সার্থকতা।

খবর পেলাম বইগুলোর বিক্রি ভালো। বইগুলোর বহুল প্রচার কামনা করছি। সুস্বাস্থ্য কামনা করছি তিনজন লেখকের। সাথে সাথে প্রকাশনা সংস্থা জাগৃতিকে বলবো আপনাদের প্রায় বইয়েই প্রচুর টাইপো। এদিকে একটু খেয়াল না দিলে এই ভাষা আন্দোলনের মাসে বাংলা ভাষাকে খুব দীন মনে হয়!
২৩.০২.২০০৮


মন্তব্য

আরিফ জেবতিক এর ছবি

জলিল ভাই , আলোচনা/ সমালোচনার জন্য ধন্যবাদ । উপন্যাসটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে অনুপ্রানিত হলাম ।

আপনার দুইটি অতৃপ্তি প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি । প্রথম কথা হচ্ছে , এই উপন্যাসে শেষ পর্যন্ত আনিস বা দীপু , কেউই প্রধান চরিত্র নয় , দুই পয়সার মানুষদের যৌথ শক্তিই এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র । দুই পয়সার মানুষ একসাথে হলে যে অনেক কিছুই করা সম্ভব সেটাই উপন্যাসের বক্তব্য । তাই কোন একক চরিত্র এখানে বড়ো হয়ে আসে নি । আর যেহেতু যৌথ শক্তিকেই এখানে বড়ো করে আনা হয়েছে তাই ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলোকে বর্ণনা করতে যাই নি । শুধু পাঠকের কাছে চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তোলার জন্য কিছূ ব্যক্তিগত সম্পর্ক এখানে এসেছে ।

যেহেতু সত্য ঘটনার কাছাকাছি থেকে এই উপন্যাস , তাই দীপুর শেষ পরিনতিটাকে বিশদ বর্ণনা করতে পারিনি । আমি অনেক কষ্ট করেও মনে করতে পারি না , আসলেই আমি রাহীকে ( যে চরিত্রের ছায়ায় দীপু ) হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে দেখেছিলাম কি না । শুধু মনে আছে প্রচন্ড বেগে মোটরসাইকেল চালিয়ে সিলেট মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সী গেট দিয়ে ঢুকছি । আর মনে আছে রাহীর কবরের পাশে দাড়িয়ে আছি কয়েকদিন পরে । মাঝের স্মৃতিগুলো অনেকটাই ধোঁয়াশে , খাপছাড়া । শুধু আমার নয় , সেই সময়ের অনেকের কাছেই । তাই আমার বন্ধুদের কেউও ঠিকভাবে সেই সময়টাকে মনে করতে পারে নি । লেখা দিয়ে হয়তো সেই সময়টাকে নির্মান করা যেত , কিন্তু আমি সেটা করতে গেলাম না । তাই উপন্যাসের সমাপ্তি অনেকটা হুট করেই হয়ে গেল ।
এতে করে পাঠকদের একটা অতৃপ্তি রয়ে গেছে , এ কথাটি অনেক বন্ধু পাঠকই উল্লেখ করেছেন । কী আর করা !

টাইপো আসলেই যন্ত্রনা হয়ে দাড়িয়েছে এবারের জাগৃতির অনেকগুলো বইয়ে । আশা করি পরের বার সেগুলো শুধরে নেয়া যাবে ।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আরিফ ভাইয়ের সঙ্গে যদি কখনো সাক্ষাত হয়, সুদ (স্বাক্ষর) সমেত আসল (সকল বই) আদায় করে নিবো!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

অমিত আহমেদ এর ছবি

জলিল ভাইয়ের গন্দম বিশ্লেষণে আমি এতটাই আপ্লুত যে সেই আবেশে মন্তব্যে কিছু লিখতে পারলাম না। তবে একটা শপথ করতে পারি, গন্দম পড়ে যে প্রত্যাশা আমার উপর এসে পড়েছে, তার মর্যাদা আমি রাখবোই রাখবো।

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে জলিল ভাই!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।