আমার পড়া দু'টো কবিতার বই

শেখ জলিল এর ছবি
লিখেছেন শেখ জলিল (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৮/০২/২০০৮ - ১:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বই পড়া আলোচনায় আগের পর্বে উপন্যাসের কথা লিখেছিলাম। ব্লগারদের বই নিয়ে আমার আগ্রহ বেশ পুরনো। গত বছরও লিখেছিলাম। বই হাতে পড়লেই কিছু লিখতে ইচ্ছে করে। এতে করে আমার নিজেরও বই পড়ার জ্ঞান ঝালাই হয়ে যায়। আসলে বই পড়ে আর কতোটুকুই বা বুঝি! বিশেষ করে কবিতার বই। সত্যিকারের কবির ভাবনা কী পাঠক ধরতে পারে? আমার ক্ষেত্রে তো তাই মনে হচ্ছে আজকাল। আশির দশকে যখন কবিতা লিখতে শুরু করি তখন কবিতায় পরাবাস্তবতার জোয়ার বইছে। সেই সাথে কবিতার শব্দে গেঁথে ছিলো বিমূর্ততা, নৈব্যক্তিকতা এবং চিত্রকল্পের সমাহার। লিখতে লিখতে যখন কিছুটা সার্থকতা এলো তখন আমার কবিতাও ছাপা হতো জাতীয় পত্র-পত্রিকায়। এরপর মাঝখানে গান নিয়ে ব্যস্ততা এবং বেশ ক'বছর লিখায় বিরতি। আর এরই মধ্যে ঘটে গেছে কাব্যজগতে নতুন বিপ্লব। নব্বই দশকের শেষ দিকে এবং শূন্য দশকের গোড়া থেকেই কবিতায় এলো দারুণ পরিবর্তন। তরুণ কবিরা শুরু করলেন অ্যাবসার্ট কাব্য লেখা। কবিতার ভাষার এলো পরিবর্তন। উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপকধর্মিতা কমে গেলো। সহজবোধ্য মুখের ভাষা এমন কি আঞ্চলিক ভাষাও এলো কবিতার শরীরে। সেই সহজ ভাষাকে আশ্রয় করে তরুণ কবিরা আনলেন বিপ্লব। কবিতা পাঠকদের মনে হলো- আরে, এ যে অ্যাবসার্ড কথামালা নয়! পুরোপুরি অ্যাবস্ট্রাকট বিষয় উঠে আসছে এর মধ্য দিয়ে। এই হলো নব্বই-এর শেষ এবং শূন্য দশকের কবিদের কথা। এ ধারার দু'জন কবির কথা বলবো আজ। যাঁদের বই বেরিয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০০৮-এ।

মেঘ। সচলায়তন এবং সামহোয়্যারইনব্লগে লিখেন। লেখালিখি জগতে নাম আফসানা কিশোয়ার। তুখোড় কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখেন। ২০০০ সালে 'যায় যায় দিন' থেকে লেখা প্রকাশ শুরু তারপর দৈনিক 'প্রথম আলো'র সেরা ফিচার লেখক পুরস্কার লাভ। এরপর আর পিছন ফিরে তাকান নি। এর আগে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আমি তাঁর পালটায় নারী, বাহারি, শব্দোৎসব, ত্রৈরাশিক, নস্টাজিয়া বইগুলো পড়েছি। দারুণ লেখার হাত তাঁর। এই বইমেলায় এসেছে তাঁর দু'টো বই। আমি কিনেছি তাঁর কবিতার বই ' জলপাই, অপছন্দ যে কারণে'। আবুল হাসান আবু-র সুন্দর প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছে উৎস প্রকাশন।

আফসানা কিশোয়ার-এর কবিতায় এক ধরনের লিরিকবদ্ধতা, গীতলয়তা থাকে সবসময়। কবিতার পরতে পরতে থাকে রোমান্টিক ছোঁয়া। কী নিপূণভাবেই না তিনি তুলে আনেন তিনি প্রেমের কাব্যগাথা! পড়তে পড়তে চলে যাই আমি ভালোলাগা, ভালোবাসার মুক্ত দিগন্তে। এ বইটিতে মোট ৫৩টি কবিতা আছে। আসলে আলাদাভাবে কোনো কবিতা নেই- আছে তারিখ দেয়া, যে তারিখে কবিতাটি লেখা হয়েছে। এই সিরিজ কবিতার প্রথমদিকে উঠে এসেছে ইসাবেলার কথা, তার অতৃপ্তির কথা, গৃহবন্দী গৃহস্থালী যন্ত্রণার কথা। প্রথমদিকের এই কবিতাগুলো পড়ে আমার গতানুগতিক নারী কবিদের কবিতার কথাই মনে হয়েছে। তবে বইয়ের শিরোনামের কবিতা 'জলপাই, অপছন্দ যে কারণে'পড়ে আমার সে ধারণা পালটে গেছে। এরপর উঠে এসেছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, কারফিউ, চট্টগ্রামে ভূমিধস- যা তাঁর কবিতাকে যোগ করছে নতুন মাত্রা। তবে কবিতার স্টাইলে আফসানা কিশোয়ার শূন্য দশক-কে গ্রহণ করেন নি বলেই আমার বিশ্বাস। এখনকার তরুণদের কবিতাতে চলে এসেছে অ্যাবসার্টিজম- যা তাঁর কবিতাতে নেই।

মাহবুব লীলেন। আমার প্রিয় কবিদের একজন। লিখেন সচলায়তনে এবং সামহোয়্যারইনব্লগে। অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং যত্নশীল লেখক। তাঁর প্রতিটি বই যে তিনি বেশ যত্ন করে প্রকাশ করেন তার প্রমাণ এবারের বইমেলায় প্রকাশিত কবিতার বই- খেরোখাতা। সত্যি কথা বলতে কী- এবারের বইমেলায় যে বইটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে প্রচ্ছদে, ভেতরের কলেবরে এবং লিখায় তা হলো কবি মাহবুব লীলেন-এর কবিতার বই 'খেরোখাতা'। ঝকঝকে লেখা, সুন্দর অফসেট পাতায় সুসংবদ্ধ কবিতার দিনলিপি 'খেরোখাতা'। এই একটিমাত্র বই দেখলাম মুদ্রণপ্রমাদবিহীন। বোধ করি আহমেদুর রশীদ এর মতো প্রকাশক এর জন্য কৃতির ভাগীদার। কবিতার ভাষা সুসংবদ্ধ। কোনো অবহেলা চোখে পড়ে না। আশ্চর্য না হয়ে পারি না- বাংলা ভাষায় কী এবং কি এর ব্যবহারেও কবি সচেতন!

খেরোখাতা'র কবিতা সসম্পর্কে কবি নিজেই বলেছেন-
স্মৃতি আর ক্ষতেরা অজ্ঞাত হয়ে উঠার আগেই আমি তাই
নোটখাতা খুলে রাখি ধুলোময় পথে। প্রাত্যহিক জীবনের যন্ত্রণা তির্যক ভাষায় কবি লিপিবদ্ধ করেছেন অবরুদ্ধ, পণ্যপুরাণ, রান্নাসূত্র, মার্কেটিং, ট্র্যাকআউট এবং অচেনা আঁধার-এর মতো কবিতায়। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন সমাজ, রাজনীতির নানান অসঙ্গতি লেইয়াখাউরি, কৃষ্ণগহ্বর, মধ্যমানুষ, বনস্পতি, তৃণভোজী এবং গ্রাম্যতা কবিতাগুলোতে। সিলেটের কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার-এর অকাল মৃত্যু পিতার অনুভূতি দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন শবানুগ এবং পিতৃঠৈকে কবি দিলওয়ার কবিতায়। তিনি স্বপ্ন বুনেছেন ইশতেহার কবিতায়, দ্রোহে মেতেছেন কেঁচো বিত্তান্ত কবিতায় এবং শোষকের প্রতিবাদ করেছেন মানববন্ধন কবিতায়। আসলে সব ভালো লাগা কবিতা বলে শেষ করার মতো নয়। ৫৮টি কবিতার বই 'খেরোখাতা' পুরোপুরি ভালোলাগা কবিতার বই। তবে আমার কাছে শূন্য দশকের কবিতা নিয়ে বিভ্রান্তি কাটবে না যতোক্ষণ না পুরোপুরি আত্মস্থ হই। এজন্য মাহবুব লীলেন এর আরও কিছু বই ভবিষ্যতে পড়ার ইচ্ছে রইলো।

সবশেষে কবি আফসানা কিশোয়ার এবং মাহবুব লীলেন-এর কবিতার বই দু'টির বহুল প্রচার কামনা করছি।
২৮.০২.২০০৮


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

সুন্দর একটা রিভিউ পড়লাম।


কি মাঝি? ডরাইলা?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার প্রতিটা বইয়ের প্রথম ফ্লিপটার নাম অন্দরঘাট। যেখানে আমি বইটা নিয়ে লিখি। আর শেষ ফ্লেপটার নাম সদরপাট্টা যেখানে আমি ওই সময়ের নিজেকে নিয়ে লিখি। খোরোখাতার অন্দরঘাটটা দিয়ে দিলাম এখানে
আর তার আগে রিভিউ করার জন্য শেখ জলিলকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ

খেরোখাতার অন্দরঘাট

ধুলোবালি কুড়োতে হয় না
আপনাতেই মনে ও মগজে এসে জমে যায়

কিন্তু বর্ষার কাদা শুকিয়ে দেয় শীত
শীতের দাগ মিটিয়ে দেয় বৃষ্টি
কোনো ক্ষতই পোড়ায় না বেশিদিন
কোনো স্মৃতিই ভাবায় না বেশিদিন

স্মৃতি আর ক্ষতেরা অজ্ঞাত হয়ে উঠার আগেই আমি তাই
নোটখাতা খুলে রাখি ধুলোময় পথে

সেই নোটকে আমি কবিতাও বলি
আর কোনো বিশুদ্ধবাদী তেড়ে এলে বলি
হাবিজাবি

.............

এইসব হাবিজাবি কেউ পড়ে আর তা নিয়ে কেউ লেখে
সেটাই একটা বিস্ময়ের ব্যাপার....

অনিন্দিতা এর ছবি

@ লীলেন বিস্মিত হয়ে আরও কবিতা লিখুন। আমরা ও বিস্মিত হই!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

একজন স্পন্সরের কল্যাণে এক হালি কবিতার বই করলাম ৪ বছর ধরে
এখন আছে মাত্র একটা গল্পের বইয়ের স্পন্সর। আগামী বছর করব
যদি আপনি কবিতার স্পন্সরের বিষয়টা দেখেন তাহলে না হয় আরো ৪ ফর্মা আবর্জনা আগামী বইমেলায় আনলোড করতে পারি

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

খুবই ভাল একটা রিভিউ পড়লাম। রিভিউ আর সমালোচনা এক নয় তবে , রিভিউ'র মধ্যেও কিছুটা সমালোচনা থাকে।

শেখ জলিল এর লেখায়ও তা' আছে এবং বোনাস হিসেবে আছে "৮০-৯০ আর ০০ দশকের কাব্য প্রবনতা।

শেখ জলিল কে অভিনন্দন ।

মাহবুব লীলেন। আমার প্রিয় কবিদের একজন। লিখেন সচলায়তনে এবং সামহোয়্যারইনব্লগে। অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং যত্নশীল লেখক।

আমারও একই মত।

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

অমিত আহমেদ এর ছবি

অপূর্ব!

অনিন্দিতা এর ছবি

@ লীলেন, প্রস্তাবটা শর্তসাপেক্ষে বিবেচনাধীন। আপনি মানলে বিবেচনা করা যেতে পারে।
শর্ত টা ভয়ে নাকি নির্ভয়ে বলবো?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

১০০% নির্ভয়ে ১০০টা শর্ত বলতে পারেন
টাকা দিলে সব মানি
শুধু বই উৎসর্গ করতে বলবেন না কারো নামে
(স্পন্সর করার কথা পরিষ্কার করে লেখা থাকবে। আমার বর্তমান স্পন্সর তার নাম দিতে চান না বলে নাম দেয়া হয় না)

অনিন্দিতা এর ছবি

শর্ত হচ্ছে- ১০০% বিষন্নতামুক্ত কবিতা পড়তে চাই সে বই এ।
সহজ না কঠিন শর্ত?
হাঃ হাঃ হাঃ।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

জ্বি রাজি

অতিথি লেখক এর ছবি

জলিল ভাই ,
লিলেন ভাইয়ের কবিতার বইটা আজিজে কোন দেকানে পাব একটু বলবেন?

মামুন ম. আজিজ (পথিক!!!!!!!)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।