গোল্লায় যাচ্ছে 'বিটিটিবি'

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: মঙ্গল, ২৮/১০/২০০৮ - ১২:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লেখার শিরোনামটাই বোধহয় ভুল হয়ে গেলো। কারণ বিটিটিবি (বাংলাদেশ টেলিফোন অ্যান্ড টেলিগ্রাফ বোর্ড) আর নেই। এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে 'বিটিসিএল' (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড)। বেসরকারীকরণের প্রথম ধাপ। উন্নত দেশের অনুকরণে এবং সেই দেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা বহুজাতিক কোম্পানির প্ররোচনায় একে একে বাংলাদেশের সবকিছু বেসরকারী খাতে চলে যাচ্ছে। এসেছে প্রাইভেটাইজেশনের জোয়াড়।
হে সরকার, তোমাদের দুর্নীতিবাজ বলেছি বলে কি সবকিছুর উপর থেকে দাবী সরিয়ে নিচ্ছো, নাকি রেগে গিয়ে দুর্নীতি কাকে বলে দেখিয়ে দিচ্ছো? তোমার বিধি বোঝার ক্ষমতা তো আমাদের মতো ছাপোষা মানুষের নেই।

গতকাল থেকে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং শুরু হয়েছে। প্রথম সপ্তাহ টিঅ্যান্ডটি-তে। আজকের ভেন্যু ছিলো এই বিটিসিএল। আমাদের ক্লাস নিলেন বিটিটিবি থেকে বিটিসিএল হওয়ার ঘটনায় মর্মাহত ও ত্যক্ত-বিরক্ত এক সরকারী প্রকৌশলী। তার কথাগুলো খুব ভালো লেগেছে। মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে আদ্যিকালের অপারেটরভিত্তিক সুইচিং সিস্টেম থেকে শুরু করে স্ট্রোগারের রোটারি ডায়াল হয়ে আধুনিক ডিটিএমএফ (আজকালকার ফোনের নাম্বারিং যা দিয়ে করা হয়) পর্যন্ত বুঝিয়ে দিলেন। এরপরে হাতে-কলমে সবকিছু দেখালেন। এরপর শুরু হলো ব্যবসার কথা। বাংলাদেশে টেলিকম ব্যবসা কোন দিকে যাচ্ছে, এই নতুন পরিস্থিতিতে দেশীয় টেলিকম বাজারের অবস্থা কি হবে, বিটিসিএল এর পরিণতি কি হবে সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। তার এই কথাটুকু থেকেই আমি অনুপ্রাণিত। এটাকে পুঁজি করেই লিখছি। অবশ্য নেট থেকেও কিছু তথ্য নিয়ে নিয়েছি। এই প্রকৌশলীর ব্যবসায়িক আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশ সরকারের ILDTS (International Long Distance Telecommunication Services)-২০০৭ অনুমোদন।

আইএলডিটিএস-এর কথা আমরা কেউই জানি না। কিন্তু ভিওআইপি-র কথা কমবেশী সবাই জানি। কারণ, পত্র-পত্রিকায় এই নামটাই এসেছে। ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে ভিওআইপি-র বেসরকারীকরণের লাভের কথা। জানানো হয়েছে, বেসরকারী টেলিকম কোম্পানিগুলোকে ভিওআইপি ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশ সরকার কি যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটাই না নিয়েছে। এমনকি নেটে সার্চ দিলেও এর প্রশংসাসূচক লেখাগুলো নজরে পড়ে। ভিওআইপি-র এই বেসরকারীকরণ কিন্তু আইএলডিটিএস-২০০৭ অনুমোদনের মাধ্যমেই হয়েছে। এর জন্য আমাদের প্রথমেই জেনে নেয়া দরকার আইএলডিটিএস-২০০৭ এবং ভিওআইপি কি জিনিস। তার পর সম্পর্ক ও পরিণতির কথায় আসা যাবে।

আইএলডিটিএস একটা পলিসিমাত্র। এতে বলা হয়েছে, বিশাল-দূরত্বের (দেশ থেকে বিদেশে বা বিদেশ থেকে দেশে) কলগুলোর খরচ কমানোর জন্য এতোদিন বাংলাদেশ সরকার যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করে এসেছে তার দুই তৃতীয়াংশ এবার বেসরকারী কোম্পানিগুলোর হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এরকমই একটি পদ্ধতির নাম ভিওআইপি (VoIP) যার পূর্ণরূপ "ভয়েস-ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল"। এবার এই ভিওআইপি-র কথায় আসা যাক।

ইতোমধ্যেই বলে ফেলেছি ভিওআইপি-র মাধ্যমে বিশাল-দূরত্বের কলগুলোর খরচ কমানো যায়। কিন্তু কিভাবে?
প্রক্রিয়াটা বেশ সোজা। এটা বোঝার জন্য প্রথমে বুঝতে হবে বিদেশী কলের খরচটা কোথায় হচ্ছে। খরচ হচ্ছে সার্কিট সুইচ্‌ড সিস্টেমের কারণে। অর্থাৎ এতোদিন এক লোকের সাথে আরেক লোকের কথা বলিয়ে দেয়ার জন্য দুজনের ল্যান্ডসেটের মধ্যে এক জোড়া তার সরাসরি কানেক্ট করতে হতো। তা সে দেশেই হোক বা বিদেশেই হোক। লোকাল টেলিফোন ব্যবস্থায় অবশ্য এর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু বিদেশে বিকল্প না থাকলে কতো খরচ হবে একবার ভেবে দেখুন। তার দিয়ে সংযুক্ত করার পাশাপাশি আমি যে দেশের লাইন ব্যবহার করছি সে দেশকে ট্যাক্স দিতে হতো। এই ধরুন, আপনি মধ্যপ্রাচ্যে কল করতে চাচ্ছেন। আপনাকে ভারত, পাকিস্তান, ইরানের লাইন ব্যবহার করে তবেই মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছুতে হতো। এর ফলে এই প্রতিটা দেশকে লাইন ব্যবহারের অনুপাতে ট্যাক্স দিতে হতো। এখানেই বিপুল খরচ হতো।

কিন্তু ভিওআইপি এক নতুন ব্যবস্থা নিয়ে এলো যার নাম প্যাকেট-সুইচ্‌ড। এখানে কোন টেলিফোনের তার লাগে না। লোকাল কথাবার্তার জন্য আপনি তারই ব্যবহার করবেন, কিন্তু বিদেশে কথা পাঠানোর জন্য আর এই তার লাগবে না। এটা হবে উন্মুক্ত ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এজন্যই নাম হয়েছে ভয়েস-ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল। ব্যাপারটা এরকম:

বিদেশী কলগুলো সব দেশে রাখা আইটিএক্স-এ জড়ো হবে। আইটিএক্স মানে ধরে নেন একটা যন্ত্র যা কোন দেশে কল যাবে তা ঠিক করে। আগে আইটিএক্স থেকে সার্কিট সুইচ্‌ড পদ্ধতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে কল পাঠানো হতো। যার ফলে অনেক টাকা লাগতো। কিন্তু এখন আইটিএক্স থেকে সরাসরি ইন্টারনেটের মাধ্যমে কথা যায়। ইন্টারনেটে লজিক্যাল প্যাকেটের মাধ্যমে ডিজিটাল উপাত্তগুলো চলাচল করে। যার ফলে মাঝের এই ট্যাক্সের খরচটা থাকে না। এভাবেই ভিওআইপি বাজিমাত করে।

এতোদিন ধরে বাংলাদেশ সরকার ভিওআইপি নিজের হাতে রেখে দিয়েছিলো। অর্থাৎ বিটিটিবি ছাড়া আর কেউ এটা ব্যবহার করতে পারতো না। কিন্তু ২০০৭ সালে আইএলডিটিএস অনুমোদনের মাধ্যমে দেশের বেসরকারী টেলিকম কোম্পানিগুলোকে ভিওআইপি-র দুই তৃতীয়াংশ রিসোর্স ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার দেশে-বিদেশে বিপুল প্রশংসিত হয়। দেশের বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানিগুলো খুব খুশী হয়। ভিওআইপি-র পক্ষে এরকম যুক্তি দেখানো হয়:
- বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে।
- এর আগে বেসরকারী কোম্পানিগুলো চুরি করে ভিওআইপি ব্যবহার করতো। ফলে সরকার ভিওআইপি-র ট্যাক্সটাও পেতো না। এখন আর চুরি হবে না। ফলে সরকার পুরো রাজস্বটা পকেটে পুরতে পারবে।

এর আগে আসলেই চুরি হতো। এজন্যই আমরা বিদেশ থেকে কল আসলে অনেক সময় উল্টাপাল্টা মোবাইল নাম্বার দেখতাম। বোঝা যেতো, কোন একটা মোবাইল কোম্পানির মাধ্যমে কলগুলো আসছে। এবার আসলেই আর চুরি হবে না। সবাই এর ভালো দিকগুলো নিয়ে মেতে আছে। কিন্তু এর মাধ্যমে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বিটিটিবি-র যে কত বড় ক্ষতি হয়ে গেলো এবং সার্বিকভাবে সাধারণ মানুষের যে কত বড় ক্ষতি হলো তা কেউ দেখলো না। আজ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং এ আমরা সে কথাগুলোই শুনলাম। আসুন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে তা দেখে নেয়া যাক:

ঢাকার মগবাজার আর মহাখালীতে অবস্থিত বিটিটিবি-র অফিসে আইটিএক্স আছে। অর্থাৎ এখান থেকে বিভিন্ন দেশে কল যায়। এজন্যই এ স্থানগুলোতে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়। এর নিরাপত্তার মাত্রা 1a, অর্থাৎ এর উপরে আর কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তা মাত্রাও 1a। এতো নিরাপত্তা কিন্তু এ কারণে নয় যে, কেউ বিটিটিবি-তে আগুন জালিয়ে দেবে বা বোমা ফাটিয়ে দেবে। এতো নিরাপত্তার কারণ টাকা। টেলিকম সেক্টর থেকে আসা মোট রাজস্বের শতকরা ৮০ ভাগই আসে এই আইটিএক্স দুটি থেকে। আনুমানিক হিসাবটা এরকম:

গত বছরও লোকাল আর বিদেশী কল মিলে বিটিটিবি-র মোট আয় হয়েছে ১৮০০ কোটি টাকা। ব্যয় ২০০ কোটি টাকা বাদ দিলে লাভ দাড়ায় ১৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২০০ কোটি টাকা এসেছে বিদেশী কল থেকে আর ৪০০ কোটি টাকা লোকাল কল থেকে।
আইএলডিটিএস অনুমোদনের মাধ্যমে কল সুবিধার দুই তৃতীয়াংশ দিয়ে দিতে হবে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে। তার মানে সবকিছু এক তৃতীয়াংশ হয়ে যাবে।
বিদেশী কল থেকে মোট লাভ হবে ৪০০ কোটি টাকা
লোকাল কল থেকে মোট লাভ হবে প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ২০০ কোটি টাকা
মোট লাভ দাড়াচ্ছে ৬০০ কোটি টাকা।

এর মধ্যেও প্যাঁচ আছে। বিটিটিবি-র নীতিমালা তৈরীর জন্য অনেক আগেই বিটিআরসি (বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স রেগুলেটরি কমিশন) নামে একটা সংস্থা করা হয়েছিলো। এবার রাজা হয়েছে এই বিটিআরসি। তারাই আইএলডিটিএস অনুমোদনের হর্তাকর্তা সেজেছে। তারা বিটিসিএল-কে বলছে, তোমরা সরকারকে টাকা দেও এটা আমাদের পছন্দ না। তারচেয়ে তোমরা আমাদের দাও, আমরা সরকারের হাতে পৌঁছে দেবো। হাত ঘুরতে গিয়ে কিছুটা দুর্নীতিও হয়ে যাবে। আমি বলছি না বিটিটিবি-তে দুর্নীতি হয় না। কিন্তু দুই হাত ঘোরানোর অর্থই হচ্ছে দুর্নীতিটা বেড়ে যাওয়া।

বিটিটিব-র মোট লাভের ৫৫% বিটিআরসি-কে দিয়ে দিতে হবে। বিটিআরসি তা দিয়ে নিজেদের নীতিমালা প্রণয়নের কাজ করবে আর সরকারকে রাজস্ব দেবে, কিছু কেটে। তার মানে,
বিটিটিবি-র মোট লাভ দাড়াচ্ছে, ৩০০ কোটি টাকা।
এই প্রকৌশলী আমাদের বললেন, ৩০০ কোটি টাকা লাভের প্রতিষ্ঠান থাকবে না। মাত্র ২ বছরের মধ্যে যে প্রতিষ্ঠানের লাভ ১৬০০ কোটি টাকা থেকে কমে ৩০০ কোটি টাকায় পৌঁছায় তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

এবার ভিওআইপি-র তথাকথিত লাভটা নিয়েও আমরা কথা বলতে পারি। প্রথমেই বলেছিলাম, ভিওআইপি-র ব্যবহার সিদ্ধ হওয়ায় সরকার বেসরকারী কোম্পানিগুলো থেকে আগের চেয়ে বেশী ট্যাক্স পাবে। কিন্তু বিটিটিবি যে লাভটা করতো তার পুরোটাই তো সরকার পেতো, রাজস্বটা না। এবার সেই লভ্যাংশের রাজস্বটাই শুধু পাবে।

আধুনিক যুগে বদ্ধ ভিওআইপি-র কথা কেউ ভাবতে পারে না। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা উন্মুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে কি এর মাধ্যমে কোন সুফল আসবে। আমার মনে হয় না। কারণ, এর আগে টেলিকম সেক্টরে বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য বিটিটিবি ছিল, এখন সেটাও থাকছে না। লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেশের টেলিকম সেক্টর। টিঅ্যান্ডটি-র এই সরকারী কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, আর দুই-তিন বছরের মধ্যে দেশের কলরেট আবার বেড়ে যাবে। কারণ বিদেশী কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করার কেউ থাকবে না। সবাই একসাথে কল রেট বাড়িয়ে দিলে কারোই কিছু করার থাকবে না। ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

এমন ঘোর সংকটময় পরিস্থিতিতে আবার বিটিটিবি-র বেসরকারীকরণ কি ভেবে করা হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে কোন গহীন ঘড়যন্ত্র। ইতোমধ্যে বিটিটিবি নাম পাল্টিয়ে বিটিসিএল করা হয়েছে। এ বছরের ১লা জুলাই থেকে বিটিসিএল কার্যকর হয়েছে। ১৫,০০০ কোটি টাকা দাম হাকা হয়েছে। অচিরেই শেয়ার ছাড়া শুরু হবে। সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে। সরকার কি বিটিটিবি-র সংকট মোকাবেলার দায়িত্বও এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে? কোন প্রাইভেট কোম্পানির হাতে সব ছেড়ে দিয়ে শান্তিতে ঘুমাতে চাচ্ছে। এর জন্যই কি সংবিধান লংঘন করে বিটিটিবি-র সরকারী কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে টেনে আনছে?

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কথা শুনে বেশ খারাপও লাগলো। বললেন তাদের মত বিসিএস অফিসাররা এখন ভাসমান অবস্থায় আছেন। দুই বছর তাদের ভাসমান থাকতেই হবে। তাদেরকে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, দুই বছরের মধ্যে তাদেরকে অন্য কোন সরকারী অফিসে বদলীর সুযোগ দেয়া হবে। ততদিন সবকিছু অনিশ্চিত।

এমনিতেই সরকারী চাকুরিজীবীদের স্বচ্ছল জীবন-যাপন করা হয়ে উঠে না। তার উপর একে একে সব গোল্লায় যাচ্ছে। আর কতদিন বাংলাদেশে এসব অরাজকতা চলবে? আর কতদিনে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে? কতদিন পর বাংলাদেশের সামরিক পোশাক পরা শাসকেরা ব্যারাকে ফিরে যাবে? সে সুসময় কি দেখে যেতে পারবো না?


মন্তব্য

আলমগীর এর ছবি

দুই বিষয় গুলিয়ে গেছে।

১. আন্তর্জাতিক ফোন কল যা আন্তর্জাতিক গেটওয়ের মাধ্যমে হতো (৮৮০ প্রিফিক্স দিয়ে) তার পুরোটা পেত বিটিটিবি। সম্প্রতি আরো দুটি কোম্পানিকে এরকম গেটওয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে যারা লাভের ৬৩% সরকারকে দেবে। এখানে ভিওআপি হবে না কী হবে, তা বলা নেই (সেটাই হবে খরচ বিবেচনায়)।

২. ভিওআইপি আগেও অবৈধ ছিল এখনও তা পুরা মাত্রায় অবৈধ। এর কারন ৩নং।

৩. ভিওআইপি ব্যবহারে যেসব কল পিএসটিএন হয়ে যাবার কথা তা নেট দিয়ে যায়। কিন্তু এর মধ্যে একটা বড় দুই নাম্বারি করে মোবাইল অপারেটররা। পিএসটিএনের চেয়ে এদের গ্রাহক ঘনত্ব বেশী, তাই নামমাত্র খরচে তারা কল করার সুযোগ দিতে পারে। আর সে সুযোগ নিয়ে অলিতে গলিতে ভিওআইপি প্রোভাইডার গড়ে উঠেছে। এরা দুটি কাজ করে। বিদেশী কল গুলো তাদের সার্ভারে টার্মিনেট করে (এগুলো শ্রেফ সিপ সার্ভার)। আর সেসব কল গ্রামীণ/সিটিলিংক/বাংলালিংকের সংযোগ ব্যবহার করে গ্রাহকের কাছে পৌছায়। এর জন্য এসব প্রোভাইডার নেটে এড দেয় যাতে অন্যান্য প্রোভাইডার তাদের ট্রাফিক কেনে। এটি আগের মতো এখনও অবৈধ। (কিন্তু চালু আছে)।

মোবাইল ক্যারিয়ারগুলোর অপরাধ তারা খুব কম কল-রেটে এসব চোরা প্রোভাইডারদের সিম সরাবরাহ করত। মোবাইল যখন বহুল ছিল না তখন তারা বিটিটিবিকে ঘুষ দিয়ে ই-১ লাইন ব্যবহার করত। অনেক আইএসপিও একাজে জড়িত, কারণ ই-১ মূলত তাদের পেতে সুবিধা হত।

এর বাইরে গ্রামীণ সম্ভবত সবচেয়ে বড় বেআইনি কাজ করেছিল। তারা নিজেরা পুরোদুস্তর গেটওয়ে বসিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে লবি করেছে ট্রাফিক বিটিটিবি গেটওয়ে না দিয়ে তাদের ওখানে দেয়ার জন্য। এ নিয়ে জাকারিয়া স্বপনের একটা লেখা পড়েছিলাম।

৪. ম্যাঙ্গো টেলিকম লাইসেন্স পাওয়ায় এই অবৈধ অলি-গলির কারাবারিরা মারা যাবে। তবে কলের রেট আমাদের প্রবাসীদের জন্য বেশী হবে। ভিওআইপি এখনকার মতো নিষিদ্ধ থাকলে সরকারের আয়ে কোন খারাপ প্রভাব পড়ার কথা না। যদি না ম্যাঙ্গো ভুল হিসাব ধরায়।

৫. বিটিটিবির কর্মকর্তাদের জন্য কোন সহানুভিতি নাই।

শিক্ষানবিস এর ছবি

বেশ ভয়ে ভয়েই লিখেছিলাম। তবে আশা ছিল, কেউ না কেউ ভুল ধরিয়ে দেবে। আপনি এগিয়ে এলেন। ধন্যবাদ।

আইএলডিটিএস-২০০৭ এর পিডিএফটা নামিয়েছিলাম। কিন্তু পুরোটা পড়া হয়নি। ভিওআইপি ছাড়া আরও অনেক বিষয়ই ছিলো। আমি বোধহয় যতটুকু বুঝি ততটুকুতে বেশী গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি। আপনার মন্তব্য পড়ে কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার হলো।

বিটিসিএল এর ঐ কর্মকর্তা বলেছিলেন আগামী বছরই তাদের লাভ ৩০০ কোটি টাকায় নেমে আসবে। আপনি বলছেন ভিওআইপি নিষিদ্ধ আছে এবং এটা ঠিক থাকলে ভয়ের কোন কারণ নেই।

আজকেও KPI-1b সাইট থেকে ঘুরে এলাম: রমনা এক্সচেঞ্জ। সেখানকার কর্মকর্তারাও কিন্তু একই কথা বলছেন। তারা আজ আমাদের প্রশ্ন করেছিলেন: ভিওআইপি হলেও তো সেই গেটওয়ে দিয়েই যায়, তাহলে এক্ষেত্রে সরকার রেভিনিউ পায় না কেন? ভাগ্যিস প্রশ্নটা আমরা পেরেছিলাম।
কথা হলো, তাদের সবাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই একই প্রসঙ্গ নিয়ে আসছেন। এজন্যই তৎপর হয়ে লিখে ফেলেছিলাম।

আমার মধ্যে অবশ্য সরকারী কর্মকর্তাদের জন্য একটু সহানুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ আসলেই তো, তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছেন আন্তর্জাতিক স্কেলে আর নিজেদের শ্রম বিক্রি করছেন দেশীয় স্কেলে।

আলমগীর এর ছবি

১. যখন বাংলাদেশ থেকে কেউ আইএসডি কল করেন তখন তা:
ক) নিউমার্কেট (মগবাজারেও হতে পারে) এ যায়।
খ) সেখান থেকে স্যাটেলাইট (বা এখন হয়ত ফাইবার) দিয়ে ITU এর প্রটোকলে টার্গেট দেশের আন্তর্জাতিক গেটওয়েতে যায়। পুরোটা সার্কিট সুইচড। কেউ মোবাইল থেকে কল করলেও তা বিটিটিবর একই গেটওয়ে দিয়ে যাবার কথা।

২. বিদেশ থেকে যখন কেউ কল করেন (সে দেশের জাতীয় গেটওয়ের মাধ্যমে) একই ভাবে তা বাংলাদেশে আসে।

ভোআইপিতে:
আমি ধরুন অস্ট্রেলিয়া থেকে আমার নিজের মেশিনে একটা এসটারিক্স সার্ভার চালু করে সরাসরি যেকোন সিপবক্সের সাথে কানেক্ট করতে পারি। আমার বক্স থেকে ওই বক্সের প্রটোকল ইউডিপি ভিক্তিক, এবং কেবলমাত্র আইপি এড্রেস দিয়ে এড্রেস করা। টার্গেট সার্ভার থেকে সেটা যে কোন পিএটিএন (ই-১ দিয়ে) বা মোবাইলে (চলতি ভাষায় সিম-মেশিন বলে, ভাল নাম জানি না; সাধারণত কুইনটিন ব্রান্ডের ) টার্মিনেট করতে পারে। পিএসটিনে দিলে গেলে বিটিটিবি লোকাল কলের পয়সা পাবে, মোবাইল দিয়ে গেলে মোবাইল অপারেটর।

কল হিসাবে, প্রায় +-৮০ভাগেরও বেশী আসে বাইরে থেকে বাংলাদেশে ইনকামিং কলের জন্য। ভোআপিতে (মোবাইল দিয়ে টার্মিনেট করলে) বিটিটিবি ইনকামিং কলের জন্য কোন পয়সা পায় না, পায় মোবাইল অপারেটররা। এরা আউটগোয়িং তেমন কিচ্ছু করে না, কারণ পয়সা নেই।

বেসরকারীকরণ কার্যকরভাবে করা গেলে সরকার ক্রমাগত কম লাভের ধারা থেকে বাঁচবে। আগে বিটিটিবির যেসব লোক ঘুষ নিয়ে দোকানগুলোতে আইএসডি লাইন দিত তাদের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে।

বিপরীত দিক চিন্তা করলে, বেসরকারীকরণ ততক্ষণই ভাল যতক্ষণ সরকার নিশ্চিত করতে পারবে কোন মনোপলি হবে না। যদি মনোপলি হয় (যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে) তা হলে লাভ নেই।

শিক্ষানবিস এর ছবি

বিষয়টা আরও একটু পরিষ্কার হলো।
আর আইএলডিটিএস প্রসঙ্গে আপনার অবস্থানটা কিন্তু এখনও পরিষ্কার হলো না। এতে কি দেশের লাভ হলো না ক্ষতি হলো? ৬৩% লাভ দেয়ার বিষয়টা কি যথেষ্ট?
আর বিটিটিবি-র বেসরকারীকরণ বিষয়ে কি মনে করেন?

আলমগীর এর ছবি

আমি ব্যক্তিগত ভাবে ইন্টারনেট, ফোন আর বিদ্যুতের বেসরকারিকণের পক্ষে। আমাদের দেশে মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের ফাইবারের কোন সুবিধা কেউ পাচ্ছে না। গড়ে প্রতি মাসে একবার কাটা খাচ্ছে। ফোনের অবস্থা আরও খারাপ। হাইস্পিড নেটের জন্য পিএসটিএন ভিত্তিক এডিএসলের বিকল্প নেই। যাদের পিএসটিএন নেই তাদের জন্য ওয়াইফাই কিছুটা ভাল স্পিড দিতে পারবে। এইচপিডিএ নেটওয়ার্ক কেউ বসাচ্ছে কিনা জানি না। বসালেও তা বিটিটিবে যে না তা নিশ্চিত বলা যায়।

এখন প্রশ্ন হলো দক্ষতার। কদিন আগের একটা খবর ছিল: বেসরকারি উৎপাদকেরা কত বিদ্যুৎ গ্রিডে দেয় তার কোন সঠিক হিসাব করতে পারে না পিডিবি, আর ওই বেটাদের হিসাব মতো ৪০কোটি টাকা বাড়তি বিল দেয়। তারপর পিডিবি কিছু করে 'কেটে' নেয়া শুরু করে। কিন্তু আগামি ইলেকশনের পর, আবার যে ফেরত দিবে তা ধরে নেয়া যায়।

একই কথা ওই গেটওয়ে সম্পর্কে প্রযোজ্য। আগে পিছে বৈধ/অবৈধ সব টেকনিকের জোরে সরকার ইনকামিং কলের সব রাজস্ব হারাবে। বেসরকারীকরণ করে যদি ভিওআইপি বন্ধ রাখতে পারে তবে কিছুটা টাকা পাবে। কিন্তু আবার ওই একই কথা রাজনৈতিক সরকার আসলে ভিওআইপি চালু হবে পুরোদমে।

পলাশ দত্ত এর ছবি

বিটিটিবির এই দিকটা কেউ ধরলো না ক্যান! শিক্ষানবিস, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

শিক্ষানবিস এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকেও

দুর্দান্ত এর ছবি

বুঝলাম বিসিএস ইনজিনিয়ার সাহেব ফ্যাকড়ায় পড়েছেন - কিন্তু একটার জায়গায় চারটা প্রতিষ্ঠান হলে, তার ও তার সহকর্মিদের জন্য আরও ভাল হয় না?

দরকারি কথা হল, ভোক্তা কিভাবে লাভবান হচ্ছেন। প্রতিযোগীতার কারনে কলরেট কমার ই কথা। বেসরকারি কম্পানিগুলো একজোট হয়ে কলরেট যাতে বাড়িয়ে দিতে না পারে, তার জন্যই তো বিটিআরসি।

সরকারের কাজ খবরদারি করা আর শুল্ক আদায় করা। ঝুঁকি নিয়ে মুনাফা খুঁজবে মুলধনের মালিক, সরকার নয়।

শিক্ষানবিস এর ছবি

বাংলাদেশে টেলিকম কোম্পানিগুলো কিন্তু একরকম আগ্রাসনই চালিয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ। এতো অল্প সময়ে নিজের পুরোটা দেশ বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দিতে অন্য কোন দেশ রাজি হতো কি-না তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রতিপক্ষ হিসেবে একটা বাংলাদেশী কোম্পানি কি প্রয়োজনীয় না।
শুনেছি, ইন্ডিয়াতে সমগ্র দেশব্যাপী এক্সচেঞ্জ একমাত্র সরকারী কোম্পানিরই আছে। বেসরকারী কোম্পানিগুলো সরকারের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে একেকজন একেক স্থানে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। কেউই একচেটিয়া হতে পারেনি। বাংলাদেশ কিন্তু ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
অবশ্য আলমগীরের মন্তব্য পড়ে বুঝতে পারছি, বিটিসিএল-এ আমাদেরকে যেভাবে বোঝানো হয়েছে বিষয়টা তত জটিল না। তাই যেন হয়।

আসিফ মোহাম্মদ আদনান [অতিথি] এর ছবি

আমার নিজের এ ব্যাপারে কিছু বলার ছিল:
১) উদার এবং লাগামহীন বেসরকারীকরণ এর অপকারী দিকগুলো বিবেচনা করা উচিত। বেসরকারী করে দিলেও কিছু মাত্রায় হলেও সরকারী নিয়ন্ত্রন দরকার।
২) বিটিটিবি নিজে উদ্যোগি হয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যাবহারের মাধ্যমে দেশীয় ভোক্তাদের সাহায়্যে এগিয়ে আসে না কেন। যেখানে বিটিটিবি - এর মোটামুটি উপজেলা (ভূল হলে ঠিক করে দিয়েন) পর্যায়ে অফিস আছে কিংবা সরকরীভাবে যেখানে জনবল অনেক বেশী, সেইঅবস্থায় বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে বিটিটিবি এর চেয়ে পিছিয়ে থেকেও আজকে ধনি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়?
৩) সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারী - দের পারিতোষিক এর ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত। সম্মানজনক বেতন-ভাতা তাদের অধিকার।

শিক্ষানবিস এর ছবি

একটা বিষয় ভাবলে আসলেই খারাপ লাগে। এদেশের সরকারী অফিসগুলোতে কেউ উদ্যোগী হয় না। বিটিটিবি যদি উন্নতি করতে চায় তো তার সিদ্ধান্তটা তো ভেতর থেকেই আসতে হতো। তারপরে না রাজনীতিবিদদের কাছে যাওয়া। সিদ্ধান্ত তো আর রাজনীতিবিদরা নিতে পারেন না।

রানা মেহের এর ছবি

আমি এই ব্যাপারগুলো একদমই বুঝিনা শিক্ষানবীশ।
শুধু বুঝি লাভের টাকাটা আমাদের সরকার পাক।
প্রাইভেট কোম্পানী দরকার হলে সরকারের কাছ থেকে
সেবা কিনে নিক। অনেকটা আসিফ মোহাম্মদ আদনান যেমন বলেছেন
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

শিক্ষানবিস এর ছবি

আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। টেকনিকেল বিষয়গুলা না বুঝলেও এরকম জনসচেতনতা আমাদের দেশে বড় প্রয়োজন।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

জানিসই তো শুধু জানা ছাড়া আর কিছুই বলার নাই। চলুক
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।