আরেকটি পৃথিবী - ১

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৭/০৫/২০০৯ - ১১:৪৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কত বড় হয়ে গেছি। অমাবস্যার রাতে, চিত হয় শুয়ে, আকাশের দিকে মেলে ধরা চোখ দিয়ে দেখা তারাগুলো আমাকে আর বিস্মিত করে না। মাঝেমাঝে তাই খুব আফসোস হয়। আজ থেকে কয়েক সহস্র বছর আগে, যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আকাশ থেকে ধপ করে খসে পড়া একটা আলোকবিন্দু আমাকে বিহ্বল করতো। শতকের পর শতক বিহ্বল হয়ে থাকতাম। আর আজকে আমার বিহ্বলতা ঠাঁই নিয়েছে বুধ গ্রহের কক্ষপথে। নাহ, বুধ গ্রহের ব্যতিক্রমী আচরণ দেখেও তো আর বি...কত বড় হয়ে গেছি। অমাবস্যার রাতে, চিত হয় শুয়ে, আকাশের দিকে মেলে ধরা চোখ দিয়ে দেখা তারাগুলো আমাকে আর বিস্মিত করে না। মাঝেমাঝে তাই খুব আফসোস হয়। আজ থেকে কয়েক সহস্র বছর আগে, যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আকাশ থেকে ধপ করে খসে পড়া একটা আলোকবিন্দু আমাকে বিহ্বল করতো। শতকের পর শতক বিহ্বল হয়ে থাকতাম। আর আজকে আমার বিহ্বলতা ঠাঁই নিয়েছে বুধ গ্রহের কক্ষপথে। নাহ, বুধ গ্রহের ব্যতিক্রমী আচরণ দেখেও তো আর বিস্মিত হই না, ব্যাখ্যা পেয়ে গেছি যে। সপ্তদশ শতকের মহাকর্ষ তত্ত্ব, উনবিংশ শতকের কোয়ান্টাম তত্ত্ব আর বিংশ শতকের আপেক্ষিকতা আমার বিহ্বলতার অধঃপতন ঘটিয়েছে কি?- মনে হয় না। এটাকে অধঃপতন না বলে বিবর্তন বললেই তো হয়ে যায়। আমার বিহ্বলতার বিবর্তন ঘটেছে। বিবর্তন বললে সুবিধা হচ্ছে, তখন আর আকাশ থেকে খসে পড়া তারার সাথে সূর্যের প্রভাবে বেঁকে যাওয়া আলোর তুলনা দিতে হয় না।

বিহ্বলতার বিবর্তনের প্রধান দিক হচ্ছে এটা বাস্তবতা আর তত্ত্বকে উল্টে দিয়েছে। শত-সহস্র বছর আগে বাস্তবতার পর ব্যাখ্যা আসতো। আগে প্রকৃতির একটা ঘটনা দেখতাম, তারপর সেটার ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতাম। আর এখন ব্যাখ্যাটাই আসে আগে। বাস্তবতা নয়, তত্ত্বই আমাকে বিহ্বল করে। প্রকৃতি নয়, আমার প্রকৃতি ব্যাখ্যার ক্ষমতাই যেন এখন চালকের আসনে। এ ধরণের বিবর্তনের যথেষ্ট কারণ আছে- ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না এমন অনেক কিছুকেই গণিত আর বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। এই উল্টোমুখী বিবর্তন আমার অমরত্ব ধরে রাখার সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাবতে ইচ্ছে করে, স্থান-কালে একমাত্র আমিই অমর। আমি মানুষ, আমি জানি অমরত্ব কাকে বলে, আমি জানি সবকিছু পরিবর্তনশীল, আমি জানি প্রকৃতির নিয়ম স্থির হলেও নিয়ম আবিষ্কারের প্রচেষ্টা পরিবর্তনশীল, আমি জানি প্রকৃতির কোন চেতনা নেই, আমি জানি আমার চেতনা আছে, আমি জানি কিভাবে নিজেকে অমর ভাবতে হয়- তাই আমি অমর।

অন্তহীন বিবর্তনের এই পর্যায়ে আমি বুঝতে পারছি, আমার ভবিষ্যৎ অমরত্ব খুব একটা নিরাপদ না। কারণ আর ৫০০ কোটি বছর পর সূর্য অক্কা পাবে, সাথে সাথে পৃথিবীও। তাছাড়া অসীম সমুদ্রের তীরে দাড়িয়ে কেবল ঝিনুক কুড়াতে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখনও পৃথিবীয় বস্তু ছাড়া অন্য কোন কিছুর উপর নিজের অবস্থান ভাবতে পারি না। আর আরেকটা পৃথিবীর খোঁজ পেলে অন্তরে যে শিহরণ জাগবে সেটা ভেবে আরও শিহরিত হয়ে উঠি। মহাকাশ যুগের একটা অংশ হিসেবে বহির্গ্রহ সন্ধান তাই আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আকাশগঙ্গার শতকরা এক ভাগ তারার চারদিকেও যদি একটা করে পার্থিব গ্রহ থাকে তাহলেও, মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০ কোটি। জানি না, ১০০ কোটি পার্থিব গ্রহ আমার হাতে ধরা দেয়ার জন্য অপেক্ষা করছে কি-না। জানার জন্যই এ অডিসি.....

[কাট করে সাবজেক্টিভ থেকে অবজেক্টিভ পয়েন্ট অফ ভিউয়ে চলে যাওয়া উচিত বলে মনে হচ্ছে]

প্রথম বহির্গ্রহ আবিষ্কারের গল্প

১৯৮০-র দশকের প্রথম দিকে বহির্গ্রহ খোঁজার বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা ছিল আউট অভ ট্র্যাক। বহির্গ্রহ শিকারীরা ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতো। ভোগারই কথা। ১১ বছর আকাশ পর্যবেক্ষণ করে কোন ফলাফল না পাওয়া বিজ্ঞানীর জন্য ভোগান্তি ছাড়া আর কিইবা থাকতে পারে, যদিও পর্যবেক্ষণের আনন্দটা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। জেফ্রি মার্সি এমনই এক বিজ্ঞানী- সে এবং তার সহকর্মী পল বাটলারকে একটু পড়েই নায়ক হিসেবে উপস্থাপিত করা হবে, যদিও প্রথম বহির্গ্রহ আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাদের না।

তারা ১১ বছর বেগার খেটে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত। এমনই এক সময় নেচার পত্রিকায় এক যুগান্তকারী গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল- প্রকাশক ইউনিভার্সিটি অফ জেনেভার অধ্যাপক মিশেল মায়োর ও তার ছাত্র দিদিয়ের কুয়েলোৎস। তারা দাবী করলেন, ৫১ পেগাসি নামক তারাটির চারপাশে বৃহস্পতির মত এক গ্যাসীয় দানব গ্রহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। সামষ্টিক জ্ঞানই যেখানে মুখ্য সেখানে অর্জিত জ্ঞান বিনিময়ের কোন বিকল্প নেই। মায়োর আর কুয়েলোৎসের গবেষণাপত্র পড়ার পর জেফ মার্সি আর পল বাটলার নিবিঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন ৫১ পেগাসিকে। এটা ছিল তাদের জীবনের দ্বিতীয় সেরা অর্জন। স্যান জোসের লিক মানমন্দির থেকে বেরিয়ে তারা পৃথিবীর মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানালেন, প্রথম বহির্জাগতিক গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে।

মায়োর ও কুয়েলোৎসের গবেষণাপত্র পুনঃনিরীক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল অ্যালান বসকে। বস এটা পড়ে ধাঁধায় পড়ে গিয়েছিলেন। কারণ তাদের হিসাব মতে, এই গ্রহের আকার প্রায় বৃহস্পতির সমান। অথচ বৃহস্পতি যেখানে ১২ বছরে একবার সূর্যকে আবর্তন করে, সেখানে এটা মাত্র ৪ দিনে ৫১ পেগাসিকে আবর্তন করে। এই শর্ত রক্ষা করতে গেলে বিশাল গ্রহটিকে তারার খুব কাছে থাকতে হবে। বুধ গ্রহ সূর্যের যত কাছে, তার থেকেও কাছে। আর এত কাছে থাকা মানে গ্রহটা রীতিমত দাউ দাউ করে জ্বলছে। শেষ পর্যন্ত এটাই সত্য প্রমাণিত হল। আর এর মাধ্যমে মার্সি-বাটলারের গবেষণার ধরণ গেল বদলে।

এর আগে তারা কেবল বড় আবর্তন কালের গ্রহ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। যার কারণে কিছুই পাননি। তারা ধরে নিয়েছিলেন, অন্য তারার জগৎ অনেকটা সৌরগতের মতই হওয়ার কথা। কিন্তু তাদের ভুল ভাঙলো মায়োরদের আবিষ্কারে। তারা তাদের ১১ বছরের উপাত্তগুলো আবার বিশ্লেষণ করলেন। এভাবেই মার্সি-বাটলারের হাতে দ্বিতীয় বহির্গ্রহটি আবিষ্কৃত হল। প্রথমটার নাম দেয়া হয়েছিল "৫১ পেগাসি বি"। এটাই বর্তমানে স্বীকৃত নিয়ম। তারার চারপাশে আবিষ্কৃত প্রথম গ্রহটার নাম রাখতে হবে তারার নামের শেষে ইংরেজি "b" অক্ষরটি বসিয়ে। আবিষ্কৃত দ্বিতীয় গ্রহের নামের জন্য বসাতে হবে "c"। এভাবে ইংরেজি বর্ণমালা ধরে এগুতে হবে। এ নিয়মেই মার্সি-বাটলার আবিষ্কৃত প্রথম বহির্গ্রহের নাম রাখা হল "৭০ ভার্জিনিস বি"। তারার নাম কি ছিল সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে, সেটা কোন তারামণ্ডলে তাও বোঝা যাচ্ছে- ভার্গো (কন্যা রাশি)।

৭০ ভার্জিনিস বি বৃহস্পতির চেয়ে ৭ গুণ বড়। আবিষ্কারের সাথে সাথেই এটাকে "প্ল্যানেটারি হেভিওয়েট" নামে ডাকা হতে থাকে। পুরনো উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই মার্সি-বাটলার আরও অনেকগুলো গ্রহ আবিষ্কার করেন। আর তাদের আবিষ্কারগুলো আমাদের চিন্তাধারায় বিপ্লব ঘটায়। তারাজগৎ সম্পর্কে আমাদের প্রথাগত ধারণা ভেঙে পড়ে। আমরা বুঝতে পারি, আমাদের সৌরজগৎটাই ব্যতিক্রম। তারার জগৎ সাধারণত এরকম হয় না। সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথ খুব বেশী উৎকেন্দ্রিক না, অর্থাৎ প্রায় বৃত্তীয়। কিন্তু আবিষ্কৃত বহির্গ্রহগুলোর কক্ষপথ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব বেশী উৎকেন্দ্রিক, অর্থাৎ উপবৃত্তের মত। এখন পর্যন্ত তিন ধরণের বহির্গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে:

১। যারা তারার খুব কাছে থাকায় রীতিমত দাউ দাউ করে জ্বলছে
২। যারা তারা থেকে অনেক দূরে থাকায় আলোক ও তাপস্বল্পতায় ভুগছে
৩। যাদের কক্ষপথ প্রচণ্ড উপবৃত্তীয় হওয়ার কারণে, একসময় তারার খুব কাছে আসছে আবার তারা থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে

এই তিন অবস্থাই চরমপন্থী। পৃথিবীর মত লিবারেল গ্রহের সন্ধান আমরা আজও পাইনি। যে তিন ধরণের গ্রহের কথা বলা হল তার কোনটিতেই প্রাণের বিকাশ সম্ভব না। আসলে তারার চারপাশে একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলকে বলা হয় "বাসযোগ্য এলাকা" বা habitable zone. কোন গ্রহ যদি এই এলাকার মধ্যে থাকে তাহলেই কেবল সেখানে প্রাণের বিকাশ সম্ভব। অবশ্য এক্ষেত্রে যথারীতি প্রাণ বলতে আমরা পার্থিব প্রাণ ধরে নিয়েছি। চরমপন্থী প্রাণ কেমন হতে পারে সেটা ভেবে দেখার সুযোগ পাইনি এখনও। এ যাবৎকালে আবিষ্কৃত কোন গ্রহই বাসযোগ্য এলাকার মধ্যে নেই। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ আমাদের গ্রহ শিকার সবে শুরু হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিবেশী তারাগুলোর চারপাশে কোন গ্রহ আছে কি-না সেটা খতিয়ে দেখার জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে কেপলার মিশন পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে ২৫০ টিরও বেশী বহির্গ্রহের খোঁজ পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে আরও অনেক। আমাদের অডিসি সেই ট্র্যাক ধরেই এগোবে।

[চলবে...]


মন্তব্য

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

অসামান্য! দুর্ধর্ষ! ফাটাফাটি!

লেখার শেষে চলবে দেখে আরোও খুশী হলাম! হাসি

এনকিদু এর ছবি

অনেকদিন পর সচলায়তনে শিক্ষানবীসকে পাওয়া গেল । দিনকাল কেমন চলছে ?

লেখা যথারীতি ফাটাফাটি ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

তুলিরেখা এর ছবি

খুব ভালো লাগছে। এই অভিযানে আমাদের সঙ্গে নিন। বেশী দেরি করবেন না পরের পর্ব দিতে।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

চলুক...

শিক্ষানবিস এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে। এই সিরিজটা চালিয়ে যাব। অবশ্য খুব বেশী বড় হবে না। ৪-৫ পর্ব হতে পারে। মূল লক্ষ্য অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বহির্গ্রহ শিকার তদন্ত করা। আগামী পর্বে থাকছে- কিভাবে বহির্গ্রহ সনাক্ত করা হয়?

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অ-নে-ক দিন পর! লেখা যথারীতি দুর্দান্ত। তোমার কিছু কিছু ব্যাপারে খুবই হিংসা হয়। সবার সামনে না বলি। সাক্ষাতে বিস্তারিত বলবনে দেঁতো হাসি

পরের পর্বের অপেক্ষায়...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।