আমার পাহাড় যাত্রা-০১ [যত গণ্ডগোল গ্যাংটকেই]

সবজান্তা এর ছবি
লিখেছেন সবজান্তা (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/০১/২০০৯ - ৫:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঈদ আর নির্বাচনের ছুটি - বিশ্ববিদ্যালয় কবে খুলবে আর কবে পরীক্ষা হবে, সে'টাও কেউ বলতে পারেনা। মোটামুটি শিকড়-বাকড় গজিয়ে যাওয়ার মত অবস্থাই হয়ে গিয়েছিলো, শেষকালে বাসার সবাই মিলে ঠিক করা হল, এই ছুটিতেই ইন্ডিয়ায় পাহাড়ে বেড়াতে যাবো।

আমার নিজের বাসায় আমি মোটামুটি নিগৃহীত, বঞ্চিত- আমার কথা কেউই বিশেষ পাত্তা দেয় না। আমি বার বার বললাম, আমার পরীক্ষাটা শেষ হোক, তারপর শান্তিমতো যাই - কিন্তু আমার বড় বোনের অফিসে পরে আর ছুটি পাওয়া যাবে না আর তারচেয়েও বড় যুক্তি, আমি এমনিতেই পরীক্ষার আগে পড়াশোনা করে উলটে ফেলি না, কাজেই পরিকল্পনা বাতিলের প্রশ্নই উঠে না । অগ্যতা কী আর করা, দাঁড়িয়ে পড়লাম ভিসার লাইনে। সেই দুর্ভোগের কথা আমার আর আলাদা করে বলার দরকার নেই, মুজিব ভাইই বলে দিয়েছেন তাঁর লেখায়

বর্ণনার এই পর্যায়ে একটা বড়সড় লাফ দেওয়া যাক। চলে যাই একেবারে কলকাতা থেকে সারা রাত ট্রেনে করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এসে নামার পরের ঘটনায়। এখানে অবশ্য একটা ব্যাপার আগেই জানিয়ে রাখা যেতে পারে সে'টা হচ্ছে, শিলিগুড়ি শহরটা অদ্ভুত সুন্দর। যদিও যাওয়ার সময় শিলিগুড়ি হয়ে যাই নি, কিন্তু পাহাড় থেকে যখন আবার কলকাতা ফেরত আসি তখন রাতের বেলা শিলিগুড়ির উপর দিয়েই এসেছিলাম। একেতেই যথেষ্ট আলো ঝলমল সুন্দর শহরটা, উপরন্তু কলকাতার মত মানুষের ভীড় কিংবা নোংরাও চোখে পড়ে নি। সব মিলিয়ে শিলিগুড়ি শহরটা বেশ পছন্দ হয়েছে আমার। যাই হোক, নিউ জলপাইগুড়িতে নামা মাত্রই গ্যাংটক, দার্জিলিং-এর ট্রাভেল এজেন্সীর দালালেরা এসে ছেঁকে ধরেছে। তাদের সবাই দেখি আমার সুখ সাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে রীতিমত আকুল! দিশেহারা অবস্থায় কোনমতে, মোটামুটি দৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় একটা ট্রাভেল এজেন্ট বেছে নিয়ে তার অফিসে ঢুকে পড়লাম।

কথা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে কারণ অনেকেই হয়ত জানেন না, সিকিম ভারতের অংশ হয়েছিলো অনেক পরে এবং যেহেতু সিকিমের সাথেই চীনের বর্ডার - তাই বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানিদের জন্য বিনা অনুমতিতে সিকিমে ঢোকা নিষিদ্ধ। কানাঘুষা শুনেছি, ভিসার সাথে আবেদন করতে হয়, সে'টা অনেক ঘাটের জল খেয়ে মাসখানেক পর ঢাকা এসে পৌছায়। তবে আবেদন না-মঞ্জুরও হতে পারে। এতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশিদের জন্য সিকিম যাওয়ার সহজ পন্থা ছিলো, শেয়ারের গাড়ি কিংবা বাসে চড়ে বসা। সিকিমে ঢোকার মুখে চেক হত, সেখানে যদি কপাল খারাপ থাকে তাহলে হয়ত জিজ্ঞেস করে কোথাকার লোক। মোটামুটি হিন্দিতে নিজেকে কলকাতার লোক বলে পরিচয় দিতে পারলেই ঝামেলা শেষ। তাই ট্রাভেল এজেন্সীতে ঢুকে হিন্দিতেই কথা বলা শুরু করলাম, আর নিজেদের পরিচয় দিলাম কলকাতার লোক হিসেবে।

কিন্তু কপাল আমাদের মন্দ। ট্রাভেল এজেন্ট কথা বলার এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন, "আপনার সাথে আই কার্ড (ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ড সম্ভবত) আছে তো" ?

শুকনো মুখে জানালাম নেই।

ভদ্রলোক বললেন, "একজনেরও নেই ? কিংবা ডাইভিং লাইসেন্সে ? কিংবা অন্তত একটা ডাক্তারি প্রেসক্রিপশন (এটা কেন চাইলো কে জানে !! ) ?"

আমাদের ক্রমাগত ঘাড় নাড়ানো দেখে ভদ্রলোক হতাশ হয়ে গেলেন। জানালেন মুম্বাই হামলার পর থেকে নিরাপত্তা ভীষণ রকম কড়া, কোন মতেই সম্ভব না। এত দূর থেকে এত কষ্ট করে আসা গ্যাংটকের পাহাড় দেখতে আর সে'টাই যদি দেখা না যায়- মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

হতাশায় যখন দু'চোখ ফেটে জল বের হওয়ার মত অবস্থা, তখন হঠাৎ করেই মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। আমার বাবা'র সবচেয়ে বড় ভাই যিনি, সাতচল্লিশের দেশভাগের আগেই শিলিগুড়ির কাছাকাছি মালবাজার নামে পাহাড়ের পাদদেশে একটা জায়গায় চা বাগানে চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন। ওখানেই তিনি চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। এর ফলে জন্মসূত্রেই উনার ছেলে-মেয়েরা সবাই ভারতীয় নাগরিক।
আমরা এবার সোজা চলে গেলাম মালবাজার। সেখানে যেয়ে উনার সবচেয়ে বড় ছেলেকে আমাদের দুঃখের কথা সবিস্তারে জানালাম। সবকিছু শুনে উনি হাসিমুখে রাজি হয়ে গেলেন আমাদের সাথে গ্যাংটক যাওয়ার জন্য।আমাদের প্ল্যান একটাই, উনার ভারতীয় আই কার্ড দিয়ে বাকি সবার বৈতরণী পার। আর ফাও লাভ হল, মালবাজার জায়গাটাও চমৎকার, পাহাড়ের পাদদেশে। একদম নিশ্চুপ, নিরিবিলি আর নির্ঝঞ্ঝাট একটা জায়গা। মোটামুটি একদিন মালবাজারের পথে ঘাটেই ঘুরে বেরিয়েছি আর কিছু ছবি তুলেছি।

ছবিঃ মালবাজারের দৃশ্য

ছবিঃ মালবাজারের দৃশ্য

ছবিঃ মালবাজারের দৃশ্য

পরদিন সকাল বেলা আমরা রওনা দিলাম সিকিমের উদ্দেশ্যে। সারা রাস্তাই আমি জিপের সামনে বসে চারপাশের চমৎকার দৃশ্য দেখছিলাম।এখানে জানিয়ে রাখা যেতে পারে পুরো ডুয়ার্স অঞ্চল থেকে শুরু করে পাহাড় অবধি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে তিস্তা নদী। অদ্ভুত সুন্দর এক নদী এই তিস্তা - সবুজাভ স্বচ্ছ জল, আর পাহাড়ি নদী ফলে জল কম, তলদেশ দেখা যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু প্রচন্ড খরস্রোতা। আর নদীর মাঝে আর দুইপাশে পাথরে ভর্তি। পুরো তিস্তাকেই দেখেছি গাড়িতে বসে চলমান অবস্থায়। একেতে ছবি তোলার হাত ভালো না, তার উপর সিকিম চেকপোস্টের চিন্তায় মনে শান্তি নেই, তাই আর গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলি নি। কোন কোন বাঁকের মুখে গাড়ি একটু ধীর হলেই ছবি তুলেছি।

ছবিঃ তিস্তা নদী

এদিকে যতই সৌন্দর্য দেখি, ভিতরে ভিতরে কেউ রীতিমত ঢাক পেটাচ্ছে, যদি চেকপোস্টে আবার আটকে যাই। এভবে ঘন্টা দেড়-দুই যাওয়ার পর চলে আসলো সিকিমের চেকপোস্ট। বুকের মধ্যে তখন রীতিমত বিশ্ব ড্রাম বাজানো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে যদিও চোখ মুখ খুবই স্বাভাবিক করে বসে আছি যেন কিছুই হয় নি। অবশেষে আইডেন্টিটি কার্ড দেখে চেকপোস্ট থেকে ছাড়া পেলাম। বুক থেকে খুব সাবধানে চেপে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিলাম।

যাক, অবশেষে আমরা সিকিমে !

(চলবে)

** নামকরণ রাহুল সাংকৃত্যায়ণের বিখ্যাত বই, "আমার লাদাখ যাত্রা" থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে


মন্তব্য

খেকশিয়াল এর ছবি

আহা সিকিম! আবার মনে পইড়া গেল রে! মন খারাপ

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

সবজান্তা এর ছবি

হা হা... আর তো যাইতে পারবেন না ... চোখ টিপি


অলমিতি বিস্তারেণ

খেকশিয়াল এর ছবি

হুরো ব্যাটা! চিনস আমাগো! এইবার আইডি কার্ড বানায়া যামু!!

------------------------------
'এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি ?'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

সবজান্তা এর ছবি

গুড।

জেলের ভাত মোবারক। তবে আমি কথা দিলাম আপনাদের জীবনের করুণ কাহিনী নিয়া আমি কাজী হায়াৎ'রে অনুরোধ করবো একটি একশনধর্মী সামাজিক চলচ্চিত্র বানাইতে। চোখ টিপি


অলমিতি বিস্তারেণ

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

আরেকটু বড় করে লিখেন.......তিস্তার ছবিটা সাংঘাতিক হইছে...

---------------------------------------------------------

আমরা যারা শিখিনি চাষবাস,ফসলের গীত
গুলালিতে পাখি হত্যা

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

সবজান্তা এর ছবি

এই লিখতেই খবর হয়া গেল... সামনে আরো কিছু সুন্দর ছবি আসতেছে... আপনার কম্পু কেমন আছে ?


অলমিতি বিস্তারেণ

মুস্তাফিজ এর ছবি

ভালো লাগতাছে, লেখেন

...........................
Every Picture Tells a Story

সবজান্তা এর ছবি
এনকিদু এর ছবি

লেখা ছবি উভয়ই চমৎকার । চালিয়ে যা ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

তিস্তা নদী এত সুন্দর কেনো!

জুয়েল বিন জহির এর ছবি

ভারতে আমি তিস্তাকে দেখেছিলাম জলপাইগুড়ির নাগড়াকাটা এলাকা থেকে। তেমন টানতে পারেনি। তবে আপনার তোলা ছবিটা দেখে আমি সত্যিই তিস্তার প্রেমে পড়ে গেছি।

স্নিগ্ধা এর ছবি

মুখে এক, কাজে আর এক - এগুলা আমি একদম পছন্দ করি না!!

"আঁমি লিঁখতে পাঁরি নাঁ", "আঁমার ছঁবি তোঁলার হাঁত ভাঁলো নাঁ" - এসব বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি পরের পর্ব ছাড়ো !

তুমি যে দুটাই খুব ভালো পারো সেটা আমরা বুঝতে পারসি, এবার আগে বাড়ো ......।

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- জীবনে তো তাইলে মারাত্মক ফস্কে গেলো একটা সুযোগ, 'সিকিম'! কতো আশা ছিলো সিকিম, তিব্বত দেখার! মন খারাপ
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

সচেতনা এর ছবি

খুব ভাল লাগছে লেখাটা। অপেক্ষা করছি পরের অংশের জন্য। এগুলো আমার খুব আপন জায়গা তাই আরও ভাল লাগছে। তিস্তার ছবি খুব সুন্দর।

কনফুসিয়াস এর ছবি

জটিল্স!
পরের পর্ব ছাড়েন জলদি।
-----------------------------------
আমার ইচ্ছে হলো বাজাতে গীটার, মন আমার, মন আমার, মন আমার-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অতিথি লেখক এর ছবি

ভ্রমন কাহিনী মজার হতে পারে এটা জানা ছিল না ..................।

( জয়িতা )

সবজান্তা এর ছবি

সব্বাইকে ধন্যবাদ পড়ার জন্য, মন্তব্য করার জন্য।

তিস্তা নদী আসলেই অপূর্ব সুন্দর। যতক্ষণ সমতলে ছিলাম, ততোক্ষণ অতোটা টের পাই নি কারণ কোন এক হাইড্রোইলেকট্রিসিটি প্রোজেক্টের জন্য নদীর চারপাশে কন্সট্রাকশনাল ওয়ার্কের ধুম।

তবে পাহাড়ে উঠার পর থেকে তিস্তা অপূর্ব !


অলমিতি বিস্তারেণ

নজমুল আলবাব এর ছবি
বিপ্রতীপ এর ছবি

সমরেশের বই পড়ে একসময় ডুয়ার্সে যাবার খুব শখ ছিল...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান...

সবজান্তা এর ছবি

আমার ধারণা এ প্রজন্মের অধিকাংশ বাংলাদেশিরই ডুয়ার্সের প্রতি আগ্রহের জন্ম সমরেশ বসুর বই পড়ে।


অলমিতি বিস্তারেণ

বিপ্রতীপ এর ছবি

বসু না মজুমদার...
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
খুঁজে যাই শেকড়ের সন্ধান...

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

বর্ণনা জব্বর!

তবে বোঝাই যায়, আপনি নজরুল ইসলামের মতো সিরিয়াল-লেখক না হাসি
হলে...

... যদি চেকপোস্টে আবার আটকে যাই। এভবে ঘন্টা দেড়-দুই যাওয়ার পর চলে আসলো সিকিমের চেকপোস্ট। বুকের মধ্যে তখন রীতিমত বিশ্ব ড্রাম বাজানো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে যদিও চোখ মুখ খুবই স্বাভাবিক করে বসে আছি যেন কিছুই হয় নি।

... এখানেই শেষ করে দিতেন এই পর্বটি চোখ টিপি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

সবজান্তা এর ছবি
রানা মেহের এর ছবি

জটিল ছবি
লেখাও ভালো
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ইমরুল কায়েস এর ছবি

তিস্তার ছবি তো সেইরকম হৈছে । ভাল লিখছ ।
......................................................
উত্তর বাংলার অনাহারী যুবক

সবজান্তা এর ছবি

ধন্যবাদ রানা মেহের এবং ইমরুল কায়েস হাসি


অলমিতি বিস্তারেণ

বৃষ্টি বিলাসিনী এর ছবি

আপনার পাহাড়ের গল্প পড়া শুরু করলাম। এই হল প্রথমটা। সিকিমিরটা পড়ব...
পরের সবটা পড়ে জানাব কেমন লাগল।

~মিনা~

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।