আমরা কেন সংগঠন করি?

সচল জাহিদ এর ছবি
লিখেছেন সচল জাহিদ (তারিখ: বিষ্যুদ, ১১/০৬/২০০৯ - ১০:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বুয়েটে ডিবেটিং ক্লাবের কোন এক অনুষ্ঠানে একবার একটি প্রশ্ন উঠেছিল, ‘আমরা কেন সংগঠন করি’। এর উত্তরে এসেছিল অসংখ্য মতামতঃ সমাজের জন্য, মানুষের কাছে নিজের দায়বদ্ধতার জন্য, সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য, ভাল কিছু করার জন্য ইত্যাদি ইত্যাদি।সেই সব মতামতের ভীরে যেটি আমার কাছে সবচাইতে যৌক্তিক মনে হয়েছিল তা হলো, ‘আমি সংগঠন করি আমার নিজের আনন্দের জন্য’। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি কিছুটা স্বার্থপরতার মত মনে হচ্ছে তবে কিছুটা ব্যখ্যা দিলে উত্তরটি সেই রাজা আর তিন কন্যার গল্পের ‘আমাকে তোমরা কে কত ভালবাস’ এর উত্তরে রাজার ছোট কন্যার ‘তোমাকে আমি লবণের মত ভালবাসি’ এর মত হবে।

আমরা একটি বিষয়ে মোটামুটি একমত যে যেকোন কিছু যদি আনন্দের সাথে সম্পন্ন করা যায় সেক্ষেত্রে কাজটি সহজতর হয় এবং তা নিয়ে নিজের কিছু সুখকর স্মৃতি জমা হয় তা পরবর্তীতে রোমন্থন করে আমরা নস্টালজক হই। এই যেমন ধরা যাক শিশুদের শিক্ষাদানের বিষয়টি। যদি কোন শিশু খেলাধূলার মাধ্যমে আনন্দ নিয়ে কোন কিছু শিখে আমার দৃঢ় বিশ্বাস তা প্রায়োগিক দিক দিয়ে অধিকতর কার্যকরী হয়। একই রকম ভাবে একটি সংগঠনে সংগঠক বা কর্মীরা যদি আনন্দ নিয়ে কাজ করে সেক্ষেত্রেই কেবলমাত্র সেই সংগঠন সফল কিছু অনুষ্ঠান বা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারে।বোধকরি যে সংগঠনের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে শুধুমাত্র নিজেদের জন্য একটুকরো আনন্দের জন্য সেই সংগঠনের সাফল্য অনিবার্য্য।

আমাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে, এই যেমন আমরা ধরেই নেই বিতর্ক ক্লাবে আসতে হলে আমাকে বিতার্কিক হতে হবে, কিংবা সঙ্গীতের ক্লাবে আসতে হলে আমাকে গান গাইতে জানতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যারা বিতর্ক করেনা বা গান করেনা কিন্তু এই সব কলাকে ভালবাসে মনে থেকে। তাই যদি কেউ আনন্দ নিয়ে এইসব ক্লাবের সংগঠকের দায়িত্বে থাকে সেটা ইতিবাচক হিসেবেই পরিগণিত হওয়া উচিৎ।আমি নিজে বুয়েট ডিবেটিং ক্লাবের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি, সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলাম বুয়েট ড্রামা সোসাইটি, বুয়েট সেফটি মুভমেন্ট ইত্যাদির সাথে। আমার চেনা জানা একজন আছে যে বিতার্কিক ছিলনা কিন্তু তার কাছ থেকে বুয়েট ডিবেটিং ক্লাব যা পেয়েছে বা এখনো যা পাচ্ছে সেটা অনেক খ্যাতনামা বিতার্কিকও কখনো ক্লাবকে দিতে পারেনি।

গতানুগতিক চারুকলা, ললিতকলা বা বিজ্ঞান ভিত্তিক ক্লাব গুলোর বাইরে আমারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছোট বড় ছাত্র বিভিন্ন সংগঠনের সাথে কম বেশী যুক্ত থাকি। কেউবা রাজনৈতিক, কেউবা বিভাগ বা অনুষদ ভিত্তিক, কেউবা ব্যাচ ভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখে। এইসব সংগঠনে কাজ করে আমার যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছে তার কিছুটা শেয়ার করি। লক্ষ্যনীয় হলো এইসব সংগঠনে আমাদের অনেকের মধ্যে নেতা হবার প্রবণতা থাকে কিন্তু কর্মী হবার সময় অনেকেরই কোন হদিস পাওয়া যায়না। একটি সংগঠনের জন্য যতজন নেতা দরকার তার চেয়ে অনেক বেশী প্রয়োজন কর্মীর, আবার একই সাথে বিবেচ্য যে নেতা বিহীন কর্মীও কিন্তু কোন সংগঠনের জন্য ভাল কিছু বয়ে আনতে পারেনা।মানুষ হিসেবে আমার চারিত্রিক কিছু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো আমরা নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে ভালবাসি। তাই একটি সংগঠনের নেতা হবার জন্য আমরা যতটা উদগ্রীব থাকি কর্মী হবার জন্য ঠিক ততটাই পিছিয়ে থাকি। আবার এর ব্যাতিক্রমও আছে, আমি অনেক সংগঠন দেখেছি যেখানে পেছন থেকে অনেকেই কাজ করতে চায় কিন্তু সামনে এসে নেতৃত্ব দিতে কুন্ঠা বোধ করে কিংবা বিব্রত হয়।তবে যোগ্য নেতৃত্ব আর বিশাল কর্মীবাহিনীই কিন্তু পারে একটি সফল সংগঠনের জন্ম দিতে, বা সংগঠনটিকে একটি বিশেষ অবস্থানে নিয়ে যেতে।

যেকোন একটি সংগঠনের নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয় একটি নির্দীষ্ট সময়ের আবর্তে। এই সময়ের মধ্যে প্রত্যেকটি কমিটির দায়িত্ব থাকে পরবর্তী সময়ের জন্য একটি দায়িত্বশীল কমিটি গঠন করে যাওয়া।আমি অনেককে বলতে শুনেছি, ‘দেখ আমরা কমিটির মেয়াদ শেষ করার পরে এখন ঐ সংগঠনের অবস্থা কত খারাপ’। এদের জন্য আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো নতুন কোন কমিটি যদি পুরোপুরি ব্যার্থ হয় তার কিছুটা দায়ভার আগের কমিটির উপরেও বর্তায় কারন তারা তাদের যোগ্য উত্তরসূরী রেখে যেতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত সংগঠনের কথা ধরা যাক।যেহেতু এই সব সংগঠন শতভাগ সেচ্ছাসেবী ঘরনার, তাই এই ক্ষেত্রে বাছাইকরণ বা নির্বাচন এর মধ্যে কোনটি ভাল তা নিয়ে বিতর্ক সবসময় হয়।আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে যে বলতে পারি তা হলো সংগঠন যখন ছোট থাকে তখন আমরা এক অন্যকে ভাল মত চিনি এবং জানি, সেক্ষেত্রে বাছাই করে একটি নতুন নেতৃত্ব তৈরী করা অনেক সহজ। কিন্তু সংগঠন যখন বড় হয় তখন অনেক মানুষের আগ্রহ থাকতেই পারে এবং সেক্ষেত্রে গনতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচনটাই একমাত্র সমাধান। বাঙালী হিসেবে আমাদের কিছু ধ্যান ধারণার মধ্যে একটি হলো আমরা মনে করি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দী হওয়া মানেই হলো এক বা একাধিক মানুষের সাথে আমার শীতল সম্পর্ক তৈরী হওয়া এবং এই চিন্তা ভাবনা থেকেই দেখা যায় যখনই কোন সংগঠনে নির্বাচন হয়, নেতৃত্বদানে যোগ্য অনেকেই এগিয়ে আসতে চায়না নিছক ঝামেলা এড়ানোর জন্য অথচ বাছাই করলে সেই একই লোক হয়ত দায়িত্বে আসত। আমি বেশ কিছু সংগঠনের নির্বাচনে দেখেছি যে নির্বাচনে হেরে গিয়ে সেই সংগঠনটিকেই ভেঙে দু’টুকরো করে দিয়েছে। শুধুমাত্র নেতৃত্বে না যাবার কারনে যারা এই কাজ করতে পারে তারা সেই সংগঠনটিকে কতটুকু ভালবাসে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

একটি সফল সংগঠনের সাফল্যের পেছনে আরো একটি জিনিস কাজ করে তা হলো এর নির্বাহী কমিটির অভ্যন্তরস্থ মত প্রকাশের স্বাধীনতা। যদি কোন নির্বাহী কমিটি ব্যাক্তিতান্ত্রিক হয় অর্থ্যাৎ যেখানে কমিটির প্রধানই সকল গুরুত্ত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহন করে অথবা চাপিয়ে দেয় সেই ক্ষেত্রে তা সংগঠনের জন্য খারাপ বই ভাল কিছু বয়ে আনেনা। আমি বিশ্বাষ করি নির্বাহী কমিটির প্রতিটি সদস্যের যেখানে মত প্রকাশের ও প্রয়োগের স্বাধীনতা থাকে সেখানে আনন্দ নিয়ে কাজও করা যায়।সেই সাথে অধিক সংখ্যক সাধারণ সদস্যদের স্বতস্ফুর্ত সম্পৃক্ততা সে আনন্দকে বাড়িয়ে দেয় হাজার গুনে। একটি নির্বাহী কমিটির এমন ভাবে কাজ করা উচিৎ যেন সংগঠনের প্রতিটি সদস্য মনে করে এই সংগঠনটা তার নিজের।

যেকোন সংগঠনের সম্পদ হচ্ছে এর প্রাক্তন সদস্যরা। আমরা যখন বুয়েট ডিবেটিং ক্লাবে সক্রিয় ভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম ক্লাবের যেকোন অনুষ্ঠানে, বড় কোন আয়োজনে, কিংবা সংকটে আমাদের প্রাক্তন সদস্যদের কাছ থেকে পরামর্শ, সাহায্য, সহযোগীতা গ্রহণ করতাম। তাদের অভিজ্ঞতা আর আমাদের উদ্দম মিলে সফল কিছু আয়োজন সম্ভবপর হত। এখন আমরা ক্লাব থেকে অনেক দূরে কিন্তু এখনো যেকোন সাফল্য বা ব্যার্থতার ভাগ কিন্তু আমরাও নেই। অথচ বাংলাদেশে অনেক সংগঠন আছে যেখান থেকে সিনিয়র সদস্যদের বিব্রত করে তাদেরকে সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ততা রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়। সেক্ষেত্রে আসলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় সংগঠনটি।

যাই হোক আমার মূল আলোচনা ছিল কেন সংগঠন করি সেটা নিয়ে এবং আমি আমার উপরের আলোচনায় এটাই বোঝাতে চেয়েছি যে সব কিছুর উর্দ্ধে আনন্দ নিয়ে কাজ করার মধ্যেই একটি সফল সংগঠকের সাফল্য জড়িত। আর সেই আনন্দ আসবে মত প্রকাশের ও প্রয়োগের স্বাধীনতা, সকলের স্বতস্ফূর্ত অংশগহণ, আর ব্যক্তিস্বার্থ পরিত্যাগ করে সর্বোপরি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একটি সংগঠনকে সামনের দিকে নিয়ে যাবার মধ্যে।কারন আমি যদি প্রশ্ন করি একটি সংগঠন করে আসলে কি পাওয়া যায়, ভাল করে চিন্তা করলে কিছু আনন্দময় স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার থাকেনা।


মন্তব্য

অনীক আন্দালিব এর ছবি

চমৎকার বিশ্লেষণ!
পুরো লেখার সাথেই একমত, তবে নির্বাচনের বিষয়ে একটু যোগ করতে চাই। নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাঝে শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়, এটার দায়ভার আবার অন্যান্য সদস্যদের ঘাড়েও পড়ে। আমি নিজেই দেখেছি নির্বাচনে হেরে যাওয়া একজনকে সদিচ্ছা দেখিয়ে কাজ করতে দেখে অন্যেরা টিটকারি মেরেছে, এখন কাজ করে কী লাভ, জিততে তো পারো নাই। এরকম মানসিকতাও বিরাজ করে।

সচল জাহিদ এর ছবি

ধন্যবাদ অনীক। আপনার পর্যবেক্ষণও সত্য, এইসব ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই কেন জানি নিজেদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরী করি। আসলে সবাই মিলে কাজ করলে তার মধ্যকার অনুভূতি অতুলনীয়।

-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমার সময়ে আমার আশেপাশে এমন কোনো সংগঠন ছিলো না, যা আমি করি নাই... রাজনীতি থেকে শুরু করে স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট, লিও ক্লাব, রোটারেক্ট ক্লাব, আবৃত্তি সংগঠন, থিয়েটার, চলচ্চিত্র, বিতর্ক... হেন কোনো সংগঠন বাদ রাখি নাই।

কিন্তু আবৃত্তি সংগঠন মানেই আমি আবৃত্তি করি নাই, থিয়েটার মানে অভিনয় করি নাই, বিতর্ক সংগঠন মানেই বিতর্ক করি নাই।
কোনো সংগঠনেই আমি কোনোদিন নেতা ছিলাম না। খুব বেশিদিন করে করতেও পারিনি।

সংগঠন করার আমার একটাই উদ্দেশ্য... নতুন নতুন মানুষকে জানা। বিভিন্ন চিন্তার মানুষের সংস্পর্ষে আসা... মানুষের সাথে মেশা...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সচল জাহিদ এর ছবি

সংগঠন করার আমার একটাই উদ্দেশ্য... নতুন নতুন মানুষকে জানা। বিভিন্ন চিন্তার মানুষের সংস্পর্ষে আসা... মানুষের সাথে মেশা...

নজু ভাই আপনার এই কথাগুলি চমৎকার। আমরা যখন ক্লাব করতাম তখন মনে আছে বন্ধুত্বের বৃত্তগুলি বাড়তেই থাকত। ছোট বড় সবার সাথে পরিচিত হয়ে একসাথে কাজ করার আনন্দময় স্মৃতিগুলি মনে পড়লে আমার এখনো ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই দিনগুলিতে।

-----------------------------------------------------------------------------
আমি বৃষ্টি চাই অবিরত মেঘ, তবুও সমূদ্র ছোবনা
মরুর আকাশে রোদ হব শুধু ছায়া হবনা ।।


এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ অভ্র।

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

সংগঠন-স্মৃষ্টি ও সাফল্যের উৎস, ধ্বংসের কারণও।

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।