মুহম্মদ জুবায়েরের অপ্রকাশিত রচনা: বালকবেলা / ‘আহা কী যে বালখিল্য’ - ০৪

সন্দেশ এর ছবি
লিখেছেন সন্দেশ (তারিখ: মঙ্গল, ২০/০১/২০০৯ - ১:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৫. ‘বাহির হয়ে বাইরে’


বগুড়া আমার শহর, কিন্তু জন্ম রাজশাহীতে। একইভাবে প্রাথমিক শিক্ষা পি টি স্কুলে হলেও প্রথম স্কুল ইসলামিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়, সে স্কুলটি লুপ্তও হয়েছে অনেককাল আগেই। নামে ইসলামিয়া হলেও মাদ্রসা-মক্তব নয়, অন্যসব প্রাইমারি স্কুলের মতোই এই প্রতিষ্ঠানটি ছিলো এখন যেখানে সিটি গার্লস হাই স্কুল, তার ঠিক পাশে। সিটি গার্লস স্কুল অবশ্য তখনো হয়নি, সেই জায়গাটি খালি পড়ে ছিলো।

আমাদের পাশের বাড়ির তারা-হেলাল দুই ভাই ইসলামিয়া স্কুলে পড়ে। তারার বয়স আমার চেয়ে কিছু বেশি, হেলাল সামান্য ছোটো। ওদের দেখাদেখি ওই স্কুলেই যাওয়া সাব্যস্ত হলো। ওদের সঙ্গেই স্কুলে গেলাম, জীবনে প্রথম স্কুলে যাওয়ার কী উত্তেজনা। সেই উত্তেজনা মরে গেলো স্কুলে যাওয়ার পর। স্কুল বলতে যে ধারণা এতোদিন মনে মনে ছিলো তার সঙ্গে একটুও মেলে না। স্কুল বলতে এখানে বেশ বড়োসড়ো একটি ঘরের একেক কোণে একেক শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা বসা, তাদের সামনে একজন করে শিক্ষক। সে এক মহা হট্টগোলের জায়গা। বাড়ি ফিরে আম্মাকে বললাম, এই স্কুল ভালো না, আমি আর যাবো না।

যাইনি। আব্বাও পাঠাতে চাননি। ফলে আরো কিছুকাল ঘরেই বিদ্যাশিক্ষা। পরের বছর আমি এবং ঝর্ণা একসঙ্গে পি টি স্কুলে ভর্তি হই। স্কুলের পুরো নাম প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, প্রাথমিক স্কুলশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জায়গা। এখানকার ক্ষুদে বালক-বালিকারা এক অর্থে এই প্রশিক্ষণার্থীদের গিনিপিগ।

আমি ভর্তি হই সরাসরি ক্লাস টুতে, ঝর্ণা ওয়ানে। বাড়ি থেকে স্কুল ক্ষুদে পায়ে হেঁটে পাঁচ মিনিটের পথ। প্রথম প্রথম দুই ভাইবোন একসঙ্গে যাই, আসি। অবিলম্বে এই জ্ঞান অর্জিত হলো যে বালক-বালিকার পৃথিবী আলাদা, ঠিক কীভাবে তা অবশ্য জানা নেই, এবং ভাইবোন হলেও একসঙ্গে যাতায়াত খুব কাজের কথা নয়। তার ওপরে বোন আবার আস্ত এক ক্লাস নিচে। ফলে আমাদের পৃথিবী আলাদা হতে শুরু করলো।

তা অবশ্য শুধুমাত্র স্কুলে এবং বাড়ির বাইরে, বাড়িতে তখনো আমরা পরস্পরের খেলার সঙ্গী, ঝগড়া-বিবাদেরও। রাতে ঘুমাই এক বিছানায়, শুয়ে শুয়ে স্কুলের সহপাঠীদের নামের তালিকা বিনিময় করি। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমাদের আরেকটি প্রিয় আলোচ্য বিষয় ছিলো, সহপাঠীদের কার বাবা সবচেয়ে বড়োলোক। এখনকার জেলার ডি সি-দের তখন বলা হতো ডি এম বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। ডি এম-এর ছেলে বা মেয়ে ঝর্ণার সঙ্গে পড়তো। সুতরাং ডি এম সাহেব বরাবর ধনীদের তালিকার শীর্ষে। তখন আমাদের পৃথিবীতে ডি এম এতোটাই বড়ো! তবে আমরা যে বড়োলোক শ্রেণীভুক্ত নই, তা পরিষ্কার জানা হয়ে গিয়েছিলো।

তখনো আমাদের বাড়িতে বিদ্যুতের আলো আসেনি, হ্যারিকেনই ভরসা। বড়ো রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুতের আলো জ্বলে। ছোটো রাস্তাগুলোতে পৌরসভার লোক এসে সন্ধ্যার সময় অনুচ্চ ল্যাম্পপোস্টে অনুজ্জ্বল বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে যায়, ভোরে আসে নিবিয়ে দিতে। সংখ্যায় অল্প হলেও তখন বগুড়া শহরে ঘোড়ার গাড়ি চলে, সেগুলো টমটম নামে পরিচিত। হাতেগোনা কিছু রিকশা। পুরনো চেহারার ট্রাক-বাস চলে, হেলপাররা গাড়ির সামনে দ-সদৃশ লোহার হ্যান্ডেল সজোরে না ঘোরালে স্টার্ট নেয় না, মাঝেমধ্যে তাতেও কাজ না হলে বাস-ট্রাকের মাথার খুলি উল্টে পানি ঢালতে হয়। শহরে প্রাইভেট গাড়ি একটা-দুটো, পাশ দিয়ে গেলে অন্য সবার মতো আমরাও হাঁ করে তাকিয়ে দেখি।

স্কুলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে আমার প্রথম বন্ধু হয় বাচ্চু নামের একটি ছেলে। পুরো নাম ওবায়দুর রহমান। তার বাবা ছিলেন বগুড়ার এসডিও। মালতীনগর বকশীবাজারের কাছে বাচ্চুদের সরকারি বাড়িটি যখন চিনেছি তার আগেই বাচ্চুর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়েছে। তার বাবার বদলির চাকরির কারণে তাদের চলে যেতে হয় অল্পদিনের মধ্যে। যাওয়ার সময় বাচ্চু আমাকে একটি কলম দিয়েছিলো, অনেকদিন যত্নে রক্ষা করেছিলাম কলমটি। তারপর কোথায় কীভাবে হারালো মনে নেই। অনেক বছর পরে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রস্তুতি চলছে, সেই সময় একদিন সেখানে গেছি। রফিক আজাদ ধরে বসিয়ে দিলেন, পাঠকের চিঠির পাতার জন্যে একটি চিঠি লিখে দিতে হবে। যে কাগজ প্রকাশিতই হয়নি, তার পাঠকের সত্যিকারের চিঠি পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং রফিক ভাই যাকে সামনে পাচ্ছেন তাকে দিয়ে দুই কলম লিখিয়ে নিচ্ছেন। আমাকে লিখতে বসিয়ে দিলে আমার আচমকাই বাচ্চুর কথা মনে পড়ে। জীবনের প্রথম বন্ধুত্ব ও বিচ্ছেদের কথা লিখেছিলাম মনে আছে। রফিক ভাই পরে একদিন বলেছিলেন, এই চিঠি পড়ে বাচ্চু নাকি তাঁকে ফোন করেছিলো। তার ফোন নাম্বারটি রফিক ভাই দেবেন বলেছিলেন, আর হয়ে ওঠেনি। বাচ্চুর সঙ্গে আরেকবার যোগাযোগ ঘটে গেলে কেমন হতো কে জানে!

এখানে আমার সহপাঠী জাফর ও খসরুর সঙ্গে যোগাযোগ অনিয়মিত হলেও আজও বন্ধুত্ব অটুট। ফারুখ ফয়সলও তাই। তার কথা অবশ্য একটু আলাদা করে উল্লেখ করা দরকার এইজন্যে যে, আমরা পুরুষানুক্রমে বন্ধু। তার এবং আমার পিতা একই অঞ্চলের মানুষ, তাঁদের পড়াশোনা খঞ্জনপুর হাই স্কুলে, বগুড়া আযিযুল হক কলেজ হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য পড়লেন দু'জনেই, পাঠশেষে দু'জনেই অধ্যাপক হলেন আযিযুল হক কলেজে। ফারুখ ফয়সলের সঙ্গে আমারও অনেকটা সেরকমই হয়েছিলো অনেকদূর পর্যন্ত। আরেকজন ছিলো আক্কু, তার কলেজ-পড়ুয়া বড়ো ভাইয়ের নাম পেস্তা, ছোটো ভাই টিটু আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়ে। পেস্তা ও টিটু এই কাহিনীতে পরে ফিরে আসবে।

মনে আছে পাকা-পাকা ভাব করা ছোটো চুলের মামুন, ভালো ফুটবল-খেলা খোকা, ফ্যাকাশেমতো ফর্সা নিরীহদর্শন গোলগাল মুখের সোবহান, ফর্সামুখ রব্বানীর কথা। রব্বানীর দুলাভাই আমাদের স্কুলে ড্রইং-এর শিক্ষক হুদা স্যার। অসাধারণ সুদর্শন সুপুরুষ ছিলেন স্যার, অনায়াসে চোখের পলকে একেকটা ছবি এঁকে ফেলতেন, আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকি। একবার স্কুলের এক ফাংশানে 'শান্ত নদীটি পটে আঁকা ছবিটি' গানের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে একটি বোর্ডে হুদা স্যার গানে বর্ণিত দৃশ্যগুলি এঁকে যান। গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ছবিও শেষ। মানুষ এতো সুন্দর কী করে আঁকে! ছবি আঁকার বাসনা আমার চিরকালের, মনে মনে পারি, হাতে আঙুলের ডগায় আনা সম্ভব হয়ে ওঠেনি কোনোদিন। স্কুলে ড্রইং ক্লাসে আমি বরাবর খারাপ করতাম। একেকদিন শিক্ষকসহ দল বেঁধে আমরা কাছাকাছি কানছগাড়ির পুকুর থেকে কাদামাটি এনে সেই মাটি দিয়ে কিছু একটা বানাতে হতো। আমারটা কোনোকালে কিছু হয়ে উঠতো না– আম বানাতে গেলে পেঁপে হয়ে যায়।

ক্লাসের ফারুক তালুকদারের বাবা ছিলেন মৌলভী। মিলাদ পড়ানোর সময়, কোরবানীর দিনে তাঁর ডাক পড়তো। সোবহানদের বাড়ি স্কুল-সংলগ্ন, তার মা শহরে মেয়েদের সবচেয়ে ভালো স্কুল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, সংক্ষেপে ভি এম গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা, বড়ো ভাই খোকন তখন সম্ভবত কলেজের ছাত্র। ছোটো বোনটি, আফরোজ জাহান, আমাদের স্কুলেই পড়ে, সম্ভবত ঝর্ণার সঙ্গে। এই মেয়েটি ছড়া এবং ছোটোদের লেখালেখি কিছু করেছিলো, তারপর তার কী হলো আর জানি না। তাদের ভি এম স্কুলে পড়া বড়ো বোন রুনু বিকেলবেলা পি টি স্কুলের মাঠে একা একা সাইকেল চালায়। বগুড়ার মতো শহরে ওই সময়ে রুনু আপা ছাড়া আর কোনো মেয়েকে সাইকেলে চড়তে দেখিনি। এই রুনু আপা অল্প কিছুকাল পরে আমাকে সাইকেল চালানো শেখাবেন।

সহপাঠিনীদের মধ্যে দু'জনের কথা মনে পড়ে। ভুল হলো, আসলে তিনজন। প্রথম দু'জনের নাম বেলা ও হাসি। ক্লাস টু-এর ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, তিনজন ছাত্রছাত্রীর সর্বমোট নম্বর একই সমান। এই তিনজনের মধ্যে বেলা ও আমি আছি, তৃতীয়জন কে ছিলো, বাচ্চু? না, হাসি? মনে নেই। শেষ পর্যন্ত কোন বিবেচনায় কে জানে, আমাকেই প্রথম ঘোষণা করা হয়, তৃতীয় শ্রেণীতে উঠে আমার রোল নম্বর এক। জীবনে ওই একবারই, আর কখনো লেখাপড়ায় তো নয়ই, কোনোকিছুতেই আর প্রথম হইনি। শীর্ষেন্দুর একটা গল্পে যেমন ছিলো, 'বাঘটা একবারই বেরিয়েছিলো...'। আমাকে প্রথম ঘোষণা করায় বেলার অসন্তুষ্ট পিতা স্কুলে কিছু হৈ চৈ করেছিলেন মনে আছে। তখন মনে হতো, বেলাকেই কেন প্রথম করা হলো না!

বেলা-হাসির সেই ছোটোকালের মুখ আবছা মনে আছে। পি টি স্কুল পেরোনোর পর হাসিকে আর কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। একই পাড়ার বাসিন্দা হিসেবে বেলাকে ভি এম স্কুলের ইউনিফর্ম পরে যেতে দেখেছি। আমরা আবার বাড়ি বদল করার পর আর দেখা হয়নি। তৃতীয় যে সহপাঠিনীর কথা মনে আছে তার নাম মনোয়ারা। ক্লাস টুতে ভর্তি হয়েই পেলাম তাকে, ক্লাসের অন্যসব বালক-বালিকার তুলনায় দেখতে বড়োসড়ো সে। বয়সেও সম্ভবত। ক্লাস টুতে পড়ার সময়ই পরপর কয়েকদিন মনোয়ারা অনুপস্থিত। শোনা যায়, আর স্কুলে আসবে না সে। কেন? স্কুলে আসার আর দরকার নেই, তার বিয়ে হয়ে গেছে!

আমার দশ বছর বয়সী পুত্রের একটি প্রিয় কৌতূহলের বিষয় তার বাবার ছেলেবেলা। আমি যখন তার বয়সী সেই সময়ে আমাদের বাড়িতে রেডিও বলে কিছু ছিলো না, বিদ্যুত্ না, টেলিভিশনের নাম আমরা জানি না, ভিডিও গেম বলে কোনো বস্তু মানুষের কল্পনায়ও নেই– এইসব কাহিনী তার কাছে অবিশ্বাস্য ও অতি অবাস্তব লাগে। মন্দ অর্থে বলছি না, আজকাল এমনকি মফস্বল শহরের শিশুরাও এসব চেনে জন্মের সময় থেকেই, ব্যবহারের সামর্থ্য থাকা-না-থাকার বিষয় আলাদা থাক। এইসব হয়েছে সময়ের টানে, সময়ের প্রয়োজনে, মানুষের উদ্ভাবনী শক্তির ফসল হিসেবে এবং এইসবের ব্যাপক প্রচলনের ফলে। তবে বললে বোধহয় খুব ভুল হবে না যে, মায়ের মুখের চেয়ে টিভির পর্দায় আজকের শিশুদের চোখ বেশি নিবদ্ধ থাকে।

আলোহীন, জৌলুসহীন এবং আপাত-বিনোদনবিহীন শৈশবে আমরা অবশ্য খুব নিরানন্দ ছিলাম না। মানুষ হয়তো শেষ বিচারে তার পরিবেশ-প্রতিবেশের সন্তান। তার চারপাশে সে উপযুক্ত ও শ্রেষ্ঠ আনন্দের উপকরণ সে সন্ধান করে এবং আহরণ করতেও সমর্থ হয়। আমরাও পেরেছিলাম। এইসব বিষয়ে এক সময়ের সঙ্গে আরেক সময়ের তুলনা চলে না। আমার পিতা বড়ো হয়েছেন গ্রামে, তাঁর শৈশবের সঙ্গে আমারটা কিছুতেই মেলে না। আমার সময়ের সঙ্গে আমার পুত্রের শৈশব ঠিক ততোটাই বা ততোধিক পরিমাণে আলাদা। এখানে ধারাবাহিকতা বা পরম্পরা খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন পণ্ডশ্রম।

সময় ষাট দশকের প্রথমার্ধ। তখন আমাদের জীবনে প্লাস্টিক নামের একটি বস্তুর প্রবেশ ঘটছে। বিশুদ্ধ সুতির যুগ পার হয়ে ক্যারোলিন-টেরিলিন শার্ট পরণে উঠছে আমাদের। প্রেসিডেন্ট নামের ঢাউস মোটা ফাউন্টেন কলম এসেছে, সেই কলমে ব্যবহার্য চীনের তৈরি ইয়ুথ নামের কালো ও নীল দোয়াতের কালি। পেন্সিলে পাকিস্তান ক্রিকেট টীমের খেলোয়াড়দের ছবি উৎকীর্ণ– জাভেদ বারকি, হানিফ মোহাম্মদ, ইনতেখাব আলম, মোশতাক মোহাম্মদ। তখন শহরাঞ্চলে বাসাবাড়িতে খড়ির চুলা ও কয়লার চুলার পাশাপাশি আসতে শুরু করেছে কেরোসিনের স্টোভ।

পরিবারের সদস্যদের মাথার হিসেবে রেশনকার্ড দিয়ে প্রতি সপ্তাহে লাইনে দাঁড়িয়ে বরাদ্দের চাল, ময়দা, চিনি এবং যতোদূর মনে পড়ে কেরোসিন তেলও পাওয়া যায়। আমাদের বাড়িতে অবশ্য রেশনের চাল খাওয়া হতো না, প্রধানত চিনি ও ময়দা নেওয়া হতো। পাড়ার রেশন দোকানের ডিলার কফিলউদ্দিনের বড়ো ছেলে, নাম সম্ভবত পল্টু, কলেজে আব্বার ছাত্র। আরেক পুত্র এনামুল কবির পরে জেলা স্কুলে আমার সহপাঠী হয়।

আমেরিকা থেকে রিলিফের গম আর গুঁড়ো দুধ আসে, তাই দিয়ে পি টি স্কুলে আমাদের জন্যে খিচুড়ি ও পায়েসের টিফিন তৈরি হয়। গমের খিচুড়ি-পায়েস আগে কোনোদিন কেউ খায়নি। পানিতে গোলানো গুঁড়ো দুধের পায়েস মুখে দেওয়া যেতো না, অতি জঘন্য তার স্বাদ-গন্ধ। গরম খিচুড়ি খেতে খুব খারাপ লাগতো না, গমের অচেনা কিন্তু নতুন গন্ধটা ভালো।

চৌরাস্তার মোড়ে পি টি স্কুলের ঠিক কোণাকুনি একটি দোকান। একপাশে মুদিখানার যাবতীয় সদাইয়ের পসরা, আরেকপাশে চা-মিষ্টি-সিঙাড়ার দোকান। মালিকের নাম কিয়ামউদ্দিন, কিয়ার দোকান বলে সবাই চেনে। দোকানের সামনে একটি গাছতলায় গোটাদুয়েক রিকশা দাঁড়ানোর জায়গা। একটি রিকশার পেছনে বড়ো করে লাল রঙে লেখা ৩, তার দু'পাশে ভাগাভাগি করে কালো হরফে লেখা বগুড়া পৌরসভা। অর্থাৎ শহরের তিন নম্বর রিকশা। এই রিকশার মালিক-কাম-চালক আকবর মিয়া। কাঁচা-পাকা চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, সাদা চেক লুঙ্গি আর পরিষ্কার গেঞ্জি পরা রীতিমতো সম্ভ্রান্ত চেহারার আকবর মিয়াকে দেখলে রিকশাওয়ালা বলে অনুমান করা শক্ত। কিয়ার দোকানের পেছনেই তার বাড়ি। ছেলে বাদশা ঢাকায় পড়ে। মাঝে-মধ্যে ছুটিছাটায় আসে। ঢেউ খেলিয়ে আঁচড়ানো চুল আর ইস্ত্রি করা প্যান্ট-শার্ট পরে বিকেলে বেড়াতে বের হলে বাদশাকে তখন দেখতে বেশ রাজপুত্র-রাজপুত্র লাগে।

এ পাড়ায় আসার পর থেকে আমাদের বাঁধা রিকশাওয়ালা আকবর মিয়া। আম্মা কোথাও যাবেন, ডাকো আকবর মিয়াকে। আমিই যেতাম ডাকতে। ডেকে কিয়ার দোকান থেকে বাড়ি পর্যন্ত ফেরার পথে একা রিকশা চড়ার আয়েশ। নিজেকে তখন বেশ বড়ো বড়ো লাগে। নানাবাড়ি বা দাদাবাড়ি যাওয়ার জন্যে রেলস্টেশনে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আগেই খবর দেওয়া থাকতো, ঠিক সময়মতো আকবর মিয়া বাড়ির সামনে এসে হর্ণ বাজাবে, তখনো রিকশায় হর্ণ ব্যবহার করা হয়। দরকার হলে আরেকটি রিকশাও সে-ই ধরে আনে। কিছুদিন পরে আমাদের আবার বাড়ি বদল হবে, নতুন পাড়ায় আকবর মিয়ার জায়গা নেবে সুবরতি। লোকটা কোথাকার জানা যায় না, বাংলা বলে ভাঙা ভাঙা। সবাই বলে বিহারী।

কিয়ার দোকান থেকে আমাদের বাড়ির দৈনন্দিন সদাইপত্র কেনা হয়। আটা-ময়দা, পাঁউরুটি (রুটিতে মাখনের ধারণা মধ্যমশ্রেণীতে তখনো আসেনি), ডালডা, কেরোসিন তেল, শর্ষের তেল (ভেজিটেবল বা পাম অয়েল তখনো দূরস্ত), সাবান এইসব। দিস্তা হিসেবে ফুল’স ক্যাপ কাগজ, পেন্সিল, রুলটানা খাতা। বেশি ভারি কিছু না হলে আমি যাই কিনতে। এই দোকানে বাকির খাতায় আব্বার নামে একটি পাতা বরাদ্দ থাকে। নগদ লেনদেনের দরকার নেই। যা কেনা হলো, আমার উপস্থিতিতেই খাতায় লেখা হয়ে গেলো। মাসের এক তারিখে বেতনের টাকা আব্বার হাতে আসে, রেডিওতে আইয়ুব খানের মাসপহেলা বেতার ভাষণের মতো। সেদিন কিয়ার দোকানে বাকির হিসেব শূন্য থেকে শুরু হতো আবার।

আমাদের বাড়িতে চায়ের চল ছিলো না, কিয়ার দোকান থেকে কালেভদ্রে চা-পাতা কেনা হতো। বস্তুত, চা, পান, সিগারেট কোনোরকম নেশার দ্রব্যই আমাদের বাড়িতে নেই তখন। চা-পাতা কেনা হতো অতিথিদের জন্যে। প্রতিদিন বিকেলে আব্বার তাস খেলার আসর, খেলার পার্টনারদের একেকজনের বাসায় খেলা হয়। আমাদের বাসায় হলে তাসারুদের জন্যে আম্মা চা বানিয়ে দিলে আমি ট্রেতে করে নিয়ে যাই। ওই অছিলায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে খেলা দেখি, যতোক্ষণ না আব্বা খেয়াল করে ভেতরে যেতে না বলতেন। তাসের আসরের কারো সিগারেট শেষ হলেও ডাক পড়ে, আবার কিয়ার দোকানে। সিগারেট এনে দিয়ে আরেক দফা দাঁড়িয়ে তাস খেলা দেখার সুযোগ। দেখে দেখেই অকশান ব্রীজের নিয়মকানুনগুলো আমার শেখা হয়ে যায়।

কিয়ার দোকানে যাওয়া-আসার সময় বেলাদের বাড়ির পরে জাকারিয়া ভাইদের বাড়ি। সেই বাড়ির দোতলায় একটিমাত্র ঘর, সেখানে জাকারিয়া ভাই থাকেন। তাঁর পিতা তসলিম তালুকদার আসলে পালকপিতা। জাকারিয়া ভাই আসলে আমার সহপাঠী ফারুক তালুকদারের সহোদর, ফারুকের চাচা তসলিম তালুকদার নিঃসন্তান বলে ভাইয়ের একটি পুত্রকে দত্তক নিয়েছিলেন। জাকারিয়া ভাই শরীরচর্চায় অতি মনোযোগী ছিলেন। দেখার মতো শরীর ছিলো, জানতেন বলে বেশিরভাগ সময় খালি গায়ে বা শুধু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে থাকতেন। তাঁর দোতলার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে দেখা যায়। একবার শহরের শরীরচর্চাবিদদের প্রতিযোগিতা হয় জেলা স্কুলের মাঠে। মি. বগুড়া নির্বাচন করা হবে। পাড়ার ছেলে জাকারিয়া ভাইয়ের দিকে আমার সমর্থন। কিন্তু তিনি হলেন রানার আপ, মিস্টার বগুড়া হয়েছিলেন কাটনারপাড়ার আবদুল জলিল। তাতে কিছু এসে যায় না। জাকারিয়া ভাই অনেককাল আমার হিরো ছিলেন। শরীরচর্চা করে তাঁর মতো শরীরের মালিক হওয়ার বাসনা দীর্ঘকাল ছিলো। এ জন্মে তা হয়ে উঠলো না। চর্চার জন্যে শরীরটিকে জায়গামতো নিয়ে যেতে হবে, সেটি করে দেবে কে!

সদাইপাতির জন্যে কিয়ার দোকানে যাওয়া শুধু নিয়মপালন মাত্র। আমার আকর্ষণ ছিলো অন্যত্র। বাড়িতে ক্ষণকালের অতিথি, অর্থাত্ রাত্রিবাস করবে না এরকম কেউ এলে রীতি ছিলো মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করার। ব্রীজ খেলোয়াড়রাও এই শ্রেণীভুক্ত হতেন প্রায়ই। যেহেতু তখন ফ্রিজ বলে কোনো জিনিস ছিলো না, জিনিসটি প্রয়োজনের সময়ই কিনে আনতে হবে। অভ্যাগতরা এলে আমি অপেক্ষা করি কখন টিফিন ক্যারিয়ারের একটি বাটি হাতে মিষ্টি আনার ডাক পড়বে। একেকটা মিষ্টির দাম দুই আনা, তখনো দশমিকের হিসেব চালু হয়নি, ষোলো আনায় এক টাকা হয়। অতিথিরা সংখ্যায় বড়ো না হলে এক টাকার মিষ্টিতেই কাজ চলে যায়। কিয়ার দোকানে এক টাকার মিষ্টিতে একটা ফাও পাওয়া যায়। ওই নয় নম্বর মিষ্টি দোকান থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছায় না, ফেরার পথে সেটি উধাও হয়ে যায়। অতিথি বিদায় হলে উদ্বৃত্ত থেকে ভাগ আমরা সবাই পেতাম, আমার জন্যে হয়তো সেটাই সত্যিকারের ফাও। কারণ অতিথি সত্কারে সব মিষ্টি শেষ হয়ে গেলেও আমার লোকসান কিছু নেই!

এক অর্থে এটিই জানামতে আমার প্রথম অপরাধমূলক কাজ! এখন ভাবি, এই বুদ্ধি আমার মাথায় কী করে এসেছিলো? শান্তশিষ্ট ভালো ছেলে বলে সবাই জানে, নিজেও তাতে কিছু আত্মপ্রসাদ ভোগ করি। তবু ছিঁচকে চুরিতে আমার হাত উঠলো। এমন নয় যে মিষ্টিতে আমার বিশেষ আসক্তি ছিলো। আসলে আজও নেই। তাহলে? উত্তর হয়তো এই যে ওই বালক বয়সে একটু লুকোচুরির রোমাঞ্চ আমার দরকার ছিলো। কোথাও কোথাও তো আমাকে জিততে হবে!

ভালো ছেলে বলে পরিচিত হওয়ার ফলে স্কুলে শিক্ষকদের কাছে কিছু বাড়তি প্রশ্রয় পাওয়া যেতো। কিন্তু সহপাঠী ও স্কুলের অন্য বালকদের কাছে সমীহ জুটলেও নিতান্ত নিরামিষ আমি, সে অর্থে চালু ছেলে নই মোটেই। আমি তখনো দ্বিতীয় ক্লাসে, একদিন উঁচু ক্লাসের এক বালক ছুটির সময় আমাকে শাসিয়ে বলে, কাল চার আনা প'সা দিবু হামাক।

রীতিমতো আদেশ জারি। এই বালক ক্লাস ফাইভে পড়ে। ডানপিটে বলে খ্যাতি আছে, স্কুলের সবাই তাকে চেনে। নাম মঞ্জু। তার ছোটো ভাই বাবলু ক্লাস ফোরে, অত্যন্ত নিরীহ ছেলে এবং ভালো ছাত্র। তাদের পিতা এই স্কুলের শিক্ষক মিজানুর রহমান, অত্যন্ত উঁচুমানের মানুষ ও শিক্ষক। কিছুদিন আমাকে এবং ঝর্ণাকে প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন মিজান স্যার। তাঁর পুত্র হিসেবে বাবলু মানানসই, মঞ্জুকে মানতে কষ্ট হয়।

একটি তথ্য তখন জানা ছিলো না, জেনেছি অনেক পরে। ষাটের দশকের শেষার্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনএসএফ-এর ত্রাস হিসেব নাম শোনা যেতো খোকা-পাঁচপাত্তুর। ছবিতে দেখেছি চশমাপরা খোকা নিরীহদর্শন মেধাবী ছাত্রের প্রতিমূর্তি খোকা। সে নাকি গলায় সাপ ঝুলিয়ে প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করতো। আইয়ুব ও মোনেম খানের হয়ে অনেক অপকর্ম সংঘটিত করেছিলো খোকা-পাঁচপাত্তুরা। সম্ভবত ঊনসত্তরের এক সকালে খোকার লাশ পাওয়া যায় রমনা রেসকোর্সের (এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাশে। এই খোকা ছিলো আমাদের মিজান স্যারের জ্যেষ্ঠ পুত্র, মঞ্জু-বাবলুর ভাই।

চার আনা পয়সা দাবি করে বসার আগে মঞ্জুর সঙ্গে কখনো কথা হয়নি। আমাকে তার চেনারও কোনো কারণ নেই। কিন্তু এই ধরনের প্রতিভাবান বালকেরা বোধহয় ঠিক গন্ধ পেয়ে যায়, ঠিক কার ওপরে দাপট দেখানো যাবে।

এখন আমার হলো মহাবিপদ। চার আনা পয়সা পাই কোথায়? একবারও মনে হয়নি, চাইলেই ওকে আমি পয়সাটা কেন দেবো। মঞ্জু বলেছে, সুতরাং দিতে হবে। শিক্ষকদের কাছে নালিশ করা যায়, কিন্তু প্রমাণ কী? মঞ্জু সরাসরি অস্বীকার করলে? করবে জানা কথা। কিন্তু তারপর? তার সঙ্গে পরে আমার দেখা হবেই, সে আমাকে খুঁজে বের করতে পারবে সহজেই। তখন?

পরদিন স্কুলে আসার আগে আম্মার কাছে কান্নাকাটি করে চার আনা পয়সা আদায় করতে সক্ষম হই। চার আনা তখন অনেক পয়সা, ছ'আনায় একসের চাল হয়। আম্মার জেরার উত্তরে শুধু বলি, দরকার আছে। স্কুলে যতোক্ষণ ক্লাস ততোক্ষণ ভয় নেই। টিফিন পিরিয়ডে কাঁটা হয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘুরে বেড়াই। মঞ্জুর সামনে পড়িনি। মনে হয় ছুটির পর আর রক্ষা নেই। যদিও আমার পকেটে তার দাবি করা পয়সা আছে, চাইলেই দিয়ে দিতে পারি। তবু ভয় যায় না। একসময় মনে হয়, আচ্ছা ওকে আমি পয়সাটা দেবো কেন? ছুটির পর আমাদের ক্লাসরুমের পেছনে দেওয়ালের পাশে কাঁঠাল গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। একটু পরে উঁকি দিয়ে দেখি মঞ্জু স্কুলের গেটে, বেরিয়ে যাচ্ছে তার দলবল নিয়ে। সে চোখের আড়াল হলে আমি বাড়ি ফিরি।

পরদিন মঞ্জুর মুখোমুখি পড়ে যাই। একটু ভয় ভয় লাগে, যদিও সেই চার আনা পকেটে তখনো আছে আমার। কিন্তু সে যেন আমাকে চেনে না, কখনো দেখেইনি– এইভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ঘটনাটি কিছুই নয়, তবু আমার ভেতরের অকারণ ভয়ের বোধটুকু বেরিয়ে এসেছিলো বলে এখন বুঝতে পারি। ভালো ছেলে হওয়ার বিড়ম্বনা টের পাচ্ছিলাম।

এর কাছাকাছি সময়ে আরেকটি ঘটনা ঘটে। একদিন সকালে সারা শহরে প্রচারিত হয়ে যায় যে দুই জোড়া যুবক-যুবতী গতরাতে শহর থেকে উধাও হয়ে গেছে। তখন বোঝার বয়সও হয়নি, প্রেমের কারণে শুধু উধাও হওয়া নয়, মানুষ আরো অনেক কিছু করে, করতে পারে। জোর গুজব ও জল্পনা হয় এইসব নিয়ে, দিনকয়েক পর দুই জোড়া নতুন দম্পতির আবির্ভাব ঘটে শহরে। একটি জুটিতে ছিলেন আমাদের আয়েশা ভিলার দু'পাশের দুই বাড়ির ঝর্ণা খালাম্মা এবং বাচ্চু মামা। দ্বিতীয়টির পাত্রপাত্রীর নাম দুলু ও মিনি। এই দু'জনও আব্বার কলেজের ছাত্রছাত্রী। মিনির বাড়তি পরিচয়, তিনি আমাদের মিজান স্যারের মেয়ে, খোকা-মঞ্জু-বাবলুর সহোদরা।

[চলবে]


পর্ব - ০১, পর্ব - ০২, পর্ব - ০৩



জুবায়ের ভাইয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে পাঠকদের কাছে অনুরোধ রইলো, রেটিং পদ্ধতির ব্যবহার না করার। ধন্যবাদ।



মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

সিরিজটা মনে হয় জমে উঠেছে ! একটু একটু করে মজে যাচ্ছি এটাতে !! কিন্তু হায়..!!!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

নিজের শহরের পরিচিত সব নাম।
ভালো লাগছে পড়তে।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

রানা মেহের এর ছবি

কী দুর্দান্ত লেখা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।