মুহম্মদ জুবায়েরের অপ্রকাশিত রচনা: বালকবেলা / ‘আহা কী যে বালখিল্য’ - ০৩

সন্দেশ এর ছবি
লিখেছেন সন্দেশ (তারিখ: রবি, ০৪/০১/২০০৯ - ১০:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৪. তেঁতুলতলার নতুন বাসিন্দা

আব্বা বাড়ি কিনলেন শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে দক্ষিণে, ঠনঠনিয়ার তেঁতুলতলা এলাকায়। বাড়ির বিক্রেতা এক বৃদ্ধ দম্পতি। তাঁদের শর্ত ছিলো, বিক্রির পরেও বাড়ির একটি ঘরে তাঁরা বাস করবেন আমৃত্যু। তাঁদের হাটবাজার, রান্নাবান্না সবই নিজেদের, শুধু বসবাস করতে হবে পাশাপাশি - এক বাড়ির মধ্যে। এই শেষ বয়সে তাঁদের আর কোথাও যাওয়ার নেই। আজকের দিনের হিসেবে খুবই অসম্ভব শর্ত মনে হয়, তখন কিন্তু খুব অবাস্তব ছিলো না। তখন ছিলো অন্য এক কাল, ভিন্ন তার মূল্যবোধ ও বাস্তবতা।

তবে এই কেনাবেচায় তার চেয়েও এক বড়ো বিস্ময় ছিলো। বাড়ির বিক্রেতা দম্পতি এবং ক্রেতা দম্পতির নামগুলি বানানের সামান্য হেরফের ছাড়া হুবহু এক। জীবনে এমন কাকতালীয় ঘটনা দ্বিতীয়টি দেখিনি।

আম্মা এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দাদা-দাদী সম্বোধন করেন, ফলে আমরা ডাকি বুড়া-আব্বা ও বুড়া-আম্মা। উচ্চারণে হয়ে যায় বুড়াব্বা ও বুড়াম্মা। আব্বা অবশ্য কোনো সম্বোধনে নেই। কী কারণে জানি না, তিনি কাউকেই এই ধরনের আত্মীয়তাসূচক সম্বোধন করতেন না। এমনকি তাঁর পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কাউকেও না। আমাদের কাছে তাঁর পিতার সম্পর্কে কিছু বলতে হলে বলতেন, তোমার দাদা। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। ভাইদের প্রসঙ্গ এলে বলতেন, তোমার বড়ো-আব্বা, অথবা ভ্রাতুষ্পুত্রদের নাম টেনে বলতেন খোকার বাপ বা আশরাফের বাপ। তাঁর ভাবীদেরও কখনো ভাবী বলে ডাকতে শুনিনি। এমন নয় যে বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্পর্কে তাঁর ভক্তিশ্রদ্ধা কিছু কম ছিলো। তাঁদের কখনো অসম্মান করেছেন বলেও জানি না। বরং ভাইদের সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ সমর্থন-সহায়তায় পরিবারের একমাত্র তিনিই উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, এই কৃতজ্ঞতাবোধ তাঁর আজীবন অটুট দেখেছি। তবু তাঁর এই সম্বোধন-বিমুখতার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। জীবনে উত্তর না-পাওয়া অনেক প্রশ্নের একটি।

বুড়াব্বা-বুড়াম্মা দু'জনেই ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষ। কী করে বগুড়া এসে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন সঠিক জানি না। সম্ভবত বুড়াব্বার কর্মসংক্রান্ত কোনো কারণ ছিলো। তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি স্মৃতি নেই, আমরা ওই বাড়িতে ওঠার সময় তিনি অবসরভোগী, বছর দুই-তিনেকের মধ্যে মারা যান। দুয়েকবার তাঁর হাত ধরে শেরপুর রোডে পি টি স্কুলের মোড়ে কিয়ার দোকানে গিয়েছি বলে আবছা মনে পড়ে। আমাকে সন্দেশ কিনে দিয়ে নিজে বসতেন এক কাপ চা নিয়ে। চায়ের কাপ থেকে উঠে আসা ধোঁয়া, গরম চা তিনি পিরিচে ঢেলে ফুঁ দিয়ে খাচ্ছেন – এই দৃশ্যগুলি মনে পড়ে। যতোদূর মনে পড়ে, ফিরোজ তাঁর সবচেয়ে বেশি ন্যাওটা ছিলো। আমাদের সবার ছোটো ভাই মাসুদের জন্ম তেঁতুলতলার বাড়িতে উঠে আসার পরের বছর। সে বুড়াব্বার ঘনিষ্ঠ হওয়ার সময় পায়নি, তবে বুড়াম্মার ভক্ত-অনুরক্ত হয়ে উঠেছিলো সে।

বুড়াব্বা মারা যাওয়ার পর বুড়াম্মার সঙ্গী তাঁর এক নাতনি। আমাদের লিলি খালাম্মা। আম্মা তাঁর বুবু, আব্বা দুলাভাই। লিলি খালাম্মার বয়স তখন পনেরো-ষোলো, সারাক্ষণ দেখতাম বুকের নিচে বালিশ গুঁজে উপুড় হয়ে গল্পের বই পড়ছেন। বস্তুত তাঁকে আর কিছু কখনো করতে দেখেছি এরকম মনে করতে পারি না। বকাঝকাও খেতেন বুড়াম্মার কাছে, সেসব তিনি কিছুমাত্র গায়ে মাখতেন বলে মনে হতো না।

আমাদের চার ভাইবোনের জন্যে বুড়াম্মার আদর-প্রশ্রয়ের সীমা-পরিসীমা ছিলো না। ক্ষীণকায়া বৃদ্ধার শরীর বেশ শক্তপোক্ত ছিলো। সারাক্ষণ চরকির মতো ঘুরছেন। দুপুর হলেই তিনি বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্যে চঞ্চল হয়ে উঠতেন। কালো একটি বোরখা চাপিয়ে পায়ে হেঁটে পাড়ায় পাড়ায় পরিচিতজনদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতে যেতেন। পানদোক্তা খেয়ে সুখ-দুঃখর গল্প করে ফিরতেন সন্ধ্যার মুখে। ঝুলিতে থাকতো রাজ্যের সব গল্প। আম্মা ঠাট্টা করে বলতেন, পাড়াবেড়ানি বুড়ি। ফোকলা মুখে বুড়াম্মা প্রশ্রয়ের হাসি হাসতেন।

এক গ্রীষ্মের দুপুরে ঝর্ণা ও আমি পড়ার টেবিলে বসে স্কুলে নতুন অর্জিত জ্ঞান নিয়ে যাবতীয় সবজির নামের তালিকা করছি। উত্তরবঙ্গে কচুর লতিকে বলে কচুর বই, বা বইকচু। এই জিনিস সবজির অন্তর্ভুক্ত কি না, আমরা স্থির করে উঠতে পারি না। বুড়াম্মা তখন আশেপাশে ছিলেন। ঝর্ণা জিজ্ঞেস করে, বুড়াম্মা কচুর বই কি তরকারি?

ঠিক শুনতে না পেয়ে বুড়াম্মা বললেন, কী জিনিস?

কচুর বই।

ফরিদপুরের টান বজায় রেখে বুড়াম্মার উত্তর, খাস কী তয়?

কতো কাল পার হয়ে গেলো তারপর। আজও আমাদের বাড়িতে কচুর বই বললে খাস কী তয় অবধারিতভাবে আসে, উচ্চারিত হয়। স্মৃতির ধুলো সরিয়ে বুড়াম্মা উঁকি দেন এক ঝলক। কতো তুচ্ছ একটি কথা কীভাবে আমাদের সঙ্গে চলমান থেকে যায়, মানুষটি না হয় না-ই থাকলো!

লিলি খালাম্মার বাপের বাড়ি আধ মাইল দূরে গাড়ামারায়, পরে এই জায়গার নাম হয় রহমাননগর, আনসার ক্যাম্পের মাঠটির পুবদিক ঘেঁষে। সেখানে তিনি যেতেন কদাচিৎ। কিছুদিন পর তাঁর বিয়ে হয় ফরিদপুর অঞ্চলের কোথাও। একবার জ্বর গায়ে নিয়ে বুড়াম্মা গেলেন নাতনির শ্বশুরবাড়ি। আর ফিরলেন না। গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বুড়াম্মার মৃত্যুর সংবাদ দেওয়া হলো। আমার প্রতিক্রিয়াটি স্পষ্ট মনে আছে এখনো। সদ্যভাঙা ঘুমের কারণে হোক বা বুড়াম্মা এইভাবে আচমকা চলে গেলেন এই ক্ষোভ-অভিমানে ঠিক বলতে পারবো না, আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, গেলো কেন অসুস্থ শরীর নিয়ে? কে যেতে বলেছিলো? কী দরকার ছিলো?

মৃত্যু কী জিনিস তখনো ভালো করে জানি না, মৃত মানুষের কাছে এই যে এই অনুযোগ পৌঁছানো সম্ভব নয় তা-ও বোধহয় ঠিক জানা ছিলো না। ঠিক মনে নেই কে, তবে এই মর্মে কারো মৃদু তিরস্কার শুনেছিলাম যে, মৃত মানুষের সম্পর্কে এভাবে বলতে হয় না।

এক অভিজ্ঞান অর্জিত হলো। তখন আমি ক্লাস নাইনে।

তেঁতুলতলায় আমাদের নতুন বাড়ির দেওয়াল মাটির তৈরি, তার ওপরে সিমেন্টের আস্তরণ দিয়ে চুনকাম করা। ইটের বাড়ি বলে ভ্রম হয়। টিনের চাল। বৃষ্টি এলে টিনের চালে শব্দ ওঠে, ঘরের ভেতরে শুয়েবসেও সেই শব্দ শুনে বুঝি বৃষ্টির তীব্রতা কতোটা। খোলা জানালা দিয়ে হাত বাড়ালে বৃষ্টির ছাঁট এসে পড়ে। এখনো ইচ্ছে করলে বৃষ্টির স্পর্শ পাওয়া সম্ভব, কিন্তু টিনের চালে বৃষ্টির সেই শব্দ জীবন থেকে কবেই হারিয়ে গেছে।

তখন সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছি অথবা হবো-হবো। আমাদের রান্নাঘরের পুবদিক ঘেঁষে একটা বড়ো পেয়ারা গাছ। গাছে উঠতে পারি না। আমি আর ঝর্ণা মই বেয়ে টিনের চালে উঠে পেয়ারা পেড়ে খাই, পকেটভর্তি করে নিয়ে নেমে আসি। এইরকম একদিন চালে উঠেছি, আচমকা ভীষণ তোড়ে বৃষ্টি নামলো। আকাশ মেঘলা ছিল, কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি বৃষ্টি শুরু হবে ভাবা যায়নি। টিনের চালে সেই বৃষ্টির শব্দের ভীষণ শব্দে আমি ভয় পেয়ে যাই, কেঁদে ফেলি। ঝর্ণা কিন্তু দিব্যি মই বেয়ে নেমে গেলো। আমি দিশেহারার মতো কাঁদতে লাগলাম, নেমে যাওয়া যে দরকার এবং সম্ভব, তা-ও মনে আসে না। সেদিন শেষ পর্যন্তু কী হয়েছিলো, নিজে নেমেছিলাম না কেউ নামিয়ে এনেছিলো মনে নেই। সেই রাতে আমার প্রবল জ্বর আসে, তীব্র জ্বরের ঘোরে রাতভর আমি প্রলাপ বকি। প্রলাপে আমি হাতি ধরার বাসনা প্রকাশ করেছিলাম বলে জানা যায়।

আমার এই বীরত্বের কাহিনী আজও আমাদের পরিবারে কিংবদন্তিসম হয়ে আছে। আম্মার কাছে শুনে শুনে এমনকি ফিরোজ-মাসুদ, যাদের তখনো তেমন বোঝায় বয়সই হয়নি, হলেও মনে থাকার কথা নয়, তারাও এই ঘটনার সরস বিবরণ দিয়ে থাকে, যেন তারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।

বাড়ির ভেতরে আরো কিছু গাছপালা ছিলো। উঠানের ঠিক মাঝখানে একটি আম গাছ, সে গাছের আম খুবই মিষ্টি, কিন্তু কোনো এক দুর্জ্ঞেয় কারণে পাকতে শুরু করলেই আমে পোকা ধরে যেতো। রান্নাঘরের পশ্চিমদিকে আরো একটি পেয়ারা গাছ লাগানো হয়েছিলো, এই গাছের পেয়ারা সংখ্যায় কম হলেও আকারে বিশাল এবং অতি সুম্বাদু। রান্নাঘরের সামনের দিকে একটি ডালিম গাছ। পুবের দেওয়াল ঘেঁষে পাশাপাশি দুটি কাঁঠাল গাছ। অতি মিষ্ট সেই গাছের কাঁঠাল।

পুবের দেওয়ালের ওপাশের বাড়ির মালিক কমরুদ্দিন সাহেব, শুনেছি তিনি পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, এ বাড়িতে বাস করতেন না। ভাড়া দিয়েছিলেন মেসবাড়ি হিসেবে, সেখানকার কোনো বাসিন্দার কথা আমার স্মরণে নেই। মেসবাড়ির পাশ দিয়ে আমাদের বাড়ির খিড়কি দরজা। এই টিনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা ছোটো গলিপথ, বাঁ দিকের বাড়ির মমতাজ ভাই ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন মনে আছে। গলি ধরে এগোলে সামনে পীচরাস্তা, ডানদিকে ঘুরে সামান্য গেলেই পি টি স্কুলের চৌরাস্তার মোড়।

একদিন বিকেল এই খিড়কি দরজার বাইরে থেকে মহিলাকণ্ঠের চিৎকার শোনা যায়, আম্মা দ্যাখছেননি, গলির মইদ্যে পরহাণ্ড এক পোহা বাইর হইছে।

টিনের দরজায় প্রবল ধাক্কাধাক্কির শব্দ শুনে আম্মা উঠান পেরিয়ে দরজা খুলে দিতেই তাঁকে একরকম ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে শীর্ণ চেহারার এক রমণী। দেখে অনুমান হয়, ভিক্ষা চাইতে দরজায় এসেছিলো সে। আম্মা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মহিলা নিজে থেকে দ্রুতহাতে দরজা বন্ধ করে দেয়। তার ভাষা, কথা বলার ধরন অপরিচিত, এ অঞ্চলের মানুষ নয় সে। তার বিস্ফারিত চোখ, মুখ থেকে নিঃসারিত অচেনা শব্দের সমাহার আর হাত-পা সঞ্চালনের বিবরণে অতি কষ্টে বোঝা যায়, গলির ভেতরে ঢুকে একটি সাপ চোখে পড়ে তার। ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে সে, দেখে ফনা তুলে পথ আগলে আছে সাপ। চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েও চিৎকারটা গিলে ফেলতে হয়, যদি সাপ তেড়ে আসে! চুপ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখে, সাপ মাথা নামিয়ে পাশের বাড়ির মাটির দেওয়ালের গর্তে ঢুকে পড়ে। তখন সে আমাদের দরজায় সজোরে ধাক্কা দিতে শুরু করে। পোহা বলতে যে সে সাপ বোঝাতে চায়, বুঝতে অনেক সময় লেগেছিলো আমাদের।

নতুন পাড়ার বাসিন্দারা নিম্নমধ্যবিত্ত। তখনো আযিযুল হক কলেজ সরকারি হয়নি, সেই বেসরকারি কলেজের বাংলার তরুণ অধ্যাপক আমার পিতাও আর্থিক বিচারে তার ওপরে কিছু নন। কিন্তু পোরবেসার সায়েবের ছোলপোল হিসেবে পাড়ায় আমরা কিছু আলাদা মর্যাদা ভোগ করি। এই মর্যাদা আরো একধাপ উঠে গেলো এক ঘটনায়। কী এক উপলক্ষে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বগুড়ায় এলেন। আব্বা তাঁর প্রিয় ছাত্রদের একজন, সেই সুবাদে এক দুপুরে তিনি আমাদের বাড়িতে আহার করবেন। খবরটি কী প্রকারে পাড়ায় প্রচারিত হয়ে গিয়েছিলো জানা নেই। নির্ধারিত দিনে আমাদের বাড়ির সামনে রীতিমতো ভিড় জমে গেলো ড. শহীদুল্লাহকে এক নজর দেখার জন্যে। তাঁর পাণ্ডিত্য ও ভাষাবিদ পরিচয় অল্প দু'চারজন ছাড়া আর কারো জানা নেই, কিন্তু পাঠ্য পুস্তকে যাঁর লেখা অন্তর্ভুক্ত হয় তিনি নিশ্চয়ই অনেক বড়ো মানুষ। এইসব মানুষের দর্শন প্রতিদিন মেলে না।

আকারে ছোটোখাটো মানুষটিকে দেখে মানুষ হতাশ হয়েছিলো কি না কে জানে! আমার মস্তকটি শরীরের তুলনায় কিঞ্চিৎ বড়ো দেখে পণ্ডিত মানুষটি নাকি বলেছিলেন, এ ছেলে তো বড়ো হয়ে সর্দার-টর্দার হয়ে যাবে!

আমার মনে নেই, আম্মার কাছে অনেকবার শুনেছি এই গল্প। সর্দার-টর্দার বলতে তিনি কোনোকিছুতে আমার নেতৃস্থানীয় কেউ একজন হওয়ার কথাই বুঝিয়ে থাকবেন। কিন্তু প্রবল পাণ্ডিত্যের সঙ্গে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হওয়ার সম্ভাবনা যে শূন্য, তা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তাঁকে সর্বাংশে ভুল প্রমাণ করতে আমাকে কোনো চেষ্টাই করতে হয়নি, বিনা ক্লেশে সবার পেছনে থেকে গেছি বরাবর। এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার মানুষের অভাব হবে না।

মাসুদ তখন কয়েক মাস বয়সী। ড. শহীদুল্লাহ তাকে কোলে নিতেই সে তাঁর সাদা পাঞ্জাবিতে তার বমনোদগীরণ-প্রতিভার স্বাক্ষর দিয়ে ফেলে। সেই বিড়ম্বনার গল্প মাসুদ সারা জীবনভর শুনে যাচ্ছে, পারিবারিক কেচ্ছাকাহিনীতে তা খোদাই হয়ে গেছে।

আমাদের প্রতিবেশীরা স্কুলশিক্ষক, উকিলের মুহুরি, কাঠমিস্ত্রি, শহরের বাজারে দোকানদার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিচের দিকের চাকুরে – এই ধরনের বিচিত্র পেশার মানুষ। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে কসাইপাড়া। অল্প কয়েকটি পরিবার নিয়ে এই কসাইপাড়া। তাদের বাড়ির পেছনে প্রতিদিন ভোরে গরু-ছাগল-ভেড়া জবাই হয়। আমরা ছোটোরা যাতে এই নিধন-প্রক্রিয়া স্বচক্ষে না দেখি সে বিষয়ে আব্বা যত্নবান ছিলেন। তিনি নিজেও স্বচক্ষে এসব দেখতে পারতেন না, বাড়িতে মুরগি জবাইও না। কোরবানী ঈদের দিন জবাইয়ের সময় তিনি ঘরে এসে বসে থাকতেন।

কসাইপাড়ায় জবাই হওয়া এইসব গরু-ছাগল-ভেড়া ঠেলাগাড়িতে তুলে বাজারে নিয়ে যাওয়া হতো। তার আগেই আব্বা মাংস নিয়ে আসতেন। পরিমাণে বেশি নয়, তার কারণ দুটি। আব্বা আহারের ব্যাপারে অতিশয় খুঁতখুঁতে, প্রতিবেলার খাবার টাটকা রান্না হওয়া চাই যার ফলে আম্মার জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয় রান্নাঘরে। দুই, ফ্রিজ নামে কোনো জিনিসের নামও তখন কেউ শোনেনি।

কসাইপাড়ার কসিমুদ্দিন আব্বার বিশেষ অনুরক্ত হয়ে যায়। স্যার যেহেতু বকরি বা ভেড়ার মাংস খান না, তরুণ বয়সী খাসির সেরা মাংস সে আলাদা করে রেখে দেয়। আব্বা নিজে না খেলেও ভালো গোমাংসও আসতো কসিমুদ্দিনের কল্যাণে।

কসিমুদ্দিনের গায়ের রং কালো হলেও এক ধরনের আভিজাত্যময়। তার চর্চিত পুরু গোঁফ এবং স্বাস্থ্যবান চেহারাটি আমার এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে। তাকে সবসময় দেখতাম সাদা ধবধবে শার্ট আর পরিষ্কার লুঙ্গি পরা। পায়ে কাবলি জুতা। তার চোখ দুটি মায়াবী, স্বভাবে মৃদুভাষী। পেশার সঙ্গে তার চেহারা ও স্বভাবের মিল নেই। এই নিরীহ-নির্বিবাদী কসিমউদ্দিনকেও একাত্তরে যুদ্ধের সময়, কোন অপরাধে কে জানে, পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে প্রাণ দিতে হবে।

আমাদের বাড়ির বসার ঘরটি পশ্চিমমুখী, সামনের বারান্দা থেকে নেমে রাস্তা পর্যন্ত প্রায় বিশ গজের দূরত্বে। সাত-আট ফুট চওড়া এই পথটুকু ইট বিছিয়ে দেওয়া। তার দুইপাশে গাছ লাগানো হয়েছে। বাঁ দিকে কয়েকটি পেঁপে গাছ এবং একটি আম গাছ। ডানে একটি নিম গাছের কথা মনে আছে। এই দিকটাতে একবার ভুট্টা গাছ লাগানো হয়েছিলো, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে তখন ভুট্টা চাষকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। আব্বাই লাগালেন গাছগুলি। ভুট্টা হয়েছিলো প্রচুর। পুড়িয়ে খাওয়া হলো, বিজাতীয় এবং বিস্বাদ বস্তু – একটুও ভালো লাগেনি। তবে ভুট্টার খই মন্দ লাগেনি। এখন সেই জিনিসের নাম পপকর্ন!

বাড়িতেই বাংলা ও ইংরেজি অক্ষরজ্ঞান হলো আম্মার কাছে। গাঢ় গোলাপি রঙের মলাটে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা বাংলা শেখার বই। ইংরেজি বইটির কথা মনে নেই। আম্মার লেখাপড়া ক্লাস সেভেন পর্যন্ত। সেই আমলের বিচারে মন্দ নয়। আমরা ভাইবোনরা পরবর্তীকালে এই মর্মে একমত হই যে সুযোগ পেলে আম্মার পক্ষে ঘরকন্নার বাইরেও সত্যিকারের বড়ো কিছু করা হয়তো অসম্ভব হতো না।


(চলবে)


পর্ব - ০১, পর্ব - ০২



জুবায়ের ভাইয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে পাঠকদের কাছে অনুরোধ রইলো, রেটিং পদ্ধতির ব্যবহার না করার। ধন্যবাদ।



মন্তব্য

স্নিগ্ধা এর ছবি

কোন লেখা পড়তে পড়তে আনন্দ আর কষ্ট, একইসাথে এমনভাবে আর কখনো হয়নি!!

রণদীপম বসু এর ছবি

একটা ইতিহাসের শৈশব পেরোচ্ছি আমরা.....

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

s-s এর ছবি

আমার আম্মা ও খালাদের লেখা শৈশবস্মৃতির সাথে অনেক মিল খুঁজে পেলাম। নির্মোহ অথচ ভীষণ জীবন্ত এই লেখনী থেমে গ্যাছে - ভাবতে পারছিনা!

জীবন জীবন্ত হোক, তুচ্ছ অমরতা

রানা মেহের এর ছবি

এতো ভালো লেখা
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।