বোর্হেসের ভুল

স্পর্শ এর ছবি
লিখেছেন স্পর্শ (তারিখ: বুধ, ১৪/০৮/২০১৩ - ৯:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে, হোর্হে লুইস বোর্হেস একবার চোখ বুজতেই ক্ষণিকের জন্য কিছু পাখি দেখতে পেলেন। যদিও সেই কল্পদৃশ্যটির স্থায়ীত্ব ছিলো মাত্র এক পলক, কিন্তু সেটা তার চিন্তাকে নিয়ে যায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব সংক্রান্ত এক অবশ্যম্ভাবী উপসংহারের দিকে। বাকিটা আমরা তার মুখেই শুনি, [1]

‘... আমি নিশ্চিত নই, ঠিক কতগুলো পাখি আমি দেখেছিলাম। তাহলে সংখ্যাটা কি অনির্দিষ্ট নাকি সুনির্দিষ্ট? সমস্যাটার সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। যদি ঈশ্বর থেকে থাকে, তাহলে সংখ্যাটা সুনির্দিষ্ট, কারণ ঈশ্বর জানে ঠিক কতগুলো পাখি আমি দেখেছি। যদি ঈশ্বর না থাকে, তাহলে সংখ্যাটা অনির্দিষ্ট, কারণ আর কেউ তো গুণে দেখেনি। যেমন এ ক্ষেত্রে, আমার দেখা পাখির সংখ্যা দশ এর কম, এবং (অন্তত) এক এর বেশি। কিন্তু আমি নয়, আট, সাত, ছয়, পাঁচ, চার, তিন, বা দুইটা পাখি দেখিনি। অর্থাৎ আমি দশ এবং এক এর মাঝামাঝি একটা সংখ্যা দেখেছি, যা নয়, আট, সাত, ছয়, পাঁচ ইত্যাদি নয়। কিন্তু এমন একটা পূর্ণ সংখ্যা, যা নয়ও-না, আটও-না, সাতও-না, ছয়ও-না, পাঁচও-না... অচিন্তনীয়। অতয়েব, ঈশ্বর আছে।’

এটা ঠিক যে, এক ও দশ এর মাঝে পূর্ণ সংখ্যা আছে ঠিক আট টি। এবং এটাও ঠিক যে, এক ঝাকে অপূর্ণ সংখ্যক পাখি থাকতে পারে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো একটা পূর্ণ কিন্তু অনির্দিষ্ট সংখ্যক পাখির ঝাকের ধারণাটা অচিন্তনীয় কিছু নয়। লেজার রশ্মিতে এমন ঝাক আমরা অহরহ দেখি। যেখানে, ফোটনরা দল বেধে বেরিয়ে আসে। একেকটা দলে এক থেকে শুরু করে হাজার হাজার ফোটন থাকতে পারে। ওদিকে ফোটনের ভগ্নাংশ হয় না। মজার ব্যাপার হলো এইসব দলের ফোটন সংখ্যা পূর্ণ হলেও বোর্হেসের পাখিদের মত অনির্দিষ্ট [২]। হয়তো কোনো একটা দলে দশের অধিক ফোটন নেই, আবার অন্তত একটা ফোটন আছেই। কিন্তু তারা নয়, আট, সাত, ছয়, পাঁচ... ইত্যাদি কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা না হয়ে, বরং বিভিন্ন মাত্রায় একাধিক পূর্ণ সংখ্যার একটা সুপারপজিশনে (উপরিপাতিত অবস্থায়) আছে। প্রথাগত ধারণায় ব্যাপারটা অচিন্তনীয়। কিন্তু ধারনা এবং বাস্তবতাকে কেন প্রথাগত গণ্ডি মানতে হবে?

হয়তো বর্হেস, কল্পনায় এমন একটা সুপারপজিশনের ধারণা প্রায় ধরেই ফেলেছিলেন। যা শেষ-মেস ঈশ্বর চিন্তায় পতিত হয়।

টীকা-
[1] বর্হেসের ১৯৬০ তে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ “সৃষ্টিকর্তা” (The Maker) -র “পক্ষীবিদ্যীয় উপপত্তি” (Argumentum Ornithologicum) নামক অণুগল্পের অনুবাদ।
[২] কোহেরেন্ট স্টেট
[৩] সুপারপজিশন, এটা-সেটা নিয়ে আগ্রহী পাঠকরা দেখতে পারেন এই লেখাটি।


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

আরে রাখেন আপনার বোর্হেস... আমি যে ঘুমাইলেই গোলামাজম্রে দেখি দশ বারের কম, এবং (অন্তত) এক বারের বেশি। কিন্তু আমি নয়, আট, সাত, ছয়, পাঁচ, চার, তিন, বা দুইবার তাকে দেখিনি। অর্থাৎ আমি দশ এবং এক এর মাঝামাঝি একটা সংখ্যায় তাকে দেখেছি, যা নয়, আট, সাত, ছয়, পাঁচ ইত্যাদি নয়। কিন্তু এমন একটা পূর্ণ সংখ্যায়, যা নয়ও-না, আটও-না, সাতও-না, ছয়ও-না, পাঁচও-না... অতএব? চিন্তিত

ফাঁসি আছেন? নাকি নেই??

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

স্পর্শ এর ছবি

১)
খাইসে, গোলাম আজমের সুপারপজিশন!

২)
আবার জিগায়!


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

তিন নাম্বার লিঙ্ক দেখে ভয় খাইলাম মন খারাপ

এত ভয়ঙ্কর সব দার্শনিক কথাবার্তার প্রায় কিছুই তো জানিনা... নিজেকে এখন ঐ ফোঁড়াকাটা নাপিতের মত লাগছে... আপাতত লেখালেখি বন্ধ... পড়াশুনা করে নেই

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

স্পর্শ এর ছবি

অ্যাঁ!

এই জন্যই ঐ আবজাব লেখার লিঙ্ক দিতে চাইনি। সব ত্রিমাত্রিক কবির দোষ।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ইয়ে, মানে...

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হো হো হো

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অ্যাঁ
ইসরাত

স্পর্শ এর ছবি

চিন্তিত


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

বিস্তারিত হল কি? আরেকটু বোঝার বাকি ছিল মনে হচ্ছে। চমৎকার একটা সূচনা হয়ে কেন যেন মনে হল শেষ করে দিলেন!

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

স্পর্শ এর ছবি

বোর্হেসের যুক্তির মতই সংক্ষিপ্ত রাখতে চেয়েছি।
বিস্তারিত জানতে এই লেখাটা দেখতে পারেণ। মূল পোস্টের শেষে যোগ করে দিচ্ছি লিঙ্ক টা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

রিয়াজ এর ছবি

বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর হিস্ট্রি অফ ওয়েস্টার্ন ফিলসফির এক জায়গায় টমাস একুইনাস এর দর্শন আলোচনায় প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, যে -ঈশ্বর কীকী পারেন না।তিনি দেহী হতে পারেন না,নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেন না,অকৃতকার্য হতে পারেন না,ক্লান্ত হতে পারেন না,কোনো কিছু ভুলে যেতে পারেন না,অনুতপ্ত বা রাগান্বিত বা দুঃখিত হতে পারেন না,আত্মাবিহীন মানুষ সৃষ্টি করতে পারেন না,ত্রিভুজের কোণগুলো দুই সমকোণাবিহীন রূপে সৃষ্টি করতে পারেন না,অতীতকে বিনষ্ট করতে পারেন না,পাপকাজ করতে পারেন না,আর একটি ঈশ্বর সৃষ্টি করতে পারেন না বা নিজেকে অনস্তিত্বশীল করতে পারেন না।

ত্রিভুজের বিষয়টির উল্লেখ থাকায় বুঝেছিলাম যে,গণিত-ও দার্শনিক আলোচনা-সমালোচনায় বিবেচ্য।

বোর্হেসের গাণিতিক ধারণা পরিষ্কার বুঝলাম না,ত্রিমাত্রিক কবির সাথে একমত যে আপনি আরেকটু বুঝিয়ে বলতে পারতেন।

স্পর্শ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
আমি স্রেফ বলতে চেয়েছিলাম। বোর্হেস চিন্তার যে গন্ডিটা পেরোতে পারেননি, আধুনিক বিজ্ঞান সেটা পেরিয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হলো। অবশ্য এই সময়ের মানুষ হলে তিনি সম্ভবত অন্যভাবে ভাবতেন।

বিস্তারিত নিয়ে নতুন যোগ করা [৩] নাম্বার লিঙ্কটা দেখতে পারেন। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

তারেক অণু এর ছবি

বোর্হেস চিন্তার যে গন্ডিটা পেরোতে পারেননি, আধুনিক বিজ্ঞান সেটা পেরিয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হলো। অবশ্য এই সময়ের মানুষ হলে তিনি সম্ভবত অন্যভাবে ভাবতেন।

মন মাঝি এর ছবি

রাসেলের বহু শত বছর আগে রসরাজ বীরবল সম্রাট আকবরের কাছে রাসেলের চেয়ে অনেক বেশি বোধগম্য একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন। অসীম ঈশ্বর তার সৃষ্টিকে নিজ রাজ্য থেকে বহিষ্কার করতে পারেন না, যা কিনা সামান্য মানুষ সম্রাট আকবর বা যে কোন মানুষ রাজাই পারেন। অতএব....! হাসি

****************************************

স্পর্শ এর ছবি

হা হা হা! বীরবল দেখি চ্রম! দেঁতো হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

লেখা পড়ে কিছুক্ষণ বোঝার চেষ্টার করলাম, পরে মন্তব্যে পড়েটরে বুঝলাম কিছুটা! হাসি

স্পর্শ এর ছবি

এই সংকলনের বোর্হেসের গল্পগুলো সব এমন। ছোট্ট একটা প্যারা। কিন্তু পড়ার পরে ভাবতে ভাবতে দিন যায়।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

অতিথি লেখক এর ছবি

হঠাৎ করেই শেষ করে ফেললেন যে! পড়তে খুব ভালোই লাগছিলো।

-নিয়াজ

স্পর্শ এর ছবি

ধন্যবাদ! ভালোলাগাটা চালিয়ে যেতে চাইলে টীকা অংশের [৩] নাম্বার লিঙ্কটা পড়তে পারেন। আকৃতিতে কম নয় ওটা। হাসি


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

বন্দনা এর ছবি

ইয়ে মানে মাথার এন্টেনার উপর দিয়ে গেসেরে। ইয়ে, মানে...

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলেই তাই! ধর্মের বাড়বৃদ্ধি কার হাতে? অজ্ঞানতা, অক্ষমতা, সীমাবদ্ধ উপলব্ধির হাতে। মানুষের জ্ঞানের পরিধি যত বিস্তৃত হয়, ইশ্বর তত দূর দিগন্তে বিলীন হতে থাকেন। জ্ঞানের এই পরিধিটাকে বিজ্ঞান ক্রমাগত বাড়িয়ে চলে। আর তাই তো ধর্মান্ধরা সবচেয়ে দূরে রাখতে চায় বিজ্ঞানকে, থামিয়ে দিতে চায় বিজ্ঞানের প্রসার। চলুক
- একলহমা

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

পড়লাম। যাই এবার চিন্তা করতে বসি! দেঁতো হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।