এমির কুস্তুরিকার মহাকাব্য । কিস্তি ২ (আন্ডারগ্রাউন্ড)

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: শনি, ৩১/১০/২০০৯ - ১২:১৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ ছবিতে মার্কো আর ব্লেকি এই দুই চরিত্রের মধ্যে এমির পুরা যুগোশ্লাভিয়ার ইতিহাস ঘুটা মেরে দিয়েছেন। শুরুতে দেখা যায় ব্লেকির কম্যুনিস্ট পার্টিতে নাম লেখানো নিয়ে আনন্দমিছিল। ব্যান্ডপার্টি সহযোগে। পরদিন সকালে দেখা যায় নাৎসিরা বেলগ্রাদে বোমা ফেলা ধরছে। একটা চিড়িয়াখানা বোমায় তছনছ হয়ে যায়। চারিদিকে হাউমাউ, আহত প্রাণীদের চিৎকার। ব্যাপক ধরপাকড়। ব্লেকি তার বউকে নিয়ে এক সেলারে আশ্রয় নেয় , সেখানে আস্তানা নেয় আরো কিছু মানুষ। উপরে থেকে যায় দোস্ত মার্কো। বাচ্চা দিতে গিয়ে ব্লেকির বউ মারা যায়। এভাবে বছর ঘুরে যায়। এর মধ্যে যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু মার্কো তাদের সেই খবর দেয় না। সেলারের লোকজন ধরে নেয় যুদ্ধ চলছে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত তারা বেরিয়ে আসে। ততোদিনে আরেকটা যুদ্ধ লেগে গেছে দেশে। গৃহযুদ্ধ।

কুস্তুরিকার কথা তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জানা যায়-

- সারায়েভোর জিপসি পাড়ার কাছাকাছি আমি ছোটবেলা পার করেছি।আমার সিনেমায় তাই জিপসিদের অবাধ বিচরণ । তাদের জীবনযাপন, হাসি তামাশা, মুক্তচিন্তা আমাকে বরাবর মুগ্ধ করে। কিন্তু জিপসিদের উপর অন্যরা খুব নির্দয় ছিল। আমার মনে হয় এই হরিজন হরিজন খেলা ইউরোপে রেসিজম বড় আকারে ছড়িয়ে দিছে।

- জিপসিরা ইউরোপে আছে প্রায় ছয়শো বছর। তারা কোনো বিবাদে যায় নাই। অস্ত্রের তামাশা করে নাই। সার্ব বাহিনীর সাথে তাদের যোগসাজোশের কথাটা বোগাস ছাড়া কিছু না। তারা শান্তিতে থাকতে চায়। তাদের সঙ্গীত অসাধারণ বললে ও কম হয়।

- আমার কোনো বান্ধা জায়গা নাই। আমি প্যারিস, ন্যুয়র্ক, বেলগ্রাদে ঘুরে বেড়াই। সব জায়গা আমার কাছে বিমানবন্দরের মত। আমার জন্ম হারজেগোভেনিয়ার কাছেকাছি। আমার দেশ যুদ্ধের কারণে মানচিত্র থেকে মুছে গেছে। তবে এটা ও ঠিক একজনের জাতি কি- এটা আমাকে খুব একটা টানে না।

- হ্যাঁ বলতে পারেন ফেলিনির সাথে আমার কিছু মিল আছে। আমার চরিত্রগুলা আপনাকে উত্তেজিত করবে। ঠিক ফেলিনিতে ও তাই।

- লোকে কি খাবে না খাবে সেটা আমি বদার করি না। আমার নিজের কিছু জিনিস আছে যা আমি প্রায় প্রতিটা সিনেমায় ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেখাই। আমার দেখাতে ভালো লাগে, ব্যস।

- যুগোশ্লাভিয়া ধ্বংসের পেছনে আমাদের দেশের নেতাদের সাথে এয়ুরোপের তেনাদের ও দোষের কমতি নাই। এখানে মিলোশাভিকের বিরুদ্ধে সরাসরি শ্লোগান না দিলে তোমারে লোকে
মিলোশাভিকের চেলা ঠাউরে নিবে। আমার সিনেমা নিয়ে নানান প্রোপাগান্ডা চলছে। আমার দেশের উপর যে ভয়ানক ট্রাজেডি নেমে এসেছে আমি শুধু তাই দেখাতে চেয়েছি, আর কিছু না।

- আন্ডারগ্রাউন্ডের কাহিনী দেখেন। ১৯৪১ সালের বেলগ্রাড। ছবির শুরুতে জার্মানরা যুগোশ্লাভিয়ায় হামলা চালালো। তারপর শেষে দেখেন , চারদিকে গৃহযুদ্ধ লেগে গেছে। একটা যুদ্ধ শেষ না হতেই আরেকটা যুদ্ধ এসে হাজির।

- ব্রিটিশ সেন্সর আমার মাথা খেয়ে ফেলছে। আমার ‘লাইফ ইজ আ মিরাকল’ এর এক জায়গায় এক বিড়াল একটা কবুতরকে মেরে ফেলে। ওরা বললো এই জায়গা কেটে দিতে হবে। মাথা খারাপ। আমার ছবি থেকে আমি জায়গা কেটে বাদ দিব। আরে এখনো ওদের হাতে লাখ লাখ ভারতীয় আর আফ্রিকানদের মেরে ফেলার রক্তের দাগ। সে জায়গায় সামান্য একটা কবুতর। আর সেটাকে আমার লোক মারে নাই। রাস্তায় মরে পড়ে ছিল।

- সার্ভিয়ার লোকজনকে আমি বোঝাতে চাই- পশ্চিমা মানেই সব ভালো না। তারা আমাকে ভুলভাবে বোঝে। কি করা যাবে , এখানকার লোকে পশ্চিমা গু-কে কেক ঠাউরে খেয়ে লাফাচ্ছে।

- এই যে কর্পোরেট জগৎ , এটারে নয়া বলশেভিক মতবাদ ছাড়া কিছু বলা যায় না।আপনার নিজের কোন কথা থাকতে পারবে না। তাদের কথা মতোন আপনি হাসবেন , কাঁদবেন-নিজের চিন্তা বলতে তাহলে আর থাকলো কি?

- আমার নিজের চিন্তাভাবনা আমি সিনেমায় বাস্তব করে দেখায়ছি।বুঝাতে চেয়েছি এভাবে ও চলা সম্ভব। তবে অনেকে একদমই মানতে চায় না।

‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সিনেমার একটি স্থিরচিত্র

- মারাদোনার বাজে কাজগুলা মিডিয়াতে আসে কেবল। আমি বহু বড় মানুষ দেখছি যারা মারাদোনার কাছে গিয়ে কাঁপে। মারাদোনা ছাড়া একটা মানুষ দেখান আমারে এই পৃথিবীতে ,যাঁকে ঈশ্বর হিসাবে ভাবা যায়। ওই যে গোলটা- ওরা খোঁচা দিয়া চলে, ঈশ্বরের হাত। আমি সত্যি ভাবি, আসলেই ঈশ্বরের হাত।মাঝে মাঝে আমাদের তো আকাশে উড়ান দিতে হবেই , সারাজীবন পিছনে পড়ে থাকলে কেমনে হবে। আমারে সবার মাথার উপর একবার না একবার উঠা লাগবেই। কিন্তু এই যে এতো মাদারফা*র দুনিয়ায় – তোমাকে টেনে নিচে নামানোর জন্যে তারা উঠেপড়ে লেগে আছে। মারাদোনারে খারাপ বলেন, এখন তো টাকা ফেললেই ক্লাব খেলোয়ার কিনতে পারে। অথচ সে সারাজীবন পড়ে ছিল বোকা জুনিয়ার্সে। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জেহাদে মারাদোনার চে ডাকাবুকা আর কেউ নাই। সে সবসময় মাদারফা*রকে মাদারফা*র বলতে ছাড়ে নাই। কেবল ফুটবল দিয়া মারাদোনাকে বিচার করা হলে ভুল করা হবে।

- হলিয়ুডের সিনেমায় মানুষের অনুভূতি দেখনোর বালাই করে না। দর্শকের নার্ভাস সিস্টেম নিয়া তাদের গবেষণা। তাদের চিন্তা কিভাবে আপনি রেভিন্যু বেশি করতে পারবেন ।

- আমার সিনেমার শেষে দুঃখ নাই। সবগুলাতেই শেষ দৃশ্যে - অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল আমি আশা বাঁচায়ে
রাখতে চাই।

- ছবি বানানোর চেয়ে গান নিয়ে থাকতে আমার বেশি ভাল লাগে।ছবি করতে হাজারে হাজারে গ্যাঞ্জাম। গানে আগাগোড়াই শান্তি।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সাধু। সাধু।

মহসীন রেজা

পুতুল এর ছবি

লেখা ভাল হয়েছে।

এখানকার লোকে পশ্চিমা গু-কে কেক ঠাউরে খেয়ে লাফাচ্ছে।

একদম ঠিক কথা।
**********************
ছায়া বাজে পুতুল রুপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ!
!কাঁশ বনের বাঘ!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

শিক্ষানবিস এর ছবি

কুস্তুরিকা-র চিন্তাধারা সাংঘাতিক পছন্দ হইছে। আমি মূলত সিনেমা দেখি নতুন একজন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য। কারণ যাই বলি না কেন মানুষের মনের চেয়ে মহত্তম তো কিছু নাই। সিনেমা মানে তো একজন পরিচালকের মনোজগৎ। সেই জগতে বিচরণের চেয়ে আনন্দের আর কি আছে। এজন্যই সিনেমা দেখার আগে পরিচালককে বোঝার চেষ্টা করি। আপনার লেখার সুবাদে ইনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানা হয়ে গেল। ভাবছি এই সিনেমাটাই নামিয়ে দেখা শুরু করে দেব। পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। দেখার পর আবার মন্তব্য করতে পারি...

অতিথি লেখক এর ছবি

শিক্ষানবিস ভায়া,

কুস্তুরিকার বেশ কিছু সিনেমা ঢাকায় পাবেন। আন্ডারগ্রাউন্ড, ব্ল্যাক কেট য়োয়াট কেট, লাইফ ইজ আ মিরাকল। আর নামাতে চাইলে প্রায় সবগুলা নামাতে পারবেন।

দেখে জানাবেন।

সেলাম।

শুভাশীষ দাশ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।