পদবীতে ছিল না যে হাত

সুমাদ্রী এর ছবি
লিখেছেন সুমাদ্রী (তারিখ: শুক্র, ১২/০৪/২০১৩ - ৭:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।

কুদো বাকাবা যখন সিরিয়াস কোন কথা বলে দীর্ঘক্ষণ ধরে, হাতের সাদা রুমালটি সে কিছু পরপর পেঁচিয়ে ঘোরাতে থাকে আর তখন চোখ দুটো তার উত্তেজনায় প্রবলভাবে কাঁপতে থাকে। প্রায়ই আমি ওর কথা মন দিয়ে শুনিনা। হয়ত শুনছি, টুকটাক জবাবও দিচ্ছি, তারপর হঠাৎ একটা তুলোফুল বাতাসে ঘুরে ঘুরে ওর পেছন দিকে উড়ে যাচ্ছে এটা দেখে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাই, জিজ্ঞেস করে বসি, '' তুমি কি নীল ফুল ভালবাসো, কুদো? '' মাঝে মাঝে মনে হয় ঠিকই সে আঁচ করতে পারে ওর কথাগুলোকে আমি যে খুব একটা গুরুত্ব দিইনা ব্যাপারটা। লম্বা, সুঠাম ছেলেটা। কথা বলতে ভালবাসে বেশ। আমি খুব একটা আগ্রহ না দেখালেও ঘুরে ফিরে সে চলে যাবে তার আফ্রিকান গোত্রপিতার শৌর্য্যের গল্পে। বলবে সে কীকরে তার প্রাচীন প্রপিতামহ ঘাসের বনের ভেতর দিয়ে পথ খুঁজে নিয়ে এইখানে এসে পৌঁছেছিল বহু শতাব্দী আগে, গড়ে তুলেছিল কংদের গ্রাম। বলবে সে সমস্ত যুদ্ধের গল্প যখন তার প্রাচীন পিতামহরা কমই নদীর ওপারে গিয়ে হানা দিয়ে আসত মৌসিদের ডেরায়, আগুন জ্বলে উঠত পাহাড়ে পাহাড়ে, যতদূর জ্বলে যাবে সে আগুনে ততদূর দখলে যাবে তাদের। তারপর পাহাড়, নদী আর পবিত্র বনের দেবতাদের কথা; তাদের দুগুদুগু রীতির কথা। প্রথম দিকে আমি একটু কৌতুহল দেখালেও এখন এসব গল্প আমায় আর বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। আমি হাই তুলি, প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য উসখুস করি। কুদো বলে, '' কং রক্ত বইছে আমার এই শিরায়। আমার জীবন ধন্য যে কং ঘরে জন্ম আমার। মৌসিদের মত নই আমি। দুগুউগু আমার মালিক। ঐ দেখ, ঐ থিয়েরি, কে সে? না সে কং, না দিউলা, না গুরো। কোন আফ্রিকান পদবী নেই ওর। গায়ের রঙটাই শুধু তার কাল। কী লজ্জ্বা! কী লজ্জ্বা! অথচ আমাকে দেখ, আমি কং। আমি দিওমান্দে জাতির গৌরবের অংশীদার।'' এসব বলা শেষ হলে এরপর সে আমায় ধরবে, '' বল, তোমার জাতের কথা, তুমি কোন ধর্মের মানুষ।'' আমি হাই তুলি, কুদোর কথা এড়িয়ে যাই।

তারপরও কুদো এলে আমি বিরক্ত হই না। এই নির্জনতায় অন্ততঃ কথা বলার মানুষ তো আছে একজন। আজও এসেছিল সে। ছেড়ে দিয়েছিল সেই পুরোনো রেডিও। আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, '' কিসে আমি গর্ব করতে পারি, কিসের উপর আমি করতে পারি অহংকার বল দেখি?'' কুদো বলল, '' অবশ্যই তোমার জাতের, পিতৃপুরুষের, সমাজের, ধর্মীয় রীতিনীতির জন্য তুমি গর্ববোধ করবে। এটা আবার কোন প্রশ্ন হল? '' আমার হঠাৎ তর্ক করতে ইচ্ছে হল, বললাম, '' কুদো, আমার জাত, আমার সমাজ, আমার রীতিনীতি এসব তো আমাকে অর্জন করতে হয়নি। তুমি যখন সারা মাঠের সব খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোল দাও, সেই কৃতিত্বটা তোমার, যখন তুমি সারা বছর পড়ালেখা করে পরীক্ষা দিয়ে পাশ কর, সেই ফলাফলটা তোমার অর্জন। এগুলো তুমি এমনি এমনি, না চাইতেই পেয়ে যাওনি। না চাইতেই যেটা পেয়ে গেছ সেটার জন্য অহংকার, গৌরব হবে কেন? আমার শৈশবে, যখন আমি বুঝতে শিখিনি, ভাবতে শিখিনি ভাল করে, আমার উপরে যে আচকানটা চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল সেটার জন্য আমার কোন গর্ব নেই কুদো। তুমি কং নও কুদো, তুমিও হেনরীর মতই একজন। তোমাকে ছোট বেলায় বলে দিয়েছে সবাই তুমি কং, তুমি দিওমান্দে, তুমি দুগুউগু। এটা তুমি নিজে বেছে নাওনি কুদো, ফুটবল খেলায় গোল দেওয়ার মত পরিশ্রম করে অর্জন করতে হয়নি এটি। যা তুমি অর্জনই করলে না তার জন্য কিসের অহংকার তোমার? '' আমি দেখলাম কুদো সাদা রুমালটা হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে কেবল ঘোরাচ্ছে, চোখগুলো কাঁপছে তিরতির করে।

২।

অনেক ছোটবেলায় দূরের এক সংক্রান্তির মেলায় বাবা নিয়ে গিয়েছিল আমাদের তিন ভাইকে। ছোট্ট ভাইটি ছিল তখন একদম ছোট। ওর হাত ধরে রাখতে হত শক্ত করে হাতের মুঠোয়। সংক্রান্তির সে মেলায় এসেছিল সেবার বহু মানুষ। কত খেলা। কত কত মজার খেলনা। মিষ্টি খাবার। গান। কোন ফাঁকে যে ছোট্ট ভাইটি হাতের মুঠো ফস্কে বেরিয়ে গিয়েছিল কেউ টের পাইনি। তারপর সারা মেলা খুঁজেও ভাইটিকে পাইনি আমরা কেউ। আমার মা কত কেঁদেছিল ভাইটির জন্য।! বাবার সাথে কথা বলেনি অনেক মাস। আবার কোন এক সংক্রান্তির মেলা থেকে বাবা ঘরে নিয়ে আসে ছোট আরেকটি ছেলেকে। বাবা বলেছিল মেলায় নাকি ছেলেটি বেড়াতে এসে হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর কত কাণ্ড! বাবা পুলিশে খবর দিয়েছিলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও নাকি দিয়েছিলেন কিন্তু কেউ ছেলেটিকে নিতে আসেনি বাবার কাছে। মানিক দিনরাত কাঁদত ঘরের এক কোনায়। আমাদের সাথে খেলতনা। আমার মা ওকে আদর করে দুধভাত খাইয়ে দিত। মা কাছে এলে ছেলেটা আর কাঁদত না। মানিকের চোখের কোনায় একটা মার্ক ছিল। তারপর বহু বছর কেটে গেল ধীরে ধীরে। সময় বড় দ্রুত কেটে যায়। মানিক আমাদের ভাই হয়ে গেল। সে দাদার সাথে মারপিট করত। বাবা বাসায় ফিরে এসে সে কাহিনী শুনে ওকে চড় মারত গালে। মা'র সাথে ছাদে সে আমসত্ত্ব বানাত। আমার সাথে স্কুলে যেত বগলের তলায় বই-খাতা রেখে। সময় বড় দ্রুত কেটে যায়। আমরা বড় হয়ে যাই। আমাদের সবার চেহারা, গলার স্বর বদলে যায়। মানিকের চোখের কোনার মার্কটা রয়ে যায়। একদিন কোথা থেকে একটা বুড়ো মতন লোক পুলিশের গাড়িতে করে আমাদের উঠোনে আসে। বাবা তাদের নিয়ে বসার ঘরে অনেক কথা বলে। আমরা জানালা দিয়ে দেখি বুড়ো লোকটা একটা ফাইল থেকে অনেকগুলো ছবি বের করে বাবার হাতে দেয়। বাবা ছবিগুলো বারবার দেখেন। জামার আস্তিন দিয়ে অল্পক্ষণ পরপর চোখ মোছেন। মানিকের ডাক পড়ে ও ঘরে। বুড়ো লোকটা মানিককে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ভেতরের ঘরে বিগ্রহের সামনে আমার মা বারবার মূর্চ্ছা যেতে থাকেন।

মানিককে অবশ্য সেই বুড়ো লোকটি নিয়ে চলে যাননি কারণ ততদিনে মানিক অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু মানিক হঠাৎ করে জেনে যায় তার নাম রজতাভ নয়, সোহেল। মা'র সাথে ছোটবেলায় দুপুরে বসে যে কালীঠাকুরের জন্য রক্ত চন্দন বাটত সে সে চণ্ডীদেবী এখন তার আর কে? আমাদের যে ভাইটি সংক্রান্তির মেলায় হারিয়ে গিয়েছিল তার খোঁজ আমরা কখনই পাইনি। ছোট্ট ভাইটির নাম ছিল রজতাভ। আজ তার নাম কী? সে ভজে কার নাম?

৩।

আমার গোরার কথা মনে পড়ে যায় মাঝে মাঝে। গায়ের রঙটি তার গৌর বলেই সবাই ডাকত তাকে গোরা। যে ব্রাহ্ম ধর্মের জন্য সে তর্ক করে মান করে বন্ধুর সাথে, নারীর প্রেমকে করে অবহেলা , যে স্বাজাত্যবোধ তাকে অহংকার দেয় সেই গোরা যখন জানতে পারে আইরিশ দম্পতির ফেলে যাওয়া সন্তান সে, ব্রাহ্মের ঘরে জন্ম নয় তার, রক্তে নেই তার ভারতমাতার বীজ, তখন সে বিমূঢ় হয়ে পড়ে, ধর্মের পৃথিবী, জাতের পৃথিবী ধূলোর প্রাসাদের মত হঠাৎ করে তার সামনে ধসে পড়ে। কুদো তুমি আমাকে বল না আর তুমি কং, তুমি দুগুউগু, দিওমান্দের রক্ত বইছে তোমার শরীরে, ঐ হেনরীর নেই কোন পদবী। কুদো, তুমি, আমি, মানিক, রজতাভ, গোরা, হেনরী- আমরা কেউই আমাদের পদবীগুলো বেছে নিইনি। পদবীগুলোতে আমাদের কারও ছিলনা কোন হাত।


মন্তব্য

চরম উদাস এর ছবি

চলুক
জন্ম একটা র‍্যন্ডম প্রসেস, এই অঙ্ক বুঝতে বুঝতে অঙ্ক করারকেউ বাকি থাকবেনা।

সুমাদ্রী এর ছবি

অনেকে বুঝেও বালির ভিতর নাক গুঁজে বসে থাকে। আসলে সংস্কারের চাদর খুলে ফেললে অনেকে একদম অসহায় হয়ে পড়ার ভয়েই আরও টাইট করে চাদরটাকে পেঁচিয়ে রাখতে চায় শরীরে। ধন্যবাদ।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

কিছু বলবার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। আপাতত আপনার লেখায় মুগ্ধতা জানিয়ে যাই।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সুমাদ্রী এর ছবি

ধন্যবাদ নজরুল ভাই।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

তারানা_শব্দ এর ছবি

আপনি এতো সুন্দর লেখেন আর এতো সুন্দর গান গান আর এতো সুন্দর করে কথা বলেন- কিভাবে?

"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"

সুমাদ্রী এর ছবি

মাইর খাবি। লেখস না কা?

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

তিথীডোর এর ছবি

গান শুনিনি।
তয় লেখা এবং কথার ব্যাপারে সহমত। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

উত্তম জাঝা!

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

সুমাদ্রী এর ছবি

ধন্যবাদ কবি।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

সুমাদ্রী, কেন লিখেছেন আপনি এই লেখাটা? কাঁদিয়ে ছাড়লেন ।

মানুষ কি আজব চিজ, তাই না? যে ক্ষুদ্র মানুষ মানুষকে লেবেল এটে দেয় “সাদা”, “কালো”, “হিন্দু”, “মুসলমান”...সেই মানুষই মেলা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া শিশুকে ভালবাসে হৃদয় উজাড় করে ।

সুমাদ্রী, ভালো থাকুন ভাই ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

সুমাদ্রী এর ছবি

মানুষ এক অদ্ভুত জীব জোহরা আপা। কপালকুণ্ডলাকে কাপালিক যত্নে বড় করেছিল শুধু উপযুক্ত সময়ে তাকে বলি দেবে এই আশায়। হত্যা দিয়ে আমরা উৎসব করি, তুষ্ট করি দেবতাকে। আবার পেট ভরিয়ে এসে বলি, জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। ভাল থাকবেন।

অন্ধকার এসে বিশ্বচরাচর ঢেকে দেওয়ার পরেই
আমি দেখতে পাই একটি দুটি তিনটি তারা জ্বলছে আকাশে।।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

অসাধারন লেখা!!!

উত্তম জাঝা!

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

তানিম এহসান এর ছবি

অসাধারণ একটা লেখা। মোবাইলে আগেই পড়েছিলাম, আবার পড়তে যেয়ে আরও মুগ্ধতা।

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

কিছুই বলার নাই, এই কথাগুলো খুব সহজ, কিন্তু কেউ বোঝে না।

খুব সুন্দর করে লিখেছেন।

রাহী এর ছবি

বিশ্বাস হচ্ছেনা এটা গল্প, মনে হচ্ছে সত্যি ঘটনা কোন।

অসাধারন লেখা।

সায়ন এর ছবি

চলুক

ইমন  এর ছবি

ঠিক মনের কথাগুলো গুছিয়ে লেখা। অসাধারণ চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।