রঞ্জু, তোর জন্য....

সুমাদ্রী এর ছবি
লিখেছেন সুমাদ্রী (তারিখ: সোম, ১৭/০৬/২০১৩ - ১১:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার বিশ বছর বয়সী ভাইপো পরশু সন্ধ্যারাতে সিলিং থেকে ফাঁসীতে ঝুলে হন্তারক হয়েছে নিজের। বছর খানেক আগে কলেজ থেকে ঘরে ফিরেছিল সে ছোট একটা মেয়েকে লাল শাড়ি, কপালে টকটকে লাল সিঁদুর আর হাতে সফেদ শাঁখা পরিয়ে। সেদিন এতটুকু ছেলের সাহস দেখে হতবাক হয়ে গেলেও আমি মনে মনে তার বেশ প্রশংসা করেছিলাম। আমি কোনদিন ওরকম সাহস করতে পারি নি। আমার ভাইপোটির বাবা মানে আমার ভাইটি তার পুত্রবধূর মুখ দেখার মাস দুয়েক পর একরাতে ছটফট করতে করতে মারা গিয়েছিল। দূরদেশ থেকে বেদনায়, শোকে আর্দ্র হয়ে আমি ভাবছিলাম আমার ভাইয়ের একমাত্র ছেলেটা কীকরে তার পিতাকে হারানোর এই শোকটা সামলাবে। অথচ আমার ভাতৃষ্পুত্রটি খুব দ্রুতই সেই শোকের অন্ধকার ঘর ছেড়ে দিয়ে ঊজ্জ্বল দিনে ফিরে এসেছিল। আমি এই সদ্য কৈশোর পেরুনো, সদ্য রেজারে হাত লাগানো ছেলেটির সাহসের তারিফ করতাম খুব। আমার বৌদির জন্য খুব খারাপ লাগত। মা বলত, অচিন্ত্যদা'র মৃত্যুর পর সুনন্দা বৌদি নাকি একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। গতরাতে অরুণ ফোনে যখন খবরটা দিল তখন প্রথমেই আমার মাথায় যে প্রশ্নটি এসেছিল সেটি হল, '' বৌদি এরপর কি বেঁচে থাকবে?'' বৌদিকে আমি কখনও ফোন করে সান্ত্বনা জানাতে পারব না। আমার অতটুকু সাহস করার মত স্পর্ধা নেই। আমার অতটুকু শক্তি নেই।

রঞ্জুর অসম্ভব সুন্দর মুখটা বারবার ভেসে উঠছে আমার চোখে। আমি কয়েকবার ভয়ানক সেই দৃশ্যটা ভাবার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। স্কুলে পড়ার সময় আমাদের বাসার নীচ তলার রনি ট্রেডার্সের এক কর্মচারী ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল। ঐ লোকটার মৃত, ঝুলন্ত শরীরটা দেখে বহুদিন আমি ভয়ে একা ঘুমাতে পারি নি। চোখ দুটো বিশ্রীরকমভাবে বেরিয়ে এসেছিল লোকটার, জিভটাও। লোকটার স্বাভাবিক যে চেহারাটা প্রতিদিন দেখতাম তা এক মূহুর্তে বদলে গিয়ে কী ভীষণ বিভৎস হয়ে গিয়েছিল! রঞ্জুরও সেই একই চেহারা হয়েছিল আমি জানি। বৌদি কি রঞ্জুকে ওভাবে দেখেছিল? কেউ যেন আমাকে দু'দিন পর বলুক রঞ্জুকে তার মাকে ঐ অবস্থায় দেখতে দেয়া হয় নি।

অরুণ জানালো, পুলিশ একটা অপমৃত্যুর কেস করেছে। মৃত্যুর কত কত নাম। স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক। অপমৃত্যু। অপঘাতে মৃত্যু। যে দুর্দান্ত ছেলেটা একটু আগেও প্রাণোচ্ছ্বলতার প্রতীক ছিল, এখন সবাই তাকে বলছে বডি। লাশ। আমার বৌদির কাছে রঞ্জু কোনদিনও লাশ হবে না। আমার এক সহকর্মী জানতে চাইল, আত্মঘাতীর স্বাভাবিক অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া হয় কিনা, মানে রঞ্জুকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করা হবে কিনা। আমার কিছু জানা নেই। মরে গিয়েও মানুষের শান্তি নেই। রঞ্জুকে চিতায় তোলা হবে কি মাটিতে গোর দেওয়া হবে কি সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া হবে, আমি নিশ্চিত এটা নিয়ে কথা উঠবে বিস্তর। কে জিতে যাবে এই তর্কে? রঞ্জুর পুনরুত্থান তো হবে না আর কোনদিনও।

অপমৃত্যু হয়েছে যার তার শরীরটাকে চিরে ফেলে ডোম। আমি চিনি এমন এক ডোমকে। মাছ কাটার মত দুমদুম করে ধামা দিয়ে মৃত মানুষের শরীরটাকে কোপায় সে। হৃৎপিণ্ডটাকে কয়েকটুকরো করে কাটে। মগজটাকেও। মানুষও আখেরে একটা প্রাণীই। বড় পশুকে এভাবে যখন কসাইরা কাটে তখন অনেকে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি। নেপাল ডোম রঞ্জুর শরীরটাকে যখন নির্দয়ভাবে কোপাবে তখন কি ভীড় হবে মানুষের মর্গে। কেউ যেন আমাকে দু'দিন পর বলুক আমার বৌদিকে বলা হয় নি রঞ্জুকে মর্গে নিয়ে যাওয়ার খবর।

কী বিরাট ক্ষতি! গত দু'দিন ধরে এই কথাটিই মনে হচ্ছে কেবল। প্রায়শই মনে হয়, চরম অর্থহীন এই জীবন। একটা বিশাল কূলহীন মরুভূমির বুকে একটা ক্ষুদ্র বালুকণার মত আমার এই অস্তিত্ব। আমার থাকা না থাকাতে এই বিশালত্বের কোথাও কিছু নড়চড় হবে না, কারও কিছুই যাবে আসবে না। তারপরও জানি এই অতি ক্ষুদ্র মূল্যহীন জীবনটা আমার অমূল্য। দ্বিতীয়বার ফিরে আসব না এখানে আর। এই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবীটা শুধুমাত্র বেঁচে থাকলেই বিভিন্নরূপে দেখতে পাবার, স্পর্শ করার, শুনতে পাবার সুযোগ পাওয়া যাবে। রঞ্জু একটা নিভে যাওয়া প্রদীপের আলো হয়ে গেছে সে নিজেও জানে না এখন। যাদের সে দুঃখ দিতে চেয়েছে তারা দুঃখ পেয়েছে নিশ্চিত; তবে এই বিপুল, বিশাল জীবনের কাছে তার মূল্য কতটুকুই বা আর? রঞ্জু হয়ত একদিন সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে পারত যেখানে সে যেতে চাইত খুব। আমেরিকায়। রঞ্জু হয়ত তার সন্তানকে কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আসতে পারত বিকেলের ফসলের মাঠ। অনেক কিছুই হতে পারত। যদিও বা নাও পারত ক্ষতি হতনা কোথাও। কোন কিছুই তো আর পারফেক্ট নয়রে রঞ্জু, অবিমিশ্র সুখ বলেও কিছু নেই কোথাও। কী বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল তোর বুঝতেও পারলি না রে বোকা। গলায় যখন ফাঁসটা চেপে বসছিল তখন কী মনে হয়েছিল তোর তা এখন খুব জানতে ইচ্ছে করে।

কোন কিছুর সাথে তুলনীয় নয় একটা জীবন হেলায় খোয়ালি রঞ্জু!! কত বড় গর্দভ তুই নিজেও জানলি না।


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

...

মৃত্যুময় ঈষৎ এর ছবি

.......................

একটা মানুষকেও একা ছাড়া যাবে না। কাউকে না কাউকে ছায়ার মত অদৃশ্যের মত পাশে থাকতে হবে, মানুষের ঘোর বড় অচিন! মানুষরে বড় ভালোবাসতে হয়!

( এই পোস্টে কোন শব্দ-মন্তব্য আসে না, মন্তব্যের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী!)


_____________________
Give Her Freedom!

অতিথি লেখক এর ছবি

প্লীজ প্লীজ বলুন যে এই লেখাটা একটা গল্প। আর দুঃস্বপ্ন দেখতে ভাল লাগেনা- নিশিতা

অতিথি লেখক এর ছবি

একবছর আগে বান্ধবীর নাইনে পড়ুয়া ভাই এভাবেই নিজের জীবন শেষ করেছিল, কেন যে এরা বুঝে না, জীবনের চেয়ে অমূল্য কিছুই নেই, মনটা খারাপ হয়ে গেল।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

মাথাটা ফাঁকা মনে হচ্ছে ! কিছু ভাবতে পারছিনা।।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

ইস, কেন যে এভাবে ঝরে যায় তাজা প্রাণ। কে বোঝাবে যে মৃত্যু এমনই একটি অপরিবর্তনীয় প্রক্রিয়া যে এর কোন না কোন বিকল্প না থেকেই পারেনা।

অগ্নির এর ছবি

আমিও খুব দ্রুত এই কাজটা করব । বেঁচে থাকাটা খুব ক্লান্তিকর হয়ে যাচ্ছে আমার জন্য ।

মরুদ্যান এর ছবি

অফ যা

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

খুব দুঃখ পেলাম! মন খারাপ

একেকটা মানুষ কি অসীম ক্ষমতা নিয়ে আসে, দুনিয়াকে বদলে দেবার। খুবই খারাপ লাগে যখন অকালে কেউ চলে যায়।

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

eva এর ছবি

khub valo legeche apnar lekhata....moner moddhe kemon kore othe jeno emon khobor pele....kichudin age khobore sunechi ek baba tar chele ebong strike mere feleche...baba tar cheleke merechilo baseball bat diye mathay aghat kore kore...drishow ta kolpona korte chaile amar matha awla hoye jay bar bar....manusher jibon asholei ki orthohin...tobuo beche thakar ki durnibar icche amader....valo thakben

guest_writer এর ছবি

সুমাদ্রী, এটা নিশ্চয় একটা গল্প, তাইনা?

রানা মেহের এর ছবি

রঞ্জুর মা কেমন আছেন এখন?

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

মেঘনাদ এর ছবি

আমারও ইচ্ছা করে এরকম সব জেগে থাকা ছুঁড়ে ফেলে লাশ কাটা ঘরে আরামের ঘুম দিতে। সাহস হয় না

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।