কাসেলের চিঠি ১

সুমন চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন সুমন চৌধুরী (তারিখ: মঙ্গল, ২২/০৯/২০০৯ - ১১:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

আর মাত্র চারদিন। আগামী রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানীর সতেরতম সাধারণ নির্বাচন। মনুষ্যসমাজের আর দশটা নির্বাচনী রাজনীতিভিত্তিক রাষ্ট্রের মতো জার্মানীতেও সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচনী রাজনীতি সম্পর্কে একধরণের সাধারণ হতাশা বিরাজ করে। সাধারণ মানুষ বলতে অবশ্যই নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলছি। জার্মান নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী পুঁজিবাদী বিশ্বে বৃহত্তম না হলেও বৃহত্তমদের অন্যতম বলা যেতে পারে চোখ বুঁজেই। তবুও শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের নিয়মে খেটে খাওয়া দরিদ্ররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। নির্বাচনে এদের অংশগ্রহণ এক ধরণের ঐচ্ছিক পিকনিকের মতো। ভোট দিলে দিলাম না দিলে নাই দৃষ্টিকোণ থেকে এখনো খেটে খাওয়া মানুষেরা নির্বাচনকে দেখে থাকে। যে কারণে জন্যসংখ্যার খুব বড়ো একটা শতাংশ ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করে না।

মোটামুটি সারা পৃথিবীর ভোটের রাজনীতির গড়পড়তা হিসাব এরকমই। নির্বাচনী রাজনীতির চানাচুর আলাপে আগ্রহ দেখা যায় খবরের কাগজের পাঠক আর রেডিও-টেলিভিশনের দর্শক শ্রোতা শ্রেণীর বৃহত্তর অংশের কাছে। এঁদের মধ্যে নিচের দিকে আছেন নিয়মিত-অনিয়মিত পেশাজীবিরা, আছেন নিয়মিত শ্রমিকেরা অর্থাৎ এখনো যারা চাকরি খোয়ান নাই, আছেন সদ্য চাকুরি খোয়ানো বেকারভাতা প্রাপ্তরা, আছেন চিরদিনের অস্থায়ী শ্রমিকরা আর বিশাল সংখ্যার তালিকাবহির্ভূত শ্রমিকরা। এরপর নিচ থেকে উপরের দিকে উঠতে উঠতে ভার্টিগো রোগাক্রান্তদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নির্বাচনী রাজনীতির গলাবাজী আর্থ-সামাজিক বিভাজন সাপেক্ষে এখানে বিভাজিত চেহারায় বিরাজ করে। জার্মান রাজনীতি, ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে হেজিমনিক অবস্থান থেকে দেখা বিশ্ব রাজনীতির পরস্পরবিরোধী বিশ্লেষণী চিত্রগুলি এদের অবস্থান থেকেই আসে। নিরপেক্ষতার মতো পবীত্র পারিভাষিক অবস্থান সেখানে অনুপস্থিত। এদের একজন হিসাবে জার্মান নির্বাচনের প্রাক্কালে কয়েক দিনের খানিক নির্বাচনী কচকচির উদ্দেশ্যে বর্তমান সিরিজ শুরু করলাম।

২.

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী চার দশক ধরে কল্যাণমুখী পুঁজিবাদের পরাকাষ্ঠাধারী জার্মান মডেল সামজতন্ত্রী নিন্দুকদের মুখে ঝাঁটা মেরে বিশ্বকে দেখিয়েছে, পুঁজিবাদী অবকাঠামোর ভেতরেও রাষ্ট্র কীভাবে উচ্চ মজুরি, জীবনযাত্রার উন্নততর মান এবং সার্বজনীন সমাজ কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে। ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের প্রতিদ্বন্দ্বি পূর্ব জার্মানীকে আত্মস্থ করাকেও নব্বুই দশকের শুরুতে জার্মান মডেলের রাজনৈতিক বিজয় হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। নতুন শতাব্দী শুরু হতে হতে নব্বুই এর শেষ নাগাদ তাতে সংশয় দেখা দিতে শুরু করে গত সাত বছরে ক্রমশ গাঢ়তর সঙ্কটের মুখ দেখছে। দীর্ঘদিন অতিউচ্চ উৎপাদন মাত্রায় বিচরণ করার কারণে ত্রাহি ত্রাহি হাল না হলেও ক্রমবর্ধমান শ্রমিক ছাটাই, কর্মঘন্টার অনুপাতে মজুরি হ্রাসের ঘটনাগুলো প্রান্তিক সামাজিক শ্রেণীকে ইতিমধ্যেই নাড়া দিয়েছে। এই নাড়া দেবার মাত্রা বাংলাদেশের মতো দারিদ্রসীমার বাইরে থাকা প্রাক-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতে সুড়সুড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু পুঁজিবাদী উৎপাদনের ধ্রুপদী প্রাণকেন্দ্র, ভারীশিল্পে অতিদীর্ঘকাল একচেটিয়া উপভোগকারী জার্মানীর প্রাণ সঙ্কট তৈরী করছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। আশঙ্কাটি অমূলক হবার সম্ভাবনা হয়তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবুও বিষয়টি এই মুহুর্তে অন্তত পশ্চিম ইউরোপের অন্তত অ্যাকাডেমিক সারফেইসে বহুল আলোচিত।

১৯৪৯ সালে ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানী জন্ম নেয় ভাইমার রিপাবলিকের মার্কিন,বৃটিশ আর ফরাসী দখলে থাকা জমিনে, বলা যায় প্রুশিয় সাম্রাজ্যের শিল্পোন্নত এলাকার প্রায় পুরোটা নিয়ে। জার্মান সোশাল ডেমোক্র্যাসীর মডেল তৈরীর মৌল উপাদান ছিল খৃষ্টীয় গণতন্ত্র(!) বা তথাকথিত ট্র্যাডিশনালিজমের সাথে তখনকার বাকি দুই আধুনিক প্রতিদ্বন্দ্বী পুরো পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের একধরণের আপোষরফা। এই আপোষরফার বিপরীতে ছিল দীর্ঘদিন কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শ্রমিক আন্দোলন। জার্মান শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক দাপটের কারণে ২য় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী জার্মান রাজনীতিতে দীর্ঘদিন মধ্যবিত্ত আর শ্রমিক শ্রেনী ছাড়া আর কারো অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। বিশেষ করে, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রভাব-লবি ইত্যাদি থাকলেও সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না। রাজনীতিতে ধর্মের নামনিশানাও ছিলনা ভাইমার রিপাবলিক এবং জাতীয় সমাজতন্ত্রী জার্মানীতে। মার্কিন-বৃটিশ-ফরাসী নিয়ন্ত্রণাধীন পশ্চিম জার্মানী ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের এবং ১৮৪৮ সালের বেয়াদব বিপ্লবীদের শায়েস্তা করতে গণতন্ত্রের আগে একখানা ক্রিশ্চিয়ান জুড়ে দিয়ে তৈরী করেন বর্তমান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। এর পর থেকে আমেরিকা-বৃটেনের মডেলে একটা উদার আর একটা রক্ষণশীল মডেলে অনেকদিন পর্যন্ত চলেছে উচ্চবিত্তের স্বস্তির স্বারক দ্বিদলীয় ভোটের রাজনীতি। কিন্তু উনিশ শতকের আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক ভাংচুর এবং দুটো বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস শেষ পর্যন্ত জার্মান রাজনীতিকে অ্যাঙলো-স্যাক্সনদের ক্রিয়াবাদী সমাজের মতো স্বস্তিকর থাকতে দেয়নি। ক্রমশ রাজনৈতিক বিরোধ বিভাজনের ঊর্ধ্বগতি এখানকার রাজনীতিকে জটিল করে তুলতে থাকে। ১৯৯০ নাগাদ সমাজতান্ত্রিকব্লকের পতন এই জটিলতার অবসান ঘটাবে বলে অনেক সফেদ ছাগুর শিঙে যে আকাঙ্খা ঘুরপাক খাচ্ছিল সাবেক পূর্বজার্মানীর পৃথক বাস্তবতার মিথস্ক্রিয়া কার্যত: ঐ জটিলতায় নতুন মাত্রা যোগ করে।

৩.

এই জটিলতা সম্পর্কে একটা সাধারণ চিত্র পেতে গেলে জার্মান রাজনৈতিক দলগুলি সম্পর্কে একটা হুমেইডহু বয়ানের প্রয়োজন। আগামী কিস্তিগুলিতে সেগুলি আলোচনার ইচ্ছা থাকলো।

ছবি : ২০০৫ সালের ফলাফল .....কৃতজ্ঞতা গুগল


মন্তব্য

তানবীরা এর ছবি

তেহারী খাইলে বোধ হয় এতো জ্ঞান হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিই বুঝিই না আর বদ্দা জর্মন রাজনীতি বুঝায়, যাই কই......।..।.......।।...ঃ) ঃ) ঃ)

**************************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

shohag এর ছবি

কাগু অনেক দিন পরে তোর লেহা পইড়া আরাম পাইলাম। পরের কিস্তির অপেক্ষায়।

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

ঢোঁক গিল্লাম। এট্টু পরে আবার টেরাই মারতেছি।

অটঃ আপনের পোস্টে পাচানোর অনেক শখ ছিলো বদ্দা দেঁতো হাসি

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

দময়ন্তী এর ছবি

সাগ্রহে নজর রাখলাম৷
-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

Milon [অতিথি] এর ছবি

Tui to dehi valoi lehos. ami ai porjonto ai blog kichu porar sujog pai nai. tobe valo laglo.

তীরন্দাজ এর ছবি

দারুন পর্যালোচনা! বয়ানের অপেক্ষায় রইলাম।

মধ্যবিত্তদের মাঝে যে গভীর রাজনৈতিক উদাসীনতা দেখছি, ততটা আগে ছিলনা। আমার অফিসে কাউকে ইলেকশন নিয়ে ভাবতে দেখিনা। এমনকি সিডিউর আনগেলা মার্কেল আর এসপিডির স্টাইনমায়ারের বিতর্কও খুব দেখেছে বলে মনে হলোনা। মনে হয়, অর্থনৈতিক সংকট ওদের আগ্রহকে স্তিমিত করেছে অনেকখানি। কোন রাজনৈতিক দলকেই বিশ্বাস করতে পারছে না জার্মানরা। সেজন্যে ভোটও অনেক কম পড়বে এবার।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

হাসিব এর ছবি

মনে হয়, অর্থনৈতিক সংকট ওদের আগ্রহকে স্তিমিত করেছে অনেকখানি।

আমার হিসেবে উল্টাটাই হবার কথা । পকেটে টান পড়লেই মানুষ খুঁজতে বের হয় সরকার কি করতেছে যে তার পকেটে কড়ি নাই ! যেসব দেশে দেখবেন মানুষ দুধে ভাতে থাকে তাদের রাজনীতি নিয়ে আগ্রহও কম থাকে । এইটা মোটাদাগের জেনারালাইজেশন মনে হৈলেও পশ্চিম ইউরোপ আর নর্ডিক দেশগুলোতে সত্য বলে আমার ধারনা ।

তীরন্দাজ এর ছবি

আমার মনে হয় না। জরিপেই বলা হচ্ছে যে, এবার গতবারের চেয়ে তুলনামূলক কম ভোট পড়বে। এখানকার মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার চেয়ে নিজস্ব আত্মিক ও সামাজিক সচেতনতা অনেক বেশী। সেকারনেই এই সমাজের একটি বিরাট শিক্ষিত অংশ দলের নামের উপর নির্ভর না করে রাজনৈতিক প্রোগ্রামের দিকে নজর রাখে বেশী। অর্থনৈতিক মন্দা ও রাষ্ট্রীয় ঋণের বোঝা এতো ভারী যে, কোন দলই সঠিক প্রোগ্রাম দিতে পারে নি। একেবারে দলীয় সমর্থক ছাড়া, অনেকেকই 'মন্দের ভালো' খুঁজেই ভোট দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এক ধরণের অবিশ্বাস কাজ করছে এদের ভেতরে। ভেতরের এই অবিশ্বাস নিয়ে সচেতন যারা, তারা ভোটকেন্দ্রে এবার কিছুটা কমই যাবেন।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

দ্রোহী এর ছবি

যথারীতি একটা অপ্রাসংগিক প্রশ্ন করি: বদ্দা কি অদূর ভবিষ্যতে জর্মন দেশে ভোটে খাড়াইবেন নাকি?

হাসিব এর ছবি

এই জায়গায় এনপিডি নামে একটা পার্টি আছে । হেরা শুনলাম সব বিদেশী বংশোদ্ভুত রাজনীতিবিদগো চিঠি দিতেছে কিভাবে তারা জার্মান দেশ ছাইড়া চইলা যাইতে পারে সেই উপদেশ দিয়া । সুমঞ্চৌ খুব তাড়াতাড়ি এই জাতীয় চিঠি পাইতে চায় বৈলা মনে হয় না ।

Shahidul Mamun এর ছবি

It would be quite interesting to see how the German nationalists respond to the post-war pan-Germanism in a changed century. It might be platitudinous to say that Germany was born in 1872 as an artificial state out of the need for the newly emerging capitalists who saw it an opportunity to cash on a weakening Monarchical hold on small German-speaking principalities.

I am sure that the presence of Suman Choudhury in Germany and his first-hand experience of the forthcoming election will provide us with some fresh insight.

I have a few doubts though. I throughly enjoyed a young Bangladeshi's views of German political scene as described in the first section of the writing. However, the first para on the second section, the so called 'success' of the economic model should have raised a few eyebrows - including the auther's. I would like to hear more of the artificiality of such an economy at the expense of large amount of taxpayers' money from the western countries - money's that were siphoned into German economy through various means. In fact, the German industrial "success" looks really grim in the face of a virtual absence of large overseas "markets" [Germany 'can not' have any more territorial gains] and in the possibility of demise of western backing.

Regarding the comments on the German political parties it should be noticed that German political parties are probably the most hierarchically rigid of all the European parties. It is no wonder that Germany is still referred to as a "Party State" where formation of political parties are methodically controlled through legislative means. Imagine a state where legislation still exists where formation of political parties based on ideological basis is still forbidden under the constitution.

Shahidul Mamun

হিমু এর ছবি

কন্ট্রোল + অল্ট + ইউ বা কন্ট্রোল + অল্ট + পি চাপলে বাংলা লেআউট পাবেন দুই ধরনের। বাংলায় আপনার মূল্যবান মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ।

যথাসাধ্য চেষ্টা করবো মোটামুটি একটা গড়পড়তা চিত্র দাঁড় করাতে।



অজ্ঞাতবাস

সিরাত এর ছবি

ভাল লাগলো সুমন ভাই।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।