ঘুরে এলাম সিঙ্গাপুর (পর্ব - ৪)

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি
লিখেছেন সৈয়দ আখতারুজ্জামান (তারিখ: বিষ্যুদ, ২১/০৮/২০০৮ - ১২:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


মি. লী কুয়ান ইউ এবং অন্যান্য
সিঙ্গাপুর ভ্রমণ সার্থক - একথা বলতে গিয়ে যে ঘটনাগুলো আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তার অধিকাংশই আজকের ঘটনা। একের পর এক ঘটে গেছে, টের পাই নি কখন সময় কেটে গেছে। সকাল আটটায় হোটেল লবিতে নেমে দেখি ড্যানি অপেক্ষা করছে। আমরা দ্রুত বাসে উঠলাম। আজকে ভ্রমণের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন এ কথা বলতে একটুও দ্বিধা নেই। সবার ভেতরেই একটা অব্যক্ত উত্তেজনা বিরাজ করছে। একটু পরেই আমাদের সাথে দেখা হবে কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব মি. লী কুয়ান ইউ - এর। আধুনিক সিঙ্গাপুরের স্থপতি মি. লী কুয়ান ইউ। তার সম্পর্কে আমরা সবাই-ই জানি, এখানে বিস্তারিত কিছু বলার আছে বলে মনে করি না। ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুরের স্বাধীনতা লাভের পর মি. লী’র জাতিগঠনমূলক ফর্মুলার সূত্র ধরে গড়ে ওঠে সিঙ্গাপুর। আজকের বিশ্বে অর্থনীতিবিদগণ যে সিঙ্গাপুরকে 'মডার্ণ মিরাকল' বলেন এর অন্যতম প্রধাণ কারণ মি. লী। এর ভেতরকার কাহিনী আরো অনেক লম্বা। যেখানে তার সুনাম, বদনাম দুই-ই আছে। একটা ডায়ালগ সেশনে তিনি আসবেন যেখানে আমারও আমন্ত্রিত অতিথি। সানটেক সিটির কনফারেন্স হলে প্রোগামটার আয়োজন করা হয়েছে। ঠিক দশটায় তিনি কনফারেন্স হলে প্রবেশ করলেন।

ডায়ালগ সেশনে আধুনিক সিঙ্গাপুরের স্থপতি মি. লী কুয়ান ইউ (বামে)

মি. লী টানা দেড় ঘণ্টা কথা বললেন আর আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম। তার জীবন দর্শন আর সিঙ্গাপুরের ভবিষ্যতে করনীয় দিক নিদের্শনামূলক বক্তব্য একসাথে বলে যেতে লাগলেন। এমন ভঙ্গিতে যেন নিজ ড্রইংরুমে বন্ধুদের সাথে গল্প করছেন। এত অনবদ্য আর হাস্যকৌতুকমিশ্রিত তার বক্তব্য! ভারি কন্ঠে এক সময় গমগম শব্দ তুলে কনফারেন্স হল কাঁপিয়ে তুললেন, তারপর অনেকক্ষনের নিরবতা, আবার মুখ খুললেন। আবার গল্প বললেন, ঐতিহাসিক কিছু ঘটনার স্মৃতিচারণ করলেন, বললেন কিভাবে আগামীকে দেখতে শিখেছেন এবং শিখছেন প্রতিদিন পৃথিবীর পাল্টে যাওয়ার রহস্য। বললেন, জীবনে সুশৃংখল থাকার গুরুত্বের কথা, নিজের জীবন কতটা বিশৃংখল ছিলো সে কথা বলতেও দ্বিধা করেন নি। অকপটে বলেছেন, তার নানা সময়ের বদ অভ্যাসের কথা। তিনি এক সময় চেইন স্মোকার ছিলেন এবং পরে অনুধাবন করেছেন এর অপকারিতা কতো। হয়ত সে কারনেই সিঙাপুরে সিগারেট নিয়ে আছে মারাত্মক কড়া আইন। যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়ার কোনো উপায় নেই। ধরা পরলে ততক্ষনাত ২০০ ডলার জরিমানা। নির্ধারিত জায়গা আছে, যেখানে এ্যাশস্ট্রে রাখা, সেখানে দাঁড়িয়েই খেতে হবে। সিগারেট খেয়ে অবশিষ্ট অংশ ফুটপাতে বা অন্যকোন স্থানে ফেললেও জরিমানা। আমি যতোটুকু সম্ভব তার বক্তব্য ভিডিও করেছি। প্রোগ্রাম শেষ হলো কিন্তু লী কুয়ান ইউয়ের কথাগুলো তখনও কানে বাজছে। এখনও বাজে।

ফাউন্টেন অফ ওয়েলথ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঝরণা

আমরা সানটেক সিটি ঘুরতে বের হলাম। মনেপড়ে গেলো সিঙ্গাপুরের দুটি অনন্য আকর্ষণতো এখানেই। প্রথমত ফাউন্টেন অফ ওয়েল্থ, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঝরণা । ১৯৯৮ সালে গিনিজ বুক অফ রেকর্ডসে স্থান করে নেয় এটি। ১৩.৮ মিটার উঁচু ব্রোঞ্জের তৈরি বিশাল এই ঝরণা প্রতিদিন হাজারো দর্শককে মোহিত করে রাখে। এই ঝরণার নানা অংশের নানা অর্থ আছে। যেমন পানির দুটো অর্থ এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে। একটা হচ্ছে - পানি মানে জীবন আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে - চীনা সংস্কৃতিতে পানি মানে সম্পদ। চীনাদের মধ্যে কথিত আছে যে, যদি কেউ তিন বার এই ঝরণা প্রদক্ষিণ করে এবং প্রত্যেকবার পানি স্পর্শ করে তাহলে কিছু ভালো ফল অবশ্যই পাবে ! দিনের বিশেষ একটা সময়ে ঝরণা বন্ধ থাকে তখন লোকজন ঝরণার বেদির ওপর উঠে চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, ছবি তোলে, কেউ পানি স্পর্শ করে ইত্যাদি।
আর দ্বিতীয়ত আকর্ষণ হচ্ছে সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় শপিংমল - সানটেক সিটি মল। যার আয়তন ৭৭ হাজার বর্গমিটার। খুব দ্রুত সবাই মিলে একটা চক্কর লাগালাম সানটেক সিটি মলে। খোদা তালাই শুধু জানেন এর শেষ কোথায় আর শুরু কোথায় আর কত হাজার দোকান এর মধ্যে আছে।

সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় শপিংমল, সানটেক সিটি মলের ভেতরে

এরপর আমরা সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত র‌্যাফলস্ এবং গ্লেনিগেল্স হাসপাতাল পরিদর্শন করতে গেলাম। র‌্যাফলস হাসপাতালটা আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে কেকেএইচ, তারপরই র‌্যাফলস হাসপাতাল। সবচেয়ে বেদনাদায়ক লেগেছে ন্যাশনাল ক্যান্সার হাসপাতাল। আমি একান্ত বাধ্য না হলে হয়ত কখনোই আর কোনো ক্যান্সার হাসপাতালে যাবো না। (কে জানে নিজের কপালে খোদা কী লিখে রেখেছে!!!)। র‌্যাফলস্ হাসপাতালে ঢুকতে গিয়ে প্রথমেই নজরে পড়লো নিচতলার দারুণ সুন্দর একটা পিয়ানো। হাসপাতালে পিয়ানো কেন? ড্যানি জানালো, অপেক্ষমান অতিথিদের জন্য বাজানো হয়। কী অপুর্ব আইডিয়া!

র‌্যাফলস্ হাসপাতালের নিচতলায় রাখা পিয়ানোর সামনে

বিশেষ বিশেষ বিভাগগুলো ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। হাসপাতালের রুমগুলো এতই সুন্দর যে মনেহলো ফাইভ স্টার হোটেলের ডিলাক্স রুমকেও হার মানাবে। সবচেয়ে মজার লাগলো র‌্যাফলস্ এ্যাসথেটিকস্ বিভাগ, যেখানে বডি ম্যাসেজের মাধ্যমে শরীরের নানা ধরনের রোগ সারিয়ে তোলা হয়। বডি ম্যাসেজের জন্য, বলা ভালো ত্বকের চিকিৎসার জন্য, যতো ধরনের আয়োজন হতে পারে মনে হলো তার সবই এখানে আছে। বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, ধনাঢ্য ব্যাক্তিত্ব, বিশ্বখ্যাত সেলিব্রেটিরা সব ধরনের লোকেদেরই আগমন এখানে। কেউ ফিজিওথেরাপীর জন্য আসে, কেউ কসমেটিক সার্জারীর জন্য, কেউ বার্ধক্য রোধের চিকিৎসার জন্য, কেউ ওজন কমানোর জন্য, কেউ আসে স্থূল স্তন আকর্ষণীয় করার জন্য অথবা উল্টোটা, কেউ কসমেটিক ডেন্টিস্ট্রির মাধ্যমে হাসি সুন্দর করার জন্য, এ রকম আরো কত কী! ক'টা বলবো। এই বিভাগের মোট ৫ টি ক্যাটাগরীতে প্রায় ৩০ টিরও বেশি এ রকম সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে। এতো গেলো শুধু একটা বিভাগ এমনি প্রত্যেকটা বিভাগ সম্পর্কে হাজারো তথ্য দেয়ার আছে।

র‌্যাফলস্ এ্যাসথেটিকস্ বিভাগের একটি কেবিন

২০০২ সালে হাসপাতালটি উদ্বোধন হওয়ার পরে মূলত সারা বিশ্বে আলোচিত এবং সমালোচিত দুটোই হয় যখন ২০০৩ সালে লাদান বিজানী আর লালেহ বিজানী নামে দুই জমজ বোনের জোড়ামাথা আলাদা করার অপারেশান হয়। আমাদের দেশেও পত্র পত্রিকাগুলো এই বিখ্যাত অপারেশানের খবর প্রথম পেইজে ফলাও করে ছেপেছে। অপারেশানটি করেন এই হাসপাতালেরই একজন বিশ্বখ্যাত নিউরো সার্জন ড. কেইথ গোহ। আমাদের সাথে সেই অপারেশানে অংশ নেয়া আরেক বিখ্যাত নিউরো সার্জনের দেখা হলো। তার নাম এখন নাম মনে আসছে না। পরে যদিও অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে লাদান বিজানী আর লালেহ বিজানী দুবোনই মারা গিয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে দক্ষিণ কোরিয়ার আরেক জমজ মিন জি হে এবং মিন সা র‌্যাংদের জোড়া মেরুদন্ড (মূলত লোয়ার ষ্পাইন) সফলভাবে আলাদা করতে পারায় হাসাতালটি আবার তার হারানো সম্মান ফিরে পায়।

হাসপাতালের প্রফেসররা তাদের বিজয় গাঁথা আমাদের শোনালেন, পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশানে নানা জটিল অপারেশনের ছবি এবং কিভাবে এসব জটিল সমস্যার সমাধান করা হয় সেসব দেখালেন। আর আমরা সত্যিকার অর্থেই হা করে শুনছিলাম। যাই হোক, সে নানা ইতিহাস নানা গল্প। অন্য লেখায় সময় নিয়ে বলা যাবে।
দুপুরে লাঞ্চ করলাম হাউজ অফ সানডানীজ নামে একটি ইন্দোনেশিয়ান রেস্টুরেন্টে। গরুর লম্বা হাড়ের ভেতর থেকে শাস বের করে খাবার দারুণ কৌশল দেখলাম এখানে। হাড়ের মধ্যে একটা স্ট্র ঢুকিয়ে দেয়া আছে, খুব সহজেই কোনো প্লেটের মধ্যে বাইরাবাইরি করা ছাড়াই আরাম করে খাওয়া যায়।

আমরা খাওয়া শেষে বিশেষ প্রস্তুতি নিলাম সান্তোসা আয়ল্যান্ড যাওয়ার। সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে বড় আকর্ষন। অন্তত আমার কাছে তো বটেই। আমি ক্যামেরায় নতুন মেমোরি কার্ড লোড করলাম।

(সান্তোসা আয়ল্যান্ডের গল্প আজকে বলা হলো না। পর্ব ৫-এ আসছি সেই রোমাঞ্চকর কাহিনী নিয়ে। ততক্ষন থাকুন সচলের সাথেই)


মন্তব্য

কীর্তিনাশা এর ছবি

দারুন বর্ননা, খুব ভালো লাগলো। তবে মি. লী কুয়ান ইউ সম্পর্কে আরো জানতে চাই। এ ব্যাপারে আলাদা পোস্টের দাবী জানাচ্ছি।
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

লেখা খুবই ভাল হচ্ছে আখতার ভাই। ভাল লাগছিল পড়তে।

--------------------------------------------------------

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

চারটা পর্বই বেশ হাওচি (সুস্বাদু) হয়েছে ,,,,
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

সবাইকে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। পর্ব ৫ নিয়ে আসছি শীঘ্রই।

মুশফিকা মুমু এর ছবি

বাহ ঝরনার কথাটা জানতাম না হাসি পিয়ানোর আইডিয়াটাও ভাল হাসি
আমরা যেবার সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম তখন কোথায় শপিং এ গিয়েছিলাম জানিনা, এতটা মনেও নেই। আপনার সব পড়ে ছবি দেখে যেতে ইচ্ছা করছে। ভাল লাগল এ পর্বও।
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

যথারীতি ভালো লাগল এই পর্বটাও। কি অত্যাধুনিক ব্যাপার স্যাপার সব! তবে মিঃ লী কুয়ান ইউ সম্পর্কে আলাদা একটা পোস্ট চাই। পাবো আশা করি হাসি
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।