পর্ব ৩: জাকার্তার বাণিজ্য মেলা, বইয়ের বাজার আর সুরাবায়ার পাখি

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি
লিখেছেন সৈয়দ আখতারুজ্জামান (তারিখ: শনি, ২৬/০৪/২০১৪ - ৯:৪১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকে জাকার্তার তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রী। সকাল থেকে তেতে উঠেছে রোদ। আকাশ নীল। এক খন্ড মেঘও নেই কোথাও। গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ছে না। পাথর বসানো খোলা রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে গিয়ে মনে হচ্ছে রিফ্লেকটরের ওপর দিয়ে হাঁটছি। চামড়া পোড়া রোদ চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসছে।

হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করে দেখলাম এ শহরে পাবলিক পরিবহন খুবই কম। বাস বহুক্ষণ পর পর দু'একটা চোখে পড়ছে। তাও অদ্ভূত দেখতে। বাসের দরজা অনেক উঁচুতে। বুঝতে পারছিলাম না, এই বাস থেকে যাত্রিরা নামবে কী করে! ভেতরে কি কোন সিঁড়ি আছে প্লেনের মতো! আর এত ঝক্কিই থাকবে কেন! ভাবতে ভাবতে এক বাসস্ট্যান্ডের কাছে চলে আসতেই সব পরিস্কার হয়ে গেল। বাসস্ট্যান্ডের প্ল্যাটফর্ম বেশ অনেকটা উচুঁতে। এবং বাম দিকে নয়, ডান দিকে । বাসের দরজা প্ল্যাটফর্ম বরাবরই আছে। তার মানে হলো, যাত্রীদের প্ল্যাটফর্ম ছাড়া হুট হুাট করে চলন্ত বাস দিয়ে লাফিয়ে নামার কোন সুযোগ নেই কিংবা রাস্তা দিয়ে হঠাৎ লাফিয়ে বাসে ওঠারও কোন সুযোগ নেই। যাত্রিদেরকে লাইন ধরে বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে হবে। বাস আসবে, আগে যাত্রিরা নামবে, তারপর একে একে উঠবে, শূন্য সিটগুলো ভরে গেলে বাস দরজা বন্ধ করে দেবে। অপেক্ষমান বাকি যাত্রিদেরকে পরবর্তী বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

জানিনা হয়ত এ কারনেই কিনা, জাকার্তায় বেশির ভাগ সাধারণ মানুষেরই নিজস্ব চলাচলের জন্য মোটর সাইকেল আছে । আমার কয়েকজন বন্ধু আছে জাকার্তায়। তাদের সকলেরই একই অবস্থা। যেমন, আদে। আদের পরিবারে পাঁচ জন সদস্য। ছোট বোনটি, যার বয়স ৬ বছর, সে ছাড়া বাকি ৪ জনের জন্য ৪টি মোটর সাইকেল আছে। মাঝে মাঝে তাদের সাথে অনেক বেশি মালামাল থাকলেও কোনমতে দড়িটড়ি দিয়ে বেধে এই মোটর সাইকেলেই সব নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়।

আরেকটা অদ্ভূত ব্যাপার জানলাম, জাকার্তার রাস্তায় দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে মোটর সাইকেল চালাতে হবে। এটা আইন।

এবং জাকার্তায় এত মটোর সাইকেল যে একে সিটি অফ মটোর সাইকেল বললেও ভুল বলা হবে না।

বেলা ৯টার দিকে জাকার্তার কামায়রান এলাকায় চলে এলাম। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে রাস্তার ফুটপাত ধরে আরো কিছুটা পথ এগুচ্ছি। ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে বড় বাণিজ্য মেলায় যাচ্ছি। এলাকটি শহরের কেন্দ্রে নয়, অনেকটা পূব দিক ঘেঁষে। এখানে অনেক বড় বড় গাছ চোখে পড়ল। রাস্তার পাশে কিছুটা শীতল ছায়া পাওয়া যাচ্ছে। ঝরা পাতা নেই। পরিস্কার। বিখ্যাত সাইক্লিস্ট আশরাফুজ্জ্বামান উজ্জ্বল আমাকে একবার বলেছিলেন, যেখানেই যাও দুইটা জিনিসে দেখতে ভুলবানা। একটা হইলো বইয়ের বাজার, আরেকটা হইলো কাঁচা বাজার। এই কথা শোনার পর থেকে কোথায় গেলে এই দুইটা জিনিস আমি দেখার চেষ্টা করি এবং সত্যি সত্যি অনেক কিছু জানা যায়। এই বাণিজ্য মেলায় ঢুকে উজ্জ্বল ভাইয়ের কথাটা মনে পড়ে গেল।

পুরো ইন্দোনেশিয়ার উৎপাদনমুখী অর্থনীতির চালিকা-উপাদানগুলোর অনেকটাই আপনি এখানে দেখতে পাবেন। বিশেষ করে কাঠের কাজ, কাপড় ও পোষাক, প্লাস্টিক, বেত, প্রক্রিয়াজাত খাবার, কাগজ, স্টেশনারী উল্লেখযোগ্য। সবর্ত্র শিল্পের ছোঁয়া। কাঠের আসবাসপত্র, শো পিছ খুবই রুচিসম্মত ও নান্দনিক। ইন্দোনেমিয়ার পোশাকে বাটিকের বিশেষত্ব সম্পর্কে আপনারা কমবেশি জানেন। আমারও খুব ইচ্ছে ছিলো এই বাটিকের কাপড় দিয়ে একটা জামা বানাবো। এই বাণিজ্য মেলায় এসে দেখলাম বাটিকের বাহার। কত রকমের কাপড়, কত রকমের যে রঙ আর নকশা, কত বৈচিত্রময় ডিজাইন! কিন্তু সে তুলনায় দাম অনেক বেশি মনে হলো। সবচেয়ে নিচু গ্রেডের একটা বাটিকের শার্টের দাম বাংলাদেশি টাকায় দুই হাজার টাকার কম নয়। ঢাকায় হয়ত কেউ ঐ শার্টটির দাম ৩শ টাকার বেশি দেবে না। ফলে বাটিকগুলো নেড়েচেড়ে দেখে আর ছবিতুলেই তৃপ্ত থাকতে হলো। বিশাল এলাকাজুড়ে পুরো বাণিজ্য মেলা অপূর্ব দক্ষতায় সাজানো। ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বড় হবে আয়তনে। পণ্যের বিষয় অনুযায়ি মেলায় এলাকা ভাগ করা। সব কাঠ, বোর্ড, ফার্ণিচার এক পাশে, সব খাদ্য-পণ্য এক পাশে, এভাবে হারবাল, প্রসাধনী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার উপোযোগী যন্ত্রপাতি আরো ৩০ রকমের পণ্য ভাগ ভাগ করে সাজানো হয়েছে। আবার বিভিন্ন দ্বীপরাজ্যের সরকারি প্যাভিলিয়নও আছে। যার যার রাজ্যের বিশেষত্ব তুলে ধরেছে সেখানে।

ইন্দোনেশিয়া দূতাবাসের বাণিজ্য বিভাগ থেকে একজন সবসময় সাথে আছেন। ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন মেলা অঞ্চল। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে। কোথাও কোথাও স্বউদ্যোগে মিটিং সেট করিয়ে দিচ্ছেন। এই সকল কর্মকান্ড দেখে ও বুঝে আমার তিনটা শিক্ষা হলো।
এক. ইন্দোনেশিয়ার চীনের মতো পণ্যের রকমারি যদিও নেই কিন্তু ইন্দোনেশিয়া সেরা মানের পণ্য তৈরিতে আগ্রহী। একটা স্টলেও নিম্মমানের পণ্য আমাদের চোখে পড়েনি। বাজার-ঘাট-মেলা-দোকান, কোথাও না।
দ্ইু. সরকারি কর্মকর্তারা বিদেশি ক্রেতাদের সাথে স্বদেশি বিক্রেতাদের কোনভাবে একটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক করিয়ে দেয়ার জন্য যেন মরিয়া। ৪ দিন মেলা চলেছে, এত বড় আয়োজন, তার মধ্যে আমাকে ঠিকই তারা নজরে রেখেছে, প্রতিদিন জিজ্ঞেস করতে ভোলেনি, আজকে কারো সাথে ব্যবসায়িক কোন সম্পর্ক হলো কিনা।
তিন. আয়োজনের ছোট ছোট ভুল পুরো-উদ্দেশ্যকে ভন্ডুল করে দিতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার এই মেলায় সারা পৃথিবীর প্রায় শতাধিক দেশ থেকে প্রতিনিধি এসেছেন। কিন্তু বিভিন্ন স্টলে প্রাপ্ত ব্রুশিয়ার, ক্যাটালগ, লিফলেট, কোম্পানি প্রোফাইল অধিকাংশই ইন্দোনেশিয়ার ভাষায় লেখা। আমরা যারা কিছুই বুঝতে পারিনি, অনন্ত তাদের মার্কেটটা ইন্দোনেশিয়া হারিয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার উচ্চ পদস্থ ও উচ্চ শিক্ষিত কর্মকর্তারা নিজেরাও ভালো ইংরেজি জানেন না। যারা জানেন তারা খুবই দুর্বল। এমনকি যাদের ইংরেজি জানাটা বেশ জরুরী, যেমন দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ, তারাও আস্তে আস্তে দুমিনিট লাগিয়ে একটি ইংরেজী বাক্য অবশেষে সমাপÍ করেন। ফলে তাদের পণ্য ও সেবা সম্পর্কে আমাদেরকে বলতে গেলে কিছুই বোঝাতে পারেননি। আমরা নিজগুণে যা বোঝার বুঝে পাশের স্টলের দিকে পা বাড়িয়েছি।

এই মেলায় একটা মুখোশের স্টল আমার অনেকদিন মনে থাকবে। ইন্দোনশিয়ার ধর্ম, বিশ্বাস, দেব-দেবী, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এর অনেক কিছুই মুখোশে ফুটে উঠেছিলো। এই দ্বীপ দেশটিতে কত যে ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠী আছে তার ইয়ত্তা নেই। এত অল্প সময়ে সবকিছু জানতে পারিনি। এক এক দ্বীপের মানুষের এক এক পোষাক, অলংকার, স্টাইল, সংস্কৃতি। আর এসবই ছাপ রেখেছে মুখোশের গায়ে।

গাধার মতো হাঁটতে হাঁটতে মেলা পরিদর্শন প্রায় শেষ করে এনেছি। বইয়ের বাজারে গিয়ে খোঁজ লাগাতে হবে। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আবার সেই ঠা ঠা রোদ। ইচ্ছে ছিলো পায়ে হেঁটে নগর পরিভ্রমণ করবো। সেটা বুঝি এই যাত্রা আর করা হবে না। সিরাজ ভাইকে বইয়ের দোকানের খোঁজ জানতে চাইলে এই যাত্রা মাফ চেয়ে আরেক সাহায্য প্রার্থীর দিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো। আমরা পড়লাম এক ইন্দোনেশিয়ানের পাল্লায়। কিছুতেই বোঝাতে পারিনা যে আমারা কোন বিচ্ছিন্ন বইয়ের দোকান খুঁজছি না, বইয়ের বাজার খোঁজ করছি, আজিজ সুপার মার্কেট, বাংলাবাজার, এইরকম। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে তার মতোই যাত্রা শুরু করলাম। ভাবলাম, প্রথমত এই ব্যাটার কথা মতো সেই বইয়ের দোকানটায় যাই। তারপর ঐ দোকানের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বই বাজারের খোঁজ পাওয়া যাবে।

এই বারের ট্যাক্সি ড্রাইভার কিছুটা হলেও ইংরেজী বোঝে, কপাল ভালো। জিজ্ঞেস করতেই বলল, নাম ‘আদে’। নাম শুনে আমি চমকে উঠলাম। মশকরা করছে না তো? বাণিজ্য মেলায় প্লাস্টিকের দোকানের ম্যানেজারের নামও ছিলো, আদে। আমাদের জালান জাকসা রোডের বন্ধুর নামও আদে। এক শহরে এক পর্যটকের কপালে এত আদের উপস্থিতি কেন? ভাবলাম, সবজান্তা সিরাজ ভাইর কাছে এর একটা ব্যাখ্যা থাকবে নিশ্চয়ই। সিরাজই ভাই বাংলাদেশের ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসে কাজ করেন। বাণিজ্য মেলা উপলক্ষে এসেছেন জাকার্তায়। গত বিশ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি এখন পৌনে ইন্দোনেশিয়ান হয়ে উঠেছেন, একথা হলফ করে বলা যায়। পুরো ইন্দোনেশিয়ান হতে হলে আর কী লাগবে? এই প্রশ্নের উত্তরে সিরাজ নিচু স্বরে বলেছিলেন, এইখানে আর একখান বিয়া কইরা থাইকা যাওন লাগবো।


(সিরাজ ভাইর সাথে বাণিজ্য মেলার সামনের চত্ত্বরে)

আমরা ডাব্লুটিসি মাঙ্গাডুয়া মার্কেটে এসে পড়েছি। বিশাল মার্কেট। আন্ডার গ্রাউন্ডেই আছে ৪তলা। উপরে কত তলা কে জানে! শাড়ি কাপড় জুতা ঘড়ি এসবে আমার কখনোই কোন আগ্রহ ছিলো না। যদিও একথা বউ সাথে থাকলে কখনো ভাবিও না, বলা তো দূরের কথা। এখানে এসে বইয়ের দোকান আর খুঁজতে হলো না। নিচতলায়, সামনের খোলা চত্ত্বরের অনেকটা জায়গা জুড়ে কাঠের নিচু চৌকিমতো পাটাতনের ওপর সারিসারি বই সারিজে রাখা আছে। ঘাসের ভেতর হারিয়ে যাওয়া নাকফুল খোঁজার মতো আমি বই খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু একটি, বইয়ের টাইটেলতো দেখতে ইংরেজী হরফের মতোই লাগছে, কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন? সহসা আবিস্কার করলাম, আমি ইংরেজি হরফে বাহাসা ভাষা পড়ছি, ইন্দোনেশিয়ার ভাষায় লেখা সকল বই। একটি বইও ইংরেজিতে পেলাম না। ঘোরাঘুরি সাড়! চাইনিজ বইক্রেতার বাংলাবাজার ভ্রমণের মতো আমার অবস্থা দেখে মুন্না মনেহলো হাসি চাপা দিতেই দ্রুত গতিতে পাশের জুসের দোকানে গেলো। হেঁকে বললাম, তুই কি বুঝবি রে দাঁতাল! সিডি-ডিভিডির দোকান হলে তো তুই খ্যাপা ষাড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তি! এরপর আরো বেশকিছু বইয়ের দোকান খুঁজে বের করে ঘুরে দেখেছিলাম। একই অবস্থা, পাঠ্যবই ছাড়া ইংরেজিতে তেমন বই পেলাম না।

মার্কেটে মার্কেটে বইয়ের দোকান খুঁজতে খুঁজতে সানায়ান সিটিতে অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য চোখে পড়ল। একটা ফলের দোকানে বেশ কিছু বাচ্চা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিয়ে দুজন স্কুল শিক্ষিকা এসেছেন। কলার সেলভের সামনে দাঁড়িয়ে শেখাচ্ছেন ফলের নাম আর গণনা। প্রত্যেকটা ফুটফুটে লিলিপুট বাচ্চার হাতে একটা করে বাস্কেট। এক এক জন চিৎকার করে বলছে, আমি কলা চাই, আমি ৩টা কলা চাই। শিক্ষিকা কলার কাঁদি থেকে ৩টা কলা ছিড়ে বলছেন, এখানে কটা কলা আছে? ছাত্রটি বলল ৩টা। উত্তর সঠিক, সুতরাং তাকে ৩টা কলা দেয়া হলো। এই সুন্দর দৃশ্যটি কাছ থেকে দেখতে আমরা ইতিমধ্যে ফলের দোকানে ঢুকে পড়েছি। যে ছাত্রটি সঠিক উত্তর দিতে পারছে না, তাকে কলা দেয়া হচ্ছে না। তাকে আবার শুরু থেকে কোন একটা ফল চাইতে হবে। পুরো ক্লাসরুম ফলের দোকানটিতে চলে এসেছে।

এই ফলের দোকানেই এক অদ্ভূত তরমুজ দেখলাম। উপরটা দেখতে দেশের তরমুজের মতোই। কিন্তু ভেতরটা হলুদ!
আজব এই তরমুজ আগে দেখি নাই।


(তরমুজরে ভেতরটা লাল নাও হতে পারে, সানায়ান সিটিতে)

কিন্তু ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসের ওপর একটা বই আমার চাই-ই। এক দোকানদারের কথা মতো প্রায় একহাজার টাকা ট্যাক্সি ভাড়ার দূরত্বে গিয়ে এক বইয়ের দোকান থেকে সবে ধন নীলমনি একটা গাইড বই পেয়েছিলাম। তার ভেতর কয়েকপৃষ্ঠা ইতিহাস সংক্রান্ত লেখার একটা আভাস রয়েছে। মুন্না দ্রুত গতিতে আসে পাশে কোন জুসের দোকান না পেয়ে একটা পরোটার দোকানের দিকে সটকে পড়ল। বুঝতে পারছিলাম ওর পেটের ভেতর থেকে তখন হাসির দমক উঠছে। চেচিয়ে বললাম, শোন, ঐ দোকান শুকরের তেল দিয়ে পরোটা ভাজে। খেলে বুঝবি ‘হারাম’ কাকে বলে!

শহরের দক্ষিণে অবস্থিত রাগুনান চিড়িয়াখানা। আমরা আছি শহরের উত্তরে। পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো এ চিড়িয়াখানা ১৪০ হেক্টর জায়গা নিয়ে ১৮৬৪ সালে তৈরি। বড় ইচ্ছা চিড়িয়াখানটা ঘুরে দেখি। সময় হাত খুব বেশি নেই। দ্রুত ছুটলাম। এ চিড়িয়াখানায় ৪ হাজারেরও বেশি প্রজাতির বন্য প্রাণী প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে। কিন্তু আমাদের কপাল খারাপ। এতগুলো টাকা ট্যাক্সিওয়ালাকে অকাতরে দিয়ে দেয়ার পরেও সময়মতো পৌঁছতে পারলাম। না। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন গেট বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা বাইরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুড়ি কওে পাসার বুরং পাখির মার্কেটের পথ ধরলাম।

জালান প্রামুকায় এই পাখির মার্কেটটি পর্যটকদের কাছে খুব বিখ্যাত, নাম ‘পাসার বুরাং’। পাসার মানে বাজার আর বুরং মানে পাখি। কত রকমের যে তাদের রং, আকার, ডাক, নানা কান্ড কারখানা সে বলে শেষ করা যাবে না। জাভাবাসীদের গর্ব অত্যন্ত জনপ্রিয় গায়িকা পাখি পার্কুতুত এখানে পাওয়া যায়। কত পাখি দেখলাম, এই পার্কতুতের দেখা পেলাম না। যে দোকানে পাওয়া যায় সেটা বন্ধ। মনে মনে ভাবলাম, আসলেই এত অল্প সময়ের এক ভ্রমণে সব কি হয়!

রাত হয়ে গেছে। নটা বাজে। আমরাদের জাকার্তা ভ্রমণও শেষের পথে। ড্রাইভার আমাদের ড্যারা জালান জাকসা রোডের দিকে গাড়ি হাকিয়েছে। শাই শাই ছুটছি। এর মধ্যেই পা-সুপির (ড্রাইভার) জিজ্ঞেস করলেন, আমরা থাউজেন্ড আয়ল্যান্ড গিয়েছি কিনা। বললাম, না। এরপরের বার যাবো। বললেন, নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য ‘পুলাউ সেরিবু’ বা ‘থাউজেন্ড আয়ল্যান্ড’-এর কোন তুলনা নেই। শহরের উত্তরে সুন্দা কেলাপা বন্দর থেকে ফেরি বা স্পীড বোট খুব সহজেই জাভা সমুদ্রের এই দ্বীপ অঞ্চলে যাওয়া যায়। ১৪০টা ছোট ছোট দ্বীপ আছে। আপনি চাইলে একটি আস্ত দ্বীপ ভাড়া নিয়ে রাত্রিযাপন করতে পারেন। হাজার হাজার নারকেল গাছের সারিবদ্ধ বিন্যাসের স্বর্গীয় সৌন্দর্য নিয়ে এই দ্বীপাঞ্চল সারা পৃথিবীর পর্যটকদের মন রঞ্জন করছে। স্কুভা ডাইভ, সার্ফিং, স্নোরকেলিংসহ হাজারো রকমের জলজক্রীড়া আয়োজনের শেষ নেই এখানে। পা-সুপিরের কথা শুনে মনেহচ্ছিলো বেশ ভালোই একজন ড্রাইভার যদি এইভাবে একটা অঞ্চলকে তুলে ধরতে পারে, তাহলে পর্যটনের উন্নতি ঠেকায় কে! মনেমনে ঠিক করে নিলাম, এর পরের বার জাকার্তা এলে এক রাত পুলাউ সেরিবুতে থাকবো। উজ্জ্বল ভাইয়ের পরামর্শ মতো এই বার কাঁচা বাজারও দেখা হয় নাই। আগামী বার সমুদ্রবন্দর সুন্দা কেলাপাও দেখবো।

মুসলিম দেশ হিসেবে খাবার নিয়ে আমাদের তেমন কোন সমস্যা হয় নি। তবে আমার ভ্রমণসঙ্গী মুন্না ভাইয়ের ব্যাপারটা একটু আলাদা। হোটেলে গিয়ে বয়কে ডেকে তিনি নির্দ্বিধায় জিজ্ঞেস করতে পারেন, মোরগটি জবাই করার সময় ঠিকমতো দোয়া পড়া হয়েছিলো কিনা। তবে কখনোই যন্ত্রণা দেয় না, বরং খাবার পছন্দ না হলে অনাহারে থাকে। এতে নাকি স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। যাই হোক, সব খাবারেরই একটা ইন্দোনেশিয় ঘ্রাণ পাওয়া যায়। ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত খাবারের নাম ‘নাসি গোরেং’। এ সম্পর্কে আগে বলেছি দুএক জায়গায়। ফ্রাইড রাইস, চিকেন আর ডিম ভাজি মিলেমিশে এক দারুণ উপাদেয় খাবার। পরিবেশনে পার্থক্য থাকলেও প্রস্তুত প্রনালীতে বাংলা খাবারের সাথে এর বেশ মিল আছে। পরিবেশনের সময় সাথে থাকে দুই তিন ধরনের চিপস ও পাপড় ভাজা।

জালান জাকসায় ফিরে এসে রাতের ডিনারে ‘নাসি গোরেং’ দারুণ উপভোগ করে খেলাম। নানা মানের রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি যারা স্ট্রীট ফুড পছন্দ করেন জাকার্তা তাদের জন্য খুব ভালো স্থান হতে পারে। বেশ পরিচ্ছন এই সব স্ট্রীট রেস্টুরেন্ট। চাকরিজীবী, ছাত্র, তরুণ, বৃদ্ধ সব ধরনের মানুষরাই এসব রেস্তোরায় বসে সান্ধ্যকালীন সময় কাটান, গল্প করেন, খাবার খান। কেউ কেউ সামান্য বখশীশের আশায় এইসব রেস্টুরেন্টের সামনে ঘুরে ঘুরে গীটার বাজিয়ে গান গায়। পুরো পরিবেশে এক অনবদ্য মাত্রা যোগ করে এই সংগীত। ল্যাম্প পোস্টের আলো বাঁচিয়ে ছোট্ট ছায়ার ভেতর জীবনের কত অজানা নাটকের ছোট ছোট দৃশ্য মঞ্চায়িত হতে থাকে এই জাকার্তায়। নগর, নাগরিকতা আর নান্দনিকতা জাকার্তায় একাকার হয়ে আছে।

ডিনার শেষে হোটেলে ফিরে যাই না। আরো কিছুক্ষণ রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি। হাঁটার চেয়ে ভালো ভ্রমণ হয় না। কত কিছু দেখা যায়! কত রাস্তা, কত রকমের স্থাপত্য, কত বাজার আর মানুষের পদচারণা! রাত বেড়ে চলে। এক সময় ক্লান্ত পায়ে হোটেলের দিকে ফিরতে থাকি। আগামীকাল সকালের ফ্লাইটে আমরা বর্ণীল দ্বীপ বালি যাচ্ছি।

বালিতে যাচ্ছি বীচ দেখতে নয়, বরং ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত পাথর আর কাঠখোদাই শিল্পের দেখা মিলবে উবুদ-এ আর কিনতামানিতে দেখা মিলবে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির। এই উচ্ছ্বাস রাখি কোথায়!


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লাগছে, পাখির বাজারের ছবি পেলে ভালো লাগত।
ওদের খাবারে তো মরিচের বেশ ছড়াছড়ি, এত ঝাল নাকি?

এবার, কিনতামানি দেখান তাড়াতাড়ি হাসি

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

জ্বী ঝাল, বেশ ঝাল। না পাখির ছবি তুলতে পারি নি। কপাল খারাপ। ততক্ষণে ক্যামেরার চার্জ শেষ। আসলে পাখির বাজারটা ভালো করে দেখতেই পারিনি। প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে তখন, রাত হয়েছে। মনকে 'নেক্সট টাইম' বলে অন্যদিকে হাঁটা ধরেছিলাম।
ঠিক তেমনি নাসি গোরেং খাবারটারও ছবি তোলা হয়নি ।

জ্বী, কিনতামানি নিয়ে আসছি। লেখাটা নীড়পাতা থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে!

দীনহিন এর ছবি

চলুক

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

নির্ঝর অলয় এর ছবি

অসাধারণ লাগল। খাবারগুলো জিভে জল আনা!

এক লহমা এর ছবি

"আপনি চাইলে একটি আস্ত দ্বীপ ভাড়া নিয়ে রাত্রিযাপন করতে পারেন। " - আহা! এই না হলে ভাড়া নেওয়া! হাসি
বেড়ানোর গল্প ভাল লাগছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তারেক অণু এর ছবি

ভাল লাগল, শুধু প্রথম ছবি বদলে অন্য কোন ছবি দিতে পারতেন নীড় পাতায় ভাসছে যেহেতু সেটা। আপনার তো অনেক ভাল ভাল ছবি আছে
চলুক

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

কবি যখন ভ্রমণে, তখন বর্ণনায় কিছু অন্তত অন্যরকম কিছু আশা করেছিলাম...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

আহ, দেরীতে হলেও গোগ্রাসে গিললাম সিরিজখানি। চমৎকার বর্ণনা। চলুক

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।