আজন্ম ক্রীতদাস

তানভীর এর ছবি
লিখেছেন তানভীর (তারিখ: বুধ, ২০/০২/২০০৮ - ১২:০২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাঝে মাঝে নিজেকে ম্যালকম এক্সের সেই হাউজ নিগ্রোর মত মনে হয়; ফিল্ড নিগ্রোর চেয়ে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং সবকিছুতে ‘ইয়েস বস’ বলে যায়।

দাসত্বের যুগে কালো দাস ছিল দুই ধরনের- ফিল্ড নিগ্রো, যারা ক্ষেতে-খামারে কাজ করত এবং যাদেরকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে বাধ্য করানো হত। এরা সাদাদের মনে-প্রাণে ঘৃণা করত এবং দাসত্ব-শৃংখল থেকে মুক্ত হতে চাইত। অন্যদিকে সাদা মনিবদের সেবার জন্য ছিল হাউজ নিগ্রো। এরা মনিবের বাড়ীতেই আরাম-আয়েশে থাকত- তাই নাম হাউজ নিগ্রো, ভাল খাওয়া-দাওয়া করত, ভাল কাপড় পড়ত, মনিবকে নিজের চেয়েও বেশী ভালবাসত, মনিবের অসুখ-বিসুখে জান দিয়ে দিত। ফিল্ড নিগ্রোরা কোন ঘোট পাকাবার চেষ্টা করলে তাদের উল্টা-সিধা বুঝিয়ে আসত, ‘আমরা এই বেশ ভালো আছি’। মনে মনে তারা এই ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করত, আমরা ফিল্ড নিগ্রোদের চেয়ে অনেক ভালো জীবন-যাপন করছি।

ঘৃণার অংশটুকু বাদ দিলে বাংলাদেশের মানুষকে কেন জানি আমার এই দুই শ্রেণীর মনে হয়। এখানে ফিল্ড নিগ্রো মানে কৃষক, মজুর, শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা, বাসার কাজের লোক- এরা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, কিন্তু শ্রমের মূল্য পায় না। শুধু দিন যাপনের, শুধু প্রাণ ধারণের গ্লানি বয়ে বেড়ানো এ মানুষেরা একটু বেঁচে থাকার আশায় হাউজ নিগ্রোদের প্রায় বিনামূল্যে সেবা করে যায়। অন্যদিকে, হাউজ নিগ্রোরা দেশে বসুন্ধরা সিটি, ইস্টার্ণ প্লাজায় শপিং করে (বিদেশের কথা নাই বা বললাম), ২০০ টাকা দিয়ে হেলভেশিয়ায় চিকেন ব্রোস্ট আর বার্গার খায়, আর ফিল্ড নিগ্রোদের চালের দাম কেন ৩৫ টাকা হল তা নিয়া ব্লগিং করে (কেউ মাইন্ড খাইয়েন না আবার)। হাউজ নিগ্রোদের বাচচা-কাচচারা নামী দামী স্কুলে পড়ে, ১০০ টাকা টিকেট কেটে উইক এন্ডে ফ্যান্টাসি কিংডম যায়, তারপর এক সময় উড়োজাহাজে চড়ে মনিবদের দেশ ইউরোপ-আম্রিকায় চলে আসে (এই যেমন আমি এসেছি)।

হাউজ নিগ্রোদের প্রতিনিধিরা দেশ শাসন করে, মনিব পাটকল বন্ধ করার হুকুম দিলে ‘ইয়েস বস’ বলে সাথে সাথে বন্ধ করে দেয়। দেশের সবচেয়ে অর্থকরী খাত গার্মেন্টস শিল্পের কথাই ধরা যাক। এখানে বিদেশী মনিবদের জন্য কাপড় তৈরী হয়, ফিল্ড নিগ্রোরা কামলা খাটে, আর হাউজ নিগ্রোরা তার তদারকি করে মনিবের ফরমায়েশ অনুযায়ী। মনিবদের মার্কেটে কাপড়ের দাম কম রাখতে হবে, তাই খাঁড়াটা পড়ে শুধু ফিল্ড নিগ্রোর ওপর- তার মজুরী হয় নামমাত্র (অবশ্য গার্মেন্টস আসার আগে এই ফিল্ড নিগ্রোদেরর অবস্থা আরো খারাপ ছিল)।

হাউজ নিগ্রোরা ক্ষমতায় যাবার রাজনীতিতে খেয়োখেয়ি করে ফিল্ড নিগ্রোদের উল্টা-সিধা বুঝিয়ে, চালের দাম নাকি ষোল টাকা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাংলাদেশের ফিল্ড নিগ্রোরা কীরকম সহজ-সরল তা বলতে গিয়ে বুয়েটের এক শিক্ষক আমাদের একটা গল্প বলেছিলেন। কাহিনী উত্তরবঙ্গের কোন এক প্রভাবশালী মন্ত্রীকে নিয়ে। হাউজ নিগ্রো মন্ত্রী থাকেন ঢাকায়, শুধু ইলেকশনের সময় ফিল্ডে মানে এলাকায় যান। মন্ত্রীকে পেয়ে এলাকার এক বুড়ো ধরল, বাবা শীতে কষ্ট পাই, একটা কাপড় দিয়া যাও। মন্ত্রী বুড়োকে জড়িয়ে ধরে বলল, আরে তোমার জন্য তুলার গাছ পুঁতেছি। গাছে তুলা হলে ওটা দিয়ে কাপড় বানায়ে দিব। বুড়ো তো খুশী। মন্ত্রী তার জন্য তুলার গাছ পুঁতেছে। বিশাল ব্যাপার। ভোট পড়ল। মন্ত্রী হাওয়া হলেন। পরের ইলেকশনে আবার দেখা। কই বাবা, কাপড় তো পাইলাম না। মন্ত্রী এবার একটু কপট রাগ করলেন, আরে তোমরা কিছু বুঝতে চাও না, গাছ পুঁতেছি বড় হতে তো সময় লাগে। বড় হলে গাছে তুলা আসবে, ওটা দিয়ে একেবারে গরম কাপড় বানায়ে দিব। আবার ভোট পড়ল, আবার হাওয়া। গল্পের সত্যি-মিথ্যা জানি না। তবে আমাদের মত হাউজ নিগ্রোদের প্রতিনিধি যারা রাজনীতি করেন, তাদের আমার এমনই মনে হয়।

মাঝে মাঝে বিদেশীদের গোলামী বাদ দিয়ে সবকিছু ছেড়ে খুব দেশে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভাবি, দেশে গেলেই কি আমার এই হাউজ নিগ্রো আইডেন্টিটি ঘুচবে? এখানে বরং আমি একটু ভাল গোছের হাউজ নিগ্রো। আমার চেয়ে অধম কাউকে আমার সবসময় ‘ইয়েস বস’ বলতে হয় না, একটু উপরে উঠতে চাইলে পেছন থেকে ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়ার জন্যও কেউ বসে নেই। ব্যাচেলর শেষ করে কিছুদিন এলজিইডি-তে চাকরী করেছিলাম। আমাদের প্রজেক্ট ছিল বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটা নন-কন্সট্রাকশন প্রজেক্ট। এলজিইডিতে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ টাইপের কন্সট্রাকশন প্রজেক্টে থাকে ঘুষের ছড়াছড়ি, ঠিকাদারেরা বস্তা ভরে ঘুষ দিয়ে যায়। যাই হোক ব্যাপার হল, যেহেতু আমাদের প্রজেক্টে ঘুষের কোন কারবার নাই, এলজিইডির অন্য প্রজেক্টের কলিগ থেকে শুরু করে বয়-বেয়ারা পর্যন্ত আমাদের তাচ্ছিল্য করতে আরম্ভ করল। ঘুষখোর 'হাউজ নিগ্রো' কলিগ আর তাদের অধস্থন ফিল্ড নিগ্রোরা চলে বুক ফুলিয়ে আর আমরা হলাম গিয়ে মাইনকার চিপায় পড়া হাউজ নিগ্রো, আমাদের বেয়ারাগুলাও দেখি থাকে পাংশু মুখে। আমাদের বস অফিসে সারাদিন তার বসদের সাথে ফোনে কান্নাকাটি করেন অন্য প্রজেক্টে (মানে ঘুষের প্রজেক্টে) ট্রান্সফারের জন্য (শুনছিলাম এটা ছিল তার পানিশমেন্ট পোস্টিং, উপরের লেভেলে যারা বেশী ঘুষ খেয়ে ধরা খায় তাদের পানিশমেন্ট হিসেবে এসব নন-কন্সট্রাকশন প্রজেক্টে বস হিসেবে পাঠানো হয়)। বসের যখন এই অবস্থা, তখন আমাদের অবস্থা আরো কেরোসিন। ঘুষ নাই যেহেতু, আমাদের তাই ভরসা হল টিএ/ডিএ। ট্যুর না থাকলেও টিএ/ডিএ পাওয়ার জন্য ট্যুর বানায়ে নেই আর অফিসে বসে বসে কলিগরা সবাই মিলে ট্যুরের বিল বানাই। একদিন বেয়ারাদের রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, শুনলাম এক বেয়ারা বলছে, ‘স্যার গো দেখি কোন কাম নাই, বয়া বয়া খালি বিল বানায়’। ছ্যা, এইটা কোন জীবন হল!


মন্তব্য

হিমু এর ছবি
দ্রোহী এর ছবি
তানভীর এর ছবি

কিছুই up না। সবি down চোখ টিপি

=============
"কথা বল আমার ভাষায়, আমার রক্তে।"

হিমু এর ছবি

তানভীর বনাম তুফান কবে নাগাদ নামবে?


হাঁটুপানির জলদস্যু

তানভীর এর ছবি

নামবে অচিরেই।

=============
"কথা বল আমার ভাষায়, আমার রক্তে।"

থার্ড আই এর ছবি

হাউজ নিগ্রো আর ফিল্ড নিগ্রোর সাথে আমাদের মধ্যবিত্ত আর শ্রমজীবী মানুষের সাথে তুলনামূলক সমন্বয়ের চিত্রটা আসলেই সঠিক এবং ভয়াবহ !!
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

অতিথি লেখক এর ছবি


মাঝে মাঝে বিদেশীদের গোলামী বাদ দিয়ে সবকিছু ছেড়ে খুব দেশে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
**************************************
না ঘরকা না ঘাটকা....আসলেই সমস্যা

শুভ রহমান

rahmanshuvo@yahoo.com

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

দারুণ!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।