ডাকঘর

তাপস শর্মা এর ছবি
লিখেছেন তাপস শর্মা [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ০৩/০১/২০১২ - ১১:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অতৃপ্ত সময়ের নির্জন দিনলিপি

এক.

শেষ পর্যন্ত অলস বিলাসিতা থেকে উত্তরণের কোন পথ খুঁজে পেলাম না। নিরব এবং নিস্তরঙ্গ গলিপথের ছাইপাঁশ ছেড়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করার শেষ বাসনাটুকুও পূরণ করার কাজে লেগে গেলাম। প্রচণ্ড গরম আমার সহ্য হতোনা কোন কালেই, শীতের সময় আবার অন্য ঝামেলা নানা শারীরিক বিকৃতি। সব মিলিয়ে কোন ঋতুতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনা। আমার এই পর্যাপ্ত হীনমন্যতা একটা অলিখিত বোধ হয়ে বারবার ধাক্কা দিয়ে যায়। জীবনটাই চঞ্চল আর ছন্নছাড়া।

কাল রাতে ইমনার সঙ্গে কথা বলার সময় কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। ঐ সময়টাতে ও আমাকে খুব কাছে থেকে পেতে চায়। আদর নিতে চায়। আমিও দিতে চাই। কিন্তু পারিনা সবসময়। আমার শারীরিক দোষ আছে তা নয়। কিন্তু তবুও কেমন যেন একটা অগভীরতা আছে, একটা গভীর খাঁদ। আমি যেন বারবার একটা গর্তে বন্দি হয়ে যাচ্ছি।

ইমনাও তাই বলছিল আমাকে, - তুমি একটা ভীষণ জটিল মানুষ।

আমি বলি- সব জেনে কেন কাছে এলে?

- তোমার মধ্যে হারিয়ে গেছি বলে।

আমি চাইনা, তবুও বারবার তাকে আঘাত দেই – বাংলা সিনেমা দেখা প্লিজ বন্ধ কর। হেঁয়ালি হচ্ছে।

ইমনা একটা ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় – না, হেঁয়ালি নয়। তোমার মতো জটিল ভাবনা আমি ভাবতে পারিনা।

- কেন?

- তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি বলে।

এর জবাবে আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠাণ্ডা শত কষ্টে দীর্ণ বুকে আদর এঁকে দিতে পারতাম। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা সংকীর্ণ দেয়াল এসে সজোরে ধাক্কা মারে। এবং আমি বলে উঠি – ভালোবাসা কত টাকায় বিক্রি হচ্ছে আজকাল?

ইমনা এর পর আর কিছুই বলেনা। চুপচাপ কাপড় গুছাতে শুরু করে। আর বাথরুমের দিকে চলে যায়। আমি তখন বুকের মধ্যে একটা ডাক শুনতে পাই। নিজের সাথে নিজেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করি। একটা নির্লিপ্ত নিম গাছের অবিশিষ্ট তেতো নির্গমতা আমার সারা শরীরে ছেয়ে যায়। সামনের আয়নাটায় সবসময় একটা পর্দা দেওয়া থাকে। হাল্কা ওড়নার মতো করে সেটাকে তৈরি করে দিয়েছে ইমনা। আর তাতে আমি আমার ছবি দেখতে পাইনা।

বাথরুম থেকে ফিরে আমার দিকে তাকায়না ইমনা। একা একা বিড়বিড় করতে থাকে কখনো কখনো। আমি চুপচাপ শুয়ে থেকে দেখি কি ভাবে একটা মেয়ে তার সব কিছুর বিনিময়ে একটা সজীবতা চায়। এমনকি সদ্য ব্যবহৃত কন্ডোমটা পর্যন্ত বাথরুমের পাশে রাখা ডাস্টবিনে ফেলে আসে। চুল ঠিক করার সময় ওর পিঠটা অনেকটা উন্মুক্ত হয়ে থাকে। আমার ভালো লাগে। সারা শরীর নিয়ে খেলা করাটার চেয়ে এই এক মুহূর্ত আমার কাছে একটা ভালোলাগা নিয়ে আসে। নির্জীব চিরুনিটার উপর আমার অনেক রাগ হয়। ইমনা এরপর পাক্কা গৃহিণীর মতো বকবক করতে শুরু করে। আর আমি আগের চেয়েও বেশী নির্লিপ্ত হয়ে যাই। সিগারেটের প্যাকেটটা সামনের টুলটা থেকে এগিয়ে উঠে নিয়ে আসার ইচ্ছেটাও আমার মরে যায়। এদিকে ইমনা শুনাতে থাকে চালের দাম থেকে শুরু করে দেশের সর্বশেষ সেনসেক্স এর হিসেব। কবে যেন বলছিল শেয়ার মার্কেটে ওর কিছু টাকা লাগানো আছে। আমি নড়েচড়ে বসি।

- তোমার না শেয়ার মার্কেটে কিছু টাকা আছে? ইমনা তখন সব্জি বাজারের কথা শুনাচ্ছিল। আমার আকস্মিক প্রশ্নে আমার দিকে তাকাল।

- তুমি কী একটা?

- কেন। লস হয়ে গেছে টাকা।

- আমি খেয়ে ফেলেছি। তোমার কি?

- না। আমার কিছুই না। আমি তো এমনিতেই জিজ্ঞাসা করছিলাম।

- তোমার মধ্যে কিছু আছে। আবেগ বোধ চেতনা। আমি কার সাথে আছি। তুমি কি আমায় ভালোবাস। বাসতে কোনদিন। খুব জোরে কথা গুলো বলে হাঁপাতে শুরু করে ইমনা। জোরে জোরে শ্বাস নেয়।

- আমিও বাসি। আওয়াজটা কেমন যেন কেঁপে যায় আমার। বোধ হয় ইমনাও তা বুঝতে পারে। কিন্তু কেন এমন হয় আমি নিজেও তা বুঝে উঠতে পারিনা। আমি কি তাহলে সৎ নই। কিন্তু হাজার অনুসন্ধান করেও অসৎ হওয়ার কোন গুণ নিজের মধ্যে খুঁজে পাইনা। অনেক চেষ্টা করে, প্রচুর অনুসন্ধান করেও কিছুই বুঝে উঠতে পারিনা। এরপর ভীষণ নির্লিপ্ত হয়ে যাই।

কোন কোন সময় নিজেকে এতটা ছোট মনে হয় নিজেকে যে ঘরের দেয়ালের সাদা রঙটাকে পর্যন্ত আরোপিত মনে হয়। ইমনা অনেকবার বলেছে রঙটা চেঞ্জ করিয়ে নিতে। আমি করিনি। অনেকবার বলে ও আর আমাকে ফোরস করেনা। আজ সকালেও এই দেয়ালের রঙটাকে আমার আরোপিত মনে হচ্ছে। অথচ আজ তো নতুন কিছু ঘটেনি। সকাল সকাল কাজের মেয়েটার কলিং বেল চাপার শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছে। একটু পরেই বাগানে পায়চারি করতে গিয়ে একটা গন্ধ ভেসে এলো নাকে। গন্ধটা আমার কাছে অপরিচিত মনে হয়নি। চেনাচেনা লাগছিল। মনে হচ্ছিল কাল রাতেওতো ঠিক একই গন্ধ পেয়েছিলাম। ইমনার শরীরের উষ্ণতায় ঠিক সেই গন্ধটাই যেন মিশে আছে। এরপর থেকেই মাথা এবং শরীরটা কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। ইমনার শরীরের গন্ধ বাইরের বাতাসে কেন থাকবে।

ইমনা বলে – তুমি কতটুকু নিচে নামতে পার।

আমি বলি – যতটুকুর পর আর নিজেকে ঘৃণা করার শক্তি অবশিষ্ট থাকবেনা ততটুকু।

- আমার জন্য নাকি আমার শরীরের জন্য।

- জানিনা। কখনো মনে হয় তোমার জন্য, কখনো মনে হয় তোমার শরীরের জন্য, আবার কখনো মনে হয়...

- কী ?

- দেখো আজকের চাঁদটা কেমন যেন ছায়াসারির মতো ঘন হয়ে আছে। মা একসময় রূপ কথার গল্প শুনাতেন। এখন রোজ রাতে তোমার শরীরের ভাঙন এর শব্দ শুনি... তোমার সারাদিনের ঘটে যাওয়া কিসসা শুনি। কিন্তু তাতে রূপকথা খোঁজে পাইনা কোথাও।

- তুমি কিন্তু তৃতীয় কারণটা বলনি। তুমি একটা...

- হিপোক্রেট? বল মুখে আটকে রেখোনা প্লিজ, বলে ফেলো...। ইমনা চুপ করে থাকে।

আমি ভুলে যাই সত্যিই কোন তৃতীয় কারণ আছে কিনা। আর থাকলেও সেই কারণের উৎস কি হতে পারে...

[ক্রমশ]

=============

আমার শহর

জানুয়ারি। ০৩। ২০১২।


মন্তব্য

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

তাপস শর্মা এর ছবি

আইচ্ছা।

উচ্ছলা এর ছবি

সুভানাল্লাহ! জটিল দুনিয়াদারীর জটিল উপন্যাস লিখে আমার মাথা আউলা ঝাউলা করে দেয়ার জন্য তোমাকে অভিনন্দন!
মাথা হাল্কা করতে এখন প্রাগৈতিহাসিক কালের নাচা-গানা দেখতেছি।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

সেই ছোট্টবেলার কথা মনে করায়ে দিলেন হাসি

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

তাপস শর্মা এর ছবি

কবি ছোডবেলায় কি কত্তেন চিন্তিত , ইয়ে মানে হে হে ইয়ে, মানে...

তাপস শর্মা এর ছবি

ম্যাডামজী পড়ার জন্য থাঙ্কু ।

আর গানের জন্য দেঁতো হাসি । এই গান এতই প্রাগৈতিহাসিক যে আমার শুনতে শুনতে চোখে জল আটকায়না। যদিও আমার কোন লেইলা ছিলনা খাইছে

জহিরুল ইসলাম নাদিম এর ছবি

জটিল অ্যাঁ

তাপস শর্মা এর ছবি

আমিও তাই ভাবতেছি চিন্তিত

সমীরণ রায়, কোলকাতা এর ছবি

বা:....আসলে, শব্দ নিয়ে খেলা করার এক কাব্যিক দক্ষতা তোমার সহজাত, তাপস।। তার সাথে গভীর মনন ও চিন্তন, চরিত্র-বিশ্লেষণী ক্ষমতার সুপ্রয়োগ, পাঠককে মুগ্ধ করে রাখা ও এক নি:শ্বাসে পড়িয়ে নেওয়ার সম্মওহনী যাদু তোমার করায়ত্ত্ব।।
যথারীতি মুগ্ধ হলাম।।

তাপস শর্মা এর ছবি

সমীরণ দাদা অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা নিয়েন। আর আপনি এত প্রশংসা করেন যে লজ্জায় গর্তে চলে যেতে মঞ্চায় দেঁতো হাসি

বিভাস এর ছবি

ভালো লাগলো। বাকি টা পড়ার ইচ্ছা রইল। খুব সুন্দর বুনন লেখায় ।

তাপস শর্মা এর ছবি

আপনাকে ধন্যবাদ।

Amitava Pramanik এর ছবি

ধারাবাহিক উপন্যাসের প্রথম শর্তই বোধ হয় পাঠকের মনে এক ব্যাকুল জিজ্ঞাসা তৈরী করা, এর পর কী হতে চলেছে। এই প্রথম অধ্যায় পড়ে সে রকম কোন জিজ্ঞাসা আমার মনে তৈরী হলনা।
লেখাটার মধ্যে আমি কোন গল্প খুঁজে পেলাম না। খুবই ছোট অধ্যায়, ঘটনাবিহীন প্রায়। একটু শখের কাব্য এবং একটু সুড়সুড়ি দেওয়ার প্রবণতা ছাড়া সাহিত্যের কিছু নেই এতে।
কিন্তু বেশ কিছু বানান ভুল চোখে পড়লো। প্রথম লাইনে নিরব-টা নীরব হবে। খাঁদ নয়, খাদ। রূপকথা খোঁজে পাইনা নয়, খুঁজে পাইনা। ইত্যাদি।
তবে, আশা রইল।

তাপস শর্মা এর ছবি

Amitava Pramanik কষ্ট করে পড়েছেন বলে অনেক ধন্যবাদ ।

১।
প্রথমে বলে রাখি এটা উপন্যাস নয়। এটা নোভেলা। আর বাঙলায় যেহেতু নোভেল ছাড়া আর কিছু নেই। আই মিন ইংরেজি সাহিত্যের মতো নোভেল-নোভেলা-নোভলেট শ্রেনী বিভাগ নেই, তাই আমাকে 'উপন্যাস' শব্ধটা প্রয়োগ করতে হয়েছে।

২। ট্যাগে তাই আপনি "নোভেলা" দেখতে পেয়েছেন। নোভেলার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট আছে। আঙ্গিকও আলাদা। ন্যারাশেনের প্রয়োগ কোথাও বেশী, কোথাও খুব কম। উপন্যাসের ( নোভেল) মতো গতি নিয়ে এগোয়না। উপন্যাসের ( নোভেল ) এর কমন বৈশিষ্ট গুলি নোভেলায় অনুপস্থিত থাকে, যেমন - ঘটনার ঘনঘটা, প্রচুর চরিত্রের রসায়ন, বিশাল ক্যানভাস, প্লটের পাশাপাশি বিস্তীর্ণ সাব-প্লট ইত্যাদি।

৩।
অধ্যায় ছোট। কারণ জানেন এটা ব্লগ। বেশী বড় লেখা তাই পোস্ট করলাম না। টুকরো টুকরো করেই এগুতে চাই।

৪।

একটু শখের কাব্য এবং একটু সুড়সুড়ি দেওয়ার প্রবণতা ছাড়া সাহিত্যের কিছু নেই এতে।

- এর উত্তর আমার জানা নাই। যদি রেফারেন্স দিতেন তাহলে ভালো লাগত। বিশেষত 'সুড়সুড়ি'টা আমার বোধগম্য হলনা? শরীর নিয়ে লেখার কথা বলছেন বোধ হয়... যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের 'সাহিত্যের পথে' পড়ার পরামর্শটুকু দিতে পারি।

৫। দু-একটা টাইপো আছে। ঠিক করতে হবে। তবে নিরবকে আমি নীরব লিখি না। নতুন শব্দতত্ত্বের আঙ্গিনায় দীর্ঘ- ই কারের প্রয়োগ স্তিমিত হয়ে আসছে তাইনা।

তাপস শর্মা এর ছবি

মন্তব্যটা দুইবার চলে এসেছে।
ডুপ্লি ঘাচাং

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ প্রৌঢ় ভাবনা। আপনি অফ্লাইনে কেনু মন্তব্য করছেন চিন্তিত

শাব্দিক এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম সাথেই আছি।

তাপস শর্মা এর ছবি

ধন্যবাদ শাব্দিক হাসি । কিন্তু আপনার লেখা কো ??? লেখেন না ক্যান।

মাহবুব ময়ূখ রিশাদ এর ছবি

পড়লাম। প্রথম পর্ব তাই বেশি কিছু বলতে পারলাম না। নোভেলা সম্পর্কে জানা ছিল না। আশা রাখি সাথে থাকার

------------
'আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

তাপস শর্মা এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।