যদি আমার শৈশবের একমাত্র সুখের স্মৃতির পাতা কেউ আমাকে খুঁড়ে আনতে বলে তাহলে একটা মাত্র নাম আমার মন থেকে ওঠে আসবে - দাদু। আমার বাপের বাপ। আমার দাদু ছিলেন হোমিওপ্যাথের ডাক্তার। অবিভক্ত বাঙলার কুমিল্লায় জন্ম-কর্ম মানুষটার। দাদুর কাছে শুনেছি সেখানেই দাদুর চেম্বার ছিলো। সাথে আয়ুর্বেদের চর্চাও করতেন। সবসময় চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে সিগারেট এবং টেবিলের উপর ইয়াব্বর মান্ধাতা আমলের বইয়ে মুখ ঢেকে রাখতেন। রুপোর একটা সিগারেট-ভক্ষক ছিল দাদুর, নাম জানিনা তাই সিগারেট-ভক্ষক বললাম। ঐটা ছিল কলমের মুখটা (ক্যাপ) যেমন হয় সেই টাইপের কিছু একটা এবং সেটা গুঁজা থাকত সিগারেটের শেষ প্রান্তে। সেটার আবার একটা লতানো অংশও ছিল, রুপোর তৈরি। দেশভাগ, দাঙ্গায় সর্বহারা হন দাদু। কোপ খেয়ে একটা হাত প্রায় অচল হয়ে গিয়েছিল তার। পূর্ব-বঙ্গ ছেড়ে একবস্ত্রে বউ ছেলেপিলে নিয়ে একসময় ত্রিপুরা রাজ্যের রাজাদের রাজধানী ছিল সেই উদয়পুরে মাথা গুঁজেছিলেন তিনি। এই উদয়পুরের সাথে জড়িয়ে আছে কত রাজাদের ইতিবৃত্ত। এবং রবীন্দ্রনাথের অমর গাঁথা - ভুবনেশ্বরী মন্দির, 'রাজর্ষি', হাসি-তাতার কথা - 'এত রক্ত কেন'?...
১'লা বৈশাখ একলাই কেটেছে আমার; যদিও বরাবর একলাই কাটে। তবুও সারা বছর একে অন্যের আরোপ-প্রত্যারোপ, খিস্তিখেউর, গলা উঁচিয়ে ঝগড়া করা শর্মা বাড়ির জেলাসম যৌথ পরিবার ঐ একমাত্র পয়লা বৈশাখের দিনটিতেই চুপচাপ একসাথে থাকে, খাওয়া-দাওয়া করে, শেয়ার করে সবকিছু। আমিও থাকি, নীরবে দেখি।
[justify]
কোনো একটা সভ্যতার আদিলগ্নে হয়তো কেউ ‘প্রতারণা’ আবিষ্কার করেছিল। আর তখন থেকেই মনে হয় আমার মধ্যে প্রতারিত হবার ভয়টা ঢুকে যাবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। পৃথিবীর ডাকঘরে সমস্ত ভুল গল্পের মধ্যেই আমি বেঁচে ছিলাম। তারপর একদিন বীক্ষণাগারে নিক্ষেপের পূর্বে অভিজ্ঞ যন্ত্রগণক কলকব্জা নিরীক্ষণের যন্ত্র চালু করে আমাকে তার মধ্যে স্থানান্তরিত করলেন। ফলাফলের সূচকচিহ্নে আর্যভট্টের আবিস্কার ধরা দিল। যন্ত্রগণক তার মোটা চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে তাচ্ছিল্যভরা নজরে ছন্দোবিশ্লেষণ করে বাতিলঘরে যাবার চোথা লিখে দিলেন। শেষ রাস্তায় নামার আগে ভোগদখলি স্বত্ব হিসেবে আমার জন্যে বরাদ্দ করা হল দশ টাকার গাঁজার পোটলা, এক পেকেট হরিমোহন বিড়ি, আধা বাটি চিঁড়া এবং অবচুর্ণন দুধের গন্ধযুক্ত দৈ। অমলের মতো হাঁকতে হাঁকতে আমি ভরাপেটে এবং গাঁজার সম্মোহনে একটি অরাজক তাজা শ্মশানের উদ্দেশ্যে চিঠিটা পৌঁছে দিতে রওনা দিলাম...
তখনও কেউ সেইভাবে হাঁটতে শেখেনি, কেউ প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে বাংলা গানকে নতুনভাবে মুক্তি দেওয়ার কথা ভাবেনি। সময়টা বিশ শতকের ছয়-সাত-আটের দশক। একটা ধরাবাঁধা ফর্মেটের বাইরে বাঙলা গান তখন আর এগুচ্ছিল না। বাঙালি তখন গভীরভাবে মজে আছেন আর.ডি.বর্মণ. কিংবা কিশোর কুমারদের নিয়ে। সেই সঙ্গীতে প্রেমিক প্রেমিকা দুঃখ বিলাশ করে, সঙ্গিনী তার সঙ্গীকে নিয়ে গাছের ডাল ধরে নাচে গায়, সেই গানে আধুনিক বাঙালি ড্রাম’জ বাজিয়ে হুল্লুড় করে, আবার দুঃখে কাতর হয়ে বিরহ রাগ প্রকাশ করে। সেই সঙ্গীতে ভালবাসার কথা, প্রকৃতির কথা, আনন্দের কিংবা বিষাদের কথা, গভীর প্রেমের কথা থাকলেও আক্ষরিক অর্থে ‘মানুষে’র কথা ছিলনা। মানুষ মানে আম আদমির মনের কথা, মানুষ মানেই সময়ের বহুমাত্রিকতায় জর্জরিত একেবারেই অজানা অচেনা মানুষ, সেই মানুষ এবং তাদের জীবন সংগ্রামের কথা, নিত্যদিনের তেল-নুন-ডালের গল্প। তাদের জীবন গাঁথাকে গীটারের টুং টাং শব্দে এবং সময়ের হাহাকারকে গদ্যের নিষ্ঠুর আঘাতে জর্জরিত করে বাঙলা গানে আবির্ভূত হলেন সুমন চাটুজ্যে
'একাধিক শোকে অশ্রুর একাধিক ধারা বহে না' -- সৈয়দ শামসুল হক
অসংখ্য কথা জমে মেঘ হয়ে আছে...
অতএব প্লাস্টিকের হাসি দিতে দিতে খুচরা হিসেবগুলি নগদে সেরে ফেলার নাম নাগরিক সভ্যতা। আমি জানি চাঁদের বাহারি জৌলুস, এরপর বজ্রপাত সহ বৃষ্টি, আবার ভ্যাপসা গরম এবং দুইশোর উপরে বিপি। পরিত্যক্ত এই রাত্রিটাও কেটে যাবে আরেকটা সকাল হবে বলে। দুঃস্বপ্নের হাতপাখা নাড়তে নাড়তে একদিন খয়েরি হয়ে যায় জংধরা অনামি মানুষ; আমি সেই মানুষদের দলে...বছর কুড়ি আগের শৈশবটায় দেড় হাত লম্বা আমিটাই ভালো ছিলাম। কেন যে হুদামিছা বয়েস বেড়ে গেলো, আর জীবনের সীমানাটাও সাড়ে তিন হাত লম্বা হয়ে গেলো... কখনো কখনো ভাবি একটা মাত্রই তো জীবন, তাতেই যদি সব নিয়ম মেলে চলি তাহলে তো 'নাগরিক মানুষ' হয়ে যাবো। তারচেয়ে বরং চলুক না অনার্য জীবন...
নির্ঘুম রাতগুলি আমাকে অতীতের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারেনা। আবার আমি হতে পারি না বাস্তবমুখী। কিংবা 'আলাদা' কিছু করে দেখানোর রুচিও নেই আজকাল। তাহলে ? বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস এই দুই এর পরের কোন যায়গা আছে কি? থাকবে নিশ্চয়ই; আপাতত সেই যায়গাই আমার জন্যে বরাদ্দ থাকুক। ভয়, সংশয়, আঁধারের পর আলোর জন্য প্রতীক্ষা করা ছেড়েছি সে বহুদিন আগে। তবে আলো এবং আঁধারের মাঝেও তো কিছু থাকতে পারে?
আমি স্বদেশকে নিয়ে লিখতে বসেছিলাম
কঠিন পোড়ামাটি তখন আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে
তখন আমাদের ওলাওঠা দিন চলছিল
অতৃপ্ত ছায়াপথের জৌলুশে
অনেক দূর হেঁটে এসেছি বলে তো মনে হয়না। তবুও পেছনে তাকালেই দেখি মাইলের পর মাইল পথ। কত কথা বলার তো বাকি ছিল। কিন্তু ফুরিয়ে যাচ্ছে কেনো? কেনো 'কেউ কথা রাখেনি'? কেন সব পরবাস্তব আমার আস্তিনেই এসে ভিড় করে? কেন সব যায়গায় গিয়ে আমিই হেরে যাই? মানুষ হিসেবে বোধ আর প্রত্যয় নিয়ে শুধু 'মানুষ' হবার রাস্তাটা মসৃণ নয় সেটা অনেক আগেই জেনেছিলাম। কিন্তু কখনো কখনো এত ক্লান্ত লাগে কেনো? একটু আশ্রয় আমার জন্যে জুটেনা কেন?
ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফিরে চেয়ারে বসে আছি। ভাবছি কি করা যায়। না, ওষুধ তো খাচ্ছি, খেয়েই যাচ্ছি। নিজেকে 'চলতি ফিরতি মেডিসিন শপ' বলতে হয় এখন। আসলে অনেক কিছু ঘিরে ধরেছে যেন মনে হয়। আবার কখনো কখনো মনে হয় কই কিচ্ছু না তো, সব ওকে আছে বস। দু'টানায় জীবনছন্দ। একহাতে স্রেফ থেকে যায় অযাচিত বিস্ময় অন্যহাতে লটকে থাকে ঘুনে ধরা ফেরারি একাকীত্ব