সেতু, মূল: হাইনরিখ ব্যোল, জার্মান থেকে অনুবাদ: তীরন্দাজ

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শুক্র, ২৩/১১/২০০৭ - ৩:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ওনারা আমার ভাঙ্গা পা'টি জোড়া লাগিয়ে দিয়ে সেতুর উপরে একটি জায়গায় বসিয়ে দিয়েছেন। আমার কাজ সেসব লোকগুলোকে গোনা, যারা এই সেতুর উপর দিয়ে প্রতিদিন এপার ওপার করে। নিজেদের বাহাদুরী ওনারা সংখ্যায় প্রকাশ করতে ভালবাসেন খুব। সেজন্যেই অর্থহীন এই সংখ্যার খেলায় এরা সারাদিনই মত্ত হয়ে থাকতে চান। আমার ঠোঁট ঘড়ির টিকটিক শব্দের মতো সারাদিন অবিরাম সে সংখ্যাগুলো সাজায়, যাতে সন্ধ্যায় তাদেরকে তা সাফল্যের নিদর্শন হিসেবে উপহার দেয়া যায়।

ওনাদেরকে যখন আমার সারাদিনের কাজের ফলাফল জানাই, তাদের চেহারা অলোকিত হয়ে যায়। সংখ্যা যতো বড়, তত বেশী আলোকিত ওনাদের চেহারা। তাতে ওনারা সন্তুষ্ট মনে ঘুমোতে যেতে পারেন। কারণ, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নতুন এই সেতুর উপরেই এপার ওপার করে।

কিন্তু তাদের এই পরিসংখ্যানও ঠিক নয়। দু:খজনক হলেও এই পরিসংখ্যানকে ভুল বলতে বাধ্য হচ্ছি। আসলে আমার উপর ভরসা করা চলে না। তারপরও চেষ্টা করি কর্তব্যপরায়ণতার ভাব নিজের মাঝে ফুটিয়ে তুলতে।

মাঝে মাঝে একজন দু’জনকে হিসেবের বাইরে রেখে দিয়ে বেশ আনন্দ পেতাম। ওনাদের প্রতি সহানুভুতি হলে আবার মাঝে মাঝে একজন দু’জনকে বাড়তি হিসেবে উপহার দিতাম। আমাদের হাতেই তাদের আত্মতৃপ্তির চাবিকাঠি। মাঝে মাঝে যখন মেজাজ খারাপ থাকতো, সিগারেট থাকতো না, তখন গড়ের চেয়ে কম কোন একটা সংখ্যা জানিয়ে দিতাম। আর যখন আমার হৃদয় উম্মুক্ত, আমি যখন খোশ মেজাজে, তখন উদারতায় পাঁচ অংকের এক সংখ্যা বেরিয়ে আসতো। তখন ওনাদেরও কতো যে আনন্দ! ফলাফলের কাগজটি প্রতিবার আমার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়েই নিতেন। ওনাদের চোখের তারা উজ্জল হয়ে উঠতো, আমার পিঠ চাপড়ে দিতেন। আমি কি করেছি, সে সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না তাদের। তারপর তারা গুন শুরু করতেন, ভাগ করতেন, শতকরা হিসেব করতেন, আরো কি সব! সব জানা নেই আমার। হিসেব করতেন, আজ গড়ে প্রতি মিনিটে কতজন পুলের উপর আসাযাওয়া করলো, আরো দশ বছর পর কতজন পুলের উপর আসাযাওয়া করবে। ওনারা ঘটমান ভবিষ্যত ভালবাসেন, এটাই ওনাদের বিশেষত্ব। তারপরও, দু:খের কথা, সব হিসেবই সঠিক নয়।

আমার প্রেয়সী যখন সেতুর উপরে আসতো, প্রতিদিন দুইবার, তখন হৃদপিন্ডটাই প্রায় থেমে যেতো আমার। যতক্ষন না প্রেয়সী সামনের দুপাশে গাছে ছাওয়া রাস্তাটিতে মোড় নিয়ে আমার দৃষ্টিসীমা থেকে অদৃশ্য হতো, ততক্ষন হৃদপিন্ডের অবিরাম টিকটিক শব্দই শুনতে পেতাম না। এর মাঝে যারা আসা যাওয়া করতো, তাদের হিসেব আর করা সম্ভব হতো না আমার। এই দু’টো মিনিট আমার একান্তই নিজের ও তা আমি কাউকেই নিতে দিতে পারি না। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সে একটা আইসক্রীমের দোকানে কাজ করে। সন্ধ্যায় যখন সে দোকানে কাজ সেরে ফিরতো, তখন নিতো রাস্তার অন্য পাশটি। আমার হৃদপিন্ডের স্পন্দন তখনও থেমে যেত। গননা করাই আমার ঠচঁটের কাজ, অথচ সে ঠোঁটটিও গুনতে ভুলে যেত, যতোক্ষন না প্রেযসী আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে। তাখন যাদের সুযোগ হতো আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পার হয়ে যাওয়ার, পরিসংখ্যানের খাতায় তারা চিরদিনের জন্যই অনুপস্থিত। ছায়াপুরুষ ও ছায়ানারীরা ঘটমান ভবিষ্যতের পরিসংখ্যানের সাথে অর্থহীন ও এরা কখনোই এক কদমে চলে না।

এটা সত্য, তাকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু সে তা জানে না ও আমি চাইও না জানুক। আমি চাই না সে জানুক, এই পরিসংখ্যানকে অর্থহীন করার পেছনে তার কি শক্তিশালী অবদান। আমি চাই, সে এসব কিছু না জেনে সাবলীল ভাবে তার লম্বা বাদামী চুল ঝুলিয়ে আইক্রীমের দোকানে হেটে যায় ও ভাল টিপস্ পায়। আমি তাকে ভালবাসি । এটা জলের মতো পরিস্কার যে আমি তাকে ভালবাসি।

ক’দিন আগে ওনারা আমাকে পরীক্ষা করে দেখেছেন। আমার এক সহকর্মী সেতুর আরেকদিকে বসে গাড়িগুলো গোনে। সে আমাকে সময়মতো সাবধান করেছে। আমিও ভয়ংকর সাবধান ছিলাম। পাগলের মতো গুনেছি। গাড়ী কিলোমিটার মাপার মেশিনও আমার চাইতে ভাল গুনতে পারতো না। আমাদের প্রধান পরিসংখ্যক নিজে আরেদিকে বসে গুনেছেন এবং তার ও আমার একঘন্টার ফলাফল মিলিয়ে দেখেছেন। আমি তার থেকে একজন মানুষ কম গুনেছিলাম। সেসময় আমার প্রেয়সীও সেতু পার হয়েছে। আমি কখনোই চাই না, আমার এই প্রেয়সীকে ঘটমান ভবিষ্যতে ফেলে দিয়ে, গুন, ভাগ ও শতকরা হিসেবের অস্তিত্বহীনতায় ছুড়ে ফেলা হোক। প্রেয়সীর দিকে নজর না দিয়ে অন্যদেরকে গুনে যেতে যেতেই অনেক রক্ত ঝরেছে আমার বুকের ভেতরে। আমার সহকর্মচারী, যে গাড়িগুলো গুনে, তার কাছে আমি ভীষন কৃতজ্ঞ। কারণ এটা ছিল আমার নিজের অস্তিত্বের প্রশ্ন।

আমাদের প্রধান পরিসংখ্যক আমার পিঠ চাপড়ে আমার দ্বায়িত্বশীলতা ও সততার প্রশংসা করেছেন। ‘একঘন্টায় একটিমাত্র ভুল একেবারেই খারাপ নয়। শতকারা হিসেবের বেলায় কিছু ভুলভাল আমরা আগে থেকেই হিসেব করে রেখেছি। আমি সুপারিশ করবো, যাতে আপনাকে ঘোড়ার গাড়ী গোনার কাজ দেয়া হয়’।

ঘোড়ার গাড়ী খুব চালু ব্যাপার। আমার জন্যে ঘোড়ার গাড়ীর চেয়ে আনন্দের আর হতে পারে না। প্রতিদিন বেশী হলে পঁচিশটার মতো ঘোড়ার গাড়ী পার হয়। প্রতি পঁচিশ মিনিটে নিজের মগজে পরের নম্বরটি ঢোকানোর চেয়ে সহজ ব্যাপার আমার জন্যে আর কি হতে পারে।

ঘোড়ার গাড়ী অভাবনীয় ব্যাপার। চারটা থেকে আটটা অবধি কোন ঘোড়ার গাড়ীর চলাচলই নিষেধ। এ সময়ে কোথাও বেড়াতে যেতে পারি, এমনকি যেতে পারি আইসক্রীমের দোকানেও। আমার প্রেয়সীকে অনেকক্ষন দেখতে পারবো, হয়তোবা আমার পরিসংখ্যানের বাইরে রাখা প্রেয়সীকে তার বাড়ীর পথে কিছুটা সঙ্গও দিতে পারবো।


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

  • পড়লাম । কিন্তু বিদেশী গল্প মনে হলো । এইরকম কি করা সম্ভব যে অনুবাদ করার সময় পুরা প্রেক্ষাপটকে দেশী বানিয়ে ফেলা ? মানে এই যেমন ধরেন ঘোড়াগাড়ির বদলে গরুগাড়ী, বা রিকশা ভ্যান ?
  • আমার কখনোই চাই না যে, আমার এই প্রেয়সীকে ঘটমান ভবিষ্যতে ফেলে দিয়ে, গুন, ভাগ ও শতকরা হিসেবের অস্তিত্বহীনতার ছুড়ে ফেলা হোক।
    ভাল্লাগছে এই লাইনটা । তবে প্রথম 'আমার' শব্দটা 'আমি' হবে মনে হয় ।

তীরন্দাজ এর ছবি

হাসিব, ভুলগুলো ঠিক ধরেছেন।ধন্যবাদ। রিভাইজ করতে গিয়ে বাক্যগঠন পাল্টেছি, তাতে আবার ভুলও করেছি।

ঠিক করে ফেলব। সামনে সাবধান হতে হবে আরো।

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

তীরন্দাজ এর ছবি

পুরো প্রেক্ষাপটকে দেশী বানানো করতে যাব কি না, এ নিয়ে ভাবতে হবে অনেক। মুল লেখকের প্রতি যে দ্বায়িত্ববোধ, তা থেকে এত সহজে নিজেকে মুক্ত ভাবতে পরি না এখনও।

**********************************
যাহা বলিব সত্য বলিব

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।